ডলার ও সুইফট ব্যাংকিংয়ে মার্কিন আধিপত্য আর কত দিন?

মঞ্জুরে খোদামঞ্জুরে খোদা
Published : 6 May 2022, 03:40 PM
Updated : 6 May 2022, 03:40 PM

রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ বিশ্ব রাজনীতি-অর্থনীতির অনেক হিসাব পাল্টে দিয়েছে। রাশিয়া ইউক্রেইন আক্রমণের পর যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার উপর নজিরবিহীন অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। রাশিয়া বিশ্ব বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তাদের উপর সেসব নিষেধাজ্ঞার প্রভাব অনিবার্যভাবেই বিশ্ববাণিজ্যে গিয়ে পড়বে। অবরোধের কারণে রাশিয়ার মুদ্রার মান ব্যাপক হারে কমে যায়। রাশিয়ার ডলার রিজার্ভ আটকে দেওয়ায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য তাদের জন্য সঙ্কটাপন্ন হয়। বৈদেশিক রিজার্ভের অর্ধৈকই তারা ব্যবহার করতে পারছে না।      

২০১৪-তে রাশিয়া যখন ক্রিমিয়া দখল করে নেয় তখন দেশটিকে 'সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিনান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন' (সংক্ষেপে সুইফট) থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেয়া হয়েছিল। সে সময় রাশিয়া বলেছিল, সেটা করা হলে তা হবে যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য। সেসময় পশ্চিমা দেশগুলো আর সামনে আগায়নি। সে হুমকির ফলে রাশিয়া দ্রুত তার প্রতিবেশী দেশ, যাদের মুদ্রা এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রায় অভিন্ন- তাদের সাথে আন্ত:সীমান্ত লেনদেনের একটা নিজস্ব পদ্ধতি চালু করে। 

বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিনিদের একক আধিপত্যের দুইটি বড় অস্ত্র হচ্ছে, ইউএস ডলার ও সুইফট সিস্টেম। মারণাস্ত্রের চেয়ে এগুলো কোনও অংশেই কম ক্ষমতাসম্পন্ন নয়। রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধে তা আবার প্রমাণ হলো। পুতিনের মতে, সর্বাত্মক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা একপ্রকার যুদ্ধই। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এ অস্ত্র মার্কিনিরা দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করে আসছে।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধ ও ইউক্রেইনকে সহযোগিতার করার কারণে রুশ প্রশাসন একটি অবন্ধু দেশের তালিকা প্রকাশ করে। সে সময় তারা ঘোষণা করে যে, রাশিয়ার কাছ থেকে যে সব তেল-গ্যাস কিনবে তাদেরকে অবশ্যই রুবলে অর্থ পরিশোধ করতে হবে। তাদের এ ঘোষণা পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য ছিল কল্পনাতীত। 

অবরোধের শুরুতে রুবলের মূল্য প্রায় অর্ধেকে নেমে গেলেও- রাশিয়ার এ সিদ্ধান্তের ফলে রুবলের মান পূর্বের স্থানে চলে আসে। ফলে রুবল ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে এবং বর্তমানে তা উর্দ্ধমুখী। রাশিয়া প্রতিমাসে পশ্চিমা দেশগুলোতে ৩০ বিলিয়ন ইউরোর জ্বালানি বিক্রি করে। তাদের শর্ত অনুযায়ী, এখন থেকে ইউরোপকে অর্থ রুবলে পরিশোধ করতে হবে। ইতোমধ্যে জার্মানিসহ ইউরোপের ৪টি দেশ রুবলেই তাদেরকে দাম পরিশোধের ঘোষণা দিয়েছে। রুবলে অর্থ পরিশোধ করতে না পারায় বুলগেরিয়া ও পোল্যান্ডে গ্যাস সরবরাহ বন্ধও করে দিয়েছে রাশিয়া। বুলগেরিয়ার ৯০ এবং পোল্যান্ডের ৫৩ ভাগ গ্যাস আসে রাশিয়া থেকে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার জ্বালানি আমদানির নিষেধাজ্ঞা নিয়ে স্পষ্টত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে।

তারমানে এখন থেকে ক্রেতাদেশগুলোকে ডলার-ইউরো দিয়ে রুবল কিনতে হবে। সেটার অর্থ হচ্ছে ডলারের একচেটিয়ার আধিপত্যে রুবল ভাগ বসালো। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে রুবল প্রবেশ করলো। ডলারের কর্তৃত্ব কিছুটা হলেও খর্ব হলো ও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লো। প্রশ্ন হচ্ছে, রুবল কি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের বিকল্প হয়ে উঠতে পারবে? 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাশক্তির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র দেশ যাদের তেমন কোনও ক্ষতি হয়নি। তারা বরং সব দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ তখন তাদের কাছেই ছিল। তার উপর ভিত্তি করে ডলারের মূল্যমান নির্ধারণ হয়। সে সময় ৪৪টি দেশ ডলারকে বৈদেশিক বাণিজ্যের মুদ্রা হিসেবে ব্যবহারে সম্মত হয়। সেটাই ছিল মুদ্রাবাজারে ডলারের আধিপত্যের শুরু। 

পরবর্তিতে ডলারের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে ও চাহিদা বাড়াতে ১৯৭১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ঘোষণা করেন যে, স্বর্ণের উপর ভিত্তি করে আর ডলারের মূল্য নির্ধারণ হবে না। ১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের মধ্যে এক চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী, সৌদিআরব আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারে তেল বিক্রি করবে, প্রতিদানে মার্কিনিরা তাদের আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। ১৯৭৫ সালে তেল উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশও একই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এভাবেই ডলার বিশ্বে তার একক আধিপত্য তৈরি করে। যে কর্তৃত্ব আজও অব্যাহত।   

এই যুদ্ধ সহসাই শেষ হচ্ছে না বলেই ইতোমধ্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও ন্যাটো মহাসচিবসহ অনেকে ইঙ্গিত দিয়েছেন। তাদের বক্তব্য এ যুদ্ধ আরও কয়েক বছর দীর্ঘ হতে পারে। সেটা হলে বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে উঠবে। তারমধ্যে একটি ডলারের বিকল্প মুদ্রার প্রচলন। কারণ রাশিয়া তার বিরুদ্ধে আরোপিত অবরোধের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে তার নিজস্ব মুদ্রা নিয়ে অগ্রসর হবে এবং রুবল সহসাই ডলারের বিকল্প না হয়ে উঠতে পারলেও- বিশ্ববাণিজ্যে স্থান করতে পারলে তাতেই বা কম কি?  

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ডিজিএম গীতা গুপিনাথ বলেছেন, রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা যত দীর্ঘ হবে ডলারের প্রভাব ততো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ডলার প্রভাবশালী মুদ্রা হিসেবে থাকলেও কিছু দেশ অন্যান্য মুদ্রাও ব্যবহার করবে। কারণ বর্তমান অভিজ্ঞতায় তারা ডলারে তাদের রিজার্ভ কমিয়ে আনতে পারে।  

মার্কিন আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান- গোল্ডমান স্যাকস বলেছে, ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া তাদের রিজার্ভ ব্যবহার করতে পারছে না। সে কারণে পৃথিবীর অনেক দেশ মার্কিনে রাখা তাদের ডলারের রিজার্ভ কমিয়ে আনবে।  

চীন-রাশিয়া কয়েক বছর ধরেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে একটি বৈশ্বিকমুদ্রা ও সুইফটব্যবস্থা চালুর কথা বলছে। চীন-সৌদি আরব ইউয়ান ব্যবহার নিয়ে অনেকদিন ধরে আলাপ চালিয়ে আসছে। সেটা না হলেও বিশ্ব অর্থনীতিতে রুবল, ইউয়ান প্রবেশ করছে। কেননা আইএমএফ ইতিমধ্যে ইউয়ানকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এগুলো নিশ্চয়ই ডলারের জন্য সুখবর নয়। বিশ্ব অর্থনীতিতে ইউএস ডলার একক মুদ্রা হিসেবে যে আধিপত্য ছিল তা ক্রমশ খর্ব হতে চলেছে। বলা হয়ে থাকে, ১৯২০ সালে ব্রিটিশ পাউন্ড বিশ্বে তার একক আধিপত্য হারানোর পূর্বে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল বর্তমানেও অনেকটা সে অবস্থা বিরাজ করছে। মার্কিনিরা যুগযুগ ধরে দুর্বল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে স্যাংশন দিয়ে যে ক্ষমতার দম্ভ দেখিয়েছেন, এখন কি পারবেন এই বৃহৎ পরাশক্তিদের অবজ্ঞা করতে?   

সুইফট হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও লেনদেনের একটি ব্যাংকিং সংকেত। বিশ্বের ২০০টি দেশ এবং ১১০০০ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে লেনদেনের বার্তা আদানপ্রদানের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হয় এই সুইফট। যে কারণে বিশ্বের প্রায় সকল দেশের ব্যাংক ব্রাসেলস ভিত্তিক সুইফট ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেমের সাথে যুক্ত। এই সিস্টেমের মাধ্যমে প্রায় ৮০ ভাগ ডলারে লেনদেন হয়। 

ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোর উদ্যোগে ১৯৭৩ সালে সুইফট সিস্টেম তৈরি করা হলেও প্রতিষ্ঠাকালে এর বক্তব্য ছিল, কোন একটি প্রতিষ্ঠান একক সিস্টেমের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক লেনদেন পরিচালনা করুক। ইংল্যান্ড-যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বড় বড় কেন্দ্রীয় ব্যাংক মিলে বেলজিয়ামের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইফটের কাজকর্ম তদারকি করে। সুইফট নেটওয়ার্কে যুক্ত ব্যাংকগুলো একে-অন্যকে অর্থ পরিশোধের অনুরোধ প্রেরণ করে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংক সে মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। 

সুইফট বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও, কোনও দেশের উপর অবরোধ আরোপের আইনি ক্ষমতা তাদের নেই। সুইফট কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, কারো ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ব্যাপারটি নির্ভর করে- কোনও দেশের সরকারের ওপর। সুইফটের রাজনৈতিক ব্যবহারের কারণেই এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। 

ইউএস ডলারে সকল বাণিজ্য ও লেনদেনের কারণে এর দেনা-পাওনা পরিশোধ ও নিষ্পত্তি হয় নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে। কোন দেশ যখন অন্য দেশের সাথে ব্যবসা করে তখন এক দেশের রিজার্ভ থেকে ডলার নিয়ে অন্য দেশের রিজার্ভে যোগ করা হয়। সকল দেশে ইউএস ডলারের রিজার্ভ নিউ ইয়র্কেই থাকে। লেনদেনের অংক শুধু খাতায় বা ডিজিটে পরিবর্তন হয়। সেই কাগজের নোট বস্তায় ভরে দেশ-বিদেশ পাঠানো হয় না। বাজারে মানি চেঞ্জারে, ব্যাংক থেকে যে খুচরা ডলার বেচাকেনা হয় সেটা ওই রিজার্ভের খুব সামান্য অংশ। এগুলো সরকার দেশে এনে বাজারের চাহিদা মেটায়।

আমরা পত্রিকায় দেখি, বাংলাদেশের ৩৫ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ আছে, সে অর্থ আসলে দেশে নেই, আছে যুক্তরাষ্ট্রর নিউ ইয়র্ক শহরে। এটা শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নয়, সব দেশের ক্ষেত্রেই সত্য। তারমানে রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের পর রাশিয়ার যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল- তা যুক্তরাষ্ট্র সুইফট সিসটেম থেকে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে তাদের রিজার্ভ আটকে দিয়েছে। তাই রাশিয়া এখন তাদের রিজার্ভ ডলার ব্যবহার করে কিছু কিনতে বা বিক্রিও করতে পারছে না। সে কারণেই তারা পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে বলেছে, এখন থেকে যারা তাদের কাছে থেকে তেল-গ্যাস কিনবে তাদেরকে অবশ্যই রুবলে অর্থ পরিশোধ করতে হবে। না হলে তারা কোন পণ্য বিক্রি করবে না। 

চীনের উত্থানে যুক্তরাষ্ট্র  শঙ্কিত। রাশিয়াও নিজেদের অবস্থান সংহত করেছে। তবে চীন-রাশিয়া যদি তাদের অতীত বৈরিতা ভুলে একযোগে কাজ করে- সেটা হবে বিশ্ব রাজনীতি ও পরাশক্তি ক্ষমতাতন্ত্রের এক নতুন সমীকরণ। আমেরিকাকে পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা চীন-রাশিয়ার আছে। সুইফটের বিকল্প সমতাভিত্তিক বৈশ্বিক মুদ্রাব্যবস্থা যেদিন চালু হবে সে দিন থেকে বিশ্বে আমেরিকার একক আধিপত্যের যবনিকাপাত হবে।