নিজের পরিচয় যথাসাধ্য লুকিয়ে ও ট্রাম্পকে দৈত্য হিসেবে হাজির করে কমলা তার পরাজয়ের ও ট্রাম্পের জয়ের পথ প্রশস্ত করেছেন।
Published : 12 Nov 2024, 01:40 AM
সবার ধারণার চেয়ে সহজেই জিতে গেলেন ডনাল্ড জে. ট্রাম্প। হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট। অনেক দিক থেকে প্রথম হওয়ার স্বপ্ন দেখা কমলা হ্যারিসের ভরাডুবি ঘটিয়ে ট্রাম্পই বরং অনেক দিক থেকে প্রথম হয়ে গেলেন। কিন্তু জয়ের জন্য কী করেননি কমলা? নিজের মতামত লুকিয়েছেন, মাঝপথে থেকেছেন, ইসরায়েলি লবির তোষামোদি করেছেন, কর্পোরেট শক্তির পক্ষে থেকেছেন, ট্রাম্পকে ফ্যাসিস্ট দৈত্য হিসেবে উপস্থাপন করেছেন— এতকিছুর পরও হেরে গেলেন। তবে কি মার্কিন জনগণ গাজায় গণহত্যা বন্ধ চায় না, অস্ত্রব্যবসায়ীদের দমন চায় না, অভিবাসী চায় না— কী বার্তা দিয়ে গেলেন তিনি?
এই নির্বাচনি ফলে যা প্রমাণিত হলো তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ শান্তি চাইলেও, গণহত্যা বন্ধ চাইলেও, অভিবাসীদের সমঅধিকার চাইলেও— এসব ইচ্ছেপূরণের ক্ষেত্রে তারা কমলা হ্যারিস ও ডেমোক্র্যাটদের যথেষ্ট বিশ্বাস করতে পারেনি। ট্রাম্প অজস্র মিথ্যা কথা বলেছেন— যা করবেন ও করবেন না, দুই নিয়েই। আর কমলা অজস্র লুকিয়েছেন— যা করবেন ও করবেন না, দুইই। প্রশ্ন হতে পারে, কমলা যদি তার রং ও রূপ স্পষ্ট করতেন, তাতেই কি জিততেন? এ কথা হলফ করে বলা যায় না। তবে এ কথা বলা যায়, নিজের পরিচয় যথাসাধ্য লুকিয়ে ও ট্রাম্পকে দৈত্য হিসেবে হাজির করে কমলা তার পরাজয়ের ও ট্রাম্পের জয়ের পথ প্রশস্ত করেছেন।
ডেমোক্র্যাটদের এই মধ্যপন্থা অবলম্বনের কৌশল আবারো হালে পানি পেল না। গত নির্বাচনে ট্রাম্প যে বাইডেন-কমলা জুটির কাছে হেরে গেল, এবার তা হলো না কেন? কেননা ক্ষমতাসীন ট্রাম্পের অদক্ষতায় হতাশ হয়েছিলো যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ। এবারও তারা হতাশ বাইডেন-কমলা জুটির ব্যর্থতায়। কমলার রংকে ট্রাম্পের রং থেকে বেশি আলাদা করা যায়নি— কেবল গাঢ় আর হালকা ছাড়া। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য ট্রাম্প আমলের চেয়ে বেশি হলেও, কোথাও কোনো মৌলিক পরিবর্তন তারা আনতে পারেনি। সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা আন্তর্জাতিক পরিসরে— ইসরায়েলি গণহত্যায় তাদের শক্তিযোগানকারীর ভূমিকা, মুখে সামান্য সমালোচনাসহ— যা যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম জনগোষ্ঠিসহ সারাবিশ্বের শান্তিকামী মানুষের চোখেই ভণ্ডামি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
এইসব ভণ্ডামিই ছিলো ডেমোক্র্যাটদের আবার ক্ষমতাসীন হওয়ার নির্বাচনি কৌশল। কিন্তু তাতো ব্যর্থ হলো, যা প্রমাণ করলো ট্রাম্প ও রিপাবলিক্যানরাই সঠিক— অভিবাসী আসা বন্ধ করা, ল্যাটিনো, মেক্সিক্যান, মুসলমানদের হেয় করা, ইসরায়েলকে তোষামোদ সবই সঠিক। যা অনাকাঙ্ক্ষিত। কমলা হ্যারিস ও ডেমোক্র্যাটরা নিজেদের পতনের সঙ্গে পতন ঘটিয়েছেন এইসব সাধারণ বোধবুদ্ধি ও নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নকে। কমলা হেরেছেন লজ্জাজনকভাবে, তার পূর্বসূরি হিলারির চেয়ে বেশি। সেসময় যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে যিনি সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন তিনি বার্নি স্যান্ডার্স, যাকে ডেমোক্র্যাটচক্র নির্বাচনে দাঁড়ানোর মনোয়নই দিলো না। এবারও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হতে পারেননি, যারা তাদের পরিকল্পনা ও নতুন স্বপ্নের জন্য উজ্জ্বল ছিলেন তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কর্নেল ওয়েস্ট ও গ্রিন পার্টির জিল স্টেইন। ২০১৬-এর মতই জিল এবারও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে ছিলেন।
জ্যাকোবিন সাময়িকীর ব্রাঙ্কো মার্সেটিক ৬ নভেম্বর কমলার ব্যর্থতার কারণ সম্পর্কে লিখেছেন, “বিশেষভাবে মারাত্মক ছিলো বাইডেনের অজনপ্রিয় প্রেসিডেন্সি থেকে হ্যারিসের দূরত্ব সৃষ্টির অক্ষমতা এবং তিনি কীভাবে আলাদা তা ব্যাখ্যা করতে না পারা— আদর্শগতভাবে, নির্দিষ্টভাবে এমন কিছু দিতে না পারা যা সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ভোটাররা তার পক্ষ থেকে আশা করছিলো।
“সর্বোপরি এক রাজনৈতিক পচনশীল ক্ষত— গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যার প্রতি ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন। যেসব ইস্যু দলের ভিত্তিকে আদর্শচ্যুত করেছে, মিশিগানে জেতার সম্ভাবনা নস্যাৎ করেছে এবং পৃথিবীকে একটা বিশৃঙ্খলার মাঝে নিপতিত করেছে— এসব প্রতিস্থাপন করার পূর্ণ সুযোগ পেলেও তা হেলায় ফেলে দিয়েছেন হ্যারিস— নতমস্তকে দাঁড়িয়েছেন ইসরায়েলকে গণহত্যায় পূর্ণ সমর্থন দেওয়া সেই লোকটির পিছনে যাকে অযোগ্য হিসেবে দল বাদ দিয়েছে।
“হত্যাযজ্ঞ যখন হ্যারিসের প্রকাশ্য সমর্থন নিয়ে চলছে ও সম্প্রসারিত হচ্ছে ক্রদ্ধ আরব আমেরিকান ও মুসলমান ভোটাররা তখন দৃঢ়চিত্ত হয় দলটিকে হারিয়ে শাস্তি দেওয়ার।
“সবার ওপরে আছে এই নির্বাচন পরিচালনার জন্য হিলারি ক্লিনটনের ২০১৬ সালের নির্বাচনি কৌশল পুরোপুরি অনুসরণ— যা এই একই প্রার্থীর বিরুদ্ধে ও যা পূর্বেই ব্যর্থ প্রমাণিত।”
মার্সেটিক উল্লেখ করেছেন যে, সামাজিক মাধ্যমে ও প্রচারণায় ডেমোক্র্যাটরা হ্যারিসের চেয়ে ট্রাম্পের নামই বেশি নিয়েছে। স্টিফেন কোলবার্টের একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে দ্বিতীয়বারের মত সুযোগ পেয়েও হ্যারিস তা পানিতে ফেলে দেন। তার প্রেসিডেন্সি বাইডেনের থেকে কীভাবে আলাদা হবে, এ প্রশ্নের জবাব হাতড়াতে থাকেন হ্যারিস, অবশেষে উপস্থাপককে বলার মত যা খুঁজে পান তা হচ্ছে: “আমি ডনাল্ড ট্রাম্প নই।” এটা হতে পারতো তার নির্বাচনি স্লোগানও, যেহেতু উল্লেখযোগ্য আর কিছু তার ছিলো না।
এখানেই জিল স্টেইন আলাদা হয়ে গেছেন আপন স্বাতন্ত্র্য নিয়ে। কারণ জয়ের ন্যূনতম সম্ভাবনা না থাকলেও জিল স্টেইন একটি নীতি-আদর্শ নিয়ে লড়াই করেছেন। জিল নিজে একজন ইহুদি হয়েও গাজায় গণহত্যার তীব্র বিরোধিতা করেছেন। এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট হলে প্রথমদিন কী করবেন এ প্রশ্নের জবাবে তিনি ১৯৮২ সালে বৈরুতে ইসরায়েলি হামলা বন্ধে রোনাল্ড রিগ্যানের উদাহরণ টেনে বলেছেন, নেতানিয়াহুকে একটা ফোন করে হামলা বন্ধের নির্দেশ দিবেন, কেননা এ হামলা পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থে ও অস্ত্রে পরিচালিত। স্টেইনের এই অবস্থানই তাকে মুসলিম জনগোষ্ঠির কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ দোদুল্যমান রাজ্যে জিল স্টেইনের সমর্থন হয়েছে কমলার চেয়েও বেশি। যা কমলার পতনের অনকেগুলো কারণের মধ্যে একটি।
কমলা হ্যারিসের এমন একটা স্পষ্ট ভূমিকাই আশা করছিলো যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক মানুষ। অথচ তিনি কিছুতেই বাইডেন থেকে নিজেকে আলাদা করতে পারছিলেন না। যদিও তিনি স্টিফেন কোলবার্টকে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে বাইডেন থেকে তার স্বাতন্ত্র্য বোঝাতে কেবল এটুকুই বলতে পেরেছেন যে, “আমি জো বাইডেন নই।” ট্রাম্পের সঙ্গে বিতর্কেও তিনি ট্রাম্পকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি জো বাইডেনের বিরুদ্ধে নয়, কমলা হ্যারিসের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাতে কি হয়েছে? কার্যত তিনি জো বাইডেনের রাজনৈতিক রূপ থেকে নিজেকে একটুও আলাদা করে উপস্থাপন করতে পারেননি।
যেহেতু ডেমোক্র্যাটদের এ নির্বাচনটি ছিলো ২০১৬-এ হিলারির নির্বাচনি কৌশল থেকে অভিন্ন, এর ফলও হয়েছে অভিন্ন। অথচ কমলা হারলেও সম্মান অর্জন করতে পারতেন যদি তার আদর্শ ও নীতিকে স্পষ্ট করতেন। ডেমোক্র্যাটদেরও এই হার নিয়ে এখনকার মত অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়া লাগতো না, কারণ একটি বিজয় থাকতো— আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা। আগামী দিনে তাদের প্রয়োজন হবে এই আত্ম-অনুসন্ধান। ততদিনে ডনাল্ড ট্রাম্প যা ক্ষতি করার তাতো করবেনই। সন্দেহ নেই অনেক হাস্যরসাত্মক কাণ্ডও ঘটাবেন! তার পারফরম্যান্স কতখানি ট্র্যাজিক আর কতখানি কমিক সেই দোলাচলে থাকবে সবাই। তারপরও ডেমোক্র্যাট নেতৃত্বের শিক্ষা হবে কি?