আমরা বিশ্বাস করি মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। গাজা থেকে ইউক্রেইন সব দেশ ও জাতিতে শান্তি নামুক। নামুক আমাদের নিজেদের দেশেও।
Published : 22 Mar 2025, 05:24 PM
যে কোন দেশে যুদ্ধ মানেই পৃথিবীর সব মানুষের জন্য বিপজ্জনক। এই রোজার মাসে সিডনিতেও দেখছি, বাঙালিদের মধ্যে যারা মুসলিম, তারা সিয়াম সাধনা করছেন, পালন করছেন তাদের ধর্মীয় দায়িত্ব। মাঝেমধ্যে বুক কাঁপানো যুদ্ধের খবর আর রক্তপাত আমাদের ঘুম কেড়ে নিলেও সবার মনে ঈদের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। প্রায়ই নানাবিধ কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে মেলার আয়োজন উৎসবের প্রস্তুতি বলে দিচ্ছে ঈদ দুয়ারে দাঁড়ানো।
খেয়াল করবেন বিশ্ব বদলে গেছে। আগে দুনিয়ার যে কোনো জায়গায় একটা বোমা ফাটলেই মানুষ নড়েচড়ে বসত। খবর হয়ে যেতো সারা পৃথিবীতে। এখন আর তেমন হয় না। গাজায় আক্রান্ত সভ্যতা। মানুষের জীবনের যেন কানাকড়ির মূল্য নেই। যারা মারছে তারা বেপরোয়া। অথচ মানুষের মনে আফসোস বা দ্রোহ থাকলেও আগের মতো তা সংঘবদ্ধ নয়। হবে কিভাবে?
আপনাদের মনে থাকতে পারে একসময় বিশ্বনেতাদের মানুষ সমীহ করত। যখন আমেরিকার দায়িত্বে ছিলেন রেগান, ফোর্ড বা ক্লিনটন তখন আমেরিকার চেহারা ছিল অন্য রকমের। এর মানে এ নয় যে তাদের নিয়ে কোনো বিতর্কই হয়নি। যখন রাশিয়ায় ছিলেন লেনিন বা ক্রুশ্চেভ বা ব্রেজনেভ, তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল মানুষের আশার প্রতীক। সে রাশিয়া এখন ইউক্রেইনে যু্দ্ধ করছে। দিনের পর দিন চলছে সে লড়াই। সম্প্রতি ইউক্রেইনের নেতাকে হোয়াইট হাউসে অপদস্থ হতে দেখলাম। অথচ দু-একটা বুদবুদ নিউজের পর তার আর কোন খবর নেই।
কী হচ্ছে দুনিয়ায়? এমন কি আমাদের দেশেও আমরা দেখি হৈ চৈ আর অশান্তি যেন লেগেই আছে। পরিবর্তনের হাওয়া কতটা কি করতে পারছে তার চাইতে বড় হয়ে উঠেছে উত্তেজনা। মানুষ কি তবে উত্তেজনা ভালোবাসছে? সামাজিক মিডিয়ার ভূমিকা ভুললে চলবে না। সামাজিক মিডিয়া একদিকে যেমন আমাদের ভালো করছে আরেকদিকে উত্তেজনা প্রসারেও ভূমিকা রাখছে ব্যাপক। কোথাও কিছু হলেই সাথে সাথে তা চলে আসছে চোখের সামনে। যাচাই-বাছাই বাদ দিয়ে মানুষ দলে দলে ভাগ হয়ে লড়াই করছে এসব নিয়ে। অথচ আমরা জানতাম মিডিয়া মানে সম্পাদিত কোন নিউজ বা ভিউজ। যাতে সবটা সত্য হয়তো নেই, কিন্তু অতিরঞ্জনও করা হয়নি। যা দিনশেষে শান্তি আর সমঝোতার কথা বলেছে। সেটা এখন দুনিয়ার কোথাও নেই। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে একজন আক্রান্ত হলে বাকি দশজন মজা নিয়ে সেটা ভিডিও করে। কেউ আগ বাড়িয়ে ঝগড়া থামায় না।
মনতস্ত্ববিদরা বলছেন, এটা আমাদের রোগে পরিণত হতে চলেছে। এত আক্রমণ উত্তেজনা আর হিংসার বুকে দাঁড়িয়ে তা দেখার পর মানুষ সুস্থ থাকবে কিভাবে? আমি মনে করি আমাদের দেশের তারুণ্য বা শিশু কিশোরদের মনমানসিকতা পড়ার কেউ নেই। যেমন এসব দেশে কাউন্সিলিং হয়। কাউন্সিলিং বাধ্যতামূলকও বটে। সরকার বা সামাজিক সংস্থাগুলো এ কাজ করে। লাখ লাখ ডলার খরচ করে সরকার বা প্রতিষ্ঠানগুলো মানসিক স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা বিধান করে। হয়তো জনবহুল দেশে তা অসম্ভব। কিন্তু প্রচেষ্টা তো থাকতে হবে ।
যুদ্ধ মানুষের মনে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে তা ভয়াবহ। আমি ভিয়েতনাম গিয়েছিলাম। যুদ্ধের এতবছর পর ও বহু মানুষ ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। লাওসে বয়োবৃদ্ধ প্রজন্মটাই নেই। যু্দ্ধে যুদ্ধে মৃত তারা। আছে চল্লিশ বা তার কিছু বেশি বয়সী মানুষ। অথচ মানুষের আয়ু এর চাইতে অধিক। এই যে শূন্যতা তা আর যাই হোক কোন সমাজকে ভালোভাবে এগুতে দেয় না। আমরা যুদ্ধের ভেতর দিয়ে স্বাধীন একটি দেশ পেয়েছি। এই সেদিনও, জুলাই-অগাস্টে লড়াই করতে হয়েছিল। এরপর আর কোন লড়াই আমাদের কাঙ্ক্ষিত নয়। চাইব সকলের ভালো থাকা। এই ভালো থাকাটা এখন একক কোন দেশ বা সমাজের ওপর নির্ভর করে না। গ্লোবাল ভিলেজ নামে যে কনসেপ্ট তা আমি প্রথম পাই শ্রী অরবিন্দের দর্শনে। সে দর্শন মূলত মানুষের ভালো থাকার জন্য এক বিশ্বের স্বপ্ন। অথচ দুনিয়া এখন তার বিপরীতে হাঁটছে।
বলছিলাম সিডনি তথা অস্ট্রেলিয়ার বাঙালি সমাজের কথা। তারা সাধনা ও সংযমের পাশাপাশি যুদ্ধ বিরোধিতায় উন্মুখ। যার যা সাধ্য তা নিয়েই সোচ্চার। কারণ শান্তির কোন বিকল্প হয় না। ভালোভাবে তাকালে আমরা দেখব দুনিয়ায় মূলত দুই শ্রেণীর মানুষের বসবাস। এক, যারা সমৃদ্ধ উন্নত আর ধনী। আরেকদিকে অভাব দারিদ্র্য আর হতাশায় ভোগা মানুষ। এই অসাম্য বা ভেদাভেদ মানুষকে অসুখি করে। একসময় যখন যা খুশি দেখা যেত না, শোনা যেত, না তখন এগুলো ছিল গল্পের মতো। এখন তা চোখের সামনে দৃশ্যমান সবকিছু। তাই মানুষের মনে যে বিরূপতা তাকে সামাল দিতেই হবে।
উন্নত নামের দেশগুলোতে একাকীত্ব আর ভয়াবহ মানসিক সংকট।তাদের খাদ্য আছে কিন্তু সন্তুষ্টি নেই। অন্যপ্রান্তে খাদ্য নেই, চাহিদা আছে, যোগান নেই। সাম্যের অভাব। এভাবে আর যাই হোক সভ্যতা এগুতে পারে না। সে কারণেই বিশ্বব্যাপী শান্তি আর সহযোগিতা দরকার। বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠী প্রবাসী। তারা সাধ্যমতো দেশে টাকা-পয়সা পাঠায়। কিন্তু তারা ঠিক জানে না এর ব্যবহার বা উপকারিতা কি? বদলে যাওয়া দেশ ও সরকারের দায়িত্ব এগুলো জানানো। এবং দেশের প্রকৃত সামাজিক অবস্থা তুলে ধরা।
আমরা বিশ্ববাসীর সাথে চলতে চাই। এই চলমানতার জন্য বিজ্ঞান প্রযুক্তি আর নৈতিকতা দরকার। একসময় আমরা মায়ার দেশ ভালোবাসার সমাজ নামে পরিচিত ছিলাম। এখনও যে তা নেই, এমনটা নয়। তবে তার প্রকাশ দেখি না। সহমর্মিতা আর সহাবস্থান বিদেশে যেমন সম্ভব তেমনি দেশেও সম্ভব। সে ইতিহাস আমাদের আছে। শ্রমজীবী কর্মজীবী মানুষেরা তা পালন করেন। দরকার নিয়ম আর শৃঙ্খলা। এটা কোন কথার কথা নয়। সারা দুনিয়ায় খামখেয়ালি আর কর্তৃত্ববাদ এমনভাবে থাবা বিস্তার করেছে যে অনেক সময় আমরা ভুলে যাই আমরা আসলে কি চাই?
মানুষের মনে মনে যে শান্তি আর সৌহার্দ্য মূলত তারই নাম মানবিকতা। একটি মানবিক পৃথিবী মানেই মানুষ দেশে দেশে সমাজে সমাজে নিরাপদ। এই নিরাপত্তার কারণেই বিভিন্ন নিয়ম আর মতবাদের জন্ম হয়েছে। আধুনিকতার নামে এখন যা দেখি তা অনেক সময় মানা কঠিন। বাংলাদেশের বাঙালিরা দুনিয়ার সব দেশে এবং নিজ দেশে শান্তি চায়।
আমরা বিশ্বাস করি মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। গাজা থেকে ইউক্রেইন সব দেশ ও জাতিতে শান্তি নামুক। নামুক আমাদের নিজেদের দেশেও।