বাংলাদেশে একটা স্থিতিশীল অবস্থা বজায় রাখা ভারতের স্বার্থের জন্যও অনুকূল। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক পরস্পর সম্পূরক।
Published : 23 Oct 2024, 07:13 PM
একনায়কেরা ক্ষমতা হারাবার পর কোথায় যান? স্বভাবতই তাদের বন্ধু দেশে, যারা তাকে ক্ষমতা ধরে রাখতে সাহায্য করেছিল। ফিলিপিনের স্বৈরশাসক মার্কোসকেও ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল জনগণের রোষে, ১৯৮৬ সালে। যুক্তরাষ্ট্র একটা সি-১৩০ পরিবহন বিমানে করে তাকে নিয়ে যায় অঙ্গরাজ্য হাওয়াইতে, সেখানেই তিনি আশ্রয়ে ছিলেন তিন বছর, মৃত্যুর আগপর্যন্ত। বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জনগণের আক্রোশে পালিয়ে যান ভারতে। বিমান বাহিনীর একটি সি-১৩০ পরিবহন বিমানে করে ভারতের উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদে পৌঁছে দেওয়া হয় হাসিনাকে। এখন তিনি দিল্লির আশ্রয়ে।
শেখ হাসিনার পতন
অগাস্টের ১৫ তারিখে ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ বাংলাদেশে হাসিনার শাসন বজায় রাখতে ভারত যে আমেরিকাকে শক্তভাবে চাপ দিয়েছিল তা নিয়ে একটা সুদীর্ঘ প্রতিবেদন ছাপিয়েছে। শিরোনাম ছিল, ‘বাংলাদেশের নেত্রী ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে ভারত আমেরিকাকে চাপ দিচ্ছিল তারা যেন তার প্রতি সহজ আচরণ করে’। প্রতিবেদনে প্রকাশ পায়, আমেরিকান কূটনীতিকেরা গত নির্বাচনের সময় হাজার হাজার সমালোচককে জেলে নিক্ষেপ করার জন্য হাসিনাকে প্রত্যক্ষভাবে দোষারোপ করেছিলেন। বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশে গুম ও খুনের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন বাহিনীর একদল সদস্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। এরপর ভারতীয় কূটনীতিকরা যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে জানিয়ে দেয় তারা যেন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি না করে। তারা দাবি করে, যুক্তরাষ্ট্র যদি এই ব্যাপারে স্ট্রাটেজিক ছাড় না দেয়, তাহলে ভারতকে ভবিষ্যতে স্ট্রাটেজিক পার্টনার হিসাবে পাবে না। তাদের বক্তব্য ছিল, বিরোধীদল ক্ষমতায় আসলে বাংলাদেশ ইসলামিক চরমপন্থীদের চারণক্ষেত্র হয়ে যাবে। একসময় বাইডেন প্রশাসন নীরবে ভারতীয়দের দাবি মেনে নেয়।
জানুয়ারির নির্বাচনের পর, বাংলাদেশের জনগণ দেখতে পেল হাসিনার কীর্তিকলাপ মেনে নেওয়ার নতুন মার্কিন নীতি। নির্বাচনে কারচুপি নিয়ে তাদের সমালোচনা বন্ধ হয়ে গেল। মানবাধিকার নিয়ে কথাবার্তাও থেমে গেল। সরব কূটনীতিকদেরকে চুপ থাকতে বলা হলো এবং এরপর রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে সরিয়ে নেওয়া হলো।
হাসিনা তো বটেই, ভারতও নিশ্চিন্ত হলো। মনে করা হচ্ছিল হাসিনার দীর্ঘমেয়াদী দেশ শাসনে আর কোনো বাধা নেই। শাসকরা বুঝবার আগেই রাজনীতিতে নিউটনের তৃতীয় সূত্র সক্রিয় হলো, প্রত্যেক কর্মের একটা বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। হঠাৎ কোটাবিরোধী আন্দোলন সব লণ্ডভণ্ড করে দিল। হাসিনা পালিয়ে গেলেন ভারতে, পেছনে রয়ে গেল তার পনের বছরের দুঃশাসনের নানান সাক্ষ্য। আর তার বিশ্বস্ত অনুসারীর দল, যারা বিশ্বাস করেছিল—‘বঙ্গবন্ধুকন্যা কোনোদিন পালিয়ে যাবে না’।
কোথায় যাবেন হাসিনা?
শেখ হাসিনা এখন দিল্লিতে। বাংলাদেশ সরকার তার লাল পাসপোর্ট বাতিল করেছে, অন্যদিকে ভারত সরকার তাকে ট্রাভেল ডকুমেন্ট দিয়েছে। কিন্তু ভারতের বাইরে অন্য কোনো দেশে যাওয়া তার জন্য সহজ নয়। স্বাধীনভাবে থাকার জন্য তার একমাত্র বিকল্প ছিল যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয়। ওই দরজা সম্ভবত বন্ধ। প্রথম কারণ টেকনিক্যাল, যুক্তরাজ্যে থেকেই শুধু আশ্রয়ের জন্য আবেদন করা যায়, বাইরের থেকে নয়। তবে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলো রাজনৈতিক। হাসিনাকে আশ্রয় দিলে ওখানকার বাঙালি কমিউনিটিতে শুরু হবে দারুণ অশান্তি, লেবার পার্টির বাংলাদেশী সমর্থকেরা হয়ে যাবেন দু-ভাগ। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্টারমার এমনিতেই তার গাজা যুদ্ধের পলিসি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। তিনি চাইছেন না হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে নতুন একটা গণ্ডগোলের সূত্রপাত করতে। তাছাড়া বাঙালি বংশোদ্ভূত পার্লামেন্ট সদস্যরাও চাইছেন না হাসিনা সেখানে যান, রুপা হক প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়েছেন। শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকী এখন ওখানকার কেবিনেট মিনিস্টার। গত দুই বছর নিজের বাড়ি ভাড়া দিয়ে তার আয়ের পরিমাণ তিনি ব্রিটিশ সরকারকে জানাননি। এই নিয়ে খুব ঝামেলায় আছেন। তাছাড়া খালার সঙ্গে তার রাজনৈতিক সম্পর্ক ও রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে তার লাভবান হবার সংবাদে তিনি এখন দারুণভাবে উৎকণ্ঠিত। সব মিলিয়ে টিউলিপও সম্ভবত খালাকে দূরে রাখতে চাইবেন। দিল্লিই তাই এখন হাসিনার একমাত্র আশ্রয়স্থল।
শেখ হাসিনা দিল্লিতে কতদিন থাকবেন বা ওখানে তার স্ট্যাটাস ও কার্যকলাপ নিয়ে খুব নির্ভরযোগ্য কোনো সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে না। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, দেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তার কয়েকবার দেখা হয়েছে। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছে কিনা এনিয়ে কোনো সংবাদ প্রকাশ করা হয়নি।
১৮ অক্টোবর বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। আদালতের বেঁধে দেওয়া এক মাস সময়ের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে দেশে ফেরানোর সব চেষ্টা করা হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। এদিকে ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে, শেখ হাসিনা ভারতেই আছেন এবং ভারতেই থাকবেন।
যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্র ফিনান্সিয়াল টাইমস সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, হাসিনা দিল্লিতে একটা নিরাপদ বাড়িতে আশ্রয়ে আছেন এবং তার সঙ্গে তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল থাকেন। ভারতের কোনো সংবাদমাধ্যম থেকে এর কোনো সমর্থন পাওয়া যায়নি। উল্লেখ্য যে, কিছুদিন আগে পুতুল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছিলেন, ‘এই দুঃসময়ে আমি মায়ের কাছে থাকতে পারছি না এবং মাকে জড়িয়ে ধরতে পারছি না। আমার বুক ফেটে যাচ্ছে।’
শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় মাঝে মাঝে নানারকম বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিচ্ছেন তার মাকে নিয়ে। তিনি তার মায়ের সঙ্গে দেখা করেছেন এমন কোনো সংবাদও প্রকাশ পায়নি। বিষয়গুলো হয়ত বেশ কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, হাসিনা যদি দিল্লিতে থাকেন, তার কার্যকলাপ বাংলাদেশের স্থিতিশীলতায় কতটুকু প্রভাব ফেলবে?
ভারত-বাংলাদেশ বর্তমান সম্পর্ক
সরকার পরিবর্তনের প্রথম দিকে মোদী সরকার বেশ দায়িত্বশীলভাবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে। ‘সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা’ নিয়ে মৃদু অভিযোগ ছাড়া হাসিনার পতনে তারা তেমন উচ্চবাচ্য করেনি। ভারতীয় পররাষ্ট্র দপ্তরের সংবাদ সম্মেলনে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, ভারত বাংলাদেশের পরিবর্তন মেনে নিয়েছে এবং নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাবে। ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লার বন্যার পর বাংলাদেশের উপদেষ্টাদের কেউ কেউ ভারতকে দায়ী করলে এবং পরে ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথের কিছু উস্কানিমূলক কথাবার্তা পরিস্থিতি কিছুটা উত্তপ্ত করে। বাংলাদেশে অভ্যুত্থান পরবর্তী যাত্রাকে যেখানে বিশ্বের অন্যান্য দেশ স্বাগত জানিয়েছে, সেখানে ভারতের নির্লিপ্ততা এবং আগ্রহের অভাব বাংলাদেশের জনগণকে বেশ হতাশ করেছে।
জাতিসংঘের অধিবেশন চলাকালে মোদী-ইউনূস বৈঠকের সম্ভাবনা ভারত কৌশলে এড়িয়ে যায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নিউ ইয়র্ক ছেড়ে যান প্রধান উপদেষ্টা সেখানে পৌঁছানোর আগেই। ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি নিয়ে মোদী খুব নিশ্চিত নন। হাসিনার দিল্লি অবস্থানও একটা স্পর্শকাতর বিষয়, এটা নিয়ে মোদী সরাসরি ড. ইউনূসের সঙ্গে কথা বলতে চাননি। তবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্করের মধ্যে কথা হয়েছে। এশিয়া সোসাইটি অফ নিউ ইয়র্কের এক আলোচনায় ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বেশ খোলাখুলি ভারতের প্রত্যাশা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘পারস্পরিক নির্ভরতা, সুযোগ-সুবিধা এবং দুই পক্ষের মধ্যে একসঙ্গে এগিয়ে চলার ইচ্ছা, আমাদের দুই দেশকেই সাহায্য করবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কখনো কিছুটা সমস্যা হলেই, কিছু লোক বলতে শুরু করেন, এর থেকে আর ফিরে যাওয়া যাবে না। এরপর আপনি দেখেন, সম্পর্কের সংশোধন প্রক্রিয়া অবধারিতভাবে শুরু হয়ে যায়।’ জয়শঙ্করের বক্তব্য খুবই জোরালো এবং বাস্তববাদী।
নিউ ইয়র্কে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের বৈঠক হয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের এমন কোনো স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নেই যা বাংলাদেশের কোনো উপকারে আসবে। আর পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা এতই শোচনীয় যে, তাদের সঙ্গে এ সময় আলোচনা অহেতুক কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। তবে এটা ড. ইউনূসের জন্য কৌশলগত হতে পারে। এদিকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সম্প্রতি বলেছেন, বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে সামরিক খাতে সহযোগিতা আরও বাড়াবে। এগুলো যে ভারত খুব পছন্দ করছে না তা ধরেই নেওয়া যায়।
ভারতও বাংলাদেশকে চাপ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশে তাদের সকল ভিসা অফিস বন্ধ রেখেছে। এতে বাংলাদেশের অনেক নাগরিক যারা চিকিৎসার জন্য ভারত যেতে চায়, তাদের ভোগান্তি বাড়ছে। ভারতেরও ক্ষতি হচ্ছে। বিস্তর পর্যটক ও চিকিৎসাপ্রার্থীদের কাছ থেকে যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করত, তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা।
শেখ হাসিনা চলে যাবার পর ভারতের হাতে বিকল্পও তেমন নেই এই মুহূর্তে। বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতা নিয়ে ভারতীয় পত্রপত্রিকা গত কয়েক বছরে অনেক প্রচারণা ছড়িয়েছে। কিন্তু দেশের ছাত্র-জনতা এবারের বিক্ষোভে কোনোরূপ ভারতবিরোধী স্লোগান বা প্রচারণা করেনি। ছাত্রজনতার আন্দোলনে ক্ষোভ সীমাবদ্ধ ছিল শেখ হাসিনার একনায়কত্বের বিরুদ্ধে। ভারত-বিরোধী তৎপরতা আন্দোলনের সময় ছিল না বললেই চলে। যদি হাসিনার পক্ষ নিয়ে ভারত কিছু করতে যায় বা বাংলাদেশের সঙ্গে বৈরী আচরণ শুরু করে, তাহলে বাংলাদেশের মানুষের মনে ভারত বিরোধিতায় আরও তীব্র রূপ নিতে পারে।
ড. ইউনূস সরকারপ্রধান হওয়াতে ভারত সরকার কিছুটা হলেও স্বস্তিতে। সরকারকে পাকিস্তানপন্থী বা চীনপন্থী হিসেবে দেখার কোনো উপায় নেই। ভারতীয় এক রাজনীতিবিদ বলেছেন, ইউনূসকে বড়জোর ওয়াশিংটন-ঘেষা বলা যায়। ভারতও ইউনূসকে যথেষ্ট সম্মান করে। ড. ইউনূস নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর হাসিনা যখন তাকে দারুণভাবে অপমান ও নাজেহাল করছিলেন, ভারত সরকার তখন তাকে ভারতীয় পার্লামেন্টের যৌথ সভায় বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। ড. ইউনূস ভারতীয় পার্লামেন্টর সরকারি ও বিরোধী উভয় দল থেকে উষ্ণ অভিনন্দন পেয়েছিলেন।
আপাতত ভারত নিশ্চিন্ত, তবে বাংলাদেশে ভবিষ্যতে কী হবে, সেটা নিয়েও তারা স্বভাবতই বেশ উদ্বিগ্ন। থিঙ্কট্যাংক, সাউথ এশিয়া মনিটরের বিশ্লেষক সি. উদয় ভাস্করের মতে, বাংলাদেশে সরকারে যে-ই থাকুন না কেন, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের নীতি বজায় রাখবে, যদিও যেকোনো ভারতীয় প্রস্তাবনা শেখ হাসিনা থাকলে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য হতো এবং ভারতীয় লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হতো।
এখন পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে এমন কোনো বড় সংকট দেখা দেয়নি। কিছুটা টানাপোড়েন হচ্ছে এবং স্থবিরতা দেখা দিয়েছে— এই পর্যন্তই।
রাজনৈতিক দলগুলোর বন্ধুত্বের হাত
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে আওয়ামী লীগের আপাত অনুপুস্থিতিতে, রাজনৈতিক অঙ্গনে একটা বড় ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। এই সুযোগে যেসব রাজনৈতিক দল এতদিন বিরোধীদলে ছিল এবং যাদের কিছুটা সাংগঠনিক কাঠামো রয়েছে তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এগিয়ে আসার। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী তাদের সর্বশক্তি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিকল্প রাজনৈতিক দল হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে। এই দুটি দল হাসিনার সময় একসঙ্গে থাকলেও জামায়াত সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখন আলাদা হয়ে এগোবে। এই দু-দলই চেষ্টা করছে ভারতের বন্ধুত্ব আদায় করতে।
বিএনপির জন্য এটা নতুন কিছু নয়। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকতেই তারা একাধিকবার চেষ্টা করেছিল ভারতের ঘনিষ্ঠ হতে। ২০১৮ সালে আমীর খসরুর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটা টিম নয়াদিল্লি সফর করেন। দলে আরও ছিলেন আব্দুল আউয়াল মিন্টু ও হুমায়ুন কবির। তারা ভারতীয় কয়টা প্রভাবশালী থিঙ্কট্যাংকে বক্তব্য রাখেন, বিএনপির বিভিন্ন নতুন নীতিনির্ধারণী প্রস্তাবনা করেন যা ভারতর জন্য অনুকূল হবে। তারা কট্টরপন্থী আরএসএস নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও দেখা করেন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়, তারেক জিয়াই চাচ্ছেন এতদিনের ‘ভুল ও বিপথগামী’ ভূমিকা পরিবর্তন করতে। তখন এত চেষ্টার পরও বিএনপির প্রতি ভারতীয় মনোভাবের কোনো পরিবর্তন হয়নি বরং পররাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে বলা হলো, ভারত এমন কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পায়নি যাতে বোঝা যাবে বিএনপির পলিসির কোনো পরিবর্তন হয়েছে।
এখনকার অবস্থা অবশ্য ভিন্ন। সম্প্রতি বিএনপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করতে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এলেন ভারতীয় হাইকমিশনার। আলাপ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে। উভয়পক্ষ সম্পর্ক উন্নয়নের কথা বলেছে। ভারত বিএনপির সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক ভালো করতে আগ্রহী বলে জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব। তিনি আরও মন্তব্য করেছেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে। ভারতও যে বাংলাদেশে নতুন মিত্র খুঁজতে বেপরোয়া তা স্পষ্ট।
জামায়াতে ইসলামীও পিছিয়ে নেই। জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান ‘ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক’ চান বলে ঘোষণা দিয়েছেন। ভারত অবশ্য তাৎক্ষণিক তাদের শুভেচ্ছা গ্রহণ করেনি। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আশা ব্যাক্ত করেছেন, ভবিষ্যতে এ নিয়ে আরও আলাপ-আলোচনা হতে পারে।
ভারতের প্রভাবশালী থিঙ্কট্যাংকগুলো অনেকদিন থেকেই বলে আসছিল, বাংলাদেশে এককভাবে আওয়ামী লীগকে সমর্থনের সরকারের বৈদেশিক নীতি ভুল। সব ডিম একই ঝুড়িতে রেখে ভারতীয় সরকার যে ভুল করেছিল, এখন এটা ভারতীয় রাজনীতিকেরা আরও জোরালভাবে উপলব্ধি করছেন। আশা করা যায়, ভারত ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আরও ভারসাম্য রক্ষা করে চলবে।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের টানাপোড়েন কি চলতেই থাকবে?
ভারতে আশ্রয়ে থেকে হাসিনা কী করতে চাইবেন? আর ভারতও বা তাকে দিয়ে কী করাতে চাইবে? যেকোনো শাসক ক্ষমতাচ্যুত হবার পর তার প্রথম চিন্তা থাকে, কীভাবে ক্ষমতায ফিরে পাওয়া যায় ওই চেষ্টা করা। হাসিনার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবে না। আপাতত ভারত সম্ভবত ভারতীয় মাটিতে বসে হাসিনাকে কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাতে বা বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কোনো কথা বলতে দেবে না।
ভবিষৎ অন্যরকম হতে পারে। দ্বিপক্ষীয় দরকষাকষিতে যদি ভারত সরকার তাদের আশা অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা না পায় অথবা বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তান বা চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায়, তাহলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে। বাংলাদেশকে চাপ দিতে তারা হাসিনাকে কাজে লাগাতে হতে পারে। এর মধ্যে বাংলাদেশে হাসিনার অনুগামীরাও কিছুটা সংগঠিত হবে। হাসিনা তাদেরকে দিয়ে বাংলাদেশে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারেন। বাংলাদেশে কোনো অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি হলে, হাসিনা তার সুযোগ নেবেন এবং ক্ষমতা ফিরে পেতে চেষ্টা করবেন, তা অনেকটাই নিশ্চিত।
বাংলাদেশ একটা অস্থির সময় পার করছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু লোকের অর্বাচীন বক্তব্য এবং নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অধৈর্য্য, এই অস্থিরতাকে আরও প্রশ্রয় দিচ্ছে। অবাঞ্চিত শক্তিগুলো এই অস্থিরতাকে কাজে লাগাতে পারে।
তবে বাংলাদেশে একটা স্থিতিশীল অবস্থা বজায় রাখা ভারতের স্বার্থের জন্যও অনুকূল। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক পরস্পর সম্পূরক। ভারতের রয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে বাৎসরিক ৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য, যা প্রতিবছরেই বাড়ছে। ভারত বাংলাদেশে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রপ্তানি করে থাকে। বাংলাদেশে বিরাট সংখ্যক ভারতীয় কাজ করেন। এক পরিসংখ্যানে জানা যায় বাংলাদেশে পাঁচ লাখ ভারতীয় বৈধ এবং পনেরো লাখ অবৈধভাবে কাজ করেন। বৈদেশিক মুদ্রার উপার্জনকারীদের মধ্যে ভারত চতুর্থ, সম্ভবত মধ্যপ্রাচের দেশগুলোর পরপরই। ২০২৩ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ভারতে যত বিদেশী পর্যটক ভ্রমণ করে, বাংলাদেশ তার শীর্ষে— ২২.২৩%, এরপরই যুক্তরাষ্ট্র ১৭.৮%.। ভারতের পর্যটনশিল্পের সবচেয়ে বেশি আয় হয় বাংলাদেশিদের থেকে।
ভারতের জন্য একটা বড় দুশ্চিন্তার ব্যাপার হলো, শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেন নেক এলাকা— যেটা ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে যোগ করেছে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে। বাংলাদেশের সীমানাও এই করিডোরে যুক্ত। ভারত চাইবে এই এলাকা দিয়ে ছোট-বড় বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী যেন বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে না পারে। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পূর্বঞ্চলীয় রাজ্যগুলো সঙ্গে একটা বিকল্প যোগাযোগব্যবস্থা চালু রাখাও ভারত জরুরি মনে করে। ভারত এগুলো নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালাতে পারে।
হাসিনার ভারত অবস্থান যদি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সংকটে রূপ নেয়, সেটা ভারত ও বাংলাদেশ কারও জন্য খুব সুখকর হবে না। আশা করা যায় এই টানাপোড়েন সহসাই শেষ হবে। ভবিষ্যতে একটা সমঝোতাপূর্ণ সহঅবস্থান সম্ভবত দু-পক্ষই মেনে নেবে। দিল্লি বাংলাদেশের জনগণকে ঘটাতে চাইবে না। হাসিনার সরকারে ভারত যে সুযোগ-সুবিধা পেত, তারা হয়ত পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এতটা পাবে না। হয়তবা তাদেরকে তার ষাট থেকে সত্তরভাগ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। বাংলাদেশও তার বড় প্রতিবেশীকে বেশি চটাতে চাইবে না। তাদেরও দিল্লিকে দরকার হবে— বিদ্যুৎ-পানিতো আছেই, রোজার সময় ভারত থেকে ডাল, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ আমদানিও স্থিতিশীলতার জন্য কম জরুরি নয়।
আশা করা হচ্ছে, শেখ হাসিনাও বিদেশ থেকে বাড়াবাড়ি না করে চুপচাপ অবসর জীবন কাটাবেন। তবে যারা হাসিনাকে চেনেন বা তার প্রতিহিংসার ভাষা সম্পর্কে জানেন, তারা নিশ্চয়ই বলবেন— হাসিনাকে চুপচাপ রাখা হয়ত দিল্লির জন্যও কঠিন হবে।