অভাজনের সিলেট কথা

হোসনে আরা কামালী
Published : 30 June 2022, 11:20 PM
Updated : 30 June 2022, 11:20 PM

রবার্ট লিন্ডসে তার 'Anecdotes of an Indian life: Twelve Year's in Sylhet' গ্রন্থে সিলেটে ১৭৮১ সালে সংঘটিত ভয়াবহ বন্যার উল্লেখ করেছেন। সে বন্যায় প্রায় তিরিশ ফুট উচ্চতায় পানির প্রবাহ ছিল বলে রবার্ট জানিয়েছেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বন্যার্ত নেটিভদের সহায়তায় তেমন কিছুই করতে পারেনি বা করেনি। 

প্রায় আড়াইশ বছরেরও বেশি সময়ের ব্যবধান হলেও ২০২২ সালের বন্যায় রবার্ট সাহেবের কথাই মনে পড়ছে। তিরিশ ফুট পানির নিচে কিনা জানি না, তবে সিলেট-সুনামগঞ্জের নিচু এলাকার অনেক ঘরবাড়ি ছাপিয়ে বন্যার পানি চলে গেছে। ইতিপূর্বের যেকোনও বন্যার চেয়ে এ বছরের বন্যা ভয়ংকর।  

এমনকি ১৯৭০ সালের ভয়াবহ বন্যায় সিলেট শহুরের নাগরিক জীবন অন্তত এতটা বিপর্যস্ত হয়নি, যেমনটি হয়েছে এইবার বন্যায়। বন্যার প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে হবে সুদূরপ্রসারী কারণ বন্যার জল সহসাই নেমে যাবে, লক্ষণ এমন নয়।  

সিলেট শহরে মে ও জুন মাসে পরপর দুইবার উপর্যুপরি বন্যার আগ্রাসনে পরিস্থিতি ভীষণ নাজুক ছিল। বর্তমানে বন্যার পানি শহর থেকে নেমেছে বটে, কিন্তু পুরো শহরকেই আজ অচেনা ঠেকছে। শহরের সব শ্রেণির মানুষ ছিল দুইদফায় পানিবন্দি। বাদ পড়েনি শহরের অভিজাত এলাকাগুলো। মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ কলমে বোঝানো দুষ্কর। গত তিন থেকে আবারও বৃষ্টি হচ্ছে সিলেটে। বিশেষ করে রাতে ভারী বৃষ্টি হয়েছে দুই দিন। গ্রাম-শহরের কোনও কোনও জায়গায় পানি বাড়ছে। শহরের নিচু এলাকায় বাসা-বাড়িতে তৃতীয়বারের মতো পানি ঢুকে যাচ্ছে। বন্যার পানি অধিকাংশ এলাকা থেকে নেমে গেলেও বৃষ্টি বন্ধ না হওয়ায় আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। কোথাও কোথাও খুবই ধীর গতিতে পানি নামছে। আবার কোথাও কোথাও দুস্থ-অসহায় মানুষ আর গবাদিপশু, বন্যপ্রাণীর সহাবস্থানে এ সময়টা যেন আদিম-অসহায়-অমার্জিত এক সভ্যতাকেই উন্মোচিত করে চলেছে।

ভূ-প্রকৃতিগতভাবে সিলেট বাংলাদেশের বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা। বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ চেরাপুঞ্জি থেকে সিলেটের  দূরত্ব মাত্র তিরিশ কিলোমিটার। কিন্তু আমার পঞ্চাশ বছরের জীবনে এমন একটানা প্রায় দেড়-মাসের বৃষ্টিপাতের কোনও স্মৃতি নেই। জলবায়ু পরিবর্তনে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে অস্বাভাবিক টানা বৃষ্টিপাতের প্রভাবে সিলেটে এই বৃষ্টিপাত। ফলে ভয়াবহ বন্যা। সিলেটের প্রধান নদী সুরমা, কুশিয়ারা, পিয়াইন, সারি, লোভা, ধলাই প্রভৃতি নদী উজান থেকে নেমে এসেছে। উজানে বন্যা হওয়ায় সিলেট ভেসে যাচ্ছে প্রায় মাসব্যাপী। 

সিলেট শহরে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো কোনওমতে লড়ে যাচ্ছে প্রকৃতির সঙ্গে। কিন্তু গরীব মানুষের সহায় সম্বল সবই হারাতে হয়েছে। যদিও বা একদিন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। ততোদিনে ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে পরিসংখ্যান না করেও অনুমান করা যায়। সুনামগঞ্জের মতো কৃষিপ্রধান অঞ্চলের খাদ্য সঙ্কট পুরো দেশকে তো নাড়িয়ে দেবেই। বন্যা পরবর্তী সময়ে এটাই  আমাদের জন্য বড় দুঃসংবাদ হয়ে উঠবে।  বন্যাত্তোর নানা স্বাস্থ্য সমস্যার কথাতো বলাই বাহুল্য।

প্রকৃতি ফুঁসে উঠছে বারবার। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় মানুষের লোভ, স্বার্থপরতা আর হটকারিতার জবাবে প্রকৃতির ভাষা এমনই হয়- হবে। অপরিকল্পিত বাঁধ, রাস্তাঘাট নির্মাণ, নদী খনন না করা, নদী দখল, পাহাড় কাটা এগুলো থেকে আমাদের মুক্তি কবে হবে জানি না। একইভাবে প্রশ্ন করা যায়, বন্যা মোকাবেলায়  আমাদের প্রস্তুতি কী ছিল? দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাগুলোর ঘাটতি নিয়ে আমরা কী পর্যালোচনা করলাম পঞ্চাশ বছর? উজানের পানি নিয়ে যৌথ মোকাবেলার দ্বার খোলার জন্য আমাদের হার্দিক চেষ্টা কোথায় কতখানি হোঁচট খায় তা জানা যায় না। 

এমন সব  প্রশ্নের জবাবদিহিতার জায়গাটাও ক্রমশ ছোট হতে হতে রুগ্ন হয়ে গেছে। ত্রাণ বা বন্যার্তদের সাহায্যের কথাই যদি বলি প্রাথমিক পর্যায় থেকে এ পর্যন্ত বানভাসি মানুষের কাছে ব্যক্তি পর্যায় বা বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের তৎপরতার খবরই বেশি পাচ্ছি। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, পুলিশ বিজেপিসহ স্থানীয় প্রশাসনের কর্মতৎপরতা দুর্গতদের ত্রাণ-বিতরণ তরান্বিত করছে। 

অথচ প্রায় মাস পেরোতে চললো দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত।  দীর্ঘ পানিবদ্ধতার ফলে বন্যা শেষে পুনর্বাসন আরও কঠিন হয়ে পড়বে! কাঁচা ঘরবাড়ি যাদের ছিল তাদের প্রায় প্রতিঘরেই শিক্ষার্থী ছিল। তাদের বই-খাতা ও নানা শিক্ষাসরঞ্জাম বানের পানিতে ভেসে গেছে। তাদের কী হবে? বিছিন্নভাবে, না কোনও পরিকল্পনার আওতায় তারা পুনর্বাসিত হবে এখনও আমরা সেটি জানি না। 

বাংলাদেশে সরকারি উদ্যোগ নিতে বরাবরই দেরি হয়ে যায়। কারণ আমাদের প্রস্তুতি থাকে না। এটা আমাদের কিসের সঙ্কট আমি জানি না। জানি না কেন সিলেট বিভাগের গুরুতর বন্যা পরিস্থিতি জাতীয়  প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যথাযথ জায়গা করতে পারে না। জাতীয় সংসদ পর্যন্ত সিলেটের বন্যা বিষয়টি যেতে কেন এত সময় লাগে! 

প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটের তুলনামূলক অর্থনৈতিক সাবালম্বিতা কি তবে বরাবরের মতো এই বিপদের দিনেও কাল হয়ে দাঁড়াল? অথচ সিলেট-হবিগঞ্জ বিশেষ করে সুনামগঞ্জের অবস্থা ভয়াবহ। মৃত্যুর সংখ্যা এখনও সঠিক জানা না গেলেও তা সরকারি হিসেবের চেয়ে বেশি হবে। পাঁচদিন বিদ্যুৎ-ইন্টারনেট না থাকায়, জানা না গেলেও এখন নিখোঁজ মানুষের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে হাওর অঞ্চলে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতে চাই, তিনি সিলেটের মানুষকে ভালোবাসেন। তাদের দুর্দশা তিনি নিজচোখে দেখতে এসেছেন। বন্যার্তদের সহায়তার জন্য তিনি নগদ টাকা মঞ্জুর করেছেন। কিন্তু সাধারণভাবে ক্ষয়ক্ষতির যে পরিমাণ অনুমান করা যায়, তাতে মনে হওয়া মোটেও কষ্টকর নয় যে, সিলেটকে ভুগতে হবে অনেক দিন পর্যন্ত। আশা করি প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনায় ও পরিকল্পনায় সিলেটের প্রতি তার এই ভালোবাসা অটুট থাকবে।

পেশাগত কারণে আমি তরুণদের নিয়ে কাজ করি। যেহেতু এদেরই পড়ানোর চেষ্টা করি, তাই তাদের নিয়ে আমি বা আমাদের অনেক অভিযোগ আছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, সিলেটের বন্যার্তদের কাছে কার্যত এই 'বখে যাওয়া', 'ইন্টারনেট আসক্ত', 'বেকার', 'পড়াশোনায় অমনোযোগী-মনোযোগী তরুণরা'ই নানা উদ্যোগে দুর্গম অঞ্চলে ছুটে যাচ্ছে। তাদের কেউ শিক্ষার্থী, কেউ সাংস্কৃতিক কর্মী, আবার কারো একমাত্র পরিচয় সে একজন মানব সন্তান মাত্র। এই তরুণরাই দুর্দিনে মানুষের আস্থায় জায়গা করে নিচ্ছে। তাদের  আয়োজন হয়তো সীমিত, কিন্তু অসীম তাদের সাহস। অনেক সময় ইতিবাচক বড়ে আয়োজনও নির্মম হতে বাধ্য, যদি তাতে ভালোবাসা না থাকে। এই হৃদয়বান তরুণদের আমি  ভালোবাসা জানাতে চাই। শ্রদ্ধা জানাতে চাই।

পদ্মাসেতু বাংলাদেশের জনগণের নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি একটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন। সে হিসেবে  সিলেটের মানুষের কাছেও তা গর্বের। বিষয়টি শুধু স্বনির্ভর আত্মমর্যাদারই নয়। দেশপ্রেম ও পদ্মাসেতু নির্মাণ সম্পৃক্ততায় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর অবদান সিলেটের মানুষের আবেগকে স্পর্শ করে। কিন্তু আজকের বানভাসি মানুষের কাছে পদ্মসেতু উদ্বোধনের আনন্দ ফিকে হয়ে গেছে। এই সময়ের চরম বাস্তবতা হয়তো এটাই।

সিলেট

৩০জুন ২০২২