Published : 19 Jun 2022, 10:20 PM
আমাদের শরীরকে কর্মক্ষম ও সুস্থ রাখার জন্য যেমন ব্যায়ামের প্রয়োজন, তেমনি মস্তিস্কের ব্যায়াম হলো মেডিটেশন বা ধ্যান । নিয়মিত দৌড়ালে যেমন পায়ের পেশী মজবুত হয়, সাঁতার কাটলে যেমন হাতের পেশির শক্তি বাড়ে, তেমনি নিয়মিত মেডিটেশনে আমাদের মস্তিষ্কে নানান ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আসে । নিয়মিত মেডিটেশনে মস্তিস্ক ঠাণ্ডা থাকে আর মন থাকে প্রশান্ত যা একজন মানুষকে সর্বাধিক কর্মদক্ষতা দিতে পারে।
নিয়মিত মেডিটেশন আমাদের সময়ানুবর্তী, পরিমিতিবোধ ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সচেতন করে তোলে। মেডিটেশনে কৃতজ্ঞতাবোধ ও ইতিবাচক শক্তির জাগরণ ঘটে যা একজন মানুষের সুস্বাস্থ্য, প্রশান্তি, সাফল্য ও জীবনের সুখকে নিশ্চিত করে। মেডিটেশনের মাধ্যমে একজন মানুষ শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক, পেশাগত ও আত্মিক বিষয়গুলো সমন্বয় করার দক্ষতা অর্জন করে পায় নিশ্চিত সুখের ঠিকানা। এমনিভাবে মেডিটেশন আমাদের জীবনে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সুফল বয়ে আনে।
আমাদের যত অসুখ হয়, তার প্রায় ৭৫ শতাংশ হলো মনোদৈহিক, যার মানে হলো মনের যত বিরূপ প্রতিক্রিয়া আছে তা রোগ হিসাবে প্রকাশ পায় আমাদের শরীরে। মনের যত নেতিবাচক আবেগ যেমন রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা, দুঃখ, কষ্ট, হতাশা, না পাওয়ার বেদনা দীর্ঘ সময় ধরে বয়ে বেড়াতে থাকলে তা একসময় আমাদের দেহে বিভিন্ন অসংক্রমক রোগ হিসেবে প্রকাশ পায়। এই অসংক্রমক রোগগুলো দেহের হলেও, উৎস হলো মন। মন থেকে সমস্ত নেতিবাচক আবেগ দূর করতে পারলে এই সমস্ত অসংক্রমক রোগ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই মুক্তি পাওয়া যায়। নিয়মিত মেডিটেশন আমাদের মস্তিস্ককে ঠাণ্ডা রাখে এবং মনকে প্রশান্ত করে যা প্রাকৃতিকভাবেই সকল প্রকার মনোদৈহিক রোগ থেকে আমাদের নিরাময় করে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান হতে আমরা জানি যে মেডিটেশন দেহ-মনে ভয়-আতঙ্ক সৃষ্টিকারী অ্যাড্রিনালিন হরমোনের প্রবাহ কমায় এবং ব্যথানাশক অ্যান্ডোরফিন হরমোনের নিঃসরণের মাত্রা বাড়ায়। চিকিৎসকেরা এখন সংক্রামক-অসংক্রামক বা মাইগ্রেইন, সাইনোসাইটিস, অ্যালার্জির মতো মনোদৈহিক, যে কোনও রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে নিয়মিত মেডিটেশনের পরামর্শ দিচ্ছেন।
প্রায় দুই বছর ধরে কোভিড-১৯ সংক্রমণের ভয়াবহতারয় বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠি ছিল কার্যত গৃহবন্দি। আমাদের দেহে মনে বিভিন্ন বিরূপ ছাপ ফেলেছে, যাকে আমরা বলেছি পোস্ট কোভিড ট্রমা। এই ট্রমা আমাদের মস্তিষ্কের কর্ম-প্রক্রিয়াকে শ্লথ করে দিয়েছে। এটি কাটিয়ে উঠতে এবং আমাদের মস্তিস্ককে পুনরায় আগের মতো কর্মক্ষম করতে এবং সমগ্র জাতিকে উদ্দীপ্ত ও প্রাণবন্ত করে কর্মস্পৃহা বাড়াতে দমচর্চা, যোগব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি মেডিটেশন চর্চার কোন বিকল্প নেই। মেডিটেশনের মাধ্যমে আমরা দৈহিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থেকে অর্জন করতে পারি পুরোমাত্রায় স্বাস্থ্যগত সতেজতা। সুস্থতা শুধু একদিনের জন্য নয়, সুস্থতাকে স্থায়ীভাবে ধরে রাখতে মেডিটেশন চর্চা অত্যন্ত কার্যকরী।
পারিবারিক বন্ধন আমাদের জাতির মূল শক্তি। সোশ্যাল মিডিয়াতে আমাদের আসক্তি পরিবারের সুখকে বিনষ্ট করছে, একে অন্যের প্রতি সন্দেহ ও সংশয় বাড়ছে, বাড়ছে পরিবারের ঝগড়াঝাটি, রেষারেষি ও দ্বন্দ্ব । পরিবারের বন্ধনকে সমুন্নত রাখতে সাবাইকে মেডিটেশনে যুক্ত হওয়া প্রয়োজন, কারণ মেডিটেশনে বাড়বে পারস্পারিক মমতা ও বিশ্বাস। নিয়মিত মেডিটেশন পরিবারের সবার সাথে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা বাড়াবে । মা-বাবা ও সন্তানের মাঝে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে মেডিটেশন সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হতে পারে। প্রত্যেকের মানসিক প্রশান্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিবারে সুখ বজায় থাকবে নিরমিত ধ্যানচর্চায় । একঘেঁয়েমি ও একাকিত্বের বৃত্ত ভেঙ্গে সামাজিক মেলামেশায় আমাদের আগ্রহ বাড়বে।
আমারা বিশেষ করে আমাদের তরুণ সমাজ আজ স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়া ইত্যাদি দ্বারা আসক্ত হয়ে পড়ছে, হয়ে পড়ছি প্রযুক্তির দাস। এ আসক্তির প্রভাবে অনিদ্রার অভিশাপে ভুগছেন অগণিত মানুষ। স্ক্রিন আসক্তির ফলে আমাদের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মনোযোগী হতে পারছেন না, তাদের নেতিবাচক ভাবনা ও কিছু ভালো না লাগার আবেগ থেকে জন্ম নিচ্ছে অলসতা। মেডিটেশন চর্চার ফলে সকল ধরনের স্ক্রিন আসক্তি হতে মুক্ত থেকে আমরা পেতে পারি প্রশান্তিদায়ক ও তৃপ্তিময় ঘুম । হতাশা, হীনমন্যতা, অস্থিরতা ও আত্মহত্যার প্রবণতা দূর হয় ধ্যান চর্চায়, সৃষ্টি হয় আত্মনিয়ন্ত্রণের শক্তি যা ধুমপান, মাদকাসক্তিসহ যে-কোন ধরনের বদভ্যাস থেকে মুক্তি লাভের পথ তৈরি করে দেয়। মেডিটেশনের চর্চা আমাদের ব্রেইনের হিপোক্যাম্পাস অঞ্চলে গ্রে ম্যাটারের পুরুত্ব বাড়ায়, যা মস্তিস্ককে রাখে ক্ষুরধার।
ধ্যানচর্চা আমাদের পূর্ব পুরুষদের সাধনার ফসল যা কিনা এক অমূল্য সম্পদ। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবারই ধ্যানচর্চার সুফল গ্রহণের অধিকার রয়েছে। নিজের ভিতর সুপ্ত ইতিবাচকতার শক্তিকে মেডিটেশন শতধারায় বিকশিত করে, দেহ-মন হিংসা, রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা থেকে মুক্ত করে এবং পবিত্রতা, পরিমিতি, সংযম ও মানবিকতা দ্বারা আবেগ পরিপূর্ণ করে যা আমাদেরকে পূর্বের তুলনায় ভালো মানুষে রূপান্তরিত করে। আমরা প্রত্যেকে নিজেদের পরিবর্তন করতে পারলেই আমাদের পরিবারগুলো তথা পুরো দেশ ভালো হতে থাকবে। মেডিটেশনের পরামর্শ ও প্রশিক্ষণের উপর ভ্যাট আরোপিত হলে আমাদের দেশের জনগণ অধিক খরচের কারণে এই বিশাল সম্ভাবনা ও সুফল থেকে বঞ্চিত হবে।
মনোদৈহিক রোগ থেকে মুক্তি ও প্রতিকারের অন্যতম মাধ্যম হলো মেডিটেশন। মেডিটেশন আমাদের মনের শুভ ও ইতিবাচক শক্তিকে জাগিয়ে তোলে। বিশ্বাস, প্রত্যয় ও আশার সঞ্চার ঘটায়। আমরা হয়ে উঠি সাহসী ও প্রাণবন্ত । আমাদের যে কোন রোগের চিকিৎসার পরামর্শ নিতে ভ্যাট দিতে হয় না, তাহলে একজন মানসিক রোগীকে তার চিকিৎসার পরামর্শ বা প্রশিক্ষণ নিতে কেন ভ্যাট দিতে হবে? জনগণের কল্যাণ তথা দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য মেডিটেশনের উপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহারের জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি ।