Published : 22 Feb 2022, 08:04 PM
বাঙালি মুসলমানের বিভ্রান্তির স্বরূপ
প্রথমেই পরিষ্কার করতে চাই শিরোনামে ব্যবহৃত 'বাঙালি মুসলমান' শব্দবন্ধটি। ঠিক যে অর্থে আহমদ ছফা বাঙালি মুসলমানদের বিশেষ একটি শ্রেণির কর্ম ও মনস্তত্ত্ব বোঝাতে গোটা একটি সম্প্রদায় বোধক (তার বিখ্যাত প্রবন্ধ বাঙালি মুসলমানের মন) শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন, আমিও ঠিক ওই অর্থেই ব্যবহার করছি। কেবল আমিই নই, বদরুদ্দীন উমরসহ আরও অনেকেই তা করেছেন।
উনিশ শতকে বাঙালিদের মধ্যে যখন বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের সূচনা ঘটছে তখন বাঙালি মুসলমানরা সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিকূল আবহের কারণে নিজেদের আত্মপরিচয় নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। যে তিনটি প্রতিকূল আবহ তাদের আত্মপরিচয়ের সংকটকে ঘনীভূত করেছিল, তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ আমরা যথাসময়ে উল্লেখ করবো অবশ্যই, তার আগে শুধু এটাই বলতে চাই যে সংকট বা প্রতিকূল পরিবেশের মোকাবেলা করার জন্য যে বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞার আশ্রয় তাদের নেয়া উচিৎ ছিল, সে ব্যাপারে তারা ছিল দুঃখজনকভাবে এবং চূড়ান্ত রকমে ব্যর্থ। তাদের এই ব্যর্থতাবোধেরই রূপান্তর ঘটেছিল প্রতিক্রিয়াশীলতায় বা পশ্চাদপদতায়। কী সেই প্রতিক্রিয়াশীলতা? প্রথমত, হিন্দুদের থেকে আলাদা হতে গিয়ে ও হিন্দুদের প্রতি বিরূপতা থেকে বাংলা ভাষার প্রশ্নে তারা দাঁড়িয়েছিল এর বিপরীতে। আর সংস্কৃতি যেহেতু ভাষানির্ভর এক প্রপঞ্চ, আর ভাষাটিকেও যেহেতু হিন্দু সম্প্রদায়ের বলে ধরে নেয়া হয়েছে, ফলে বাঙালি সংস্কৃতিকে গ্রহণে তারা ছিল অনীহ। তাদের ধারণা ছিল এই যে, বাঙালি সংস্কৃতি মানেই হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি। এই কারণে সামাজিক পরিচয়েও তারা অবাঙালিত্বকেই প্রখর করে তুলেছে–মধ্যপ্রাচ্য বা আরবাগত বংশ পরিচয়ের মাধ্যমে। আর সাংস্কৃতিক পরিচয়ে তারা পরগাছার মতোই নিজেদেরকে অবাঙালি ভাবতে গৌরব বোধ করতো। যদিও নিম্নবর্গের মুসলমান জনগোষ্ঠী এসব ভাবনার খোঁজ খবর যেমন রাখতো না, তেমনি এসব ভাবনায় তাদের কোনো আগ্রহও ছিল না। তবু বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজে ওই উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের বাঙালি মুসলমানদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভাবনার একটা গুরুত্ব ছিল। ছিল বলেই ওই সব ভাবনা আলোচিত হতো এবং সময় বিশেষে বিতর্কও তৈরি করতো।
যে ইসলাম ধর্মের প্রতি নিষ্ঠাবশত নিজের দেশ ও সংস্কৃতিকে তারা ঘৃণা করেছে সেই ইসলাম ধর্ম নিজের দেশ, সংস্কৃতি ও ভাষার প্রতি বিরূপ হওয়ার পরামর্শ কখনো দেয়নি। কোরান কিংবা সহি কোনো হাদিসেও এই বিরূপতার কোনো নজির নেই। তবু এদেশের বিশেষ শ্রেণির মুসলমানরা নিজের দেশ, ভাষা ও সংস্কৃতিকে অবহেলা কেবল নয়, রীতিমতো ঘৃণা করেছে। এই ঘৃণার পক্ষে ফতোয়াও দিয়েছে তারা। কিন্তু আজকের কোনো কোনো বামপন্থি পণ্ডিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে অনেকেই এই ইতিহাসকে বেমালুম চেপে যান। তারা মধ্যযুগের ইতিহাসের কয়েকটি ঘটনা দিয়ে উনিশ শতকে উদ্ভুত ঘৃণার লেলিহান ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন। এই ধামাচাপার মধ্যে যে একটি চালাকি আছে, সেটা ওয়াকিবহাল পাঠকমাত্রই টের পাবেন। বাংলা ভাষার প্রতি মুসলমানদের অনুরাগ এবং এ ব্যাপারে মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতার কথা তারা বলেন। এ কথা সত্য যে সুলতানি আমল এবং হোসেন শাহী আমলে যে হিন্দু এবং মুসলমান সম্প্রদায় কর্তৃক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা হয়েছিল ব্যাপকভাবে, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। অবাঙালি মুসলিম শাসকরা হিন্দু পুরাণ মহাভারত ইত্যাদি গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করিয়েছেন। এসব শাসকরা বাঙালি প্রজার মন জয় করার জন্যই হোক কিংবা বাঙালি জাতি ও সংস্কৃতির প্রতি মুগ্ধতাবশতই হোক, তাদের কেউ কেউ 'শাহে বাঙ্গালিয়ান' উপাধিও ধারণ করেছিলেন। কিন্তু পাশাপাশি এও মনে পড়বে যে এরা কেউ–ই বাংলাকে কখনো দরবারী ভাষায় পরিণত করেনি। তা না করলেও বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর এই ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে তারা বিরাট ভূমিকা রেখেছেন– অবাঙালি এবং মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও।
একই সঙ্গে, এও বিস্ময়কর ব্যাপার যে মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও সেই সময় বহু মুসলমান কবি হিন্দু পুরাণ ও দেবদেবী সম্পর্কে লেখার পাশাপাশি অসংখ্য বৈঞ্চব পদাবলীর পদকর্তাও ছিলেন। এবং তারা সংখ্যায় একজন দুজন নন, অসংখ্য। শাহ আকবর, নাসির মাহমুদ, নাসির মোহাম্মদ, সৈয়দ আইনুদ্দিন, মোহাম্মদ, নজর মোহাম্মদ, ফকির হাবিব, সৈয়দ মুর্তজা, সৈয়দ সুলতান, শেখ কবির, আলাওন, সালেহ বেগ, মীর ফয়জুল্লাহ, ফাজিল নাসির, আলি রজা, চাঁদ কাজী, মোহাম্মদ হাসিম, আসাউদ্দিন, ওহাব, আফজল, মীর্জা কাঙ্গালী, পীর মোহাম্মদ, মর্তুজা গাজী, ফতে খান, কমর আলী প্রমুখ। এরা সবাই যে একই কালের, তা নয়। তবে হিন্দু পুরাণ ও বিষয়বস্তুকে অবলম্বনের কারণে সবাই ছিলেন অভিন্ন আত্মার সম্মিলিত সিম্ফনি। কিন্তু ইংরেজদের বিভেদ ও শাসনের বিষাক্ত নীতির ষড়যন্ত্রে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি মুসলমানদের মধ্যে পুঞ্জিভুত হতে শুরু করে প্রথমে বিরাগ, পরে ঘৃণা। হিন্দু পুরাণ ও বিষয়বস্তু থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে এবার মনোযোগ দিতে শুরু করে ইসলাম ও ইসলামের উৎসভূমির দিকে। এর পেছনে যতটা ধার্মিকতা কাজ করেছে, তার চেয়ে বেশি ছিল স্বাতন্ত্র্যের আকাঙ্ক্ষা, আর সেই আকাঙ্ক্ষা রূপান্তরিত হয়েছিল বিভেদনীতি ও বিরূপতায়। শুধুই ধর্মীয় কারণে ভিন্ন সংস্কৃতিতে মনোযোগ দিতে গিয়ে তারা অস্বীকার করতে শুরু করবে যা–কিছু নিজস্ব ভূখণ্ডের। "মধ্যযুগে যে বহু মুসলমান কবি কাব্যরচনা করেছিলেন, তাও ছিল গর্বের বিষয়। যদিও, যারা গর্ব করতেন, তাঁরা জানতেন যে, এসব কাব্যের ভাবধারা ইসলামি ভাবধারার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়নি।" ( মুসলিম–মানস ও বাংলা সাহিত্য, আনিসুজ্জামান, চারুলিপি, ২০১৮, পৃ ১১৭)
ধর্মের এই চোরাটান তাদের শিরায় শিরায় এতটাই কল্লোলিত হয়ে উঠলো যে বাংলা ভাষাটিকেও তারা অস্বীকার করতে দ্বিধা করেনি। এক সময় যে–সব ব্রাহ্মণ–পণ্ডিতরা ফতোয়া দিয়ে বলেছিলেন, "দেশীয় ভাষায় রামায়ন–সহ হিন্দু পুরাণ শুনলে অথবা শোনালে তাঁদের জায়গা হবে রৌরব নরকে।" (বাংলা ভাষার উদ্ভব ও অন্যান্য, গোলাম মুরশিদ, প্রথমা প্রকাশনী, ২০১৯, পৃ: ৮৫)
এই ব্রাহ্মণ–পণ্ডিতদেরই অনুসরণে মুসলমান মোল্লারাও একই কথা বলতে শুরু করলেন,
বাংলা ভাষায় যে সব মুসলমান লেখালেখি করবে এবং বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে গ্রহণ করবে তারা ইসলাম ধর্ম থেকে খারিজ হয়ে যাবে। এদের 'বিবি' তালাক হয়ে যাবে। এদের সন্তানরা হবে জারজ।" (ঐতিহাসিকের নোটবুক, সিরাজুল ইসলাম, তৃতীয় মুদ্রণ ২০১৯, কথা প্রকাশ, পৃ ৪২)
যদিও মোটাদাগে বলা হচ্ছে যে, বাংলা ভাষার প্রতি মুসলমানদের বিরূপতা মূলত ১৯ শতকে ইংরেজ শাসনামলের ফল, কিন্তু ইতিহাসের দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তাকালে দেখা যাবে এর সূচনা আরও আগে থেকেই ছিল। যে মধ্যযুগে মুসলমানদের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার কথা গৌরবের সাথে স্মরণ করা হয়, মনে রাখা দরকার যে এই চর্চার পাশাপাশিই তখন প্রবহমান ছিল অবজ্ঞার বিষাক্ত ধারাও:
"ষোলো শতকের কবি সৈয়দ সুলতানের লেখা থেকে জানা যায় যে, এ ভাষার প্রতি মোল্লা মৌলবিদের মনোভাবও ছিল দারুণ প্রতিকূল। … সৈয়দ সুলতানও কাব্যের শুরুতেই ক্ষমা চেয়ে তাঁর নবীবংশ আরম্ভ করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন যে,
মোল্লা–মৌলবিদের ফতোয়ার বিরুদ্ধে গিয়ে নবীদের কথা দেশীয় ভাষায় লেখার জন্যে যেন তাঁর নিন্দা না করে।" (বাংলা ভাষার উদ্ভব ও অন্যান্য, গোলাম মুরশিদ, ২০১৯, প্রথমা প্রকাশ, পৃ: ৮৫–৮৬)
সন্দেহ নেই যে বাংলায় মুসলিম শাসনের পতনের ফলে হিন্দু–মুসলমানের মধ্যেকার বিভেদকে কাজে লাগিয়ে ইংরেজরা মুসলমানদের মধ্যে ঘৃণাবোধের আগুনকে উস্কে দিয়েছে। অন্যদিকে, বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় নানা কারণে বাঙালি মুসলমানদের অবজ্ঞা ও অবহেলা করেছে এবং তার ঘনীভূত রূপ ছিল তাদের সাম্প্রদায়িক মনোভাব।
সেকালের লেখায় হিন্দু লেখকরা মুসলমানদের প্রতি যে–সাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন, তাও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি সাধারণ শিক্ষিত মুসলমানদের বিদ্বিষ্ট করেছিলো।" (বাংলা ভাষার উদ্ভব ও অন্যান্য, পৃ: ৬২)
বাঙালি মুসলমান এর জবাব দিতে গিয়ে শুধু সাম্প্রদায়িকই হয়ে উঠলো না, অস্বীকার করে বসলো নিজের ভাষা, সংস্কৃতি আর মাতৃভূমিকেও। ধর্মকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে "তারা বাংলাকে হিন্দুর ভাষা অথবা 'কুফুরি জবান,' অর্থাৎ কাফেরের ভাষা বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন।" (বাংলা ভাষার উদ্ভব ও অন্যান্য, পৃ ৬২)
তবে পাশাপাশি এটাও উল্লেখ করা দরকার যে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও ভূখণ্ডকে অস্বীকারের পেছনে কেবল সাম্প্রদায়িক বোধই সক্রিয় ছিল না, এর পেছনে আভিজাত্য অর্জনের আকাঙক্ষাও সক্রিয় ছিল। ঠিক এই কারণে, বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব নবাব "আব্দুল লতিফের মতো বাংলাভাষীকেও আভিজাত্য অর্জন করার জন্য বাংলাকে অস্বীকার করে উর্দুকে নিজের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে হয়েছিল।" (বাংলা ভাষার উদ্ভব ও অন্যান্য, পৃ: ৬২)
সাংস্কৃতিক যে ঐক্যবোধের পরিচয় মধ্যযুগে বাঙালি মুসলমানরা দিয়েছিল, তা রাজনৈতিক কারণে ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে, ক্ষয়ে যাওয়া সেই শূন্য জায়গাটিকে পূরণ করার জন্য ধর্মকেই তারা শক্তি সঞ্চয়ের সহজ উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছিল। কিন্তু ধর্মকে উপায় হিসেবে বেছে নিতে গিয়েও ইসলামের উদারনৈতিক ধারাটির পরিবর্তে তারা বেছে নিয়েছিল অনুদার, অন্ধ ও বদ্ধ রূপটিকেই। এর ফলে ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতীয়তার প্রশ্নে তাদের মধ্যে বহুমুখী বিভ্রান্তির জন্ম হয়েছে। বাঙালি মুসলমানের মন কতটা স্ববিরোধী ছিল সে সম্পর্কে আনিসুজ্জামানের একটা পর্যবেক্ষণ স্মরণ করা যাক:
গ্রামাঞ্চলে তো সব সময়ই কোনো না কোনো ধরনের সংগীত বা নাট্যাভিনয়ের চল ছিল আর পৃষ্ঠপোষকতা তো করতেন সাধারণ মানুষ– মুসলমানদের অংশও সেখানে কম ছিল না। সেকথা অস্বীকার করা যায় না। তবে এও অনস্বীকার্য যে, উনিশ শতকের মুসলিম সংস্কার–আন্দোলনের ধারাটা ছিল শিল্পচর্চার বিরোধী। তাই আড়ালে যা উপভোগ্য ছিল, প্রকাশে হয়তো তা ছিল বিব্রতকর।" (ইহজাগতিকতা ও অন্যান্য, আনিসুজ্জামান, কারিগর পৃ ১১.৩–১১৪)
আনিসুজ্জামানের এই পর্যবেক্ষণ আমাদেরকে কেবল এটাই মনে করিয়ে দেয় যে, বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে দুটি ধারাই প্রবহমান ছিল: কিন্তু ধর্মীয় বোধ এসে পরস্পরের মধ্যে এক অনতিক্রম্য বিভেদ রেখা টেনে দিয়েছে। এই বিভেদবোধের বিস্তার কেবল ভাষাতেই নয়, তা ছড়িয়ে পড়েছিল সংস্কৃতি সম্পর্কে সুস্থ ও স্বাভাবিক ধারণার মধ্যেও। এর ফলে বাঙালি মুসলমান এক পরস্পর–বিরোধী অবস্থানে কিন্তু দ্বিখণ্ডিত আদলে হাজির হয়। সেই জটিল আদলটি আমরা দেখতে পাবো সমসাময়িক কবি ও ভাবুকদের রচনায়। কয়েকটি উদাহরণ থেকে পাঠকরা এই চেহারাটা দেখতে পাবেন:
কবি, হাজী মুহম্মদ, পাঠকের কাছে মিনতি করেছেন, 'হিন্দুয়ানী অক্ষর দেখি না করিও হেলা।…দেশীভাষা দেখি মনে না করিও ঘীন?" (ইহজাগতিকতা ও অন্যান্য, পৃ: ৭৮)
হাজী মুহম্মদের এই বক্তব্যে পরিষ্কার যে বাংলা ভাষাকে মুসলমানদের একটা বিশেষ শ্রেণি নিজের ভাষা নয়, হিন্দুদের ভাষা বলেই মনে করতো, আর ভাষাটি জন্মসূত্রে নিজেদের হয়ে থাকলেও, তার প্রতি নিশ্চিত এক ঘৃণাবোধ ছিল। আর এ কেবল হাজী মুহম্মদের উক্তিতেই নয়, বাংলা ভাষার আরেক বড় লেখক সৈয়দ সুলতানেও তা দেখতে পাই:
মুনাফিকে বোলে আক্ষি কিতাবেতু কাড়ি
কিতাবের কথা দিলুঁ হিন্দুয়ানি করি।
আল্লাহ বুলিছে, 'মুঞি যে দেশে যে ভাষ
সে দেশে সে ভাষে কৈলু রসুল প্রকাশ।'…
কর্মদোষে বঙ্গেত বাঙ্গালী উতপন
না বঝে বঙ্গালী সবে আরবী বচন।…
এথ ভাবি নবীবশ পাঁচালী রচিলুঁ
বুঝে হেন মত করি যে কিছু কহিলুঁ।…
আলিমে কিতাব পড়ি বাখানে যে কালে
হিন্দুয়ারি করি যদি না বাখানি বোলে।
বঙ্গদেশী সকলরে কিরূপে বুঝাইব
বাখালী আরবী ভাষে বুজাইতে নারিব।
যারে যেই ভাষে প্রভু করিছে সৃজন
সেই ভাষ তাহার অমূল্য সেই ধন।
কেবল হাজী মুহম্মদ বা সৈয়দ সুলতানই নয়, আরও অনেকের লেখাতেই বাংলা ভাষার প্রতি অভিজাত মুসলমানদের ঘৃণা ও গাদ্দারির আভাস আছে। কিফায়েতুল–মুসল্লি–এর কবি শেখ মোতালেবের লেখাতেও বাংলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞার কথা আছে।
মুছলমানী শাস্ত্র কথা বাঙ্গালা করিলু।
বহু পাপ হৈল মোর নিশ্চয় জানিলু।।
তবে বাংলা ভাষার প্রতি বাঙালি মুসলমানদের গাদ্দারির একটা দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছিলেন আবদুল হাকিম:
যে সব বঙ্গেতে জম্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব জাহার জন্ম নির্ণয় না জানি।।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে না জুয়ায়।
নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায়।।
উপরে যে–কজনের উদ্ধৃতি দেয়া হলো তারা সবাই—আনিসুজ্জামানের মতে– "পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর" লেখক। তার মানে যারা বলে থাকেন মুসলমান শাসকরা মধ্যযুগে বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করেছে এবং মুসলমানরা বাংলা ভাষায় বিদ্যা চর্চা করেছে এবং বাংলা ভাষার পক্ষাবলম্বন করেছে, তারা তথ্যের সামান্য শাক দিয়ে ইতিহাসের বৃহৎ এক মাছকে ঢাকার চেষ্টা করেন। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ঘৃণা, অবজ্ঞা ও অস্বীকার যদি প্রবলই না হতো তাহলে এতসব লেখককে বাংলা ভাষায় লেখার কারণে শরমিন্দা, অপরাধী ও পাপী বলে বোধ করতে হতো না।
বেশ কিছু দিন আগে ভাষা সংস্কৃতি দেশ প্রসঙ্গে বাঙালি মুসলমানের অবস্থান নিয়ে যখন বলেছিলাম, 'বাঙালি মুসলমান মূলত গাদ্দার', তখন অনেকেই বাক্যের চাপাতি দিয়ে আমাকে টুকরো টুকরো করেছিল, কেউ একজন আমাকে আক্ষরিক অর্থেই চাপাতি দিয়ে খতম করে দেয়ার কথাও বলেছিল। বাঙালি মুসলমানের মুখোশ উন্মোচন করায় তারা ক্ষিপ্ত, ক্রুদ্ধ হয়ে অজস্র কুৎসিত ভাষায় গালাগাল করেছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সেলিম রেজা নিউটন বলেছিলেন আমার নাকি 'মুসলমানদের প্রতি আকণ্ঠ ঘৃণা'। কিন্তু ইতিহাস আর উপরোক্ত উদ্ধৃতি বলে ঠিক উল্টোটাই। আমি ঘৃণা প্রকাশ করিনি, কেবল আত্মসমালোচনা করেছি। ঘৃণা আর আত্মসমালোচনা এক জিনিস নয়। মুসলমানরা নিজেরাই নিজেদের ঘৃণা করেছে আভিজাত্যের অলীক অহংবোধ থেকে। ইতিহাসের আয়নায় এখন তাদের সেই বিকৃত মুখচ্ছবি দেখে আঁৎকে ওঠে আর অবোধ শিশুর মতো চিৎকার করে। ওই বিকৃত মুখচ্ছবির কথা তারা স্মরণ করতে ভয় পায়, তবে এনিয়ে তারা লজ্জিত নয় মোটেই। বরং বিব্রত বোধ করে এবং তা অস্বীকার করতে চায়। আমি শুধু তাদের নিজেদের প্রতি ঘৃণাবোধকে দেখিয়েছিলাম। বামপন্থি লেখক ও সাংবাদিক ফারুক ওয়াসিফ আমার ওই উক্তিতে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছিলেন যে বায়ান্ন, একাত্তর এবং পহেলা বৈশাখ – এই তিনটাই নাকি 'মুসলমানদের' অর্জন। এই বক্তব্যের চাতুর্য্য নিয়ে আমরা একটু পরে কথা বলবো। তার আগে আমরা খতিয়ে দেখতে চাই নিজের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি মুসলমানদের ঘৃণার ধারাবাহিকতা। সেই ঘৃণার এক অসামান্য আলেখ্য তুলে ধরেছিলেন লেখক আহমদ ছফা তার 'বাঙালী মুসলমানের মন' নামক দীর্ঘ এক প্রবন্ধে। মনে করা হয়েছিল মধ্যযুগে যে ঘৃণার সূচনা, তা আবদুল হাকিমের দাঁতভাঙ্গা জবাবের পর বাঙালি মুসলমানের মনে পরিবর্তন এসে গেছে। তা যে হয়নি, সে প্রমাণ আমরা দেখতে পাবো উনিশ শতকে এসে। যদিও তা ধীরে ধীরে কমে এসেছিল, কিন্তু ছিল।
মুসলমানদের মধ্যে এমন একটি ছোটো জনগোষ্ঠী থেকে যান, যারা কখনো বাংলা ভাষাকে নিজেদের ভাষা এবং বঙ্গভূমিকে নিজেদের দেশ বলে মেনে নিতে পারেননি।" (বাংলা ভাষার উদ্ভব ও অন্যান্য, গোলাম মুরশিদ, পৃ: ৬১)
মনে হতে পারে এটি একটি ছোট্ট জনগোষ্ঠী, কিন্তু গ্রামে গঞ্জে, অর্থাৎ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে তারা তাদের ধারণাকে ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করতো মক্তব মাদ্রাসায় পাঠ দানের মাধ্যমে যার ধারাবাহিকতা নানান উপায়ে আজও অব্যাহত। গোলাম মুরশিদের গবেষণার ফল বলছে:
উর্দু–ফারসি–আরবি ভাষার সঙ্গে এমন একটা ধর্মীয় অনুষঙ্গ তৈরি হয়েছিল যে, শিক্ষিত মুসলমানরা বিশ শতকের গোড়াতেও প্রধান ধারার শিক্ষাকে তাঁদের জন্য প্রাসঙ্গিক বলে মনে করতেন না। এমন কি, মক্তব–মাদ্রাসায় তখন সাধারণ বাংলা ভাষা পড়ানো হতো না, পড়ানো হতো আরবি–ফারসি–উর্দু মেশানো 'মুসলমানী বাংলা'।" (বাংলা ভাষার উদ্ভব ও অন্যান্য, পৃ: ৬২)
তবে বাঙালি মুসলমানদের অভিজাত শ্রেণি ও মোল্লা মৌলভীদের মামদোবাজি লক্ষ্য করে ১৯০৯ সালে হামেদ আলী নামে অগ্রসর চিন্তার এক লেখক বলেছিলেন:
আমাদের পূর্বপুরুষগণ আরব, পারস্য, আফগানিস্থান অথবা তাতারের অধিবাসীই হউন, আর এতদ্দেশবাসী হিন্দুই হউন, আমরা এক্ষণে বাঙালী, –আমাদের মাতৃভাষা বাঙ্গালা।… যে দেশে আমরা সাত শত বৎসর কাল বাস করিতেছি– সে দেশকে যদি আমরা এখনও স্বদেশ জ্ঞান না করি– তাহার অপেক্ষা আশ্চর্য্য এবং পরিতাপের বিষয় আর কি আছে? … আমাদের অনেকের মোহ ছুটে নাই। তাঁহারা বাঙ্গালির বাঁশবন ও আম্রকাননের মধ্যস্থিত পর্ণকুটিরে নিদ্রা যাইয়া এখনও বোগ্দাদ, বোখরা কাবুল, কান্দাহারের স্বপ্ন দেখিয়া থাকেন। কেহ কেহ আবার বাঙ্গালার পরিবর্ত্তে উর্দ্দুকে মাতৃভাষা করিবার মোহে বিভোর।
(সাময়িকপত্রে জীবন ও সমাজ, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, বাংলা একাডেমি, ফেব্রুয়ারি ২০০১, পৃ ২৫০)
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে বিশ শতকের গোড়াতে হামেদ আলী বাঙালি মুসলমানকে সঠিক পথে আনতে চাইলেও তারা ওতে খুব একটা কর্ণপাত করেনি। বিশ শতকের মাঝামাঝি এসেও তারা বাংলা ভাষাকে কোনো মতে গ্রহণ করলেও 'বাঙালি'পরিচয় নিয়ে দ্বিধা মোটেও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বদরুদ্দীন উমর তাদের এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব লক্ষ্য করে বলেছিলেন:
কিন্তু একথাও আবার অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাংলাদেশের মুসলমানেরা অনেক ক্ষেত্রে নিজেদেরকে বাঙালী বলে পরিচয় দিতে দ্বিধা এবং সঙ্কোচ বোধ করেন। এই দ্বিধা এবং সঙ্কোচের উৎপত্তি সাম্প্রদায়িকতা। সাম্প্রদায়িকতার জন্যই বাংলার সাধারণ সংস্কৃতি এবং ঐহিত্যকে মুসলমানেরা নিজেদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য বলে স্বীকার করতে প্রস্তুত হন না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বে একথা সত্য ছিল এবং এখনও পূর্ব বাংলার অনেক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলমানের মনে এ–সংশয় এবং প্রশ্ন রীতিমতো জাগ্রত। তাঁদের ধারণা আমরা বাঙালী বলে নিজেদের পরিচয় দিলে হয় রাষ্ট্রদ্রোহিতা নয় ইসলামবিরোধিতা করে বসবো। এ ধারণা যে কত ভ্রান্ত সেটা অন্যান্য জাতির ইতিহাসের কথা স্মরণ করলে সহজেই বোঝা যায়। (সংস্কৃতির সংকট, বদরুদ্দীন উমর. পৃ ৬)
আমাদের মনে পড়বে ৪৭–এর দেশ ভাগের পরপরই গোটা পাকিস্তান আমলে 'দেশ' নিয়ে নিষ্পত্তি হলেও ভাষা আর সংস্কৃতির ব্যাপারটা সহজে মেনে নিতে চায়নি বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়, এর পেছনে মধ্যযুগে উত্থাপিত 'হিন্দুয়ানি' অজুহাতটাই বড় হয়ে দেখা দিল। বাংলাকে তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাষা বলে মনে করায় সেটা তারা মেনে নিতে রাজি ছিল না। কিন্তু নানা কারণে মেনে নেয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলেও সেটাকে খৎনা করে নেয়ার পক্ষে অসংখ্য ফতোয়া জারি হতে থাকলো। প্রস্তাব এলো ভিন্ন লিপিতে বাংলা লেখার। সেই ১৯১৫ সালে আল এসলাম পত্রিকায় এক পণ্ডিত "আরবি হরফে বাংলা লেখার সুপারিশ করেছিলেন। তিরিশের দশকে বাংলা লিপির পরিবর্তে রোমান বর্ণমালার গ্রহণের প্রস্তাব সোৎসাহে সায় দিয়েছিল সওগাত ও বুলবুল পত্রিকা।" (ইহজাগতিকতা ও অন্যান্য, পৃ: ১৩০)
ভাষা নিয়ে চূড়ান্ত পাগলামির এক নজির দেখা যাবে চট্টগ্রাম অঞ্চলে। "বিংশ শতাব্দীতে এই ধারার উত্তরসাধক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন মৌলানা জুলফিকার আলী: চট্টগ্রাম থেকে হুরুফুল কুরআন নামে আরবি হরফে একটি বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা তিনি প্রকাশ করতেন।" (ইহজাগতিকতা ও অন্যান্য, পৃ: ৩০)
সারা জীবন বাংলা ভাষায় কবিতা ও গদ্য লিখে কবি গোলাম মোস্তফা বাংলায় নয়, আরবি ভাষার বিজয় কেতন উড়িয়ে আস্ত একটা বই–ই লিখে ফেললেন আরবি ভাষার পক্ষে, কিন্তু বইটি তিনি লিখলেন ইংরেজিতে। আর তাতে লিখলেন:
Islam is the best of all religions. The Holy Quran is the best of all revealed books; similarly the Arabic language and the script must be the best language and the best script of the World. (ইহজাগতিকতা ও অন্যান্য, পৃ: ১৩১)
তবে জুলফিকার আলী ও গোলাম মোস্তাফাদের আরবির পক্ষে ওকালতি সত্ত্বেও, তা তেমন একটা কল্কে পায়নি প্রয়োগের ক্ষেত্রে অসম্ভাব্যতা টের পেয়ে। কিন্তু বাঙালি মুসলমানরা খৎনার ব্যাপারে তখনও পুরোপুরি হাল ছাড়েননি। এবার তারা এগিয়ে এলেন নতুন এক চিজ নিয়ে: শাসকদের ভাষা উর্দুকে বাঙালির ভাষা করার ব্যাপারে তৎপর হয়ে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষার প্রতিক্রিয়াশীল লেখকরা পেখম মেলে তাদের রঙিন সমর্থন জানালেন। যদিও প্রধানত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও সৈয়দ মুজতবা আলীর বিরোধিতার কারণে সেই চেষ্টাও ভেস্তে যায়। কিন্তু ওই অদম্য মুসলমানরা এবার অন্য পথে এগুতে শুরু করে। উর্দুকে যখন কোনওভাবেই পূর্ব বঙ্গের রাষ্ট্রভাষা করা সম্ভব হলো না, তখন তারা বাংলা ভাষাকে মেনে নিতে বাধ্য হলেও, সেটাকে আর আগের মতো রাখতে চাইলো না এই অজুহাতে যে পূর্ববঙ্গ যেহেতু মুসলিম–অধ্যুষিত অঞ্চল, অতএব এই ভাষায় অবাধে আরবি ফারসি শব্দের প্রয়োগের মাধ্যমে স্বতন্ত্র হতে হবে। এই ভাষা থেকে 'হিন্দুয়ানি' ঝেড়ে ফেলতে হবে। অনেকে দোভাষী পুঁথিগুলোকে অনুসরণযোগ্য বলেও ফতোয়া দিলেন। আবুল মনসুর আহমদ এই সময় বেশ দৃঢ়তার সাথেই জানালেন:
বাংলার মুসলমানের যেমন একটা নিজস্ব সংস্কৃতি আছে, তেমনি তাদের একটা নিজস্ব সাহিত্যও আছে। সে সাহিত্যের নাম মুসলমানী বাঙলা সাহিত্য বা পুঁথি–সাহিত্য।' তিনি বলেন, 'পূর্ব–পাকিস্তানের সাহিত্যিক রেনেসাঁ আসবে এই পুঁথি–সাহিত্যের বুনিয়াদে।' ওই সাহিত্য রচিত হবে কোন বাঙলা ভাষায়? তাঁর মতে, 'সে সাহিত্যের ভাষাও হবে মুসলমানেরই মুখের ভাষা।' অর্থাৎ তিনি আরবি–ফার্সি–উর্দু মিশ্রিত বাঙলা ভাষায় মুসলমানি বাঙলা সাহিত্য সৃষ্ট হবে বলে মনে করেন। সে–ভাষা 'সংস্কৃত বা তথাকথিত বাঙলা ব্যাকরণের কোনো তোয়াক্কা রাখবে না। (ভাষা–আন্দোলন: সাহিত্যিক পটভূমি, পঞ্চম খণ্ড, হুমায়ুন আজাদ, ইউপিএল, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ ২০০০, পৃ ৫)
কিন্তু ড. শহীদুল্লাহ ছিলেন সতর্ক প্রহরীর মতো জাগ্রত, শুধু জাগ্রতই নয়, বরং ঘুমন্ত বাঙালিকে জাগিয়ে তোলার দায়িত্বেও ছিলেন অটল। তিনি সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন:
কতগুলি অসাহিত্যিক, গোঁড়া রাজনীতিক বাংলা অক্ষর ও ভাষাকে গায়ের জোরে বা আইনের জোরে রাতারাতি বদলাইতে চাহিলেও বাংলা ভাষা প্রবল নদীর ন্যায় নিজের মর্জি মত আপনার গতিপথ বাছিয়া লইবে। বাহিরের কোনো শক্তি তাহাকে বাধা দিতে পারিবে না। ভাষা পরিবর্ত্তনশীল সুতরাং পরিবর্ত্তন আসিবেই। কিন্তু তাহা ভাষাতত্ত্বের নিয়ম অনুসারে, কাহারও হুকুম বা ইচ্ছানুসারে নহে। (মুক্তির দিশারী মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আ. জ. ম. তকীয়ুল্লাহ, পৃ: ৯১)
এই একই ভাষণে তিনি এও জানিয়ে দিলেন যে জোর করে আলাদা হওয়ার দরকার নেই ভাষা, অঞ্চল ও জনগোষ্ঠীর। স্বভাব অনুসারে ভাষা ও সাহিত্য আপনাআপনিই বদলে যাবে। তিনি যুক্তি দেখিয়ে তাদের পাগলামির অসাড়তাই কেবল দেখালেন না, দেখালেন ভাষার স্বভাব সম্পর্কে তার তীক্ষ্ণ, নির্ভুল আর অসম্প্রদায়িক পর্যবেক্ষণ:
একথাও নিশ্চিত যে নদী যেমন যে খাত দিয়ে প্রবাহিত হয়, তাহার মাটির রং এবং স্বাদ কিছু না কিছু পায়, সেইরূপ পূর্ব–বঙ্গ ও পশ্চিম–বঙ্গের সাহিত্যের মধ্যে কিছু প্রকারভেদ থাকিবে। ইহার কারণ পশ্চিম–বঙ্গ হিন্দু প্রধান আর পূর্ব–বঙ্গ মুসলমান প্রধান, পশ্চিম–বঙ্গ ধর্মনিরপেক্ষ ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্গত আর পূর্ব–বঙ্গ ইসলামিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্গত। এই Local Colouring কিন্তু সাহিত্যের প্রাণধর্ম যে মানবীয়তা তাহার বিরোধী নয় বরং তাহারই বিশেষ প্রকাশভঙ্গি। (মুক্তির দিশারী মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, পৃ: ৮৫)
ড. শহীদুল্লাহর এই সতর্কবাণী সত্ত্বেও মুসলমান লেখকদের একটি অংশ কৃত্রিম উপায়ে আরবি ফারসি উর্দু শব্দ ব্যবহারের ধারা অব্যাহত রেখেছিলেন স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত।
বুদ্ধিবৃত্তির অপবিন্যাস ও ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ছিল তথাকথিত মুসলমানদের সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী এক জবাব। যারা মুসলমান-পরিচয়-নির্ভর রাষ্ট্র, ভাষা ও সংস্কৃতি চেয়েছিল, তাদের সমস্ত আকাঙক্ষাকে চুরমার করে দিয়ে জন্ম নিয়েছিল অসাম্প্রদায়িক এক রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষ বা অসাম্প্রদায়িক ধারণার ভিত্তিতে বাঙালিদের জন্য একটি স্বাধীন ভূ–খণ্ডের অভ্যুদয়ের কারণে দেশ, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রশ্নটির নিষ্পত্তি হয়েছিল বটে। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম ভাষা, সংস্কৃতি ও দেশ সম্পর্কে বাঙালি মুসলমানদের আত্মবিদ্বেষের যে বিষবৃক্ষটি মধ্যযুগ থেকে বেড়ে উঠছিল, তা একাত্তরে গোড়া থেকে কেটে ফেলা হয়েছে। কিন্তু মাত্র চার বছরের মাথায়, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে ওই পচে যাওয়া গুঁড়ি থেকে নতুন করে জন্ম নিয়েছে একই বৃক্ষের নাতিপুতি, ঠিক যেমনভাবে ফিনিক্স পাখি মরণোত্তর ছাই থেকে আবারও জন্মায়। কিন্তু এবার ভিন্ন চেহারায়, ভিন্নভাবে ঘটনার ব্যাখ্যার সূত্রে, ভিন্ন রকম প্রস্তাবণায়। তাদের অন্তরে বিশেষ শ্রেণির সেই মুসলমানেরই অভিন্ন রুহু স্পন্দমান।
ইতিহাসের ধারাবাহিক যে বয়ান তথ্য–প্রমাণসহ হাজির করা হলো, তা বেশিরভাগ পাঠকেরই জানা। কিন্তু এই জানা কথাগুলোই এখানে তলব করতে হলো ওই বিশেষ শ্রেণির গাদ্দারির সাম্প্রতিক রূপটি দেখাবার জন্য। সাম্প্রতিক রূপটা ভালোভাবে বোঝার জন্যই ইতিহাসের নথিগুলো সামনে নিয়ে আসা যাতে করে সঙ্গে সঙ্গে আমরা দানবের চেহারার পূর্ণাঙ্গ রূপটা স্পষ্টভাবে দেখতে পারি।
স্বাধীনতার ঘোষক কে– এ নিয়ে জল ঘোলা করা হয়েছে বহুদিন থেকে। এখন ভাষা, জাতীয়তা, অর্থাৎ আত্মপরিচয়ের মতো বিমূর্ত বিষয়গুলো নিয়ে অভিনব সব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ যদি লক্ষ্য করা যায়, তাহলে পচে যাওয়া সেই বিষবৃক্ষে নতুন কিশলয় দেখতে পাবো আমরা। দেশ যদি মূর্ত কোনো ভূখণ্ড না হতো, তাহলে এটাকেও তারা মায়াবী জাদুবলে মধ্যপ্রাচ্যের কোথাও না হলেও, অন্তত পাকিস্তানের পাশেই বসিয়ে দিতো। তবে আদর্শের দিক থেকে তারা যে সে চেষ্টা স্বাধীনতার পরেও করেনি, তা তো নয়। অ্যাকটিভিস্ট লেখক এবং সাংবাদিক ফারুক ওয়াসিফ আমাকে নসিহত করে যা লিখেছিলেন তা আসলে ওই মুসলমানিত্বেরই প্রতিনিধিত্বমূলক বয়ান। কী বলেছেন তিনি?
"বাঙালি বলে যখন কিছু ছিল না, তখন এই বাংলার মুসলমান শাসকেরা বাঙালি নাম ধারণ করেছে বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করেছে সুলতানি আমলে। বাঙালি সংস্কৃতি বলে এখন গর্ব করা যে যায় তার তিনটা প্রধান ঘটনা তারা ঘটিয়েছে, দুটি রক্ত দিয়ে আর একটি প্রেম দিয়ে। বায়ান্ন, একাত্তর ও পয়লা বৈশাখ। ভাষাভিত্তিক পরিচয়ের রাজনৈতিকতা তাদের এক বিশ্বজনীন অবদান। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান ভাগেও তারা। পয়লা বৈশাখের উদযাপন তো মধ্যবিত্তের তৈরি করা নতুন ট্র্যাডিশন, বলা যায় একমাত্র সার্বজনীন বাঙালি উৎসব। বাঙালি মুসলমানদের নিয়েই কিন্তু এসব ঘটেছে। এমনকি ইসলামিস্টদের ওয়াজে যতটা বাংলার ব্যবহার করে, ইংরেজি শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরাও ততটা করে না, তাদের মধ্যে ভর করে ইংরেজি। আজ বাংলা ভাষার ওপর যে হুমকি তা আরবির নয়, উর্দুর নয় হিন্দি ও ইংরেজির।"
ছোট্ট এই উদ্ধৃতির মধ্যে অনেক ইশারা লুকিয়ে আছে যেগুলো বিলুপ্তপ্রায় ধারণারই সাম্প্রতিক সন্তান। লক্ষ্য করুন, তিনি বলছেন 'ইংরেজি শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের' চেয়ে মোল্লা মওলানাদের ওয়াজে 'বাংলার ব্যবহার' বেশি। আর বাংলাভাষার শত্রু এখন কোন ভাষা? আরবি নয়, উর্দু নয়। তাহলে? 'হিন্দি ও ইংরেজি'। এসব উক্তির বাস্তবতা যতটা খুঁজে পাওয়া যাবে, তার চেয়ে বেশি পাওয়া যাবে প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক সমীকরণের জটিল হিসেব যা এই উক্তির মাধ্যমে আইসবার্গের চূড়াটুকুকেই দৃশ্যমান করে রেখেছে। প্রথমেই দেখা যাক তাদের ভঙ্গির মধ্যে মৌলিক কী পরিবর্তন ঘটেছে। যেহেতু দেশ স্বাধীন হয়েছে, বাঙালি হিসেবে একটি স্বাধীন সত্তার আবির্ভার ঘটেছে, এইসব অর্জনের বিরুদ্ধে খলনায়কের ভূমিকায় গিয়ে, অর্থাৎ আগের পদ্ধতিতে এসবের সরাসরি বিরোধিতা করে সুবিধা হবে না। চাতুর্যপূর্ণ কৌশল হচ্ছে এই অর্জনটিকেই আত্মসাৎ করা। এবং সেটাই তারা করছে। বাঙালি হিসেবে, বাঙালি পরিচয়ে যা কিছু অর্জিত হয়েছে, এখন সেটাকে আত্মসাৎ করে তারা ওগুলোকে 'মুসলমানদের' অর্জন হিসেবে দাবী করতে চায়। এক সময় যেসব মোল্লা মওলানারা বাংলাভাষার বিরোধিতা করেছে, ফারুক ওয়াসিফের ভাষায়, এখন তারাই ভাষার রক্ষক, ওদের ওয়াজেই বাংলাভাষা টিকে আছে। যে–আরবি ফার্সি ও উর্দুপ্রীতি বাঙালি মুসলমানকে বাংলাভাষার বিরোধী অবস্থানে নিয়ে গেছে, এখন নাকি ওটা আর বিরোধী অবস্থানে নেই। ফারুক ওয়াসিফের হাতে পুরোনো বিষয়ের নতুন মুসাবিদা চৎকার রূপ ধারণ করেছে। আমাদের নিশ্চয়ই মনে পরবে যে বাংলাদেশের মুসলমান পরিচয়ধারী জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকরা বাঙালি–পরিচয়–দ্বারা–উদ্বুদ্ধ–বাংলাদেশ নামক দেশটির বিরোধিতা করেছিল, পরে দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ায় এই দেশকে মেনে নিতে বাধ্য হলেও, তারা তাদের আদর্শ থেকে সরে আসেনি। সরে যে আসেনি তার কিছু বিক্ষিপ্ত নমুনা আমরা দেখতে পাবো এই ধারার বুদ্ধিজীবীদের কিছু মন্তব্যে যা আসলে বাঙালি পরিচয় ও ভাষার বিরুদ্ধে তাদের চোরাগুপ্তা হামলারই সামিল। এই ধারার বুদ্ধিজীবীদের দুইজন (ফরহাদ মজহার ও সলিমুল্লাহ খান) বাংলাদেশের মনন ও বুদ্ধিজীবিতার আইকন হিসেবে সেইসব লেখকদেরকেই সামনে নিয়ে আসেন যারা মূলত গৌণ –এক মাত্র নজরুল ইসলাম ছাড়া। তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে একজনও আইকনিক লেখক খুঁজে পান না। বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রসঙ্গে তারা দুজনই রবীন্দ্রনাথকে বিবস্ত্র করতে ছাড়েন না।
তাদের একজন সলিমুল্লাহ খানের কথাবার্তায় মনে হয় আহমদ ছফা রবীন্দ্রনাথের সমতুল্য কিংবা তার পরেই বাংলা ভাষার সেরা লেখক (-সলিমুল্লাহ খান)। এছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষা ও শিক্ষকরা যে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও তার শিক্ষকদের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত, সেটা সলিমুল্লাহ খান নানাভাবে বহুবার বলেছেন। একটি উদাহরণ এখনই আমাদের মনে পরবে: "আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান মাদরাসা শিক্ষার মান থেকে নিচে নেমে গেছে।"
কোনই সন্দেহ নেই যে বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান অনেকটাই নেমে গেছে, কিন্তু সেই অবনতি মাদ্রাসা শিক্ষার সাথেই তুলনা করতে হয় তাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মান যতই নিচে নামুক না কেন, তারপরও এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনও পর্যন্ত আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের বিষয়গুলোই পাঠ্যক্রম অনর্ভুক্ত হয়ে আছে। অন্যদিকে মাদ্রাসাগুলো পুরোনো ও পশ্চাদপদ জ্ঞানবিজ্ঞানকেই শিক্ষাক্রমের অন্তর্ভুক্ত করে রেখেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পতনের পরেও এখনও পর্যন্ত বিজ্ঞানী, দিগন্ত-উন্মোচনকারী গবেষক, লেখক শিল্পী কোনো মাদ্রাসা থেকে নয়, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকেই বেরিয়ে আসছে। কিন্তু এই সত্য আড়াল করার জন্য সলিমুল্লাহ খানকে পরে বলতে হয় যে, "অক্সফোর্ড, কেমব্রিজসহ ইউরোপের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা, সিস্টেম, পরীক্ষা পদ্ধতি—সবকিছু এসেছে মাদ্রাসা শিক্ষা থেকে।" এই কথা বলার মানেই হচ্ছে ধর্মভিত্তিক পরিচয়ের একটি শিক্ষা–ব্যবস্থাকে সমাজে গ্রহণযোগ্যতা দেয়ার বাসনা। পশ্চিমের ওই উন্নত শিক্ষা–ব্যবস্থা যদি মাদ্রাসা থেকেই এসে থাকে, তাহলে আমাদের অন্যসব শিক্ষাব্যবস্থাকে মাদ্রাসায় পরিণত করা উচিৎ, তাই কি বলতে চাইছেন না তিনি? সলিমুল্লাহ খান নিজে তবে উচ্চতর শিক্ষার জন্য পশ্চিমী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না গিয়ে কেন মাদ্রাসায় গেলেন না?
প্রায় এক শ বছর আগে মাদ্রাসা শিক্ষার অপ্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে এক মুসলমানই বলেছিলেন যে,
আমার শিক্ষার আদর্শ অনুযায়ী মুসলিম শিক্ষা প্রণালীর সংশোধন করিতে হইলে প্রাথমিক শিক্ষায় আরবী, পার্শী, উর্দ্দু বিজাতীয় ভাষা একেবারে উঠাইয়া দেওয়া এবং নূতন পুরাতন সকল মাদ্রাসা বন্ধ করিয়া স্কুল কলেজের শিক্ষা প্রণালী অবলম্বন করা উচিত। হিন্দুগণের ত বিশেষ সংস্কৃত বিদ্যালয় নাই, তাই বলিয়া কি তাদের সংস্কৃত শিক্ষা হইতেছে না? আমাদের মাদ্রাসা বন্ধ হইলে চলিবে না কেন?… কেহ কেহ বলেন যে আমরা মুসলমান দরিদ্র, স্কুল কলেজের খরচ চলে না, মাদ্রাসা শিক্ষা অপেক্ষাকৃত সুলভ, অতএব অশিক্ষিত থাকার চেয়ে মাদ্রাসা শিক্ষাও ভালো। কিন্তু আমার মনে হয়, মাদ্রাসার কুশিক্ষার চেয়ে অশিক্ষাই ভাল, কারণ তাতে জাতীয় শক্তির অপচয় হয় না।" (শিক্ষা সমস্যা, মমতাজউদ্দীন আহমদ, শিখা, ১ম বর্ষ, চৈত্র, ১৩৩৩)
একশ বছর আগেই যে শিক্ষা–ব্যবস্থা ছিল পশ্চাদপদ ও অপ্রয়োজনীয়, সর্বোপরি 'জাতীয় শক্তির অপচয়' হিসেবে চিহ্নিত, সেই শিক্ষা–ব্যবস্থার পক্ষে এই বুদ্ধিজীবী কেবল ওকালতিই করছেন না, আধুনিক শিক্ষা–ব্যবস্থার চেয়ে অগ্রসর বলেও মনে করছেন।
বুদ্ধিজীবিতার এই ধারারই শাখা–প্রশাখা হচ্ছে সেই ভাবুকমণ্ডলী যারা মনে করেন বায়ান্ন, একাত্তর, ও পহেলা বৈশাখ হচ্ছে মুসলমানদের অর্জন। প্রশ্ন হলো এসব কি আমরা অর্জন করেছি মুসলমান পরিচয়ে? ওই পরিচয়ে মোটেই নয়, বরং বাঙালি পরিচয়ে। আজ যেহেতু এসব প্রতিষ্ঠিত অর্জনের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছুই করা যাবে না, অতএব এসব অর্জনকে আত্মসাৎ করে মুসলমানের অর্জন বলে অভিহিত করা হচ্ছে বুদ্ধিমানের কাজ। এটি হচ্ছে পরাজিত শক্তির নতুন কৌশল। দেশভাগের আগে থেকেই বাংলা ভাষার বিরোধিতা, উর্দু ভাষার পক্ষে ওকালতি, আরও পরে বাংলাভাষাকে আরবি ও উর্দুর কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার যে–ষড়যন্ত্রগুলো হয়েছিল, তাতে হিন্দু, বৌদ্ধ বা খৃষ্টান সম্প্রদায় নয়, মুসলমানরাই অংশগ্রহণ করেছিল। এই মুসলমানরাই নাকি "ভাষাভিত্তিক পরিচয়ের রাজনৈতিকতা"য় " বিশ্বজনীন অবদান" রেখেছে! তাহলে যে–ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে অধিবেশনের কার্যবিবরণী ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাতেও প্রণয়নের দাবী রাখলেন এবং ওই দিন তিনি দীর্ঘ বক্তৃতায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবী জানালেন, তিনি কি মুসলমান ছিলেন? কেবল ধীরেন্দ্রনাথই নন, তাকে সমর্থন জানিয়েছিলেন আরও কয়েকজন হিন্দু রাজনীতিবিদ শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত, প্রেম হরি বর্মন। এরা কি মুসলমান কিংবা হিন্দু পরিচয়ে অবদান রেখেছিলেন? এরা হিন্দু জনগোষ্ঠির হলেও মূলত বাঙালি পরিচয়টিকেই প্রধান জ্ঞান করেছিলেন।
ইতিহাস থেকে হিন্দুদের মুছে ফেলার রাজনীতি কেবল ভাষার ক্ষেত্রেই নয়, আরও অন্যসব জায়গায়ও করা হচ্ছে। এমনকি এই দাবীও করা হচ্ছে যে "মুক্তিযুদ্ধের প্রধান ভাগেও তারা।" এই তারা কারা? মুসলমান জনগোষ্ঠী। মুক্তিযুদ্ধ কি তাহলে 'মুসলমান' পরিচয়কে পুঁজি করে হয়েছিল? মুক্তিযুদ্ধ কি কেবল মুসলমানরাই করেছিল? আর মুক্তিযোদ্ধা ও হিন্দু জনগোষ্ঠীদের উপর নির্যাতন ও নিপীড়ন করেছিল আলবদর,আল শামস, জামায়াতে ইসলামীরা– তারা কি অমুসলিম? তাহলে এই বাংলাদেশকে কোন মুসলমানরা অর্জন করলো? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কি 'বাঙালি মুসলমানের' জন্য পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার ডাক দিয়েছিলেন? বঙ্গবন্ধুর কোন বক্তৃতায় বা লেখায় কি এরকম কোন উক্তি আছে?
৭১–এ হিন্দু বুদ্ধিজীবীসহ (জে সি দেব, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, ব্যবসায়ী আর পি সাহা, কুণ্ডেশ্বরী নতুনচন্দ্র সিংহ প্রমুখকে হত্যা করা হয়েছিল) হাজার হাজার হিন্দু ছেলেমেয়ে যে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং শহীদ হয়েছিলেন, তারা তো মুসলমান ছিলেন না। তাহলে মুক্তিযুদ্ধ কী করে কেবল মুসলমানদের অর্জন হয়?
পঞ্চাশ বছর পার হতে না হতেই, এরই মধ্যে ইতিহাস নিয়ে বড় রকমের জোচ্চুরি শুরু হয়ে গেছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কিছু মূল নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এর মূলে ছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালিত্বের পরিচয়কে পুঁজি করে। এবং বাঙালিত্বের এই পরিচয় এক অর্থে ভাষা আন্দোলনেরও আগে থেকে শুরু হয়েছিল, বিশেষ করে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মাধ্যমে। ১৯১৭ সালে তিনি এক বক্তৃতায় বলেছিলেন:
হিন্দু–মুসলমানে মিলিয়া বাঙালী জাতি গড়িয়া তুলিতে বহু অন্তরায় আছে। কিন্তু দূর ভবিষ্যতেই হউক না কেন, তাহা ত করিতেই হইবে। (ইহজাগতিকতা ও অন্যান্য, পৃ ২৭৬)
তিনি কিন্তু এখানে 'মুসলমান' কিংবা 'হিন্দু' জাতির কথা বলছেন না, বলছেন 'বাঙালী জাতি'র কথা। কিন্তু আমাদের আজকের এই বুদ্ধিজীবীদের কাছে, সম্ভবত, শহীদুল্লাহ ভ্রান্ত বলে অভিহিত হবেন, যেমনটা আহমদ ছফা ও বদরউদ্দীন উমর নিয়ে বাঙালি মুসলমান প্রসঙ্গে উত্থাপিত হতে দেখা যাচ্ছে। শহীদুল্লাহ ওই উক্তির ৩১ বছর পর জাতীয়তার প্রশ্নটি আরও পরিষ্কার করে যা বললেন তাতে মুসলমানিত্ব নয়, বাঙালিত্বের কথাই পুনরুক্তি করে বলেছিলেন- কিন্তু ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এবং অন্য যুক্তিতে:
আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব সত্য। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে মালা–তিলক–টিকিতে কিংবা টুপি–লুঙ্গি–দাড়িতে ঢাকবার জো–টি নেই। (ইহজাগতিকতা ও অন্যান্য, কারিগর প্রকাশনী, পৃ ২৭৭)
ধর্মনিষ্ঠ মুসলিম বংশোদ্ভূত পণ্ডিত হয়েও জাতিগত পরিচয়ে নিজেকে তিনি বাঙালি বলেই মনে করেছেন। শহীদুল্লাহ–কথিত এই বাঙালি পরিচয়কেই মূল শ্লোগান ধরে ৭১ পর্যন্ত বাঙালির আন্দোলন অব্যাহত ছিল। এই বাঙালি পরিচয়ের বিরুদ্ধে যারা ছিল, তারা ছিল সেই সংকীর্ণ মুসলমান সম্প্রদায় ক্ষমতাসীন পাকিস্তানি শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাঙালিত্বের পরিচয়কে যারা নস্যাত করতে চেয়েছে। মুসলীম লীগ আর জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিই হয়ে উঠেছিল তাদের মূল আশ্রয় ও পরিচয়। এই পরিচয় ছিল বাঙালি পরিচয়ের ঠিক বিপরীত মেরুতে। ৭১ সালে শহীদুল্লাহর উক্তিকেই খানিকটা পরিবর্তন করে বলা হলো:
বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ,
বাংলার খ্রীষ্টান, বাংলার মুসলমান,
আমরা সবাই বাঙালী।।
যে–ভূখণ্ড স্বাধীন হলো বাঙালি পরিচয়ে সেটাকে মুসলমানদের অর্জন বলাটা কি হঠকারিতা নয়? এমন কি যে–পহেলা বৈশাখকেও মুসলমানদের অর্জন বলে অভিহিত করতে চাচ্ছেন এই নব্য কিশলয়কুল, সেটিও বাঙালি পরিচয়েরই ফল। বাঙালি পরিচয়ের ফল বলেই মৌলবাদী মুসলমানরা এর বিরোধিতা করে আসছে বহুদিন থেকে। করেনি কি? কিন্তু আজকের মুসলমান বুদ্ধিজীবী শ্রেণি এই বৈশাখকেও আত্মসাৎ করে নিজেদের শূন্যতা ও কূপমণ্ডুকতাকে আড়াল করতে চান। যে লালন ফকির মুসলমান পরিচয়ে নয়, বরং মানব পরিচয়ে বিশ্বাসী, তাকেও তারা আত্মসাৎ করে দাঁড় করাতে চান 'হিন্দু' লেখক রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে: "রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালন ফকিরের পায়ের কাছে বসার যুগ্যিও নন।(সলিমুল্লাহ খান)"
একথা বলার মধ্যে লালনের প্রতি যতটা না ভক্তি শ্রদ্ধার প্রকাশ, তার চেয়ে বেশি তাদের সাম্প্রদায়িক মনেরই অভিব্যক্তি লক্ষ্য করা যাবে। লালন ফকির নিশ্চয়ই বড় প্রতিভা, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তার পায়ের কাছে বসার যোগ্যও নন—এই কথার মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে তুচ্ছ করার একটা বিকৃত মানসিকতা আছে। একথা যিনি বলেছেন, তার গুরুও একইভাবে রবীন্দ্রনাথকে কেবল তুচ্ছ নয়, খুনি হিসেবে প্রতিপন্ন করেছেন। তিনি 'রক্তের দাগ মুছে রবীন্দ্র পাঠ' করতে বসেন। যেন রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এক ডাকাত কিংবা খুনি।
এসবই হচ্ছে মধ্যযুগ থেকে প্রবহমান সম্প্রদায়িক চেতনার রকমফের, বাঙালিত্বের ধারণার বিরুদ্ধে এক কাউন্টার কালচার তৈরির কোশেশ। এই সংস্কৃতির অনুসারীরা মনে করেন ভাষা আন্দোলনে মৃত্যু বরণ করেছেন মুসলমানরা, মুক্তিযুদ্ধেও যেহেতু মুসলমানরা শহীদ হয়েছেন – অতএব, এই স্বাধীনতাও মুসলমানদের আত্মত্যাগের ফসল। কিন্তু যে–স্বাধীনতাযুদ্ধে বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও হিন্দুরা শহীদ হলো, তাহলে কেন এই স্বাধীনতা তাদেরও আত্মত্যাগের ফসল নয়? তারা ইতিহাস ও সংস্কৃতির যত ভিন্ন ও অভিনব বয়ানই তৈরি করুন না কেন, তার পেছনে যে মুসলিম তাহজীব ও তমুদ্দুনকে ফিরিয়ে এনে ইসলামি খিলাফত তৈরির স্বপ্ন দেখছেন এবং সেই পথকে প্রশস্ত করতে চাচ্ছেন, তা অনুমান করতে অসুবিধা হয় না।