Published : 16 Feb 2022, 09:43 PM
তিনি সম্প্রতি খুবই বিখ্যাত, আন্তর্জাতিক রাজনীতির অঙ্গনে। তাকে ইউক্রেনের ময়দানের নায়িকা বলা যেতে পারে। তিনি যে আকর্ষণীয়, কোনো সন্দেহ নেই। ডাকসাইটে সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন, এখন তার পদোন্নতি হয়েছে, তার একটি রাজনৈতিক নিয়োগ হয়েছে― আন্ডার সেক্রেটারি, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবেও তিনি ওই দপ্তরেই ছিলেন। তার নাম ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড― ভিক্টোরিয়া জেইন ন্যুল্যান্ড।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি তিনি আবারো খবরের শিরোনাম হলেন। খবরটা দিয়েছে তাস বার্তাসংস্থা, আরটি-তেও খবরটি আছে। খবরটি হলো―
"US believes in indivisible security, wants to discuss it with Russia." — US diplomat
যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি চাকরির ধারায় অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি কোনো বিভাগের সর্ব্বোচ্চ পদ। এর উপরের পদগুলো রাজনৈতিক পদ। যেমন আন্ডার সেক্রেটারি বা ডেপুটি সেক্রেটারি, সেক্রেটারি, ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং প্রেসিডেন্ট প্রভৃতি পদ। ভিক্টোরিয়া ন্যুল্যান্ড আগে ছিলেন পররাষ্ট্র বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বর্তমান মেয়াদে পররাষ্ট্র বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি নিযুক্ত হয়েছেন। আন্ডার সেক্রেটারি অব পলিটিকেল অ্যাফেয়ার্স।
ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড সম্প্রতি একটা কথা বলেছেন, খুবই দামী কথা― "… the people of Russia deserve security in the same way as the people of America do." এ কথা তিনি যখন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ছিলেন তখন বলতে ভুলে গিয়েছিলেন। বিশেষ করে ২০১৪ সালে। তিনি আরো বলেছেন, "The United States believes in indivisible security and wants to discuss with Russia." কথাটিই প্রচার করেছে তাস বার্তাসংস্থা। ইউক্রেনের ময়দানে তিনি কী করেছিলেন সে কথা পরে বলছি।
ন্যুল্যান্ড বলেছেন, "আমরা নিরাপত্তার ধারণার অবিভাজ্যতায় বিশ্বাসী। আমাদের রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকালীন সব দলিলে একথা লেখা আছে, আমরা অনেক আগেই (প্রতিষ্ঠাকালে) এসব বিষয়ে একমত হয়েছি।"
"when asked to comment on how the United States understands the obligation not to enhance its security for the benefit of other states, and whether Washington is still guided by the relevant provisions of the 1999 OSCE Charter for European Security and the Astana Declaration, adopted during the 2010 OSCE summit."
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তাকে অর্থাৎ মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগকে সম্প্রতি এসব প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, "আমাদের উদ্বেগের বিষয় এই যে, প্রকৃতপক্ষে রাশিয়া নিরাপত্তার অবিভাজ্যতাকে হুমকিগ্রস্ত করছে। রাশিয়া জর্জিয়ায় আগ্রাসন চালিয়েছে; মলদোভায় ওই দেশের সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সৈন্য মোতায়েন করে রেখেছে; তারা ক্রিমিয়াকে দখল করে নিয়েছে এবং দনবাস এলাকায় আগ্রাসন চালিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ২০১৪ সালের ক্রিমিয়ার (রাশিয়ার সঙ্গে) পুনর্মিলনকে স্বীকার করে না।"
তিনি অবশ্য তার রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেছেন। বলেছেন, "অতএব আমাদের উভয়ের ব্যাপারে (রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের আচরণের বিষয়ে) কথা বলতে হবে। নিরাপত্তার অবিভাজ্যতার বিষয়ে আমরা কী বুঝি সে বিষয়ে কথা বলতে হবে। কী করে আমরা কমন আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ে পৌঁছতে পারি, যাতে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।"
তিনি মনে করেন, "রাশিয়ার লোকজন সমৃদ্ধি চায়, তারা ভাল স্বাস্থ্যসেবা চায় ঠিক যেমন আমেরিকার জনগণ চায় এবং এসব বিষয়ে আমাদের ফোকাস করা উচিত, আমাদের এসব বিষয়ে ফোকাস করা উচিত এ কারণে যে, কেউই ঠিক এ মুহূর্তে বড় কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে চায় না বিশেষ করে অভিভাবকরা; বিশেষ করে রুশ পরিবারগুলো যাদের বাচ্চাকাচ্চা আছে, যারা হিম-শীতল ঠাণ্ডায় বসে আছে সেসব অভিভাবকরা, তারা চায় না শত শত হাজার হাজার সেনা ইউক্রেনের সীমান্তে মোতায়েন হোক এবং আরো ৩০ হাজার সেনা বেলারুশে যাক। এসবের কোনো প্রয়োজন নেই।"
ন্যুল্যান্ড বলেছেন, "আমাদের বরং কোভিড মোকাবেলায় কাজ করা দরকার। আমাদের বরং পুনর্গঠনের দিকে মনোযোগী হওয়া দরকার। আমাদের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য কাজ করা দরকার, নিরাপত্তার অবিভাজ্যতার লক্ষ্যে কাজ করা দরকার যেমনটা রুশরা চায়।"
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক এ বক্তব্যের মাস দুয়েক আগে তিনি রাশিয়া সরকারের বিশেষ আমন্ত্রণে মস্কো গিয়েছিলেন। রাশিয়ার সরকার তখন, নানান নিউজ আউটলেটের ভাষ্য অনুযায়ী, তাকে ২০১৪ সালের ইউক্রো-ময়দানে তার ভূমিকার জন্য বেশ কড়া কথা শুনিয়েছিল; প্রকারান্তরে 'রাম ধোলাই' দিয়েছিল। তার সাম্প্রতিক কথাবার্তা সেই 'রাম ধোলাই'- এরই প্রতিক্রিয়া। ইউক্রেনের (ইউক্রেনি, রুশ ও বেলারুশিয়) ভাষায় যাকে বলা হয় 'উক্রাইনিয়া'। তিনি একজন কূটনীতিক হলেও ময়দানে তিনি কূটনৈতিক শিষ্টাচার মানেননি। কূটনীতিকদের সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের বা রাষ্ট্রসমূহের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর এক্তিয়ার নেই, সাধারণত তারা তা করেনও না। কিন্তু ন্যুল্যান্ড সে রীতি মানেননি। ইউক্রেনের ময়দানে তার ভূমিকা ছিল একজন অ্যাক্টিভিস্টের মতো। তিনি ময়দানের বিক্ষোভকারীদের মধ্যে পাউরুটি বিলিয়েছেন, তাদের উৎসাহ দিয়েছেন, তাদের পক্ষ হয়ে প্রচার-প্রচারণায় সামিল হয়েছেন। ইত্যাদি ইত্যাদি। এটা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের ব্যত্যয় বটে। এ নিয়ে কানো প্রশ্ন করা চলে না। সে কারণেই তিনি 'ময়দানের নায়িকা'। তিনি সাহসিকা।
যাই হোক, এ যাত্রায় তিনি রাশিয়ার 'সিকিউরিটি নিডস্' মেনে নিয়েছেন। তবে ন্যুল্যান্ড একটি অভিযোগও তুলেছেন (যার অথেন্টিসিটি যাচাই করা কঠিন); বলেছেন, রাশিয়ার নিরাপত্তা প্রস্তাবের নিরিখে যুক্তরাষ্ট্র যেসব কনফিডেন্সিয়াল নথি রাশিয়ার কাছে হস্তান্তর করেছে সেখান থেকে একটা লিক ঘটেছে এবং রাশিয়াই এর জন্য দায়ী।
"In fact, our original proposal, which the Russian side has now, put out in public, it was in El Pais yesterday, speaks very specifically to the indivisibility of security. So in our second letter to Mr. Lavrov we pointed that out and especially said, let's get to the negotiating table. Let's solve this through de-escalation. Let's solve this through diplomacy. Let's strengthen the system of security between us. Nobody needs, especially Russia, body bags coming home right now. We don't need that. We need to be focusing on the real issues of the day."
ন্যুল্যান্ড বলেন, "আমরা বেশ কনফিডেন্সের সঙ্গে বলছি, লিকটি রাশিয়ার মাধ্যমেই হয়েছে কারণ প্রকাশিত নথিতে আমরা দেখেছি, আমরা যেমন যেখানে দাগ দিয়ে রেখেছিলাম লিকে প্রকাশিত নথিতে তেমনই দাগ রয়েছে। আমরা আমাদের মিত্রদের যে নথি দিয়েছি তাতে অন্য ধরনের দাগ ছিল।"
একই দিনের অন্য এক খবরে বলা হয়েছে, ইউক্রেনের কমান্ডার-ইন-চিফ ক্রিমিয়ায় এবং দনবাসে সামরিক অভিযান, ইউক্রেনের পক্ষ থেকে, নাকচ করেছেন। ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার ভালেরি জালুঝ্নি নিশ্চয়তা দিয়ে বলেছেন, "Kiev was not planning a military operation in Crimea or Donbass."
তবে ইউক্রেনের জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা কাউন্সিলের প্রধান আলেক্সি দানিলভ বলেছেন, "The issue of Crimea was still on table."
তবে তিনিও এ মুহূর্তে ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিয়েছেন।
ক্রিমিয়ার অফিসিয়াল নাম 'ক্রিমিয়া অ্যান্ড সেভাস্তোপোল'; সেভাস্তোপোল ক্রিমিয়া উপদ্বীপের সব চেয়ে বড় শহর, শহরটির বিশেষ অটোনমি স্ট্যাটাস রয়েছে। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া এন্ড সেভাস্তোপোল স্বাধীনতা ঘোষণা করে। গণভোটে ৯৬.৭ শতাংশ ক্রিমিয়াবাসী এবং ৯৫ দশমিক ৬ শতাংশ সেভাস্তোপোলবাসী ইউক্রেন থেকে আলাদা হয়ে রুশ ফেডারেশনের সঙ্গে যোগ দেওয়ার পক্ষে রায় দেয়। গণভোটের রায় অনুযায়ী পুতিনও দেরি না করে ক্রিমিয়াকে রুশ ফেডারেশনে অর্ন্তভুক্তির পদক্ষেপ নেন। প্রসঙ্গত, ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ক্রিমিয়া রাশিয়ার অংশ ছিল। ওই বছর ক্রুশ্চেভ (হ্রুশিয়েভ) প্রশাসনিক সুবিধার্থে ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের সঙ্গে যুক্ত করেন। এ ব্যাপারে বরাবরই রাশিয়ার আপত্তি ছিল।
এসব খবরের আগের দিনের এক খবরে অর্থাৎ ৩ ফেব্রুয়ারির এক খবরে বলা হয়েছে, সিরিয়ার ইদলিবে আইএস লিডারের নিকেশকরণে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র একযোগে কাজ করেছে। আসলে যুক্তরাষ্ট্রই মূল ভূমিকা পালন করেছে, তবে রাশিয়াকে অবহিত করে। এই যে সহযোগিতার ঘটনা ঘটলো তার কারণ রাশিয়ার যুক্তরাষ্ট্রকে দেওয়া 'সিকিউরিটি ডিমান্ড'। সাম্প্রতিক চিঠি চালাচালির ফল। যদিও যুক্তরাষ্ট্র এখনো রাশিয়াকে চিঠি দেওয়ার বিষয়ে গোপনীয়তা রক্ষা করছে। ভাবটা অনেকটা এরকম যে, "আমি যে তোমাকে পত্র দিয়েছি সেকথা যেন কাউকে বলো না।"
ইদলিবে নিহত আইএস লিডারের নাম আবু ইব্রাহিম আল-হাশিমি আল-কুরায়শি (সত্যি হত্যা করা হয়েছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে, আসলেই ওই লোক কখনো ছিল কিনা তা নিয়েও সন্দেহ আছে)। আল-নুস্রা বা ফাতাহ্ আল-শামের এক নেতাকেও নিকেশ করা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অভিযান চালালে বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু ঘটবে না তা কি হয়! ওইদিন বেশ কয়েকজন বেসামরিক লোক এবং শিশুর মৃত্যু হয়।
ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ডের কথা শেষ করছি উত্তম কুমারের একটি ছবির প্রসঙ্গ টেনে। ছবিটি দেখে মনে পড়ল নুল্যান্ডের উদ্দেশে পুতিন, ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ্ (এবং ভবিষ্যতে কোনো এক সময় পেত্রো পোরোশেঙ্কো) এ গানটি গাইতে পারন!
'না না না না ওমন করে দাগা দিয়ে সরে থেকো না
না না না না ওমন করে দাগা দিয়ে সরে থেকো না
আমায় নিয়ে খেলা করো
তুমি ওগো নিঠুর বড়ো
আমায় নিয়ে খেলা করো
তুমি ওগো নিঠুর বড়ো
দোহাই তোমার আমায় তুমি
বিষ চোখে চেয়ে দেখো না
দোহাই তোমার আমায় তুমি
বিষ চোখে চেয়ে দেখো না
না না না না ওমন করে দাগা দিয়ে সরে থেকো না
না না না না ওমন করে দাগা দিয়ে সরে থেকো না
যা খুশি বলুক লোকে দেখুক আমায় মন্দ চোখে
যা খুশি বলুক লোকে দেখুক আমায় মন্দ চোখে
থাকলে তুমি আমার কাছে
লোকলাজে ভয় কি আছে
ফুলটাকে কাঁটা দিয়ে ভুল করে ভরে রেখো না
ফুলটাকে কাঁটা দিয়ে ভুল করে ভরে রেখো না
না না না না ওমন করে দাগা দিয়ে সরে থেকো না
না না না না ওমন করে দাগা দিয়ে সরে থেকো না
মন নিয়ে কি যে করি একি জ্বালায় জ্বলে মরি' …..
[অমানুষ (উত্তম কুমার, শর্মিলা ঠাকুর, উৎপল দত্ত; ১৯৭৫)]