মূল্যবৃদ্ধি ও জনবান্ধব সিদ্ধান্ত

মর্তুজা হাসান সৈকতমর্তুজা হাসান সৈকত
Published : 17 Feb 2012, 07:32 AM
Updated : 8 Nov 2021, 02:58 PM

কোনো প্রকার পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই গত ৪ নভেম্বর আকস্মিকভাবে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটার প্রতি ১৫ টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। দেশের ইতিহাসে এক লাফে এত বেশি জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাসে যাত্রীভাড়া ২৭% এবং লঞ্চে ৩৫% বৃদ্ধি করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে এতে পণ্য পরিবহণের ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। ফলে ভোগ্যপণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।

গত কয়েক মাসে দেশে হুহু করে বেড়েছে দ্রব্যমূল্য। নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের আমিষের জোগানের বড় উৎস আসে ডিম আর ব্রয়লার মুরগি থেকে। অবস্থা এখন এমন হয়েছে যে, এগুলোও এখন নাগালের বাইরে। এরইমধ্যে কোনো রকম প্রক্রিয়া-পদ্ধতি না মেনে হুট করে জ্বালানি তেলের এই মূল্যবৃদ্ধির কারণে করোনাকালে কষ্টের মধ্যে থাকা মানুষের দৈনন্দিন ব্যয়ের আকার যে আরও স্ফীত হবে– এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এই প্রেক্ষাপটে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর এই সিদ্ধান্তকে সুচিন্তিত বলে মনে হয়নি।

জ্বালানি তেলের দামের বিষয়টি সরাসরি জনস্বার্থ তথা ব্যবসা-বাণিজ্য ও সামগ্রিক অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। ফলে, জ্বালানির এই মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে। কারণ, বিগত কয়েক বছরে চাকুরীজীবীদের বেতন এক টাকাও বাড়েনি। শ্রমজীবীদেরও বাড়েনি আয়। তার ওপর মহামারীকালে বেড়েছে দারিদ্রের হার। সম্প্রতি ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) এর একটি যৌথ জরিপে জানানো হয়েছে, দেশে করোনাকালে ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। এর মধ্যে এ বছরের এপ্রিল মাস থেকে দেওয়া করোনা বিধিনিষেধের কারণে গত ছয় মাসে ৭৯ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে। এমন একটি জটিল পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি জনজীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনমানের ধারাকে অবনমন করবে।

তদুপরি, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব বহুমাত্রিক। এতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় যেমন বাড়ে তেমনি সামগ্রিকভাবে মূল্যস্ফীতির ওপরও এর প্রভাব পড়ে। এমনকি ব্যয় বাড়ে কৃষিপণ্য উৎপাদনেও। কারণ, ডিজেলের ব্যবহার সেখানে অপরিহার্য। ফলে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির এই প্রভাব কৃষিকাজেও পড়বে। বোরো মৌসুম চলছে। কিছুদিন পরেই সেচের প্রয়োজন হবে জমিতে। দেশে ধান উৎপাদনে মোট সেচের ৯৩ ভাগ সেচই প্রয়োজন বোরো মৌসুমে। এই সেচের জন্য ব্যবহৃত সেচযন্ত্রের অধিকাংশ ডিজেল চালিত। ফলে এবার বোরো চাষের উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাবে অনেক। ফলে বাড়বে চালের দাম।

অন্যদিকে, দেশের কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টের অনেকগুলোই জ্বালানি হিসেবে ডিজেল ব্যবহার করে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয়ও বৃদ্ধি পাবে। এর পাশাপাশি, কেরোসিনের অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি খেটে খাওয়া গরীব মানুষের জীবনমানের ব্যয় বৃদ্ধি করবে। কারণ, দেশের প্রান্তিক জনপদের গরীব মানুষেরাই মূলত কেরোসিন ব্যবহার করে থাকে। এই মূল্যবৃদ্ধি তাদের চলমান অভাব ও দুঃখকষ্টকে আরও বাড়িয়ে দিবে।

তবে, এতে উদ্যোক্তা বা পরিবহন মালিকদের তেমন কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। কারণ, তারা তো ঠিকই দাম বাড়িয়ে নিজেদের খরচ সমন্বয় করে নিচ্ছেন। বাস এবং লঞ্চে রেকর্ড পরিমাণ ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে শেষপর্যন্ত জ্বালানির এই মূল্যবৃদ্ধির খেসারত সাধারণ মানুষ কিংবা ক্রেতা-ভোক্তাকেই দিতে হবে। তাদেরকে আনুপাতিক হারের চেয়েও বেশি দামে পণ্য কিনতে হবে এবং সেবা নিতে হবে। এতে তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় অত্যধিক বেড়ে যাবে। ফলে নাভিশ্বাস উঠবে তাদের। তাছাড়া উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে দেশীয় পণ্য প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার একটা সম্ভাবনাও সৃষ্টি হবে।

আন্তর্জাতিক বাজারে টানা বেশ কয়েক বছর জ্বালানি তেলের দাম কম ছিল। একপর্যায়ে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৪০ ডলারেও নেমেছিল। সে সময় প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ অনেক দেশেই জ্বালানি তেলের দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমানো হলেও আগের লোকসান পুষিয়ে নেওয়ার কথা বলে বাংলাদেশে তেলের দাম কমানো হয়নি। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার সুফল থেকে বঞ্চিত হয়েছে এ দেশের ভোক্তারা। দুয়েকবার যা-ও কমানো হয়েছিল তাতে দাম বৃদ্ধির কারণে পরিবহণ ব্যয়, পণ্যের উৎপাদন খরচসহ যেসব খাতে ব্যয় বেড়ে গিয়েছিল পরবর্তীতে তা আর কমানো যায়নি। তাই, জনজীবনের এই বিপর্যস্ত অবস্থায় সরকার ভর্তুকিটা অব্যাহত রাখতে পারত। কারণ, যখন সরকারের সক্ষমতা অনেক কম ছিল তখনও বড় অংকের ভর্তুকি দিয়ে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ভূমিকা রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি।

ভারতে জ্বালানির দাম বেশি বলে পাচার হয়ে যাবে, এটা শক্তিশালী যুক্তি নয়। পণ্য পাচার ঠেকানোর দায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর। তাদের ব্যর্থতার জন্য দেশের পণ্যের দাম বাড়িয়ে মানুষকে দুর্ভোগে ফেলা ঠিক নয়। তাছাড়া, কিছুদিন গেলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের এই দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকবে না। তাই দেশে দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকার তেল আমদানির ওপর কর কমিয়ে দেওয়া বা প্রত্যাহারের মতো পদক্ষেপ নিতে পারত। সম্প্রতি যেটা ভারত করেছে। এতে যে রাজস্ব ক্ষতি হতো, সেটাকে অর্থনীতির জন্য প্রণোদনা হিসেবে একটি প্যাকেজের আওতায় নিয়ে আসা যেত।

করোনাকালে আমরা হার মানিনি। আমাদের অর্থনীতি ঈর্ষণীয় সমৃদ্ধ হয়েছে। জিডিপি চারশ বিলিয়নের ল্যান্ডমার্ক অতিক্রম করেছে। আইএমএফের আউটলুকেও সেটা বলা হয়েছে। অথচ আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের অর্থনীতি প্রচণ্ডভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, সেখানকার অর্থনীতি বিপর্যস্ত হওয়ার পেছনে করোনা পরিস্থিতি যতটা না দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী করা হয়েছে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিকে। ফলে, আন্তর্জাতিক বাজারের প্রেক্ষাপটে হোক কিংবা অন্য যেকোনো কারণেই হোক, জ্বালানি তেলের দাম একধাপে লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়ানো আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে মোটেও যুক্তিসংগত নয়। তাই, সরকারের উচিত যত দ্রুত সম্ভব জনবান্ধব সিদ্ধান্ত নেওয়া।