Published : 21 Apr 2021, 01:13 PM
দুই পক্ষই কেতাদুরস্ত। শিক্ষিত। দুই পক্ষের দিকে চেয়ে থাকে সাধারণ মানুষ, সমাজ, দেশ- দুটো ভালো কথা শোনার আশায়। বিপদে-আপদে একটু সাহায্য-সেবা পাওয়ার ভরসায়। এমন দুই পক্ষের খিস্তিখেউড় এখন টক অব দ্য টাউন!
'খিস্তিখেউড়' শব্দটি খাঁটি বাঙালি (দেশি) শব্দ। এর ব্যবহারে বাঙালি জাতি অতি প্রাচীন আমল থেকেই ভীষণভাবে দক্ষ। তবে হরহামেশা আমরা দেখতে পাই, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোকেরা যেমন- কুলি, মেথর, মুচি, রিকসাওয়ালা, কিংবা অন্যান্য শ্রমজীবীর অথবা বস্তিতে বসবাস করে, তাদের খিস্তিখেউড়ের প্রবণতা বেশি। যারা ভদ্রলোক নামধারী, তারা ওই খিস্তিখেউড় প্রাসঙ্গিক বলে ধরে নেই বা মেনে নেই। কিংবা মনে মনে বলি, "ওদের মুখেই তো এগুলো মানায়"।
খিস্তিখেউড়ের ব্যবহার বাঙালি বহু লেখকের অনেক পুস্তকেও উল্লেখিত হয়েছে। সেখানেও বোঝা যায় এর ব্যবহারকারীরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, অশিক্ষিত। সুতরাং এদের মুখে খিস্তিখেউড় উচ্চারিত হওয়া খুব স্বাভাবিক ব্যাপার এবং এ কারণে অনেকে তাদের খিস্তিখেউড় মেনেও নেয়, বিরক্তও কম হয়।
কিন্তু এ দেশে খিস্তিখেউড় খুবই সহজলভ্য বিষয়। এতটাই যে এটা স্বয়ং মহান সংসদের অধিবেশনে হয়ে থাকে সাংসদদের দ্বারা। কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন "খিস্তিখেউড়ে কে এগিয়ে, কে পিছিয়ে" শিরোনামে। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত ওই প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন-
"প্রধানমন্ত্রী ও দশম জাতীয় সংসদের নেতা শেখ হাসিনা সম্প্রতি হবিগঞ্জে এক সমাবেশে বলেছেন, 'পরাজয়ের ভয়ে খালেদা জিয়া নির্বাচনে আসেননি। তবে এক দিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। এখন আর সংসদে খিস্তিখেউড় হয় না। আজেবাজে বক্তব্য শুনতে হয় না।" (প্রথম আলো, ৩০ নভেম্বর, ২০১৪)
তিনি আরও উল্লেখ করেছিলেন- "প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দুটি প্রশ্ন সামনে আসে। প্রথমত, কোনো দলের কোনো সাংসদ বা কতিপয় সাংসদ খিস্তিখেউড় করলেই তাদের সংসদ বা নির্বাচনের বাইরে রাখার বিধান গণতন্ত্রে আছে কি না? দ্বিতীয়ত, সংসদে খিস্তিখেউড় কি শুধু বিএনপির সাংসদেরাই করতেন? আওয়ামী লীগের সাংসদেরা কি সবাই সুভাষণ ও সুবচনের জন্য বিখ্যাত ছিলেন বা আছেন?"
তিনি লেখায় আরো উল্লেখ করেন যে, "সংসদের পুরোনো রেকর্ড ঘাঁটলে দেখা যাবে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-উভয় দলের পেছনের সারির কয়েকজন নারী সাংসদ সংসদে কেবল অসংসদীয় ভাষাই ব্যবহার করেননি, তাঁরা জাতীয় নেতাদের অশালীন ও অশ্রাব্য ভাষায় গালমন্দ পর্যন্ত করেছেন। এমনকি নেতা–নেত্রীদের জন্ম নিয়েও কটাক্ষ করেছেন। তাঁদের ভাষা ও ভঙ্গি এতটাই অমার্জিত ছিল যে, তৎকালীন স্পিকার সংসদকে মাছের বাজার না বানানোর জন্য সতর্ক পর্যন্ত করে দিয়েছিলেন। জাতীয় সংসদ হবে যুক্তিতর্ক ও বুদ্ধিচর্চার কেন্দ্র। সেখানে পেশিশক্তি বা জিহ্বার ধার দেখানোর সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী, বিএনপি নির্বাচনে না আসায় সংসদ খিস্তিখেউড় থেকে রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু সংসদের বাইরের রাজনীতি ও গণতন্ত্র খিস্তিখেউড় থেকে রক্ষা পায়নি।"
অবশ্য জাতীয় সংসদের খিস্তিখেউড় নিয়ে জনগণের অতোটা মাথাব্যথা হয়নি বলে আমার ধারণা। কিন্তু কয়েকদিন আগে রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুই সেবামূলক পেশাজীবী- চিকিৎসক এবং পুলিশের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে যে খিস্তিখেউড় বিনিময় হয়েছে, তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ দেশের গণমাধ্যমেও হৈ-হৈ রৈ-রৈ পড়ে গেছে। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে পুলিশের গুলিতে শ্রমিকের রক্ত-প্রাণ ঝরেছে, এমন বিষয়ও আড়াল হয়ে গেছে!
এলিফ্যান্ট রোডের ওই ঘটনার একেকজন একেকভাবে ব্যাখ্যা-বর্ণনা দিচ্ছেন। কারো ব্যাখ্যা এক পক্ষে যাচ্ছে, আবার কারো ব্যাখ্যা যাচ্ছে অন্যপক্ষে। ডাক্তার-পুলিশ দুই পক্ষই বিবৃতি দিয়েছে পালাপাল্টি ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করে! আমরা যারা সাধারণ মানুষ, তারা এ ঘটনা বা দুর্ঘটনার একটি ব্যাখ্যা বা সমালোচনা করতেই পারি। এখানে যেটা ঘটেছে তা হলো-যার যার ক্ষমতার দাপট। সবার ভেতর দাম্ভিকতা, অহংকার কাজ করেছে। যার কারণে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ প্রকাশ পেয়েছে পেশাদার (!) কর্তাব্যক্তিদের মাধ্যমে।
পেশাদারী আচরণ যাতে সহনশীল হয়, জনগণ বান্ধব হয়, দেশপ্রেম প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়, সেজন্য প্রত্যেক পেশাদার ব্যক্তিকে দেওয়া হয় বিভিন্ন বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ। কেননা, যে কোনও বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ সব সময় শুদ্ধাচার শেখায়! কিন্তু বঙ্গরাষ্ট্রের প্রেক্ষিতে এ বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ উল্টা যেন যথেষ্ট অহংকারী করে তোলে, দাম্ভিক বানিয়ে দেয় প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষকদেরকে!
ওই ঘটনায় বোঝা যায়, কী দৈন্যদশা আমাদের প্রশাসনের লোকদের ভাষার ব্যবহারে। অনেক কর্তাব্যক্তির আচরণও বিশ্রী রকমের খারাপ হয়। খিস্তিখেউড় তো আছেই, তারপর আবার যার যার ক্ষমতার দাপট। অবশ্য এ ঘটনা মিডিয়ায় না আসলে আমরা যেন জানতাম না যে, ওনাদের খিস্তিখেউড়ের দৌড়ের ধারণা! কেউ যেন কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়।
কেউ বলছেন, ডাক্তার নারীকে এতটা হয়রানি না করলেও চলত। যেহেতু তিনি অ্যাপ্রোন পরিহিত ছিলেন, ডাক্তারদের স্টিকার সংযুক্ত ছিল তার গাড়িতে। এরপরও কি বাড়াবাড়ির দরকার ছিল? কেউ বলছেন, পুলিশকেও ওভাবে গালাগাল করা ঠিক হয়নি। কিন্তু মূল কথা হচ্ছে, দুই পক্ষের খিস্তিখেউড়ে সরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয়হীনতার বিষয়টিও চিত্রায়িত হয়েছে। এ কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ে দেশে প্রশাসকদের মাঝে সমন্বয়হীনতা থাকে, তাহলে দেশে নাগরিক সেবা কিভাবে হবে? অবশ্য এ রাষ্ট্রের নাগরিক সেবার মান নিয়ে বহু প্রশ্ন জাগরিত হয়েছে ইতিমধ্যে।
বিনয় ও ভদ্রতাবোধ মানুষ সাধারণত পরিবার থেকেই শেখে। এটা এখন প্রমাণিত যে, এদেশের উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত পরিবারসমূহ সে জায়গাটিতে প্রচণ্ডভাবে ব্যর্থ হয়েছে। পাশাপাশি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তেমন কোনও বিনয় এবং ভদ্রতা শেখাতে সহায়ক নয়। এলিফ্যান্ট রোডের খিস্তিখেউড় বা বাড়াবাড়ি যেন প্রমাণ করে, পুলিশ, ডাক্তার, ম্যাজিস্ট্রেট সবাই ব্যস্ত ছিলেন নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিতে।
একে অপরকে ছোট করা কিংবা অন্যের কাজকে তুচ্ছ করা আমাদের চিরাচরিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু একটি কথা সত্যি, বড় হতে হয় স্বীয় প্রতিভায়, তেজে, সাহসে, ভালোবাসায়, দুর্বলতায় এবং অঙ্গীকারে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরে এ বঙ্গভূমি শুধুই জন্ম দিয়েছে হামবড়া ডাক্তার, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট, ব্যাংকার, আমলা-কামলা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী-বণিক, সাংবাদিক ইত্যাদি। অথচ মানুষের খুব বেশি প্রয়োজন।