বিএনপির সাতই মার্চ: ১২ বছর চোঙ্গায় থাকলেও লেজ বাঁকা

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 11 March 2021, 12:45 PM
Updated : 11 March 2021, 12:45 PM

ভেবেছিলাম রাজনীতি ঘুরে দাঁড়ানো শিখেছে। বিএনপি মাঝে মাঝে ঝটিকা সফরের মতো রাস্তায় দু-একবার আসলেও, বাস্তবে নাই। আগুন সন্ত্রাসের পর দলটির অবস্থা শোচনীয় হয়ে দাঁড়ায়। এমন এক পরিবেশ যাতে- 'খাতায় আছে গোয়ালে নাই' মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। তারা সবসময় বলেন, প্রশাসন আর বাহিনী ব্যবহার করে তাদের দমিয়ে রাখা হচ্ছে। কথা পুরোপুরি অসত্য বলা যাবে না।

কিন্তু এটাও মানতে হবে আজ দেশে উন্নয়নের যে ধারা তার সাথে তাল মেলাতে না পারলে সে রাজনীতি মানুষ নেবে না। এখন লম্ফঝম্প বা মিছিল মিটিংয়ের সময় নাই। এসব আর চলে না। চাই সুষ্ঠু স্বাভাবিক সহজ রাজনীতি। আমরা ভেবেছিলাম, বিএনপি বিষয়টা বুঝেছে। তাছাড়া এটাও তাদের অজানা নয় খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার ব্যাপারে দল আসলে কিছুই করতে পারেনি। বরং বাজারে জোর গুজব তিনি নাকি সমঝোতার আবরণে বাইরে আছেন। মাঝে মাঝে এমন খবরও পাই খালেদা জিয়া তার নেতাদের সাথে নাকি দেখা করতেও চান না। তিতিবিরক্ত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী যদি তা করেনও তা কি আসলেই অন্যায্য? যে দলের নেতারা শীর্ষ নেতাকে জেলে রেখে আয়েশে দিনযাপন করেন, মৌসুমী মাঠ গরম করেন- তাদের কথা শোনার দরকার কি তার?

গণমাধ্যমে সাতই মার্চ নিয়ে বিএনপি নেতাদের যেসব বক্তব্য এসেছে সেগুলো হলো-

আওয়ামী লীগের কোন পুঁজি নাই, একটাই পুঁজি সাতই মার্চের ভাষণ। যে ভাষণে পুরো দেশ স্বাধীনতার ঘোষণা আশা করেছিল, তা আসেনি বঙ্গবন্ধুর ভাষণে। বঙ্গবন্ধু ও জিয়াউর রহমানের যার যার অবস্থান নির্ধারণ করবে ইতিহাস… ইত্যাদি ইত্যাদি। 

কারো বানানো ইতিহাসে জিয়াকে ছোট আর বঙ্গবন্ধুকে বড় করা যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। যদিও মীর্জা আব্বাস একবারের জন্যও বঙ্গবন্ধু বলেন নি। তিনি মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান বলে সম্বোধন করেছেন । কিন্তু গণমাধ্যমে তা না লিখে বঙ্গবন্ধু লিখেছে।

এমন বাস্তবতায়  বিএনপির সাতই মার্চ পালন ছিল কৌতূহলের। আশা করেছিলাম, এবার তারা তাদের অতীতের ভুল শুধরে  নতুন কথা বলবেন। আর কে কী বলেছেন জানি না, তবে সামাজিক মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যাওয়া একটি ভিডিও তে মীর্জা আব্বাস যা বলেছেন শুনলে সবাই বুঝবেন বিএনপি বদলায়নি। মীর্জা আব্বাস একজন প্রবীণ নেতা। মন্ত্রিত্ব, মেয়রের পদ সবই ছিল তার দখলে। বিএনপির এই কঠিন সময়ে তার এই বক্তৃতা নি:সন্দেহে নিন্দাজনক। মীর্জা আব্বাস বলেছেন, সাতই মার্চের জনসভায় তিনি উপস্হিত ছিলেন। শুধু তাই নয় এলাকা থেকে লোকজন নিয়ে গিয়েছিলেন জনসভায় যোগ দিতে। তার ভাষ্যমতে,  মঞ্চে জায়গা না পেলেও ছিলেন মঞ্চের নিচে মাইকের গোড়ায়।

এ বক্তব্য থেকে এটা প্রমানিত মীর্জা আব্বাস আওয়ামী লীগের ডাকে জাতির জনকের সেই ভাষণ শুনতেই রেসকোর্সে গিয়েছিলেন। তাও মিছিল নিয়ে। তো জনাব আপনি কেন গেলেন সেদিন? কেন গেলেন না আপনার নেতা জিয়াউর রহমানের ডাকে? তিনি তখন কোথায় ছিলেন মীর্জা সাহেব? তার জন্য এতো টান, এতো প্যায়ার, কেন ছুটে গেলেন না চট্টগ্রামে? জনাব আব্বাস আপনি ভুলে গেছেন তখন বাংলার আকাশে জ্বলজ্বলে রাজনৈতিক তারা নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখনসহ অনেকে । সে মঞে ছিলেন তোফায়েল আহমেদের মতো নেতারা। আপনি সেখানে বেমানান। ঊটকো এক ছোকরা মাত্র। আপনি তো নিচেই থাকার কথা জনাব।

মীর্জা আব্বাস আরো বলেছেন. পুরো ভাষণ জুড়ে নাকি বঙ্গবন্ধু (তার ভাষায় মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান) পাকিস্তানি কাঠামোয় কিভাবে প্রধানমন্ত্রী হয়ে থাকা যায় তার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। এসব বধির মানুষজনকে কে মনে করিয়ে দেবে সব? মীর্জা আব্বাস যখন এই বিকৃত বক্তব্য রাখছিলেন, তখনও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বাজছিলো সাতই মার্চের অমর ভাষণ। কান পাতলেই শুনতে পারতেন নেতা গর্জন করে বলছেন- আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না আমি এদেশের মানুষের অধিকার চাই। বধির মীর্জা আব্বাসেরা তা শোনেন না বা শুনলেও ভুলে  যান ।

মীর্জা আব্বাস বলছেন, এই ভাষণে যদি কিছু থাকে তো তার চেয়ে বেশি কিছু আছে ২৭ মার্চে তখনকার মেজর জিয়াউর রহমানের ঘোষণায়! কিন্তু সেটা কী? তা কিন্তু পরিষ্কার করতে পারেন নি। বরং এক পা এগিয়ে বললেন, আওয়ামী লীগ যদি ২৭ মার্চের ঘোষণা না মানে তো তারাও নাকি সাতই মার্চ মানবেন না। তা জনাব কে আপনাদের মানতে বলেছে? আপনারা কী মানেন আর না মানেন- তার ওপর যদি এদেশের মানুষের বিশ্বাস থাকতো, কিংবা আস্থা থাকতো আজ রক্তমাখা কেক কাটা বন্ধ হতো না। আজও আপনারা যেসব বিষয়ে দেশ জাতি একমত হলে রাজনীতি সুগম হতো- তাতে সায় দিতে নারাজ।

মাঝখানে মাঠে না থাকা বিএনপির জন্য একটু দরদও যদি থাকে কারো, এমন কথা শুনতে থাকলে অচিরেই তা লোপ পাবে। এটা এখন বোঝা সম্ভব কেন আপনারা ম্রিয়মান একটি দলের নেতায় পরিণত হয়েছেন। আপনি বলছেন, সাতই মার্চ ছাড়া আওয়ামী লীগের কোনও পুঁজি নাই। কান খুলে শুনুন সরকারী দল সম্পর্কে এখন না আছে কোনও উচ্চাশা, বা না কোনও ভালোবাসার পাহাড়। কিন্তু সত্য এটাই- আওয়ামী লীগের যা আছে, তা আপনারা এ জীবনে তো বটেই আরেক জীবনেও অর্জন করতে পারবেন না। স্বাধীনতার সাতই মার্চ, ১৪ এপ্রিলের মুজিবনগর সরকার, অস্হায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ- সবই তাদের। যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কি আপানদের নেতা ছিলেন না ওসমানি? ১৬ই ডিসেম্বরে বিজয় দিবসে স্বাধীনতার কথিত ঘোষক কোথায় ছিলেন জনাব? মোদ্দাকথায় পুরা একাত্তর জুড়ে আপনারা কোথাও নাই। তাই এ আস্ফালন, এসব আহাজারী।

মায়াকান্না আর ইতিহাস বিকৃতি গেল না আপনাদের। মীর্জা আব্বাস আপনি প্রমাণ করলেন, কোন কোন লেজ বারো বছর চোঙ্গায় রাখলেও সোজা হয় না। বারো বছর নির্বাসনে থাকার পর সে কথাই প্রমাণ করলো- দলটির সাতই মার্চের কর্মসূচি। হায়রে রাজনীতি।

সিডনি

১১.০৩.২১