আমার শিশু আমাদের শিশু

মাসুমা বিল্লাহ
Published : 16 Nov 2014, 05:41 PM
Updated : 20 Sept 2012, 03:07 PM

এবারের শিশু দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল "শারীরিক শাস্তি বন্ধ হলে বাড়বে শিশু বুদ্ধি বলে"। শিশু অধিকারে আমাদের এ যাবৎ কালের অর্জন একটি শিশু নীতি। শিশু অধিকার নিয়ে শিশু অধিকার কর্মীরা এখন সোচ্চার, শিশুর বয়স নির্ধারনে রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়ায় অনেক জট পেরিয়ে আজকে সমগ্র বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমরা শিশুর বয়সকে ১৮ বছরে নির্ধারণ করতে জোড় প্রচারনা চালিয়ে যাচ্ছি। শিশুরা দেশের ভবিষ্যৎ, তাদের জন্য সুস্থ সুন্দর নিরাপদ জীবন ধারনের পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে, এ কথা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও তাঁর শিশু অধিকার সপ্তাহের বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিছু অপ্রাতিষ্ঠানিক বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করেছেন যেমন শিশুদের প্রতি লেখাপড়ার মাত্রাতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে না দেয়া, যা আমার মত অতিসচেতন এবং অতি উৎসাহী মায়েদের জন্য সুচিন্তিত ও অভিঞ্জতাপ্রসূত দিকনির্দেশনাও বটে। শিশুর শারিরীক ও মানসিক বিকাশে খেলার মাঠ ও পর্যাপ্ত খোলা জায়গার গুরুত্ব সর্বমহলে অনুভূত হলেও বাস্তবিক কার্যকারিতার প্রশ্নে রাষ্ট্র থেকে ব্যক্তি সকলেই এ উদ্যোগে ষ্পষ্টতঃই ব্যর্থ। কিন্তু শিশুর জন্য শারিরীক ও মানসিক বিকাশের অনুকূল পরিবেশ তৈরির ব্যর্থতার ফলাফল আমাদেরকে নিকট ভবিষ্যতেই ভোগ করতে হবে নিদারুনভাবে, এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।

শিশুর অংশগ্রহণের অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, বিদ্যালয়ে সুন্দর পরিবেশ পাওয়ার অধিকার, সর্বোপরি সার্বিক শিশু অধিকার নিয়ে আজ বড়দের পাশাপাশি শিশুরাও সোচ্চার। কিছুদিন আগে শিশু সংসদের মাধ্যমে শিশুরা বিদ্যালয়ের পরিবেশ নিয়ে তাদের গবেষণার ফলাফল শিক্ষামন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেছে ।

বিগত ৪০ বছরে দেশের অর্জন আর ব্যর্থতার হিসেব কষলে প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তি কোন ঝুড়িই অপূর্ণ থাকবে না। তবে সাদা চোখে দেখতে গেলেও আমার শৈশব আর আমার মেয়ের শৈশবের মাঝে রয়েছে আকাশ পাতাল ব্যবধান। আশির দশকে আমার শৈশব কেটেছে নারায়ণগঞ্জে – শীতলক্ষ্যার পাড়ে। মেয়েকে নিয়ে সেদিন গিয়েছিলাম শীতলক্ষ্যা দেখাতে, সদ্য স্কুলগামী মেয়ে আমার বইতে পড়েছে Sitalokha is a gentle river. কিন্তু কাছে গিয়ে একি শীতলক্ষ্যা দেখলাম, দুর্গন্ধে কাছে যাওয়া দায়, কালো দূষিত পানি আর কারখানার আবর্জনায় আমার শৈশবের শীতলক্ষ্যার সে কি করুন মৃত্যু। Gentle river থেকে Dirty river বনে যাওয়া শীতলক্ষ্যা দেখে বুকের চাপা কষ্ট নিয়ে শীতলক্ষ্যা পারের শহর দর্শনে বের হলাম, সমগ্র শহর জুড়ে চলছে শুধু নির্মাণ কাজ। আমার শৈশব হারিয়ে গেছে দূষণ আর দখলে। নিষিদ্ধ শহরে বন্দী সব শিশু। খুব কষ্ট হচ্ছিল, আর মেয়ের কাছে আমি অপরাধীর মত নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। কিন্তু আমার জিঞ্জাসা , শীতলক্ষ্যা এবং এর সঙ্গী-সাথীরা তো একদিনে এই অসহনীয় রূপ ধারন করেনি। এর মাঝে পেরিয়ে গেছে ৩০টি বছর । এই সময়কালে আমাদের প্রিয় দেশ, প্রিয় শহর, প্রিয় নদীকে বাঁচাতে আমরা কী করেছি ? এই দখল আর দূষনের জন্য তো আর বৈশ্বিক জলবায়ুর প্রভাবকে দায়ী করা যাবে না !

যে দিন গেছে চলে তার কথা মনে করে কষ্ট পেয়ে বসে না থেকে আজকে খুব দ্রুত ভাবতে হবে। পূর্বের রূপে শীতলক্ষ্যাকে ফিরিয়ে আনা কি একেবারেই অসম্ভব? আর রাজধানীর বাইরে কলেবরে বৃদ্ধি পাওয়া এই শহরগুলোকে শিশু বান্ধব করার সময় তো পেরিয়ে যাচ্ছে, যত সময় লাগবে এই সব শহরের দখলদারদের আটকাতে, তত ব্যাপকভাবে হারিয়ে যাবে শহরের শিশুদের শৈশব।

এ তো গেলো প্রাকৃতিক পরিবেশের কথা, এবার তাকাই সামাজিক পরিবেশের দিকে। মেয়ে আমার বড় হচ্ছে, বড় হচ্ছে দেশের ভবিষ্যৎ, আনন্দের চেয়ে শংকা বাড়ছে বেশি। হ্যাঁ, আমি জানি, আমার কৈশোর-যৌবনের অভিঞ্জতা দিয়েই জানি, স্কুল ধারের বখাটে, মাদকাসক্ত ছেলেগুলো কিভাবে আমার উচ্ছ্বলতাকে কেড়ে নিয়েছিল শৈশবে কৈশোরে। মনে পড়ে কিভাবে কুন্ঠিত থাকতাম আমি এবং আমার বন্ধুরা এই বখাটেদের ভয়ে, যদি এক কান দুকান হয়ে পরিবারের মানুষ জানে, যদি স্কুলের শিক্ষকরা জানে, যদি পাড়ার মুরুব্বীরা জানে যে বখাটেরা আমাদের পিছু নেয় প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া আসার পথে, আমি তবে কিভাবে স্কুলে আসবো? এই বখাটেপনার প্রতিবাদে উত্তাল হতে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডিতে পা রাখা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল । আজকে আমি বড় ভয় পাই, আমার মেয়েও তো বড় হচ্ছে, আমি কিভাবে নিরাপদ রাখবো তার শৈশব কৈশোর ? এই রাজধানীতে কর্মজীবি মা তার সন্তানের স্কুলে যাওয়ার সময়গুলোতে শংকিত হওয়া ছাড়া আর কিই বা করতে পারে?

এই লেখাটি যখন লিখছি, পত্রিকায় একটা খবর দেখে আর কলম চলছিল না, বাঁধন নামের ৫ বছরের একটি শিশুর খন্ডিত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে এবং এ লেখার্টি লেখা পর্যন্ত তার একটি পা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। শিশুর প্রতি এই সহিংসতার শেষ কবে হবে ? এমন একটি সহিংসতার ঘটনা শিশুর অধিকারের অর্জনের প্রাপ্তিকে ম্লান করে দেয়। এই নিষ্ঠুরতার প্রভাব শিশুটির পরিবারের জন্য কি নিদারূন কষ্টের , শিশুটির বন্ধু, সমসাময়িক অন্য শিশুদের জন্য এই ঘটনা কতটা আতংকের তা সহজেই অনুমেয় । শিশুদের প্রতি সহিংসতা ও নিষ্ঠুরতা বন্ধ করতে আইনের দৃষ্টান্তমূলক প্রয়োগ অপরিহার্য।

জীবনকে ঘিরে জীবনের যে আয়োজন, তা তো নিরন্তর আর এই আয়োজনে সর্বাগ্রে আসে শিশুর জন্য আমাদের শত আয়োজন। তবে আমার শিশুর জন্য আমার এ আয়োজন যদি অন্যের শিশুর অধিকারকে হরণ করে তবে তা হবে বুমেরাং। সমাজের কোন নাগরিক যদি মনে করেন যে, তিনি তার শিশুর জন্য সম্পদের পাহাড় গড়ে যাবেন আর এতেই নিশ্চিত হবে তার শিশুর ভবিষ্যৎ, তবে সে ভাবনায় রয়েছে বিস্তর ভুল । সকলে মিলে সব শিশুর জন্য বাসযোগ্য পরিবেশ গড়ে তুলতে না পারলে তা সুবিধাপ্রাপ্ত ও সুবিধাবঞ্চিত সকল শিশুর জন্যই হবে ভয়াবহ বিপর্যয়ের কারণ। নগরে যখন আগুন লাগে তখন দেবালয় কি আগুনের লেলিহান শিখা থেকে রক্ষা পায় ? শীতলক্ষ্যার বিষাক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে হয় সব শিশুকে, সবার শিশুকে।

মাসুমা বিল্লাহ্: গবেষক, বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। এন এফ পি রিসার্চ ফেলো, ইউনিভার্সিটি অফ গ্রোনিনগেন, দি নেদারল্যান্ডস্।