ভিকটিমহুডের খেলায় কি হেরে যাচ্ছে বাঙালি?

আশফাক আনুপআশফাক আনুপ
Published : 30 Dec 2011, 03:17 PM
Updated : 16 Oct 2019, 11:24 AM

১.

সমাজবিজ্ঞানীদের নাম দিয়ে কোনো প্রশ্নোত্তর শুরু করাটাকে আমরা স্কুল জীবনে ভালো নম্বর পাওয়ার একটা তরিকা হিসেবে মনে করতাম। বাস্তবে আমার ধারণা সমাজবিজ্ঞানীদের নাম নিয়ে প্রবন্ধ শুরু করলে, প্রথম বাক্য পড়েই পাঠক ঘুমাতে চলে যান। এইজন্য লেখাটা শুরুর পূর্বে এই দু'টো অতিরিক্ত বাক্য খরচা করছি। আদতে, বলতে চাইছিলাম ব্র্যাডলি ক্যাম্পবেল এবং জেসন ম্যানিং নামের দু'জন সমাজবিজ্ঞানীর লেখা অতি সাম্প্রতিক একটি বই নিয়ে। বইটির নাম- 'দি রাইজ অব দ্য কালচার অব ভিকটিমহুড'। এই দুই ভদ্রলোক পশ্চিমা সমাজের নীতিগত সাংস্কৃতিক বিবর্তন নিয়ে এই বইটি লিখেছেন। মোটাদাগে তারা সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের নীতিগত আচরণ কিভাবে পরিবর্তিত হয়েছে তার একটি কাঠামো দাঁড় করাতে গিয়ে মোরাল কালচারের সময়রেখাকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন।

এক, অনার কালচার। এই সামাজিক সংস্কৃতি পুরোনো পশ্চিমা সমাজে বিদ্যমান ছিলো যেখানে যেকোনো অফেন্সকে বস্তুগতভাবে বিবেচনা না করে বরং সন্মান/মর্যাদাহানিকর ভাবে নেয়া হতো। ধরা যাক, কেউ আপনার মা'কে নিয়ে কটুক্তি করলে কটুক্তিকারীকে আপনি সরাসরি আমৃত্যু মল্লযুদ্ধে বা ডুয়েল-এ আহ্বান জানালেন। ওয়েস্টার্ন ঘরানার (জনরা) বই-পুস্তক বা চলচ্চিত্র সম্পর্কে যাদের জানা আছে তারা বুঝতে পারছেন হয়তো- এই ডুয়েলের মাধ্যমে আপনি আপনার হানি হওয়া মর্যাদার পুনরুদ্ধার করবেন বলে ধরে নেয়া হতো। অনার কালচারে যে পক্ষ পরাজিত, অর্থাৎ যে ভিক্টিম, তাদের অবস্থান নীতিগত কাঠামোতে সবথেকে নিচে।

দুই, ডিগনিটি কালচার। নিকট অতীতে উনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিংশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত পশ্চিমা সমাজের মূল নীতিগত সংস্কৃতি হচ্ছে এটি। লেখকদ্বয় বলছেন– এই সময়েই যেকোনো অফেন্সের প্রত্যুত্তরে মল্লযুদ্ধের আহ্বান না জানিয়ে বরং অফেন্সের ধরণের উপর নির্ভর করে নিয়তান্ত্রিক উপায়ে উপেক্ষা-অসহযোগীতা-সালিশ-বিচার-আইন-আদালত ইত্যাদির প্রয়োগ প্রতিষ্ঠিত হয়।

তিন, কালচার অব ভিক্টিমহুড। এই কাঠামোর উদ্ভব একেবারেই সাম্প্রতিক। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে এখন পর্যন্ত এই নীতিগত সংস্কৃতির উত্থানকাল হিসেবে দাবি করছেন লেখকেরা। এই কাঠামোতে ভিক্টিমের নীতিগত অবস্থান সবার উপরে। লেখকদ্বয় বলছেন– এই নীতিগত সংস্কৃতি 'অভিযোগের প্রচারের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি করে' (…increases the incentive to publicize grievances")। অর্থাৎ, যার প্রতি কোনো অন্যায় করা হয়েছে সে ব্যক্তিটি অন্যায়কারীকে শারিরীক বা আইনিভাবে শায়েস্তা করার থেকেও এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনসমর্থন আদায়ে আগ্রহী হচ্ছেন অধিক।

সামাজিক বাস্তবতায় এর কোনোটিকেই আসলে ভুল কিম্বা সঠিক নীতিগত অবস্থান হিসেবে দেগে দেয়া যায় না। সামাজিক এই বিবর্তনগুলোকে তাই কেবল বাস্তবতা হিসেবে দেখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। এই পর্যায়ে একটি কথা বলে রাখি। তা হচ্ছে- আধুনিক পৃথিবীর বিশ্বায়নগত ও প্রযুক্তিগত বাস্তবতায় পশ্চিমা সংস্কৃতি আগের চেয়ে অনেক দ্রুত ও কার্যকরভাবে আমাদের প্রাচ্যের নীতিগত সংস্কৃতিকেও প্রভাবিত করছে। তাই, ভিকটিমহুডের এই কালচারাল চর্চা পশ্চিমা সমাজের একক বৈশিষ্ট্য নেই আর। বৃহদার্থে তা যে আমাদের দেশীয় সামাজিক পরিমন্ডলেও ছড়িয়ে পড়ছে তার প্রমাণ কিন্তু যেকোনো একটি ঘটনা চাউর হবার পরে সেটা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার আচরণেই পরিষ্কার হয়।

২.

ক্যাম্পাসে রাজনীতি না থাকলে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর পোয়াবারো হয়; বেনামে শিবিরের, হিজবুতের বা আনসার-বাংলার কার্যক্রম দিব্যি চলমান থাকে। এগুলো কিন্তু মিথ না। এগুলো যে মিথ না তার প্রমাণ বাংলাদেশের বেশকিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। এমনকি এক যুগ আগের বুয়েট! অনেকে এক্ষেত্রে প্রশাসনের দায় দেখেন শতভাগ। আসলেও কি তাই? রাজনীতিহীন পরিসরে নিকট অতীতে কখনও শুনেছেন নামে বেনামে বাম সংগঠনের বাড়বাড়ন্ত হয়েছে? সর্বহারার রাষ্ট্রিক অধিকার নিয়ে দেয়ালে দেয়ালে পড়েছে পোস্টার? না দেখেননি! সর্বহারা নিয়ে যাও বা কথাবার্তা হয়তো শুনেছেন তাও ওই হিজবুতের কাছেই, ফরহাদ মজহারের প্রেসক্রিপশনে। আদতে তা সেই ধর্মীয় রাজনীতিরই উপজাত। কিন্তু এটা কি কখনো ভেবে দেখেছেন– একটি দেশ যেটির জন্ম হয়েছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির লেপে দেয়া দগদগে ঘা শরীরে নিয়ে সেদেশে কেন ছাত্রদের মধ্যে প্রগতিশীল রাজনীতির পরিবর্তে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির আবেদন বেশি থাকবে? কেন ছাত্রদের মধ্যে রাজনীতিহীন পরিবেশে ধর্মীয় রাজনৈতিক ধারণাকে গেঁথে দেয়া যাচ্ছে, অথচ এর বিপরীত ধারণাকে বোরিং মনে করছে তরুণরা? এই প্রশ্নের নানান উত্তর থাকতে পারে। '৭৫ পরবর্তী পট পরিবর্তন, পশ্চিমা নীতি, বৈশ্বিক রাজনীতি, ভারতীয় বিদেশনীতি ইত্যাদি ইত্যাদি। এর সবগুলোকে স্বীকার করে নিয়েও এই প্রশ্নটির আদতে যে উত্তরটি সামনে আসে তাহলো– আমরা শিবির-হিজবুত-আনসারের ধর্মীয় ন্যারেটিভ এর বিপরীতে শক্তিশালী, আপটুডেট, ছাত্রদের ব্যক্তিজীবনে প্রাসঙ্গিক কোনো প্রগতিশীল কাউন্টার ন্যারেটিভ দাঁড় করাতে পারিনি। বরং অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে– স্বাধীনতা পরবর্তীতে আমাদের অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল গ্রান্ড ন্যারেটিভই উলটো লেসার ন্যারেটিভে পরিণত হয়েছে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক ন্যারেটিভের সামনে। বর্তমানের সেই ধর্মীয় গ্রান্ড ন্যারেটিভের সামনে আমরা এখনো লড়ে যাচ্ছি সেই পুরোনো প্রগতিশীল ন্যারেটিভ নিয়ে। সময়ের সাথে তা শক্তিশালী হয়নি, বরং দিন দিন অপ্রাসঙ্গিক হচ্ছে। বৈশ্বিক ধর্মীয় রাজনীতি আজকের দিনের গড়পড়তা একজন তরুণকে যে ধরণের বৃহত্তর ন্যায়প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখায়, যে ধরণের সামগ্রিক ক্লেশবোধ বা কালেক্টিভ ভিকটিমহুডের অনুভূতি দেয়, তাকে আমরা প্রতিরোধ করছি এখনও ভাষা আন্দোলনের গর্বের উপাখ্যান, স্বাধীনতা যুদ্ধের গৌরবগাথা, কিম্বা সর্বোচ্চ- ৭১ এর গণহত্যার বিচার দাবির মাধ্যমে। বাঙালির ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, '৭১-এর গণহত্যা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ন্যারেটিভ। আমায় কেউ এই ব্যাপারে ভুল বুঝবেন না দয়া করে। কিন্তু তরুণদের মধ্যে ভবিষ্যতমুখী কর্মচাঞ্চল্য তৈরির পক্ষে এগুলো কিন্তু বাস্তবিক অর্থে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে না যখন তাকে লড়তে হয় একবারে আনকোরা ও ব্যক্তিজীবনে প্রাসঙ্গিক বৃহত্তর ধর্মীয় পরিচয় এর মূলা কিম্বা সীমান্ত-হত্যা, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, হিন্দুত্ববাদ ইত্যাদির মতো অধুনা ভারতীয় আগ্রাসী নীতির নানান উপজাতের সাথে। তাই আপনি যতই বুঝাতে চেষ্টা করুন না কেনো যে, রাজনীতিহীনতা ধর্মীয় রাজনীতিকে উস্কে দেবে, তা কিন্তু আজকের বা অদূর ভবিষ্যতের তারুণ্যকে গেলাতে পারবেন না প্রাসঙ্গিকতায় মার খেয়ে।

৩.

তারুণ্যের মূল বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে এর আদর্শবাদীতা ও ভবিষ্যতমুখীতা। তরুণরা আদর্শবাদী বিধায়, প্রচারিত যেকোনো রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা সামাজিক আদর্শকে ন্যায়সঙ্গত মনে করলে সবার প্রথমে গ্রহণ করে তরুণরাই। আর ভবিষ্যতমুখী বিধায়, সে' মতো সেই আদর্শ কার্যকরের প্রচেষ্টা গ্রহণ করার মূলভাগেও সবসময় তরুণদের অংশগ্রহণই অগ্রগণ্য। তাই যে আদর্শ ভবিষ্যতমুখী নয়, তা গুণগতভাবে শ্রেয়তর হলেও তারুণ্যের মধ্যে জিইয়ে রাখা কঠিন। খেয়াল করলে দেখবেন, তরুণদের মাধ্যমে সাম্প্রতিক অতীতে প্রগতিশীল রাজনৈতিক আদর্শের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে যে দুটো ঘটনার মধ্য দিয়ে তা হচ্ছে ১৯৯২ সালের গণ-আদালত ও ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলন। দুটোই সমসাময়িক তারুণ্যের বিস্ফোরণ এবং লক্ষ্য করলে দেখবেন এই দুটো আন্দোলনই কিন্তু ঘটেছে অভিন্ন একটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে। ১৯৭১ সালে বাঙালির উপরে চলা নৃশংস গণহত্যায় অংশ নেয়া অপরাধীদের বিচারহীনতাকে কেন্দ্র করে যে সামগ্রিক ভিকটিমহুড বাঙালি তারুণ্য অনুভব করেছে, এই রাজনৈতিক আন্দোলনগুলো সেই ভিকটিমহুডেরই বহিঃপ্রকাশ। দীর্ঘ প্রায় ৪ দশকের সেই কর্মযজ্ঞের ধারাবাহিকতায় আজকের সময়ে এসে আমরা দাবি করতে পারি যে অন্তত আইনিভাবে এই বিচারহীনতার নিরসনের প্রক্রিয়া চলমান। তবে প্রশ্ন হলো– এই সাফল্য কি আত্মতুষ্টিতে আক্রান্ত করছে আমাদের? আত্মতুষ্টির প্রসঙ্গটি আনছি কারণ, বিশ্বজুড়ে এই আন্দোলনকে ও বিচার প্রক্রিয়াকে সামান্যিকরণের যে প্রচেষ্টাকে ২০১৩'র তারুণ্য কার্যকরভাবে লড়েছিলো সেই প্রচেষ্টা কিন্তু একেবারেই বন্ধ হয়নি। অথচ বর্তমান তারুণ্যকে সেই বাস্তবতায় খুব একটা চিন্তিত বলে কিন্তু মনে হচ্ছে না। এবং হচ্ছে না বলেই, আজকে আপনি যখন ক্যাম্পাস রাজনীতি বন্ধের বিতর্কে ছাত্রসঙ্ঘ বা শিবিরের বেনামি অপকর্মকে সামনে আনতে চাইছেন তা কিন্তু গ্রান্ড ন্যারেটিভ হিসেবে ধোপে টিকছে না। পরিতাপের বিষয় এই যে, ক্যাম্পাস রাজনীতির গন্ডী ছাড়িয়ে এই বাস্তবতার সবথেকে বড় খেসারত দিতে হবে আমাদের অত্যন্ত সাধনায় পাওয়া '৭১-এর বিচার প্রক্রিয়াটিকে। মনে রাখতে হবে– ভাষা আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধকে কিন্তু মোটাদাগে বিজয়ের ইতিহাস হিসেবেই উপস্থাপন করা হয়, যেখানে গণহত্যা আর জাতির প্রতি হওয়া অবিচারের ক্ষতটা গর্বের চাদরে ঢেকে যায় অনেকটাই। তারুণ্যের সামনে যদি এই গণহত্যাকে, বাঙালির প্রতি হওয়া এই নিদারুণ অন্যায়কে, এবং এই অন্যায়ের চলমান ধারাবাহিকতাকে প্রাসঙ্গিক হিসেবে তুলে ধরা না যায়, যদি এই অন্যায়ের শিকার হিসেবে জাতিগত ক্লেশবোধ সৃষ্টি করা না যায়, তবে অদূর ভবিষ্যতেই জামাতি পিআর ক্যাম্পেইন আর আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষপাতদুষ্ট রিপোর্টগুলোই কাউন্টার ন্যারেটিভ হিসেবে অধিকতর শক্তিশালী হয়ে উঠবে। সেই অদূর ভবিষ্যতের তারুণ্যের কাছে তখন এই বিচারের দাবি করা তারুণ্য হাস্যস্পদ হয়ে উঠবেন। হয়তো অপরাধীও।

৪.

প্রথম অংশে কালচার অব ভিকটিমহুড নিয়ে যে আলোচনাটা শুরু করেছিলাম সেই বইটিতেই লেখকদ্বয় আরো একটি আগ্রহোদ্দীপক ধারণা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই ধারণাটির নাম তারা দিয়েছেন 'কম্পিটিটিভ ভিকটিমহুড', যার বাংলা করা যেতে পারে 'প্রতিযোগিতামূলক ক্লেশবোধ!' অর্থাৎ, কে কার থেকে বড় ভিক্টিম এই ব্যাপারটি প্রতিষ্ঠিত করা নিয়ে সচেতন প্রচেষ্টা। এই প্রচেষ্টা আমরা দেখেছি যখন 'অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনিদের' দুর্দশার ন্যারেটিভের বিপরীতে ইজরায়েল 'অ্যান্টিসেমিটিজম'এর ন্যারেটিভ হাজির করেছে। এই প্রচেষ্টা আমরা দেখেছি যখন তালেবানদের 'বৈশ্বিক মুসলমানের অত্যাচারের প্রতিবাদ' ন্যারেটিভের বিপরীতে পেন্টাগন 'টুইন টাওয়ারে তিন হাজার নিরাপরাধ আমেরিকানের প্রাণহানি'র ন্যারেটিভ হাজির করেছে। এই প্রচেষ্টা আমরা দেখেছি যখন 'ইসলামোফোবিয়া'র বৈশ্বিক ন্যারেটিভের বিপরীতে বিজেপি 'হিন্দু খাতরে মে হ্যায়…' ন্যারেটিভ উপস্থাপন করেছে। এবং এই প্রচেষ্টা আমরা খুব ছোট পরিসরে হলেও সাম্প্রতিক সময়ে দেখতে পাচ্ছি যখন 'আবরার হত্যার প্রেক্ষিতে বুয়েটবাসীর প্রতিবাদ' এর ন্যারেটিভের বিপরীতে প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী 'সানি হত্যা, দ্বীপ হত্যার সময় কোথায় ছিলেন' ন্যারেটিভ হাজির করছেন।

ব্যাপার হচ্ছে কোন ন্যারেটিভটি শক্তিশালী হয়ে উঠবে তা নির্ভর করে অবশ্যই সেই ন্যারেটিভের ন্যায্যতার উপর, তার প্রাসঙ্গিকতার উপর এবং একই সাথে তার প্রচারের উপরও। অনেক সময় কেবল কার্যকর প্রচারের অভাবেই একটি ন্যায্য ও প্রাসঙ্গিক ন্যারেটিভও এই কম্পিটিটিভ ভিকটিমহুডের খেলায় হেরে যায়। আবার অনেকসময় জমজমাট পিআর ক্যাম্পেইন করেও একটি ন্যারেটিভকে দাঁড় করানো যায় না তার প্রাসঙ্গিকতার অভাবের কারণে।

আগেই যেটা উল্লেখ করলাম– রাজনীতিহীন পরিবেশে ধর্মীয় রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তরুণদের মধ্যে প্রাসংগিক হয়ে উঠছে কারণ প্রতিযোগীতামূলক ক্লেশবোধের যে সংস্কৃতি আধুনিক শিক্ষিত তরুণের মধ্যে অজান্তেই ঢুকে পড়েছে, সেখানে সে ধর্মীয় পরিচয়ে নিজেকে যতটা ভিকটিমাইজড মনে করছে, ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় পরিচয়ে সে নিজেকে ততটা ভিকটিমাইজড মনে করছে না। সে নিজের অজান্তে হলেও, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে 'ইসলামোফোবিয়া'র ধারণা দ্বারা যতটা প্রভাবিত, বিশ্বব্যাপী বর্তমান 'বাঙালি-বিদ্বেষ' নিয়ে তার তেমন একটা মাথাব্যাথা নেই। এর কারণ কিন্তু ন্যায্যতা বা প্রাসঙ্গিকতার অভাব নয়, বরং ভুল প্রচার এর পেছনে অনেক বেশি করে দায়ী।

৫.

এটাই এই লেখাটির মুল অংশ। আধুনিক পৃথিবীতে সংখ্যা হিসেবে সবথেকে বৃহৎ গণহত্যাসমূহের শিকার জাতিটির নাম বাঙালি। ১৯৪৩ এর ব্রিটিশ সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে অন্ততপক্ষে ৫০ লক্ষ বাঙালি প্রাণ হারায়। ড. জনম মূখার্জী তাঁর ডক্টরাল গবেষণায় দেখিয়েছেন যে– এই দুর্ভিক্ষে সরাসরি মধ্যসত্ত্বভোগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে উত্তর-ভারতীয় মারোয়ারি ব্যবসায়ীগণ এবং পাকিস্তানপন্থি ইস্পাহান'রা। তাই এই দুর্ভিক্ষের নিহত জনগোষ্ঠীকে 'ভারতীয়' হিসেবে আখ্যায়িত করবার মাধ্যমে ইতিহাসে সত্যের যে অপলাপ করা হয়, আর 'বাঙালি'র জাতিগত নিধনের যে বাস্তবতাকে অস্বীকার করা হয় তা বাঙালির অসাম্প্রদায়িক ন্যারেটিভে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। আর এই দুর্ভিক্ষকে পাকিস্তান কর্তৃক সংঘটিত ১৯৭১ এর গণহত্যা থেকে বিন্দুমাত্র খাটো করে দেখার প্রচেষ্টাও অত্যন্ত অবিবেচনাপ্রসূত।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই এক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাতেই প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে দুর্ভিক্ষকে (famine as a weapon of war) ব্যবহারের রক্ত লেগে আছে অন্তত ইতিহাসে তিন তিনটি অধ্যায়ে। ১৮৪৭-এ আয়ারল্যান্ডের গ্যেডহিল হলোকাস্ট, বিংশ শতকের সূচনালগ্নে দক্ষিণ আফ্রিকায় বোয়ার যুদ্ধে এবং ২য় বিশ্বযুদ্ধকালীন ১৯৪৩ এর বাংলায়। তাই "পঞ্চাশের মন্বন্তর" যে আসলে "পঞ্চাশের গণহত্যা"ই ছিলো সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। এরপরও এই ব্যাপকভিত্তিক হত্যাযজ্ঞকে তাত্ত্বিকভাবে গণহত্যা হিসেবে বিশ্লেষণ করা যায় কিনা সে উত্তরের দায়িত্ব কিন্তু বাঙালি গবেষকদেরই। এর বাইরেও বাঙালির ভিকটিমহুডের ন্যারেটিভে ১৯৭১ এর ৩০ লক্ষ যতবার আসে ১৯৪৩ এর ৫০ লক্ষ কিন্তু সেভাবে আসে না! এছাড়া যে ১ কোটি উদ্বাস্তু ১৯৭১ এর গণহত্যার কারণে তৈরি হয়েছিলো, 'জেনোসাইড'-এর তাত্ত্বিক সঙ্গানুসারে তারাও কিন্তু জেনোসাইডের ভিকটিম। এই যে ১ কোটি ৩০ লাখ ভিকটিম, এমনকি তারাও বিশ্বব্যাপী জেনোসাইড ভিকটিম হিসেবে বহুল স্বীকৃত নয়। সেখানেও ২য় বিশ্বযুদ্ধের ইহুদি হলোকাস্ট, এমনকি, ক্যাম্বোডিয়ান বা রুয়ান্ডান জেনোসাইডও প্রতিযোগীতা মূলক ভিক্টিমহুডের পরিমাপে বাঙালি গণহত্যাকে টেক্কা দেয়।

এ তো দিলাম কিছুটা দূর অতীতের হিসেব। আরো সাম্প্রতিক, এই আশির দশকেও ত্রিপুরার মান্দাই গণহত্যা বা আসামের নেলি গণহত্যায় নিহত বাঙালির সংখ্যা কয়েক সহস্রেরও উপরে। কতজন জানেন এগুলো সম্পর্কে? আবার এই যে রোহিঙ্গা গণহত্যা বিশ্বব্যাপী আলোচিত, সমালোচিত, তাকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে যারা উদগ্রীব তারা কি একটিবার চিন্তা করে দেখেছেন যে এই গণহত্যায় যে দশ হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছে, যে ১৫ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে তাদেরকে কিন্তু 'মুসলমান' এমনকি 'রোহিঙ্গা' নামেও হত্যা করা হচ্ছে না। বরং যারা এই গণহত্যার কুশীলব তাদের মূল ক্ষোভ ও অভিযোগ এই যে এরা 'বাঙালি'! এটাতে হয়তো সত্যিই প্রমাণিত হয় না যে তারা সত্যিই 'বাঙালি' কিনা, কিন্তু এটা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয় যে এদের উপরে হওয়া গণহত্যায় 'বাঙালি-বিদ্বেষ'ই একমাত্র না হলেও, প্রধান প্রকাশিত নিয়ামক। এই যে সেন্স অব ভিকটিমহুড, এটা নিয়ে কথা বলতে দেখা যায় না কাউকেই!

আরো সাম্প্রতিক সময়ে, বাংলাদেশের সীমান্তের অপর পার্শ্বে যে আরো একটি বাঙালি জেনোসাইডের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে তাও উল্লেখ করা প্রয়োজন। ধর্ম নির্বিশেষে প্রায় ১৮ লক্ষ বাঙালিকে ভারতীয় নাগরিকত্ব বঞ্চিত করা হয়েছে আসামের নাগরিকপঞ্জীর মাধ্যমে। আসামে বহুযুগ ধরে চলে আসা বাঙালি-বিদ্বেষী মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে শুরু হয়েছে "তারা এবং আমরা"র ভিত্তিতে বিভক্তিকরণ। প্রফেসর গ্রেগরি স্টানটনের মতে, যেকোনো জেনোসাইডের প্রথম ধাপটি-ই হচ্ছে এই 'আমরা ও তারা' বিভাজন। স্টানটন বর্ণিত ২য় ধাপ, চিহ্নায়ন বা সিম্বলাইজেশনের কাজটিও যে জোরেশোরেই চলছে তা বোঝা যায় যখন আসামের আইন পরিষদের বিজেপি সাংসদ হেমন্ত বিশ্ব শর্মা ধর্মনির্বিশেষে বাঙালিকে উপেক্ষা করতে গিয়ে বলেন- 'আমার ধূতি-লুঙ্গির ভোট চাই না।' ঠিক যেমন ১৯৪৩ এ চার্চিল বলেছিলো, "ঘনঘন বাচ্চাদেয়া খরগোশ" (র‍্যাপিড ব্রিডিং র‍্যাবিট), ১৯৭১-এ পাকিস্তান বলেছিলো 'মাছুয়া'! বাকি ধাপগুলোও মিলিয়ে দেখবেন, রক্ত হীম হয়ে আসতে বাধ্য। আসাম ছেড়ে যদি পশ্চিমবঙ্গ বা ত্রিপুরার দিকে তাকান দেখবেন সেই একই নাগরিকপঞ্জির পদধ্বনি। লক্ষ্য সেই একই জাতিগোষ্ঠী– বাঙালি।

সেদিন কোনো একটা টিভি চ্যানেলে সদ্য মাধ্যপ্রাচ্য ফেরত একজন শ্রমিকের সাক্ষাৎকারে ভদ্রলোক একপর্যায়ে বলে বসলেন- বাঙালিদের প্রতি আরবদের মনোভাব, ভারতীয় বা পাকিস্তানি শ্রমিকদের ব্যাপারে মনোভাবের থেকে অনেকটাই নিচু। সবার প্রতিই উনি অপমানজনক মনোভাব প্রকাশ করতে দেখলেও বাঙালিদের প্রতি যেনো একটু বেশিই নিম্নধারণা পোষণ করে শেখরা। এই বক্তব্যকে হয়তো খুব সুবিবেচনাপ্রসূত বা অভ্রান্ত হিসেবে দাবি করা সম্ভব নয়, তবে বাঙালি শ্রমিকদের প্রতি নিগ্রহের ব্যাপারটি এবং বাঙালি বলেই তাদের মধ্যে সৃষ্ট হীনমন্যতাটি কিন্তু অস্বীকার করা যায় না। গালফ দেশগুলির বাইরে, মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডেও বাঙালিদের প্রতি তীব্র জাতিগত বিদ্বেষ চোখে পড়ার মতো। এর প্রমাণ মেলে যখন মালয়েশিয়ান পরিচালক উয়ি মেং চি তাঁর আলোচিত চলচ্চিত্র 'বাংলাশিয়া'তে স্যাটায়ারের মাধ্যমে মালয়েশিয়ার অন্তঃজাতিক সম্পর্কের নানান দিক তুলে ধরেন এবং মালয়েশিয়ান সেন্সরবোর্ড কর্তৃক ছবিটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। বিশ্বব্যাপী বাঙালি-বিদ্বেষকে তাই কোনো মিথ বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না।

অত্যন্ত সংকীর্ণ হিসেবেও যদি এই আধুনিক সময়ে বাঙালি-বিদ্বেষী কর্মকাণ্ডে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ বাঙালির সংখ্যা হিসেব করা হয়, সে সংখ্যাটি কমপক্ষে ২০ মিলিয়ন বা দুই কোটি ছাড়াবে গত মাত্র আশি বছরের ব্যবধানে। এরসাথে যদি সমকালীন বাস্তবতায় বারবার করে উন্নত বিশ্বের জলবায়ু সন্ত্রাসের বলি হওয়া সবথেকে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী হিসেবে বাঙালিকে বিবেচনা করা হয়, সেই সম্ভাব্য সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১০০ মিলিয়নে। অবশ্য সে হিসেব না ধরলেও– আধুনিক বিশ্বে এতো অল্প সময়ের মধ্যে একটি মাত্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ জাতিগত-বিদ্বেষের ফলে ভিকটিমাইজড হবার ইতিহাস সম্ভবত আর নেই। সেই সাথে এটাও লক্ষ্য করাটা অত্যন্ত জরুরি যে, এই যে বিরাট ও ব্যাপকভিত্তিক বাঙালি বিদ্বেষ তা কিন্তু আজকের দিনেও সম্পূর্ণভাবে প্রাসঙ্গিক এবং তার লক্ষ্য কেবল একটি নির্দিষ্ট ধর্মের বাঙালি নয়, বরং ধর্ম-নির্বিশেষে যেকোনো বাঙালি। বৈশ্বিক পরিমন্ডলে বাঙালি-বিদ্বেষ এর প্রপঞ্চটিকে (phenomenon) নিগ্রো-ফোবিয়া বা অ্যান্টিসেমিটিজমের মতোই শক্ত ন্যারেটিভ হিসেবে দাঁড় করানোটা তাই এখন সময়ের দাবি।

অথচ নিদারুণ দুঃখের বিষয় এই যে, এই বৃহৎ, প্রাসঙ্গিক ও সার্বজনীন ক্যানভাসটি আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি ন্যারেটিভে সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত। এই ধারণাগুলোকে দাঁড়া করতে, প্রচার করতে কিম্বা বিশ্লেষণ করতে যে ইতিহাসগত, সামাজিক, আইনগত, নৃতাত্তিক, ভাষাতাত্ত্বিক এমনকি জেনেটিক গবেষণার প্রয়োজন সে প্রচেষ্টাও সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত। অথচ এগুলোকে ঠিকই নিজের মতো করে, কখনো ইসলামোফোবিয়া, কখনো 'খতরে মে হ্যাঁয়' ইত্যাদি জুজু দেখিয়ে ব্যবহার করছে ধর্মীয় ন্যারেটিভের প্রচারকরা। ফলাফল, আজকে কোনো একটি ক্যাম্পাসে ছাত্র-রাজনীতি বন্ধ করলেও আমরা ভয়ে থাকি তারুণ্য হয়তো ধর্মীয় রাজনীতির ফাঁদে পড়বে। অথচ কম্পিটিটিভ ভিক্টিমহুডের এই খেলায়, আপনি যে নিজের অত্যাচারিত পিঠটাকে গর্বের চাদরে ঢেকে রেখে পিছিয়ে পড়ছেন ক্রমাগত, সেটা নিয়ে কোনোদিন দু'মিনিট ভাবছেন না। ভাবছেন না– কেন বাঙালি তরুণ বৈশ্বিক ইসলামিক ব্রাদারহুডের জেহাদি জোশে গা ভাসাবে না, যদি পূর্বপ্রজন্ম হিসেবে আপনি বাঙালির জাতিগত ক্ষতটি তার সামনে কোনোদিন উন্মুক্তই না করেন? কেনো সে সর্বভারতীয় হিন্দুত্ববাদের গড্ডলিকা প্রবাহে ভিড়বে না, যদি তাকে উপলব্ধিই করতে না দেন যে কেবলমাত্র বাঙালি বলেই সে দেশ বা ধর্ম নির্বিশেষে আজকের এই বিশ্বায়িত পৃথিবীতেও উপেক্ষিত ও অত্যাচারিত? যদি তাকে বাঙালি হিসেবে সেই কালেক্টিভ ভিকটিমহুডের, ধর্ম নির্বিশেষে এক জাতি হিসেবে বাটোয়ারা করে নেয়া সেই দুঃখবোধের স্বাদ দিতে না পারেন?