সম্রাটদের ‘সাম্রাজ্যে’ আবরাররা বাঁচে না

হাসান ইমাম
Published : 15 Oct 2019, 01:45 PM
Updated : 15 Oct 2019, 01:45 PM

নামে হয়তো জনাকয়েকই, তবে কাজ-কামে তারা হরেদরে সবাই 'সম্রাট'। ক্যাসিনো কারবার থেকে ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার— সবখানেই এই সম্রাটদের 'সাম্রাজ্য' প্রতিষ্ঠিত। তাই 'আদালত' বসানো পর্যন্ত চলে তাদের নিজেদের নিয়মে। এ এমন এক বিচারব্যবস্থা যেখানে বিবাদীর টুঁ শব্দটি করারও অধিকার নেই, সাজা মেনে নেওয়া নেওয়াই তার নিয়তি; ইলেকট্রিক শক, স্ট্যাম্প-পেটা থেকে 'মৃত্যুদণ্ড'— সব বন্দোবস্তই বহাল। এমন আলামতই পাওয়া গেল কাকরাইলের 'সম্রাট ভবন' থেকে পলাশীর 'সম্রাটদের হলে'।

'প্যারালাল' এ বিচারব্যবস্থার নাম 'টর্চার সেল'। ভাইদের, ভাইদের ছোট ভাইদের, ভাইদের পিঠ-চাপড়নো বড় ভাইদের কেউ কিছুমাত্র নাখোশ হতে পারেন এমন ভঙ্গি, ইঙ্গিত, শব্দ, বাক্য, ছবি, গ্রাফিতি ইত্যাদির জন্য বরাদ্দ হয় 'টর্চার'। টর্চারের ডোজ কম-বেশির ওপর নির্ভর করবে ঢাবির এহসান রফিক বা রাবির তরিকুলের ভাগ্য বরণ করবেন, নাকি মেনে নিতে হবে বুয়েটের আবরার ফাহাদের পরিণতি।

পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন বলছে, আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড স্বাধীন বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে ১৫১তম খুন। এসব হত্যার ফায়দা লোটা রাজনীতির দাপাদাপিতে রাজপথের পিচ পর্যন্ত গলে যায়! সেখানে রক্তের দাগ কীভাবে অটুট থাকবে? তাই বলে এই দেড়শ শিক্ষার্থীর নাম কি আমাদের স্মৃতির ফলক থেকেও মুছে যাবে? ক্ষণস্থায়ী গণস্মৃতি বিবেচনায় যদি গত এক দশকও আমলে নেওয়া হয়, তাও সংখ্যাটা হৃদপিণ্ডে রক্তসঞ্চালন বাড়িয়ে দেওয়ার কথা; এ সময়ে খুন হন ২৪জন শিক্ষার্থী।

আবরার হত্যার পর তাই আমাদের গণহুতাশন শোকের উচ্চারণ না হয়ে, প্রতিবাদের আওয়াজ না হয়ে আমাদের সামষ্টিক ভাঙনের প্রতিধ্বনি হয়ে কি ওঠে না? প্রশ্ন হলো— তাও আমরা বুঝতে পারছি কি না?

আদর্শের চর্চাহীন রাজনীতি পেশিনির্ভর হতে বাধ্য। এই পেশিতে শক্তি জোগায় অর্থ। আর এ দুইয়ের উর্বর ভূমি ক্ষমতা। সুতরাং এমন শক্তিচর্চার আবহে মানবিকতার সংকোচন অনিবার্য। আপনি কি জানেন না, শক্তিমত্তার রাজনীতির যে-কোনো ফরম্যাটই 'খুনি' প্রোডিউস করবে? আর এ খুনিদের হাতে দু-চারটে লাশ পড়বে না, তা তো হয় না। তাই এমন ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতির ক্ষেত্র মাঠ-ঘাট না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তা লাউ-কদুর মতো শব্দগত ফারাক ঘটায় মাত্র; অর্থগতভাবে দুইই সমান অঘটনঘটনপটিয়সী। সুতরাং যেখানেই নীতি-আদর্শের সঙ্গে সম্পর্কহীন রাজনীতি থাকবে, সেখানেই 'খুনি' তৈরি হবে এবং অনিবার্যভাবে আবরারদের লাশও পড়বে।

শুধু প্রতিপক্ষ হওয়ায়, একটু বিরুদ্ধ স্বর চড়ানোয়, এমনকী অভ্যন্তরীণ ঠোকাঠুকির জেরেও কি তৃণমূল থেকে শুরু করে প্রায় সব স্তরেই খুনখারাবি ঘটছে না? এক্ষেত্রে শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মেধাবী ছাত্র আর গ্রামের সাধারণ খেটে খাওয়া নিরক্ষর রাজনৈতিক কর্মী-সমর্থকের মধ্যে বিবেধ-রেখা টানা অনায্য। হত্যার চেয়ে বড় অপরাধ হয় না; হত্যার শিকার মানুষটির সামাজিক অবস্থান বা অন্য কোনও পরিচয়ের তারতম্য এই অপরাধের মাত্রার কিছুমাত্র হেরফের ঘটায় না।

জীবিকা হিসেবে জল্লাদগিরি কারো পছন্দ না-ই হতে পারে, তাই বলে জল্লাদকে 'খুনি' বলার অধিকার তার তৈরি হয় না। রাজনৈতিক ক্ষমতার একচ্ছত্র আধিপত্য যেন তেমন 'বৈধ' জল্লাদই তৈরি করে। নয়তো 'রাজনৈতিক জল্লাদ'দের পুরস্কৃত করার সাক্ষী দেশবাসীকে হতে হতো না। নিরাপদে বিদেশ পাড়ি দেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ থেকে শুরু করে 'ক্ষমা' পাওয়া, এমনকি ক্ষমতার অংশীদার হওয়াও প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে আমজনতাকে। এসব কি 'বাহবা'র ব্যবহারিক প্রয়োগ নয়? এই পটভূমিতে শুধু শিক্ষাঙ্গনের দেড়শ খুনের উদাহরণই যথেষ্ট;এসব ঘটনায় একজনেরও শাস্তি হওয়ার কথা জানা যায় না।

এই দেড়শ খুনের ঘটনার ক্ষেত্র সব আমলেই সমানভাবেই পুষ্ট— সামরিক থেকে ছদ্মবেশী, আংশিক বা পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক আমল, যে আমলের কথাই বলুন সবার আমলনামাই রক্তে ভেজা।

কথা হলো, যে রাজনীতিতে আইন ও অস্ত্র— দুই-ই অনায়াসে করায়ত্ত হয়, সেই রাজনীতির কারবারে সম্রাটদের উত্থান অবশ্যম্ভাবী। তাই একটি-দুটি নয় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করলেও কী এমন পরিবর্তনের সুবাতাস বইবে? সমাজের অন্য সব ক্ষেত্রে তো সেই রাজনীতিই জারি, যে রাজনীতি আবরারদের প্রাণ কেড়ে নেয়।

টুঁটি চেপে ধরার ব্যবহারিক পরিবেশে এর কার্যকারণ নিয়ে কিতাবি বিচার-বিশ্লেষণ বিলকুল অদরকারি। সাঁতারের ওপর পানি নাই। তা সত্ত্বেও জলাশয়ের আয়তনের একটা ধারণা নেওয়া একটা যুক্তি হতে পারে। ভাসমান বঙ্গবাসী জলাশয়ের কোন অংশে হাবুডুবু খাচ্ছে? বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) বলছে, গণমাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪১ দেশের মধ্যে ১২৩তম। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের বিচারে ১৮০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫০তম স্থানে। আর 'নাগরিক নিরাপত্তা' সূচকে ১১৩ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ আছে ১০২তম অবস্থানে।

কাগজে-কলমে প্রমাণিত হওয়াই চূড়ান্ত নয়, সত্যের প্রশ্নে উপলব্ধিই শেষ কথা বলে। যার দম বন্ধ হয়ে আসছে, তাকে অক্সিজেন ঘাটতির কথা না বলে দরকার জানলা-দরজা খুলে দেওয়া।

প্ল্যাকার্ডে লেখার জন্য '১৫১' মোক্ষম সংখ্যাই বটে, কিন্তু আবরার ফাহাদের মা-বাবার বেদনাধরার ক্ষমতা কিন্তু রাখে না গোটা মানচিত্রও। আর এই মানচিত্রের এমাথা-ওমাথা ঢুঁড়েও এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের মা-বাবারা কিছুমাত্র সান্ত্বনাও পেতে পারেন না।

যে রাজনীতি একদিন বুকভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার এই মানচিত্র দিয়েছিল, সেই রাজনীতিই আজ মানচিত্র-উপচানো দমবন্ধের কারণ!