কঠিন রাষ্ট্র নয়, প্রয়োজন কার্যকরী আইন

স্বদেশ রায়
Published : 31 Jan 2019, 09:10 AM
Updated : 31 Jan 2019, 09:10 AM

কঠিন রাষ্ট্র এবং তার পরিণতির সঙ্গে আমরা কম-বেশি পরিচিত। আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসে দুর্নীতির দায়ে একের পর এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়েছিলেন। এছাড়া তার পূর্ববর্তী সরকার অর্থাৎ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত পাকিস্তানের কেন্দ্রে ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারকে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার হিসেবে পরিচিত করার চেষ্টাও করেছিল। দুর্নীতির আঁচড় দেয়ার চেষ্টা করেছিল বঙ্গবন্ধুর নেতা, তৎকালীন উপমহাদেশের অন্যতম নেতা হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীর ওপর। এমনকি দুর্নীতির আঁচড় দেয়ার চেষ্টা করেছিল ওই সময়ে হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীর সব থেকে স্নেহধন্য নেতা সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে, অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকে তারা দুর্নীতিগ্রস্ত মন্ত্রী বলে অভিযোগ করেছিল।

কিছুদিন পরে ওই আইয়ুব খানের শাসন যে দুর্নীতি ও শোষণের শাসনে পরিণত হয়েছিল তা সকলে জানি। আইয়ুবের পরে ইয়াহিয়া ক্ষমতা নেয়ার পরে সেই বিখ্যাত 'থ্রি নট থ্রি' দুর্নীতির অভিযানের কথাও সকলের জানা। বাংলাদেশ হওয়ার পরে এদেশের দুর্ভাগ্য, এখানেও আইয়ুব খানের প্রেতাত্মারা অর্থাৎ জিয়া ও এরশাদ ক্ষমতা দখল করে। আবার সেই সামরিক শাসন। আবার জিয়ার সেই রাস্তায় হাঁটা, এমন কি সৈয়দ নজরুল ইসলামের মতো জাতীয় নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা। মার্শাল কোর্টে একের পর এক আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার কোনটাই প্রমাণ করতে পারেনি। বরং কিছুদিন যেতেই দেখা গেল কীভাবে এদেশে ঋণ খেলাপী তৈরি করা হচ্ছে।

মূলত জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশে ব্যাংক ওপেন করে দেয় দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের জন্য। অন্যদিকে তার সব থেকে বড় দুর্নীতি পানির দামে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কলকারখানাগুলো ব্যক্তির কাছে বিক্রি করা। একদিকে তিনি যেমন রাষ্ট্রের সম্পদ পানির দামে ব্যক্তির কাছে দিয়ে দিলেন, অন্যদিকে জিয়াই এদেশে ঋণ খেলাপী কালচার তৈরি করেন- যা থেকে দেশ এখনও বের হতে পারছে না। এরশাদ ক্ষমতা দখল করে সাইকেলে চড়ে অফিসে গিয়ে চমক দেখালেন। অর্থাৎ সেই সামরিক সরকারের কালচারের ধারাবাহিকতা। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই দেশ দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। দেশ এমন অবস্থায় যায় যে, 'সচিবালয় সুন্দরী' বলে খ্যাত একটি নারী শ্রেণি এদেশে দাঁড়িয়ে যায়। আইয়ুব, ইয়াহিয়া, জিয়া ও এরশাদের ধারাবাহিকতা আবার দেখা গিয়েছিল ১/১১ এর আধা সামরিক শাসনের সময়। আবার প্রথমে সেই কঠোর শাসন। তার পরে দুর্নীতির ভেতরে চলে যাওয়া।

বার বার এই কঠোর শাসনের দুর্নীতি দমনের প্রহসনে প্রবেশ করার ফলে দেশ একটি জটিল অবস্থায় চলে যায়। গত দশ বছরের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা, বিশেষ করে শেখ হাসিনার উন্নয়নের পথে যাত্রার পরেও দেশ ওই জটিল অবস্থা থেকে শতভাগ বের হয়ে আসতে পারেনি। তবে দেশ যে সেখান থেকে বের হয়ে আসছে, তার প্রমাণ দেশে উন্নয়ন হচ্ছে। উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বাজারে এক ধরনের অর্থের প্রবাহ হচ্ছে। ওই প্রবাহ শতভাগ সঠিক পথে হচ্ছে সে দাবি মনে হয় সরকারও করে না। তার পরেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশকে ধীরে ধীরে দুর্নীতিমুক্ত ও উন্নত দেশ করতে হলে ওই পদক্ষেপে লক্ষ্য করতে হবে যেন কোনও সামরিক সরকারের চমক না থাকে। অর্থাৎ সাইকেল চড়া বা অফিসে হানা দেয়া এসব চমকে কখনও দুর্নীতি দূর হয় না, আবার রাষ্ট্রও সুস্থ পথে যায় না। দুর্নীতি মুক্ত করার পথ যাত্রায় প্রথমে প্রয়োজন জিরো টলারেন্স। আর সেই জিরো টলারেন্স কোনও গায়ের জোরে বা ক্ষমতার জোরে নয়। বরং আইনের শাসনের দ্বারা। প্রতিটি মুহূর্তে প্রতিটি কাজকে এমন নিয়মের ছকে করা প্রয়োজন, যাতে সেখানে দুর্নীতির মাত্রা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব হয়। যেমন, এই প্রথম বার চল্লিশ হাজার শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে যারা এসএমএসের মাধ্যমে জানতে পেরেছেন তারা চাকরি পেয়েছেন। এখানে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেয়া মেধা তালিকার মাধ্যমে করা হয়েছে।

কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে শতভাগ না হলেও সর্বোচ্চ স্বচ্ছতার মাধ্যমে হয়েছে বলে সকলে মনে করছে। এমনিভাবে প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে নিয়ম খোঁজা দরকার, যে নিয়মের মাধ্যমে দুর্নীতি কমানো যাবে। সরকারকে, সরকারের নীতি নির্ধারকদের সর্বোচ্চ মনোযোগী হতে হবে, প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে এই নিয়ম ও প্রয়োগ কতটা স্বচ্ছভাবে করা যায়, আর তার মাধ্যমে প্রতিটি কাজ কতটা স্বচ্ছ হয়, সেই বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া। অনেক ক্ষেত্রে সে জন্য অন্য দেশের উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিতে হবে, তৈরি করতে হবে নতুন নতুন বিধি। মাঠে ছোটাছুটির চেয়ে এই টেবিলওর্য়াকে জোর দিলেই সব থেকে বেশি সুফল মিলবে বলে মনে হয়। আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে কঠোরের বদলে যত বেশি নিয়মের রাষ্ট্র তৈরি করা হবে, সে নিয়ম যতটা জনগণের জন্য সুবিধাজনক হবে, ততই সুফল মিলবে।

যেমন, সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বলেছেন, তিনি ব্যক্তি পর্যায়ে করের হার কমিয়ে করের আওতা বাড়াবেন। অর্থাৎ কর আদায়ের ক্ষেত্রে তিনি কোনও কঠোর পথে না গিয়ে নিয়মের ভেতর দিয়ে সুফল খোঁজার চেষ্টা করছেন। এটাই কিন্তু প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দুর্নীতি কমিয়ে সফলতা পাবার প্রকৃত পথ। বাস্তবে একজন করদাতাকে রাষ্ট্রের যে পরিমাণ সুযোগ-সুবিধা দেয়া উচিত আমাদের দেশে করদাতা সেটা পান না। তাই তার সুযোগের অংশটুকু যদি ছাড় দেয়া হয় অর্থাৎ করের হার কমানো হয় তাহলে সে কর দিতে আরও বেশি উৎসাহী হবে। যখন কর প্রদান কোনও ব্যক্তির ওপর জুলুমের মতো হবে না তখন আর সে কর ফাঁকি দেয়ার কোনও ফাঁক-ফোকর খুঁজবে না। অন্যদিকে বর্তমানে যারা কর দেন তাদের থেকেও অনেক বেশি আয় রোজগার করেন এমন অনেক শ্রেণি এখনও করের আওতার বাইরে। বিশেষ করে আমাদের দেশে কর প্রদান এখনও শহরকেন্দ্রিক। এটাকে গ্রাম পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। বাস্তবে কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে করের আওতা বাড়ানো দরকার সেটা নিয়ে একটা স্টাডি করে তবেই পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি মানুষ যদি দেখতে পায় বা বুঝতে পারে সে একটা সহনীয় পর্যায়ের কর দিয়ে রাষ্ট্রের কাছ থেকে যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে, ওই মানুষটি অবশ্যই কর দিতে উৎসাহী হবে।

আর কর আদায় বেশি হলে দেশের অর্থনীতি যে মজবুত হবে, বাজেটের আকার বাড়বে এ নিয়ে বলার কোন অবকাশ থাকে না। তাই স্বাভাবিকভাবে অর্থমন্ত্রীর এ কথা শোনার পরে দেশ তাকিয়ে আছে নতুন করনীতিমালার দিকে। আগামীতে করের আওতা বাড়িয়ে, করের হার কমিয়ে নিশ্চয়ই অধিক স্মার্ট একটি করনীতি আসছে। বাস্তবে করনীতি যত বেশি স্মার্ট হবে ততই কর আদায়ে দুর্নীতি কমবে। আদায় বাড়বে। জবরদস্তি যেমন কর আদায় বাড়ায় না তেমনি দুর্নীতিও কমায় না। মানুষের ভেতর তার দেশ ও রাষ্ট্রের প্রতি গভীর টান বা ভালবাসা তৈরি করাই করনীতির অন্যতম একটি দিক। মানুষ যেন মনে করতে পারে সে এই কর দেবার ফলে রাষ্ট্রের কাছ থেকে অনেক বেশি সুবিধা পাবে। যেমন, আমাদের সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। সিনিয়র সিটিজেনের দেখাশোনার জন্য তার পরিবার খুব বেশি কাছে থাকতে পারছে না। তাই যৌবনে কর দেয়ার ফসল হিসেবে রাষ্ট্র সিনিয়র সিটিজেনের পাশে থাকবে এটা যখন একজন মানুষ উপলব্ধি করতে পারবে, তখন সে তার সাধ্যমতো কর রাষ্ট্রকে দেবে। আর এক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীর উপলব্ধিই সঠিক, করের হার কমাতে হবে, যাতে মানুষ কর দিতে উৎসাহী হয়।

অন্যদিকে সম্প্রতি ব্যাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ শ্রেণিকরণের নিয়ম ঘোষণা করেছে। 'মন্দ', 'ভাল', 'খুব ভাল' এমনি কতগুলো শ্রেণি তারা ঘোষণা করেছে। তাদের ওই নিয়মের ভেতর একটি কঠোরতা ও তাড়াহুড়োর বিষয় আছে বলে মনে হয়। অর্থমন্ত্রী নিজে একজন শিল্পপতি, তিনি একজন বিনিয়োগকারী। তাই কাগজে কলমে ছাড়াও বাস্তব অভিজ্ঞতা তার অনেক বেশি। বিষয়টির দিকে তাই তাকে বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়েই নজর দিতে হবে। কারণ, শুধু ঋণ আদায়ের জন্য কিন্তু ঋণ প্রদান না এবং ব্যাংক ব্যবস্থাও না। যে কোনও মন্দ ঋণ ব্যাংককে আদায় করতে হবে ঠিকই, তবে সঙ্গে সঙ্গে দেশের শিল্প উৎপাদন ও বিনিয়োগ বাড়ানোও ঋণের মূল উদ্দেশ্য হতে হবে। অতীতের নানা কারণে অনেক মন্দ ঋণ হয়েছে। এই কালচার থেকে দেশ বেরিয়ে আসুক দেশের মানুষ এটা শতভাগ চায়।

তবে অর্থমন্ত্রী নিশ্চয় তার বিনিয়োগের বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে যাচাই করে দেখবেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের, এই ঋণ শ্রেণিকরণ নীতি কতটা বিনিয়োগবান্ধব? নতুন বিনিয়োগকারী বাড়ার সুযোগ আছে কিনা এখানে? বা বিনিয়োগকারীদের টিকে থাকার পথে কতটা সহায়ক! আবার এই কঠোরতার ফাঁকফোকর গলিয়ে যেন কেবল কিছু ব্যাংক মালিকই সব সুযোগ কুক্ষিগত না করে, সেটাও দেখতে হবে। কারণ, বিদেশি বিনিয়োগ যেমন প্রয়োজন তেমনি এটাও মানতে হবে অর্থনীতি মূলত শক্তিশালী হয় দেশের বিনিয়োগকারীরা যত বড় হয় তার ওপর। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে অনেক বড় বড় নতুন দেশীয় বিনিয়োগকারী সৃষ্টি হওয়ার পথ খুলতে হবে। কারণ, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ আকারে যতই ছোট হোক আগামী ২৫ বছরে অনেক বড় অর্থনীতির দেশ হওয়ার সুযোগ রয়েছে।