লংগদু সহিংসতা: আধিপত্যবাদের বহিঃপ্রকাশ

Published : 23 June 2017, 05:20 AM
Updated : 23 June 2017, 05:20 AM

পাহাড়ে রমেল চাকমার হত্যাকাণ্ড নিয়ে যখন দেশ-বিদেশে হইচই শুরু হল তখন পাহাড়ের ভাবনাকেন্দ্র এবং বিখ্যাত বৌদ্ধ বিহার নিয়ে মিথ্যাচার শুরু হল। সেই মিথ্যাচারে গৌতম বুদ্ধকেও ছাড় দেওয়া হয়নি।

রমেল চাকমার হত্যাকাণ্ড নিয়ে যে প্রতিবাদ তৈরি হয়েছিল তার কিছুটা ভাটা পড়ার কারণ হল মিথ্যাচারে পূর্ণ প্রতিবেদন। এরই মধ্যে ঘটে গেল লংগদু সহিংসতা। এরপর এই সহিংসতা নিয়ে হইচই শুরু হল। এবার আগের দুটি ঘটনার প্রতিবাদ অনেকটা নিষ্প্রাণ হয়ে গেল। কদিন যেতে না যেতেই আবার পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটল।

পাহাড় ধসের সর্বশেষ এই মর্মান্তিক ঘটনায় অনেক সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অনেকে। নিহত ও আহতের মধ্যে সেনাসদস্যও রয়েছেন। নিহত সবার পারলৌকিক সদগতি কামনা করছি এবং শোকাহত পরিবারগুলোর প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি।

পৃথিবীর বুকে রাতের অন্ধকার নামবে আবার সেই অন্ধকার ভেদ করে ভোর হবে, প্রভাতের সূর্য উদিত হবে– এটাই জগতের বিধান। সুখ-দুঃখ, উত্থান-পতন, আনন্দ-বেদনার মিশেলে এই তো মানবজীবন।

বাংলাদেশি বৌদ্ধদের সিংহভাগ বাস করেন পার্বত্য চট্রগ্রামে। তারা 'আদিবাসী' বা 'পাহাড়ি' নামে পরিচিত। দীর্ঘ একটা সময় গেছে যখন সমতল এবং পাহাড়ি বৌদ্ধদের মধ্যে তেমন একটা যোগাযোগ ছিল না। পরে বান্দবানে এবং রাঙামাটিতে দুই ধর্মগুরু আবির্ভূত হলে তাদের বদৌলতে সমতলের বৌদ্ধরা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণের সুবাদে পাহাড়ে যাওয়া-আসা শুরু করেন। বর্তমান এই যোগাযোগ আরও উন্নতি করেছে বলা যায়।

যোগাযোগ না থাকায় সমতলের বৌদ্ধরা পাহাড়ি বৌদ্ধদের জীবনধারা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে তেমন কিছু জানতেন না। পাহাড়ি বৌদ্ধরাও সমতলের বৌদ্ধদের সঙ্গে তেমন একটা মিশতেন না। এই দূরত্বের অনেক কারণের মধ্যে প্রধান কারণটি হল ভাষাগত বৈচিত্রতা। সমতলের বৌদ্ধরা বাংলা ভাষাভাষী। কিন্তু পাহাড়ের বৌদ্ধদের নিজস্ব মাতৃভাষা আছে। তবে আধুনিক এই সমাজব্যবস্থায় পাহাড়িদের অনেকে এখন বাংলা জানেন। এ কথাও সত্য যে, বর্তমানে পাহাড়ে ধর্মান্তর বেড়ে গেছে। বিশেষ করে অভাব-অনটন এবং শিক্ষায় অনগ্রসরতার কারণে পাহাড়ে খ্রিস্টান মিশনারিগুলো সক্রিয় রয়েছে।

মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের জন্মগত অধিকার। আমাদের দেশের সংবিধানও সব নাগরিককে এই অধিকার দিয়েছে। তবে সংবিধানে আদিবাসী বা পাহাড়িদের 'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী' উল্লেখ করায় পাহাড়িদের ঘোর আপত্তি রয়েছে। পাহাড়িদের দাবি হল তারা বংশ পরম্পরায় এ দেশের পাহাড়ি নাগরিক। তাদের নাগরিক পরিচয়ে 'আদিবাসী' বা 'পাহাড়ি' না বলে 'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী' বলার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

জাতি, ধর্ম ও ভাষা বৈচিত্র্যের এই দেশে নাগরিক হিসেবে সবাই বাংলাদেশি হলেও জাতি হিসেবে সবাইকে বাঙালি হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তবে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বসবাসরত সব বৈধ নাগরিককে এ দেশের প্রচলিত আইনকানুন মেনে চলতে হবে। দেশের জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধাবোধ এবং দেশের প্রতি প্রেম থাকতে হবে। এটাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

'বাঙালি' কথাটি নিয়ে অনেকের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি আছে। অনেকে মনে করেন যে, বাঙালি মানে মুসলমান। আসলে তা নয়। বাংলা ভাষাভাষী এ দেশের জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সবাই বাঙালি জাতির অন্তর্ভুক্ত।

জাতির পিতা ৭ মার্চের তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণেও এ কথাটি বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন:

"হিন্দু-মুসলমান, পাহাড়ি-বাঙালি আমরা সবাই ভাই ভাই।"

অর্থ্যাৎ তিনিও স্বীকার করেছেন যে, এই ভূখন্ডে নানান ভাষা এবং সংস্কৃতির মানুষ ছিল, আছে এবং থাকবে। তাদের সবাইকে বাঙালি বলা যায় না। পাহাড়িরাও জাতির পিতার কথা রেখেছিলেন। পাহাড়িদের অনেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন এবং সমতলের অনেক মুক্তিযোদ্ধা পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

অনেকে বলে বেড়ান পাহাড়িদের অনেকে বাংলাদেশ চাননি। সম্প্রতি রাজা ত্রিদিপ রায় সম্পর্কে আদালত রায় দিয়েছেন যে, তার নামে কোনো স্থাপনা রাখা যাবে না। কারণ মাননীয় আদালত প্রমাণ পেয়েছেন যে রাজা ত্রিদিপ রায় বাংলাদেশ চাননি। মহামান্য আদালতের এই রায় যথার্থ বলে মনে করি।

এ দেশে অনেক বাঙালি আছেন যারা আদৌ বাংলাদেশ চাননি। তাদের মধ্যে অনেকে সরাসরি যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়েন। উদার এবং স্বাধীন বাংলাদেশ যারা চাননি তাদের সনাক্ত করে তাদের বিচার করার উদ্যোগ নেয়নি। যারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলেমিশে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে বাংলাদেশ কেবল তাদের বিচার করছে।

তিন পার্বত্য জেলাসহ ৬৪ জেলার আমাদের এই বাংলাদেশ। কিন্তু এ কথা সত্য যে, পাহাড়িদের জন্য পার্বত্য এই তিন জেলাই যেন বাংলাদেশ। ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, পরিবেশ এবং জীবনধারার প্রশ্নে তারা পাহাড় ভিন্ন অন্য কোনো স্থানের কথা ভাবতেই পারেন না। বংশ পরম্পরায় পাহাড়িরা পার্বত্য অঞ্চলের সঙ্গে নিজেদের এমনভাবে মানিয়ে নিয়েছেন যে, পাহাড়ে থাকতে না পারলে তারা সোজা দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন।

তবে এটা পরিষ্কার যে, পাহাড়ি অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চল এখন আর পাহাড়ি অধ্যুষিত নেই। দমন-পীড়ন, সাম্প্রদায়িক হামলা এবং ভূমির অধিকার হারিয়ে পাহাড়িরা দ্রুত দেশ ত্যাগ করছেন। এই অবস্থা চলতে থাকলে পার্বত্য অঞ্চল পাহাড়িশূন্য হতে বেশি সময় লাগবে না।

পাহাড়ে অশান্তির মূলে রয়েছে ভূমি বিরোধ। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি না হলে সমস্যার স্থায়ী সমাধানও হবে না। পাহাড়িরা বলছেন, পাহাড়ে পুনর্বাসিত বাঙালিদের পাহাড় থেকে সরিয়ে আনতে হবে। বাঙালিরা বলছেন, আমরা ভূমির সম-অধিকার চাই। এই দুয়ের মাঝখানে রাষ্ট্রের অবস্থান।

পাহাড়ে কিংবা সমতলে যে যেখানেই থাকুক না কেন সব নাগরিকের বসবাসের আশ্রয় নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু জোরপূর্বক, সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়ভাবে পাহাড়ে দুটি সম্প্রদায়কে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার পরিণতি কখনও ভালো হয়নি। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জেনারেল জিয়াউর রহমান যে উদ্দেশেই এই কাজটি করে থাকুন না কেন এর ফলে আজ পাহাড়ি-বাঙালি কেউ ভালো নেই।

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের মতে,

"পার্বত্য চট্রগ্রামে দীর্ঘকাল স্বাভাবিকভাবেই বাঙালিরা গেছে, বসত গেড়েছে। কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু ৭০ দশকের শেষে জাতিগত শাসনের পদ্ধতি হিসেবে যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অর্থ, জমি ও কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গরিব বাঙালিদের পার্বত্য চট্রগ্রামে নিয়ে যাওয়া হল, তখনই জটিলতা শুরু হল। গরিব বাঙালিদের ঢাল বানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হল নিপীড়ন, সহিংসতা ও জাতিগত বিদ্বেষের আরেক পর্ব। প্রকৃতপক্ষে গরিব বাঙালিদের জীবনও নিরাপদ হয়নি।"

('প্রথম আলো', ১২ জুন ২০১৭)

পাহাড়ে যে রক্তাক্ত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল সেই পরিস্থিতি দীর্ঘ সময় পরে ১৯৯৭ সালে বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে 'পার্বত্য শান্তি চুক্তি'র মাধ্যমে বন্ধ হল। এই চুক্তি নিয়ে যথেষ্ট মত-দ্বিমত আছে, আছে জোরালো তর্ক-বিতর্ক। চুক্তির বাস্তবায়নে বিলম্ব হওয়ায় এই তর্ক-বিতর্ক আরও গতি পাচ্ছে। কিন্তু আমি বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখি।

চুক্তির প্রথম অর্জন হল পাহাড়ি, বাঙালি ও সৈনিকদের মধ্যে সৃষ্ট রক্তপাতের ধারা বন্ধ হওয়া। এটা খুব জরুরি ছিল। কারণ জগতে কেউ অমর নয়। যার যা কিছু আছে তা সবকিছু ছেড়ে একদিন সবাইকে বিদায় নিতে হবে। কষ্টে, রক্তে ও যুদ্ধে অর্জিত কোনো সম্পদ সঙ্গে যাবে না।

যে ভূমির জন্য এত রক্তপাত আজ সেই ভূমির নিচে চাপা পড়ে অনেক পাহাড়ি, বাঙালি ও সৈনিক মারা গেলেন। অথচ তাদের সঙ্গে এক টুকরা ভূমি বা জমিও গেল না।

পাহাড়ে বসবাসরত পাহাড়ি-বাঙালিদের উচিত হবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে নিজ নিজ দাবি আদায়ে গুরুত্বারোপ করা। কেউ যাতে তাদের নিয়ে খেলতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখা। অন্যথায় পাহাড়িদের পার্বত্য শান্তি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের দাবি এবং বাঙালিদের ভূমির সম-অধিকারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে। এতে পাহাড়ে অশান্তি জিইয়ে থাকবে।

যে কোনো স্থানে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ একত্রে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে হলে প্রয়োজন পারস্পরিক সম্প্রীতি, আস্থা, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধ। আস্থার এই পরিবেশ তৈরি করা না গেলে রাঙামাটির লংগদুতে সাম্প্রদায়িক যে সহিংসতা চালানো হল– এমন ভয়ংকর পরিস্থিতি যে কোনো সময় যে কোনো স্থানে তৈরি হতে পারে।

১৯৮৯ সালে যে লংগদুতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হয়েছিল ঠিক একইভাবে ২০১৭ সালে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল। পাহাড়ে বিশেষ করে বাঙালি পুনর্বাসন করার পর থেকে অনেকবার সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে। লংগদুর ঘটনা একমাত্র ঘটনা নয়। এসব ঘটনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন অজুহাত দেখালেও আদতে যুক্তিগ্রাহ্য ও গ্রহণযোগ্য কোনো কারণ ছিল না। এবারের ঘটনা যে অভিযোগ তুলে ঘটানো হয়েছে তা হল স্থানীয় এক বাঙালিকে হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে।

শুরু থেকে বাঙালিদের অভিযোগ ছিল নয়ন নামের ওই ব্যক্তিকে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছে। পরে সেটা প্রমাণিতও হয়েছে। তবে তা কেবল নয়নের মটরবাইক ছিনতাইকে কেন্দ্র করে হয়েছে বলে পুলিশের ভাষ্য। নুরুল ইসলাম নয়নকে যারা হত্যা করেছে তারা অবশ্যই জঘন্য অপরাধী। এই অপরাধের ন্যায়বিচার হতে হবে।

তবে কোনো মুসলিমকে পাহাড়িদের কেউ হত্যা করেছে বলে কি এর প্রতিবাদ এভাবে হতে হবে? প্রতিবাদে পাহাড়িদের শত শত ঘরবাড়ি লুটপাট এবং জ্বালিয়ে দিতে হবে? একটা অপরাধের প্রতিবাদ করতে গিয়ে এত বড় একটা ঘটনা ঘটানোর আদৌ কি প্রয়োজন ছিল? না এর কোনো যৌক্তিকতা আছে? এই ঘটনার প্রতিবাদ এবং প্রতিক্রিয়া যদি এভাবেই হতে হয় তাহলে সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আইন আদালতের প্রয়োজন কি? ২০১২ সালে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে ঠিক এভাবে রামু সহিংসতা ঘটিয়ে আমাদের নিঃস্ব করা হয়েছিল।

একদল লোক কোনো না কোনো অজুহাত তুলে ভিন্ন মতাদর্শের এবং সম্প্রদায়ের উপর হামলা করবে, লুটপাট করবে, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেবে, তারপর এটা নিয়ে রাজনীতি করা হবে। রাষ্ট্র, সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কেউ এর দায় স্বীকার করবে না, এটা কোন ধরনের কথা!

পাহাড়ে কিংবা সমতলে আজ পর্যন্ত যত সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটেছে সব ঘটনার ক্ষেত্রে একই আচরণ করা হয়েছে। লংগদুর ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা প্রশাসন দায় এড়াতে পারে না। কারণ নয়নের লাশ উদ্ধারের পরের দিন এই ঘটনা ঘটেছে।

পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে যেহেতু সম্পর্ক ভালো নেই, তাই এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটতে পারে– এটা তো না বোঝার কথা নয়। তাছাড়া ১৯৮৯ সালে ঠিক একইভাবে লংগদু সহিংসতা ঘটানো হয়েছিল। তাহলে শত শত বিক্ষুব্ধ মানুষকে কেন মিছিল করার সুযোগ দেওয়া হল? সুযোগ দিয়ে পাহাড়িদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হল না কেন?

লংগদুর ঘটনার ক্ষেত্রে আমরা একটা বিষয় লক্ষ্য করছি যে, কতিপয় গণমাধ্যম এবং ব্যক্তি এটাই বেশি বলতে চাইছেন যে, নয়ন হত্যাকাণ্ড না ঘটলে এই ঘটনা ঘটত না। অর্থাৎ নয়ন হত্যাকাণ্ডের কারণে এই ঘটনা ঘটা অনিবার্য ছিল। এটা কেমন বিচার! দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে প্রতিনিয়ত হত্যা, ধর্ষণ, চাদাবাজিসহ নানান অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে কি নিজেদের মধ্যে লংগদু সহিংসতার মতো ঘটনা ঘটে? এটা কি ধর্ম, মানবতা এবং বিবেকের সঙ্গে যায়? তাই এটা হল আধিপত্যবাদের বহিঃপ্রকাশ।

রামু, নাসিরনগর, গোবিন্দগঞ্জ, লংগদু সহিংসতাসহ একের পর এক সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটে চলেছে। যে ঘটনায় জনগণের চাপ থাকে সেটা নিয়ে কিছু দিন হইচই হয়। তারপর নতুন কোনো ঘটনা ঘটে। রাতের আঁধারে কিংবা দিবালোকে ঘটা এসব সাম্প্রদায়িক হামলার ইন্দনদাতা, পরিকল্পনাকারী, হামলাকারী ও প্রশ্রয়দাতাদের কেউ ধরা পড়ে না। এসব ঘটনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র আজ পর্যন্ত কোনো দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারেনি। অথচ এসব সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ক্ষেত্রে কোনো দল-মত কাজ করে না। এখানে মুখ্য হয়ে যায় ধর্ম ও সম্প্রদায়।

'ওরা হিন্দু', 'ওরা বৌদ্ধ', 'আমরা মুসলিম', 'ওরা পাহাড়ি', 'আমরা বাঙালি'– এই মনোভাব থেকেই এসব সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় মানুষ হামলে পড়ে।

এসব কথা অনেকের খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু এটাই বাস্তবতা। অত্যন্ত দুঃখজনক হল, যে জাতি যাবতীয় শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন ও অত্যাচার থেকে মুক্তিলাভের জন্য বীরের মতো যুদ্ধ করে রক্তের বিনিময়ে এই দেশ স্বাধীন করেছেন, সেই আমাদের একই জাতির কিছু মানুষ স্বাধীন দেশে একই অপরাধ করছেন। আর এসব মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রতিরোধে রাষ্ট্র কার্যকর ও স্থায়ী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না।

একটা ঘর পুড়ে যাওয়া মানে একটি সাজানো সংসার ছারখার হয়ে যাওয়া। পুড়িয়ে দেওয়া একটা ঘর হয়তো পুনরায় নির্মাণ করা যায়, কিন্তু ছারখার করে দেওয়া একটা সংসার আদৌ গোছানো যায় না। একটা সংসারে কত কিনা থাকে এসব কি আর ফিরে পাওয়া যায়? তিলে তিলে মায়া-মমতায় গড়ে তোলা সংসার হারিয়ে বুকে পাথর চেপে ভয় আর অবিশ্বাস নিয়ে বাঁচার যন্ত্রনা কি তারা বোঝেন?

লংগদুতে পুড়িয়ে দেওয়া সব ঘরবাড়ি, দোকান, বৌদ্ধ বিহার পুনর্নির্মাণের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তরা যাতে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারেন সেজন্য তাদের প্রয়োজনীয় অর্থ সহযোগিতা দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি সেখানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশ ও ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষ থেকে যেসব মামলা করা হয়েছে সেসব মামলায় নির্দোষ কোনো বাঙালি যাতে হয়রানির শিকার না হন, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এই ঘটনাকে যাতে রাজনৈতিক এবং দলীয়করণ করতে না পারে সেদিকে ক্ষতিগ্রস্তদের সজাগ থাকতে হবে। নিজেদের মধ্যে কিছু সুবিধাভোগী তথাকথিত নেতা থাকেন তারা যাতে কোনোমতেই প্রশ্রয় না পান সেটাও গুরুত্ব দিতে হবে।

অন্যথায় লংগদু সহিংসতার আদৌ কোনো সুবিচার হবে না যেমন হয়নি রামু সহিংসতার বিচার।