ঝলমলিয়া: বাঙালির জীবনসংগ্রাম ও বিশ্বাসের মেলবন্ধনের প্রামাণ্যচিত্র

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 8 Dec 2016, 05:17 AM
Updated : 8 Dec 2016, 05:17 AM

২০০৯ সালের শীতকাল। ঢাকা থেকে খুব সকালে রওয়ানা হয়ে সিনেমা-পাগল কয়েকজন যুবক-যুবতী যখন খুলনার বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার হুড়কা গ্রামে উপস্থিত হয়, তখন সেখানে সন্ধ্যা নেমে গেছে। নৌকা থেকে নেমে, গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরে চায়ের সন্ধানে তারা উপস্থিত হয় কাছাকাছি এক বাজারে। সেখানে এক চায়ের দোকানে স্থানীয় এক বৃদ্ধ কানাইলাল বিশ্বাসের মুখে তারা শুনে 'ঝলমলিয়া' নামে এক দীঘি ঘিরে হুড়কা গ্রামের উৎপত্তি ও বিকাশের কাহিনি। এই কাহিনি দিয়ে শুরু হয় সাইফুল ওয়াদুদ হেলালের প্রামাণ্যচিত্র: 'ঝলমলিয়া'

আজ থেকে শ দুই-তিনেক বছর আগে পাঁচ ঘর হিন্দু এবং এক ঘর মুসলমান অবিভক্ত বাংলার উত্তর দিকের কোনো এক স্থান থেকে এসে পৌঁছেছিল বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী এই এলাকায়। ঘন জঙ্গলে ঢাকা ছিল তখন পুরো এলাকা। 'গাছের মগডাল বেয়ে এসেছিল আমাদের পূর্বপুরুষ!'

বলতে বলতে শ্রী বিশ্বাসের মিডিয়াম শট ছেড়ে বটগাছের ঘনবুনটের শিকড় আর পত্রালির উপর ক্লোজশটে টিল্ট আপ হতে থাকে হেলালের ক্যামেরা। 'গাছের উপর দিয়ে কেন?' হেলাল প্রশ্ন করে।

'নিচে তো বাঘ!'

শ্রী বিশ্বাসের চটজলদি উত্তর শুনে মনে হয়, এলাকাটি তখনও সুন্দরবনের অংশ ছিল। বাঘের আক্রমণ ঠেকিয়ে, বড় বড় গাছ কেটে, ছোটো ছোটো ঝোপঝাড় আগুনে পুড়িয়ে সামনে এগুতে এগুতে সেই ছয় ঘর পূর্বপুরুষের চোখে পড়ে বিশাল এক দীঘি– দিনের রোদ আর রাতের জ্যোৎস্নায় যার পরিষ্কার টলমলে জল ঝলমল করছে। এরপর কখন যে এই দীঘির নাম হয়ে গিয়েছিল 'ঝলমলিয়া' এবং এর অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবে আবির্ভূতা হয়েছিলেন দেবী ঝলমলেশ্বরী তা কেউ বলতে পারে না।

দীঘিটি বেশ বড়। পাড়ের ঝুরি-নামানো বটগাছের গোড়া থেকে শুরু হয়ে পানি পর্যন্ত নেমে গেছে শানবাঁধানো সিঁড়ি। পুরো দীঘি জুড়ে ফুটে আছে হাজার হাজার লাল শাপলা। বৃষ্টিতে, সকালের কাঁচা রোদে এবং ঝিরিঝিরি বাতাসে দুলতে থাকা জাতীয় ফুলের এই দৃশ্য চমৎকার লাগে দেখতে। বটগাছের নিচে বসার জন্যে পাকা রোয়াক আছে। হুড়কা গ্রামের বৌ-ঝিরা জল নিতে এসে সেখানে দুদণ্ড বসে যায়। বটের ছায়ায় পরস্পর সুখ-দুঃখের আলাপ করে মনে চেপে রাখা কষ্ট ও দুঃখ দূর করে তারা। ধর্মীয় গান করে কেউ, কেউ-বা হয়তো একটা বই থেকে পড়ে শোনায়।

ঝলমলিয়ার তিনদিকে হিন্দু আর একদিকে মুসলমান জনবসতি। চারপাশের বাড়ির মেয়ে-বউদের দিনে অন্তত একবার ঝলমলিয়ার ঘাটে এসে বসতেই হয়। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবার বিশ্বাস, ঝলমলিয়ার ঘাটে এসে বসলে মা ঝলমলেশ্বরীর আশীর্বাদে তাদের মনে অপার শান্তি আসে।

হুড়কা ও আশেপাশের গ্রামগুলোর জন্যে ঝলমলিয়া সুপেয় জলের অন্যতম উৎস। ঝলমলিয়ার জল ছাড়া অন্য কোনো উৎসের জল তাদের অনেকের পেটে হজম হয় না। 'বাপের বাড়িতে গেলে আমার তো পেট খারাপ হবিই!' বললেন এক মহিলা।

প্রতিদিন এই পানি ড্রামে-কলসে ভরে ভ্যানে-নৌকায় চাপিয়ে বহু মানুষের ঘরে পৌঁছে দিয়ে জীবন ধারণ করছে এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা। দূরের গ্রামের কিশোরীরা কচি পায়ে তপ্ত মাটির সেঁকা খেয়ে আর সাগরের নোনা জল সাঁতড়ে কলস আর প্লাস্টিক কনটেইনারে করে দিনে কয়েক বার এই জল বহু কষ্টে নিজ নিজ বাড়িতে বয়ে নিয়ে যায়।

একবার কোথা থেকে এক লোক এসে নাকি সারাদিন ঝলমলিয়ায় ডুবে ছিল। ডুব দিয়ে দীঘির এপার থেকে ওপারে যেতে গিয়ে সে নাকি জলের তলায় দেখেছিল সুড়কিবাঁধানো এক রাস্তা। রাস্তাটি শেষ হয়েছে এক মন্দিরের প্রবেশদ্বারে। দিঘীর পাড়ে ঝলমলিয়া দেবীর কোনো মূর্তি বা মন্দির নেই। সেই ক্ষতি পূরণ করতেই হয়তো কালক্রমে সৃষ্টি হয়েছে এই রূপকথার। জাতক-মহাভারতের আমল থেকে নদী, দীঘি বা বৃক্ষের অধিষ্ঠাত্রী দেবদেবীর কথা আমরা শুনে আসছি। ঝলমলিয়া সেই সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের স্মারক।

তবে একটি কারণে ঝলমলিয়া অনন্যতার দাবি করতে পারে। অধিষ্ঠাত্রী দেবীর নামে গঙ্গা, পদ্মা, যমুনা, সরস্বতী, কাবেরি ইত্যাদি বড় বড় নদীর নাম হয়ে থাকে। কিন্তু সামান্য একটি দীঘিরও দেবতা হয়ে ওঠা চমৎকার ঘটনা বটে। বাংলাদেশে এমন দীঘি হয়তো আর দ্বিতীয়টি নেই।

চমৎকারিত্বের এখানেই শেষ নয়। ২০০৯ সালের ২১ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হানলে লোকালয় রক্ষাকারী শত শত কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। প্রায় দুই লক্ষ একর জমি নোনা পানিতে ডুবে গিয়ে সুপেয় জলের উৎস প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ঝলমলিয়া আইলার আক্রমণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল। কোনো অজানা কারণে এই দীঘিতে সাগরের নোনাজল ঢুকতে পারেনি। হুড়কার মানুষের সৌভাগ্য আর দেবী ঝলমলেশ্বরীর আশীর্বাদ ছাড়া আর কীভাবেই-বা ব্যাখ্যা করা যাবে এই ঘটনা?

যাহোক, গত পাঁচ-সাত বছর ধরে হুড়কাসহ আশেপাশের অনেকগুলো গ্রামের মানুষ ঝলমলিয়াকে মিষ্টি পানির অন্যতম উৎস হিসেবে ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে। হেলাল ইদানিং তাঁর বৈদ্যুতিন যোগাযোগ ও লেখালেখিতে প্রায়ই লিখে থাকেন: 'জয় দেবী ঝলমলেশ্বরী!'

এই জয়ধ্বনি অযৌক্তিক নয়।

স্থান-কাল-পাত্র। দীঘি বলুন, নদী বলুন, সুন্দরবন বলুন, ঢাকা শহর বলুন, বা বলুন না কেন সারা পৃথিবীর কথা, স্থানের আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে তখনই যখন আমরা জানি যে, 'পাত্র' অর্থাৎ মানুষের জীবন ধারণের জন্যে এই স্থানগুলো গুরুত্বপূর্ণ। পাত্রই যদি না থাকে, তবে কাল বা স্থানের কী গুরুত্ব আছে? প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের সময় হেলাল এই সহজ সত্যটা স্মরণে রেখেছেন। ঝলমলিয়া একটি দীঘির কাহিনিমাত্র নয়। এই দীঘির আশেপাশে বসবাসরত পরিবার এবং তাদের সঙ্গে যুক্ত আরও হাজার মানুষের জীবন, সংগ্রাম ও বিশ্বাস হেলালের তথ্যচিত্রের উপজীব্য।

২০০৯ থেকে ২০১৬– প্রায় এক দশক ধরে ঝলমলিয়া পাড়ের মানুষদের জীবন ক্যামেরাবন্দি করেছেন হেলাল। বিভিন্ন ঋতুতে তিনি সেখানে বার বার ফিরে গিয়েছেন। প্রথমবার যখন তিনি হুড়কায় গিয়েছিলেন, তখন পাশের নদীতে ব্রিটিশ আমলের বড় প্যাডেল লঞ্চ (রকেট) চলত। ২০১২ সালে গিয়ে দেখা গেল, নদী ভরাট হয়ে গিয়েছে। সরকারি উদ্যোগে ড্রেজিং করে নদীখননের কাজ চলছে। কিন্তু এলাকার নারী-পুরুষ সবাই বলছেন: 'ড্রেজিং করে জনগণের পয়সার অপচয় শুধু হবে, কাজের কাজ কিছু হবে না।'

কেন? এলাকার একজন হেলালের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন এভাবে: 'প্রকৃতির সাথে কোনো জোর-জবরদস্তি চলে না। ভারতের ফারাক্কায় বাঁধ দেওয়াতে নদীতে মিষ্টি জলের স্রোত কমে গিয়েছে। সুতরাং নদীর জলের সঙ্গে আসা পলিমাটি সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে না, নদীর তলদেশেই জমা হচ্ছে। এত পলি ড্রেজিং করে সাফ করা অসম্ভব।'

সমস্যার এখানেই শেষ নয়। নদীর স্রোত কমে যাওয়ায় জোয়ারে সাগর থেকে ঢুকছে নোনা জল। সেই জল আটকে 'ঘের' বানিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে। এর ফলে লোকালয়ের বৃষ্টির জল নিকাশ হয়ে সাগরে গিয়ে পড়তে পারছে না। সুতরাং সামান্য বৃষ্টি হলেই উঠানের হাঁটুজল ঢুকে যাচ্ছে শোবার ঘরে। দিনের পর দিন বিছানার ঠিক নিচেই জলাবদ্ধতা কত সহ্য করা যায়? মানুষ আর গৃহপালিত পশুপাখির ভোগান্তির সীমা নেই। অতিবৃষ্টিতে মাছের ঘের ভেসে গিয়ে মাছচাষে বিনিয়োগ করা মূলধন আক্ষরিক অর্থে 'জলে যাচ্ছে'।

প্রামাণ্যচিত্রে আমরা দেখি, বৃষ্টির মধ্যে পানিতে ডুব দিয়ে দুই হাতে পলি তুলে সেই পলি দিয়ে ঘেরের পাড় রক্ষার চেষ্টা করছেন একজন। ভাঙা ঘেরের পানিতে জাল বসিয়ে মাছ ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করে চলেছেন এক দম্পতি, কারণ মাছ সব আগেই পগার পার। সাউন্ড ট্র্যাকের লালনগীতি: 'কই হল মোর মাছ ধরা!'

চমৎকার খাপ খেয়েছে এই সিকোয়েন্সের সঙ্গে।

নদী এ কূল ভাঙে, ও কূল গড়ে। নদীর এই ভাঙাগড়ার খেয়ালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নদীতীরের মানুষকেও তাদের বাসস্থান বদলাতে হয়। ২০০৮ সালে হেলাল যে বাড়িতে আতিথেয়তা উপভোগ করেছেন, ২০১২ সালে সেই বাড়ির শূন্য ভিটায় আশেপাশের লোকজনকে মোবাইল ফোনে ছবি দেখিয়ে জেনে নিতে হয় লোকগুলো এখন কোথায়। ঝলমলিয়া পাড়ের জীবন 'গোলাপ ফুলের বিছানা' নয় মোটেই। বিরূপ প্রকৃতির সঙ্গে দিনরাত যুদ্ধ করে মানুষ এখানে টিকে আছে। সারাদিন বৃষ্টির মধ্যে জাল ঠেলে হয়তো পাওয়া যায় কয়েকটি পুঁটিমাছ বা এক দুটি কাঁকড়া। সেগুলোই আবার পেটের দায়ে বিক্রি করে দিতে হয়।

কী না বিক্রি হয় হুড়কায়? ফেরিওয়ালার কাছে মাথার ঝরা চুল বিক্রি করে মেয়েরা কলস-হাঁড়ি থেকে শুরু করে আরও কত কী প্রয়োজনীয় জিনিষ কেনে। একটি দৃশ্যে নদীর পাড়ে মায়ের সঙ্গে খেলতে থাকা কচি ছাগলের বাচ্চাকে ধরে বেপারির কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এ সময় সাউন্ড ট্র্যাকে শোনা যায় পাশের পাড়ার মতুয়া বাড়ি থেকে ভেসে আসা শোকসঙ্গীতের রিহার্সালের শব্দ। হুড়কায় কেউ মারা গেলে মতুয়াবাড়ির এই দলটিকে গিয়ে শোক-সংকীর্তন (মাতম) করতে হয় বলে প্রতিদিন বিকালেই তারা একবার রেওয়াজে বসে।

হেলালের এই প্রামাণচিত্র বাংলাদেশ জীবন ও প্রকৃতির সৌন্দর্য ও ভীষণতা চমৎকারভাবে তুলে ধরেছে। চমৎকার ক্যামেরার কাজ ও সম্পাদনা। দিগন্তবিস্তৃত ধানক্ষেত ও চিংড়ি ঘেরের হৃদয়-কাড়া লংশট দেখে দশর্কের হৃদয় দেশপ্রেমে আপ্লুত হওয়া অসম্ভব নয়। সেই কাঁকড়ার কথা মনে পড়ছে যেটির বুকে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল চেপে তার দুই পা দুই হাতে ধরে বালতিতে রেখে দেয় ঝলমলিয়া পাড়ের এক গৃহবধূ।

বৃষ্টির দৃশ্যগুলো এক কথায় অনবদ্য। মনে পড়ছে নদীর জলে মাঝে মাঝে লাফিয়ে ওঠা বিরল প্রাণি শুশুক বা ডলফিনের কথা। মনে পড়ছে সেই মুরগির কথা যেটির বয়স নাকি এক যুগের উপরে। বিভিন্ন সময়ে আসা অতিথিদের ক্ষুধা আর আইলার ঝাপটা থেকে কোনোমতে সে বেঁচে গেছে এবং বাড়ির কর্ত্রী এখন তাকে আর মারতে চায় না।

লাল-সবুজ সালোয়ার-কামিজ পরা সেই কিশোরীকেও কি ভোলা যায় যে কি না গোলপাতার এক ঝোপের পাশে রাখা নৌকায় দাঁড়িয়ে মাকে বলছিল টেলিভিশনের রিমোট কোথায়। ভোলা যায় না সেই কই মাছের কথা যেটি পুরো একটি আনকাট দৃশ্যজুড়ে বৃষ্টির মধ্যে কাদার উপর দিয়ে পানির দিকে এগিয়ে চলছিল এবং শেষ মুহূর্তে একজন এসে ধরে ফেলতে গেলে তার হাত গলিয়ে জলে লাফিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচাতে পেরেছিল।

প্রামাণ্যচিত্রে বেশ কয়েক বার দেখা গেছে হুড়কার মুসলমান গৃহবধু সাফিয়াকে। সারাদিন তাকে কাজ করতে হয়, রান্না, ঘর গোছানো, গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগি দেখা, মেয়ের দেখাশোনা করা– এক মুহূর্ত ফুরসত নেই তার। তার উপর সোয়ামী তাকে দিনরাত খাবার খোঁটা দেয়। সুতরাং সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আর সে গ্রামে থাকবে না, শহরে গিয়ে গার্মেন্টসে কাজ নেবে। 'গার্মেন্টসে ২০০০ টাকা আয় করে যদি ১৫০০ টাকাও থাকা-খাওয়ার জন্যে খরচ অয়, তবু ৫০০ টাকা তো আমার থাকবি!'

এই সুফিয়াই আইলার ভয়ঙ্কর রাতে দুই মেয়েকে নিজের শরীরের সঙ্গে বেঁধে প্রবল বাতাস, জলের স্রোত এবং নদীপাড়ের শ্মশান পার হয়ে ঝলমলিয়ার ঘাটে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। মনে তার ভয় ছিল না কোনো। সে শুধু মনে মনে বলছিল: 'আল্লা, আমি একা মেয়েমানুষ দুই দুইটা বাচ্চা মেয়ে নিয়ে এই দুর্যোগে ঘর থেকে বের হয়েছি। তুমি আমাকে নূতন কোনো বিপদে ফেল না!'

হুড়কা গ্রামের এক বুজর্গ বলেছেন, হিন্দু-মুসলমান কেউই মা ঝলমলেশ্বরীর আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হয় না। কথা সত্য। সাফিয়াও ঝলমলিয়ার ঘাটে গিয়ে বসে, দিনে রাতে ঝলমলিয়া থেকে কলসে ভরে গৃহস্থালির জল নিয়ে আসে। এক সন্ধ্যায় জল নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে জলকে যাওয়া অন্য মহিলাদের সাফিয়া বলছিল: 'আমারে একজন বলিছে, তুমি মুসলমান হইয়ে মন্দিরে যাও কেন, ঝলমলিয়ায় যাও কেন? আমি তারে সামনাসামনি কিছু বলিনি, কিন্তু মনে মনে বলিছি, আমি কেন যাই তা আমি জানি। আমি শান্তি পাই, তাই আমি যাই। আমাগো আল্লাহ আর তোমাগো ভগমান কি আলাদা?'

সাফিয়ার কিশোরী মেয়ে হাসি মুখে উত্তর দেয়: 'সব এক!'

সন্দেহ নেই, ধর্মের নামে ভণ্ডামি আর অস্থিরতার এই যুগে সুফিয়ার সুস্থ ধর্মবোধ সমগ্র মানবজাতির জন্যে অনুকরণযোগ্য।

২০১৬ সালে হেলাল শেষবার হুড়কা গ্রামে এসেছিল রাস উৎসবে। ঝলমলিয়া দীঘির পাশেই এক মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় এই উৎসব। নারীপুরুষ রাধা-কৃষ্ণ সেজে ঘুরে ঘুরে নাচে নাম-সংকীর্তন করতে করতে। একটি দৃশ্যে দেখা যায়, রাসপূর্ণিমার সন্ধ্যায় নারীভক্তরা ঝলমলিয়ায় পূণ্যস্নান করছে। লাল শাপলা হাতে সিক্তবসনা এক নারী যখন ঝলমলিয়ার ডুব দিয়ে উঠতে থাকে তখন ক্যামেরা তার মুখের উপর স্থির হয়। আমরা অবাক হয়ে দেখি, মুখটি সাফিয়ার। ব্যাকগ্রাউন্ডের আকাশে তখন জ্বলজ্বল করছে রাসপূর্ণিমার চাঁদ– যাকে সাফিয়ার বিচিত্র অথচ অখণ্ড বিশ্বাসের প্রতীক বিবেচনা করতে বাধা নেই।

মানুষের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে হেলাল বছর দশেক আগেও একটি ছবি করেছিলেন: 'বিশ্বাসের রঙ' । এ ছবিতে তিনি বলেছিলেন, বিশ্বাস বহু বর্ণময় হওয়াটাই স্বাভাবিক; সবার বিশ্বাস একই রকম হতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। 'ঝলমলিয়া' প্রামাণ্যচিত্রে হেলাল বিশ্বাস বিষয়ে তাঁর এই থিসিসের সমর্থনে আরও একটি উদাহরণ দাঁড় করাতে পেরেছেন।

মীরা মিডিয়ার ব্যানারে নির্মিত এই চমৎকার ছবির বহুল প্রচার হওয়া প্রয়োজন, স্বদেশে এবং বিদেশে। ইতোমধ্যেই অবশ্য ছবিটি নিউ ইয়র্ক ও প্রাগে প্রদর্শিত হয়ে দর্শক-সমালোকের প্রশংসা লাভ করেছে। প্রাগে ঝলমলিয়া দুটি নোমিনেশন পেয়েছে। এছাড়া কোলকাতা, দিল্লি, ইন্দোনেশিয়ার যোগ্যকর্তা এবং ঢাকার স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শনের জন্যে মনোনীত হয়েছে ছবিটি।

ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার এই অস্থির সময়ে 'ঝলমলিয়া' আমাদের নতুন পথের দিশা যোগাবে, সন্দেহ নেই।