শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

বেবী মওদুদ
Published : 9 Jan 2011, 05:53 PM
Updated : 9 Jan 2011, 05:53 PM

১০ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। সেদিনের স্মৃতি ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।

১৬ ডিসেম্বর দীর্ঘ নয় মাসের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের পর বাঙালি তার বিজয় পতাকা উড়িয়েছে,  দখলদার পাকিস্তানী সৈন্যদের আত্মসমর্পনে বাধ্য করেছে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ, আড়াই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং শহীদ বুদ্ধিজীবিদের নৃশংস রক্তাক্ত স্মৃতি বাঙালির হৃদয়কে কাঁদিয়েছে সত্য, তারপরও তারা বিজয় উৎসব করেছে। বাংলার মাটি  শত্রুমুক্ত হয়েছে। বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্ন সফল হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। বিভিন্ন রাষ্ট্র স্বীকৃতি প্রদান করছে। মুজিব নগরে প্রতিষ্ঠিত সরকার দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়েছে। বিদেশ থেকে সাহায্য ও সহযোগিতার আশ্বাস আসছে, প্রশাসন কাঠামো গড়ে উঠছে। ক্রমশ: স্বাভাবিক হয়ে উঠছে যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতি। কিন্তু তারপরও বাঙালির হৃদয় ভারাক্রান্ত। প্রিয় নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কোনও খবর পাওয়া যাচ্ছে না। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট রক্ত পিশাচ জেনারেল ইয়াহিয়া খান তাঁর গোপন বিচার সমাপ্ত করে মৃত্যুদন্ড শাস্তি প্রদান করেছে–এ খবর অনেক আগে জানা গিয়েছিল। কিন্তু তারপর আর কোনও খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে পাকিস্তানে ইয়াহিয়ার পতন ও ভূট্টোর সরকার গঠনের খবর পত্রিকায় আসছিল। বিশ্বজুড়ে শেখ মুজিবের জন্য শঙ্কা ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁর মুক্তির জন্য বিশ্ব নেতারা সোচ্চার  হচ্ছেন। জনমত গড়ে উঠেছে। তিনি কি সত্যই বেঁচে আছেন, নাকি খুনী ইয়াহিয়া তাঁর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করে কেলেছে। এইসব শঙ্কা-সংশয়ে বাংলার মানুষ তখন দিশাহারা।

যে নেতা স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, যে নেতা গেরিলা যুদ্ধের আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, 'যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, যে নেতা পঁচিশে মার্চ মধ্য রাতের পর প্রথম প্রহর ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা দেবার কারণে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার হয়ে পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী কারাগারে বন্দি এবং রাষ্ট্রদ্রোহী আসামী হিসেবে আর্মী আইনের বিচারে মুত্যুদন্ড শাস্তি পেয়েছেন সেই নেতাকে ছাড়া স্বাধীনতার বিজয় কি পরিপূর্ণ হতে পারে ?

কখনই না। তাঁর মুক্তির দাবিতে প্রতিদিন আন্দোলন চলছে, বিশ্বব্যাপী সেই আন্দোলনও ছড়িয়ে পড়ছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

একাত্তরের মার্চ মাস ছিল বাঙালির কাছে এক জীবন জাগানিয়া ঐতিহাসিক সময়। ১ মার্চ যখন জেনারেল ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর পরামর্শে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করে বাঙালিকে তার ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার ষড়যন্ত্র করেছিল। নির্বাচনে বিপুল ভোট পেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ  করার জন্য প্রস্তুত ঠিক তখনই এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসকরা মূলত সেদিনই নিজেদের হীনমন্যতার পরিচয় দিল এবং পাকিস্তানের কবর রচনা করে ফেললো।

আমাদের স্মৃতিতে আজও আছে, বাংলার ছাত্র-জনতা এই ঘোষণা শোনার সঙ্গে সঙ্গে রাজপথে নেমে এসে শ্লোগান দিল 'জয় বাংলা', 'বাংলাদেশ স্বাধীন করো', 'তোমার আমার ঠিকানা -পদ্মা মেঘনা যমুনা'  ইত্যাদি। বাংলার মানুষ সেদিনই জানিয়ে দেয় তারা আর পাকিস্তানের সঙ্গে থাকবে না। এরপর  শেখ মুজিব সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণ দানকালে তিনি সোচ্চার কণ্ঠে বলে ওঠেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'। এরপর পদ্মায় পানি গড়ালো ঠিকই, সেইসঙ্গে বাঙালিও ঘর ছেড়ে পথে নেমেছিল স্বাধীনতার স্বপ্নের আকাক্ষায়। ২৫ মার্চ রাতে ইয়াহিয়া – টিক্কার লেলিয়ে দেয়া সেনাবাহিনী রাতের অন্ধকারে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে বাংলার নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পরিকল্পিতভাবে গণহত্যা চালায় অগ্নিসংযোগ করে বস্তি উজার করে দেয়। শেখ মুজিব ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। পাকিস্তানী সৈন্যরা তাকে গ্রেফতার করে প্রথমে নির্মীয়মান সংসদ ভবনে আটক করে রাখে। তারপর করাচি বিমান বন্দর হয়ে লায়ালপুরে মিয়ানওয়ালী জেলে বন্দি করে রাখে। ৪ এপ্রিল করাচি বিমানবন্দরে বসে থাকা ঐ বন্দি অবস্থার ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। জেনারেল ইয়াহিয়া ২৮ মার্চ রাতে এক ভাষনে তাকে 'দেশদ্রোহী' ও বিশ্বাসঘাতক' বলে বিচারের কথা জানায়। মিয়ানওয়ালী জেলে থাকাকালে কোর্ট মার্শালে খুব দ্রুততার সঙ্গে তাঁর বিচার হয়। দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের কোন খবরই তাকে জানতে দেয়া হয়নি।

৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবকে মুক্ত করে লন্ডন পাঠাতে বাধ্য হয় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভূট্টো। ৯ জানুয়ারি সকালে ঢাকায় প্রথম খবর আসে মুক্তিলাভের। সব মহলে স্বস্থি ছড়িয়ে পড়ে। ৯ জানুয়ারি লন্ডনে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে শেখ মুজিব বলেন, "বাংলার মুক্তি সংগ্রামে আজ আমি স্বাধীনতার অপরিসীম ও অনাবিল আনন্দ অনুভব করছি। এই মুক্তি সংগ্রামের চরম লক্ষ্য ছিল স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। আমার জনগন যখন আমাকে বাংলাদেশ 'রাষ্ট্রপতি' হিসাবে ঘোষণা করেছে তখন আমি 'রাষ্ট্রেদ্রোহ' এর দায়ে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত  আসামী হিসাবে একটি নির্জন ও পরিত্যাক্ত সেলে বন্দি জীবন কাটাচ্ছি।…… পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ আমার বিরুদ্ধে বিচারের নামে এক প্রহসন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। শুনানি অর্ধেক সমাপ্ত হবার পর পাক কর্তৃপক্ষ আমার পক্ষ সমর্থনের জন্য একজন আইনজীবী নিয়োগ করে। আমি কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্টে 'বিশ্বাসঘাতক'-এর কলঙ্ক নিয়ে মৃত্যুদন্ডের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর, আমার বিচারের জন্য যে ট্রাইবুন্যাল গঠন করা হয়েছিল তার রায় কখনও প্রকাশ করা হবে না।  সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিচারের নামে প্রহসন অনুষ্ঠান করে আমাকে ফাঁসিকাষ্টে ঝুলানোর ফন্দি এঁটেছিলেন। কিন্তু ভূট্টো এই মৃত্যুদন্ড কার্যকরী করতে অস্বীকার করেন। জনাব ভূট্টো আমাকে না বলা পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিজয় সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। জেলখানা এলাকায় বিমান আক্রমনের জন্য নির্দেশ জারি করার পর আমি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কথা জানতে পারি। জেলখানায় আমাকে এক নিংসঙ্গ ও নিকৃষ্টতম কামরায় বন্দি করে রাখা হয়েছিল। যেখানে আমাকে তারা কোন রেডিও, কোন চিঠিপত্র দেয় নাই। এমনকি বিশ্বের কোথায় কি ঘটছে, তা জানতে দেওয়া হয় নাই। স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের জনগনের মত  এতো উচ্চমূল্য, এতো ভয়াবহ ও বিভীষিকাময়  জীবন দুর্ভোগ আর কোন দেশের মানুষকে  ভোগ করতে হয় নাই। বাংলাদেশে নির্মম হত্যাকান্ড ঘটানোর জন্য পাকিস্তানী সৈন্যরা দায়ী। হিটলার যদি আজ বেঁচে থাকতো, বাংলাদেশের হত্যাকান্ডে সেও লজ্জা পেত। প্রেসিডেন্ট ভুট্টো আমাকে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে যে কোনও একটি সম্পর্ক  বজায় রাখার ব্যাপারটি বিবেচনা করতে অনুরোধ জানিয়েছেন। আমি তাঁকে বলেছি, আমার দেশবাসীর সাথে আলাপ আলোচনা  না করে আমি কোন কিছু বলতে পারবো না। আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে রাজী নই। আমি আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই।"

বৃটেনের রাজ পরিবারের একটি বিশেষ বিমানে শেখ মুজিব দিল্লী হয়ে ঢাকায় এসে পৌঁছান। দিল্লী বিমান বন্দরে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধিসহ মন্ত্রীবর্গ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিমান বন্দরে এক সমাবেশে শেখ মুজিবকে বিপুল করতালি ও ফুলের মালায় স্বাগত জানায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতা করায় শেখ মুজিব ভারত সরকার, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধি ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন  এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার আহ্বান জানাল। শ্রীমতি গান্ধি  বলেছিলেন, "পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে বন্দি করলেও তাঁর আত্মাকে বন্দি করতে পারেনি।'

১০ জানুয়ারি সকালে বঙ্গবন্ধু তেজগাঁ বিমানবন্দরে এসে বাংলার মাটিতে পা রেখে প্রথমেই হাত দিয়ে মাটির স্পর্শ নিয়ে মাথায় হাত রাখেন। হৃদয় তাঁর ছিল ভারাক্রান্ত। পাক সেনাদের গণহত্যায় লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত, আড়াই লক্ষ মা-বোনের আত্মত্যাগ এবং এক কোটির উদ্বাস্তুর অসহায় জীবনের কথা তিনি শুনতে পান। দুচোখ ভরা ছিল অশ্রু"। বারবার চোখ মুছতে থাকেন। বিমানবন্দরে তিল ঠাই নেই। নেতারাও কাঁদতে কাঁদতে তাকে জড়িয়ে ধরেন। বিমানবন্দর থেকে ট্রাকে চড়ে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহয়াওয়ার্দী উদ্যান) পৌঁছাতে সময় লাগে  সাড়ে তিন ঘণ্টা। তারপর বিজয়ের উচ্ছ্বাসে উত্তাল জনস্রোতের সামনে দাঁড়িয়ে মুজিব অশ্রুভারাক্রান্ত মনে বক্তৃতা দেন তার স্বভাবসুলভ কণ্ঠ ও  উচ্চারণে।

তিনি সেদিন বলেছিলেন, "নেতা হিসাবে নয়, ভাই হিসাবে আমি আমার দেশবাসীকে বলছি, আমাদের সাধারণ মানুষ যদি আশ্রয় না পায়, খাবার না পায়, যুবকরা যদি চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে আমাদের এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে, পূর্ণ হবে না। আমাদের এখন তাই অনেক কাজ করতে হবে। আমাদের রাস্তা-ঘাট ভেঙ্গে গেছে, সেগুলো মেরামত করতে হবে। অনেকেই আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে। আমি তাদের জানি।

আপনারা আরও জানেন যে, আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। আমার সেলের পাশেই  কবর খোঁড়া হয়েছিল।  আমি মুসলমান। আমি জানি, মুসলমান মাত্র একবারই মরে। তাই আমি ঠিক করেছিলাম, আমি তাদের কাছে নতি স্বীকার করব না। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলবো, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। জয় বাংলা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে বন্দি হওয়ার পূর্বে আমার সহকর্মীরা আমাকে চলে যেতে অনুরোধ করেন। আমি তখন তাদের বলেছিলাম, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বিপদের মুখে রেখে আমি যাব না। মরতে হলে আমি এখানেই মরব। বাংলা আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়। তাজউদ্দীন এবং আমার অন্য সহকর্মীরা তখন কাঁদতে শুরু করেন।"

সেই ঐতিহাসিক সমাবেশ সরাসরি টেলিভিশনে প্রচারিত হওয়ায় সারা দেশের মানুষ বিস্ময়ভরা চোখে শেখ মুজিবকে দেখে, তাঁর কথা শোনে। সেদিন অশ্রু সম্বরণ করা সবার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। শেখ মুজিব তার প্রিয় বাংলার মানুষের মাঝে ফিরে আসতে পেরে তাদের কাছে পেয়ে বিজয়ের সম্পূর্ণতা যেন পূর্ণ হয়েছিল। সেদিন ঢাকার প্রতিটি পথই ছিল জনস্রোতে অবরুদ্ধ। যে পথ দিয়ে নেতা গিয়েছেন সে সব পথে মানুষের স্রোতে তিনি ভাসতে ভাসতে যেন চলেছেন। আশেপাশে বাড়ি ঘর থেকে পুষ্পবৃষ্টি ছড়ানো হয়। আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা এবং ভারতীয় ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাঁকে মিছিল করে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে জনসভা থেকে ধানমন্ডির ১৮ নং রোডের বাড়িতে পৌঁছিয়ে দেয় যেখানে তাঁর স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, মা-বাবাসহ স্বজনদের মাঝে গিয়ে মুজিব সেদিন শিশুর মত কাঁদতে থাকেন। তাঁর সঙ্গে সবাই কাঁদতে থাকে। সে এক আনন্দ-বেদনার মহামিলন ক্ষন হয়ে উঠেছিল।

প্রখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের কাছে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু তার কারাবন্দি জীবনের অনেক কথার মাঝে বলেছিলেন, "হ্যাঁ আমার সেলের পাশেই ওরা কবর খুঁড়লো। আমি নিজের চোখে দেখলাম ওরা আমার কবর খুঁড়ছে। আমি নিজের কাছে নিজে বললাম, "আমি জানি,  এ কবর আমার কবর। ঠিক আছে। কোন পরোয়া নেই। আমি তৈরি আছি …. আমি জানতাম, যে কোনদিন ওরা আমায় শেষ করে, দিতে পারে। কারণ ওরা অসভ্য, বর্বর। …. ওরা জেলখানায় এমন একটা অবস্থা তৈরি করেছিল যে মনে হচ্ছিল, কতগুলো কয়েদিকে ওরা সংগঠিত করেছিল যেন সকালের দিকে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওরা আমাকে হত্যা করতে পারে। আমার মনে হয়, আমাকে তত্ত্বাবধানের ভার যে অফিসারের ওপর পড়েছিল, আমার প্রতি তার কিছুটা সহানুভূতি জেগেছিল। হয়তো বা সে অফিসার এমনও বুঝাতে পেরেছিলেন যে, ইয়াহিয়া খানের দিন শেষ হয়ে আসছে। আমি দেখলাম, হঠাৎ রাত তিনটার সময়ে সে এসে আমাকে সেল থেকে সরিয়ে নিয়ে তার নিজের বাংলোতে দুদিন যাবৎ রক্ষা করলো। এ দুই দিন আমার ওপর কোন সামরিক পাহাড়া ছিল না। দুই দিন পরে এই অফিসার আমাকে আবার একটা  আবাসিক কলোনীর নির্জন এলাকায় সরিয়ে নিল। সেখানে আমাকে হয়তো চার পাঁচ কিংবা ছ'দিন রাখা হয়েছিল। এই সময়টাতে আমার অবস্থান সম্পর্কে নিচু পদস্থ কিছু অফিসার বাদে আর কেউ জ্ঞাত ছিল না।

শেখ মুজিব বন্দি থাকার সময তার ওজন অনেক  হ্রাস পেয়েছিল। স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। তবে তাঁর মনের জোর ছিল বিশাল। বন্দি অবস্থায় তাকে তিন বেলা রুটি ও ডাল, কখনও বা দু' এক টুকরো মাংস খেতে দিত। তিনি চাহিদা মতো চা পান করতে পারতেন না। তাকে সব দিক থেকে বিছিন্ন রাখার একমাত্র কারণ ছিল শারীরিক ও মানসিকভাবে যাতে ভেঙ্গে পড়ে অসুস্থ হয়ে যান। কিন্তু বাঙালির জাতির প্রিয় নেতা শেখ মুজিব মৃত্যু ভয়কে জয় করেছিলেন নিজের আদর্শ ও সাহসের শক্তিতে। তাঁর জীবনের একমাত্র স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং বাঙালির উন্নত জীবন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর শেখ মুজিব যে সাড়ে তিন বছর দেশ পরিচালনার সুযোগ পান, সে সময়টায় যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে একটা মজবুত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে যান। বিশ্বের সকল দেশের স্বীকৃতি আদায় করেন। তিনি জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে যখন দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন, তখনই স্বাধীনতার পরাজিত শক্তির দেশি বিদেশি চক্রান্তকারীরা নির্মম নৃশংসভাবে সপরিবারে হত্যা করলো। শেখ মুজিব বাঙালি জাতির আত্মার আত্মীয়। তাঁর স্মৃতি, তার নাম, তার ছবি কাল থেকে কালান্তরে অক্ষয় হয়ে থাকবে।