ক্যান্সার আমার জীবনে আর ফিরে না এলেও কাজের ভুবনে, সাহিত্যক্ষেত্রে বা সামাজিক মাধ্যমে কেউ কখনো কোন কাজে আমার সঙ্গে পেরে না উঠলে, এই ক্যান্সারের প্রভাবে তৈরি সামান্য পায়ের সমস্যা নিয়ে অনেক কটু কথা বলেছে ও নিন্দা-মন্দ করেছে।
Published : 06 Feb 2024, 08:11 PM
১৯৯২ সালের জুনে ঢাকা ভার্সিটিতে আইন সম্মান প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার কয়েক মাস আগে থেকেই আমার বেশ কাশি, কখনো কখনো রাত জেগে কাশি, অল্প পড়াশোনা করলেই ঘাম ও ক্লান্তি, দুর্বলতা এসব দেখা যাচ্ছিল। বাসায় দু/এক বার বললেও যেহেতু অতীতে আমার কখনো বছরে একবারও জ্বর হতো না, কাজেই কেউ তেমন গা করেনি।
মাত্রই এরশাদের পতনের পর ঢাকা ইউনিভার্সিটি তার অতীতের সেশন জট কাটিয়ে উঠছিল এবং তার ভেতর আমাদের আইন বিভাগ ছিল সবার আগে। অন্য ডিপার্টমেন্টের বন্ধুরা যখন বারো মাসেও ফাইনাল পরীক্ষা দেয় না, আমাদের এখানে ভর্তির ছ মাসের ভেতরেই ফাইনাল পরীক্ষার তোড়জোড়। তাতে শরীরটা বেশ খারাপ হয়ে পড়ছিল। পরীক্ষার হলেই বুঝলাম যে লিখতে গিয়েও ক্লান্ত হয়ে পড়ছি যা কখনোই আগে হইনি। পরীক্ষার পরই এক রাতে বাসায় খাবারের পর যখন বমি হয়ে রক্ত পড়ল, তখন পরিবারের সবার টনক নড়ল। তার আগে সারা রাত কাশলেও বাসায় কেউ লক্ষ্য করেনি। সবাই জানত আমার ‘লোহার শরীর’। আমার উপরের বড় বোন কাবেরীর সারা বছরই এটা-সেটা লেগে থাকত বলে ওকে নিয়েই সবাই ব্যস্ত থাকত। এছাড়া আমি নিতান্ত সমস্যা না হলে কখনো কাউকে কিছু বলি না বা বলতামও না— মাকেও না!
কাশির সঙ্গে রক্ত পড়ার পর সবার টনক নড়ল। আমার সবার বড় বোনের বর তখন পিজিতে ডাক্তার। তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন হাসপাতালে। এক্স-রে করার পর এক্স-রে দেখে সব ডাক্তার-নার্স ‘হায়- হায়‘ করতে লাগল, ‘এত দেরিতে নিয়ে এসেছেন কেন? এত বাচ্চা মেয়ে!’
আমাদের পরিবারে গড়ে সব ভাই-বোনেরই বেশ একটু এগিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিল। ডাক্তারদের চেম্বারে গেলে কেউ আমাকে ‘ভার্সিটির ছাত্রী’ বলে মানতে চাইত না। ভাবত তখনো স্কুল বা কলেজে পড়ছি। দ্রুতই ডাক্তার দেখানো হলো। প্রাথমিক ভাবে যক্ষ্মা সন্দেহে কিছু ওষুধ দেওয়া হলো যার ভেতর স্টেরয়েডও ছিল। আমি একটু ভালও হলাম এবং জুলাইয়েই দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাসে দু-তিনদিন গেলামও। তারপরই আবার ক্লান্তি, বমি, কাশি ও জ্বর, খেতে না পারা। দ্রুতই দেখা গেল বাসায় খাবার রান্নার গন্ধও আমার সহ্য হচ্ছে না। একদিন এক ডাক্তারের চেম্বারে নেওয়ার পর খানিকক্ষণ বসে আমি আর বসেও থাকতে পারছিলাম না। সোফায় শুয়ে পড়তে হলো। এরপর দেখা দিল প্রচণ্ড অনিদ্রা ও শ্বাস-কষ্ট।
বাংলাদেশের ডাক্তাররা আমাকে এই নিউমোনিয়া, এই ব্রঙ্কাইটিস আবার প্লুরিসি শনাক্ত করছেন। আমার ফুসফুসে বারবার পানি জমে গিয়ে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। শমরিতা হাসপাতালে ভর্তি করে প্রতিদিন সকালে ওটিতে নিয়ে পিঠে বড় ইঞ্জেকশন দিয়ে পানি টানা হয়— অল্প রক্তে লাল হয়ে যাওয়া পানি। একটু পরই আবার শ্বাসকষ্ট। একটা সময় বিছানা উঁচু করে অক্সিজেন মাস্ক দেওয়া শুরু হলো। সারা দিনে এক চা চামচ গ্লুকোজ পানি বা একটা আঙুর খাওয়ালেও বমি করে দিই। দেখতে দেখতে শুকিয়ে নিতান্ত কৃশকায় ও অনেকটাই মসীবর্ণ হয়ে গেলাম।
এ অবস্থায় অক্টোবেরর ২ তারিখ সকালে মুম্বাইয়ে টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে আমাকে নেওয়া হলো। সেখানে পৃথিবীর সেরা দশ ক্যান্সার স্পেশালিস্টের অন্যতম শ্যাম সুন্দর আদভানি প্রথম দিনেই আমার অসুখ ‘নন হজক্যান্স লিম্ফোমা’ বলে শনাক্ত করলেন। পরদিন থেকে আমার কেমোথেরাপি শুরু হলো। আসলে আমার ফুসফুস ও হার্টের ভেতর একটি গ্রোথ হয়েছিল, যা এত স্পর্শকাতর জায়গায় যে অপারেশন করাও সম্ভব নয়। প্রথম রাতের স্যালাইনের পর সারারাত অসহ্য বমি হলো। এক ব্যাগ রক্তও আমাকে দিল আমার ডাক্তার মেজো ভাই। তারপর একটু একটু করে খাবার বা ওষুধ খেতে পারা শুরু হলো— অন্তত, একটি নাপা চার টুকরো করে আধা ঘণ্টা ধরে আমাকে খাওয়াতে হয় না।
দ্রুতই চুল পড়তে শুরু করল। অত অসুস্থ অবস্থায় ভর্তির পরও হাসপাতালে ইতোমধ্যে ডাক্তার-নার্সরা আমার দীর্ঘ চুলের প্রশংসা করছিলেন। ‘বাঙালি মেয়েদের চুল খুব সুন্দর হয়’— এমন মন্তব্য করতেন। অনেকে অবশ্য আমার খানিকটা মঙ্গোলয়েড আদলের কারণে আমাকে ‘নেপালি‘-ও ভাবতেন। যাহোক, আমি ‘নন হজক্যান্স লিম্ফোমা’র চতুর্থ স্তরে পৌঁছে গিয়েছিলাম বলে আমার কেমোর সাইকেলগুলো ছিল সেসময় টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে ভর্তি সব রোগীর চেয়ে দীর্ঘতম।
প্রথম পাঁচ দিন টানা ২২ ঘণ্টা স্যালাইনের সঙ্গে ওষুধের পর হাসপাতাল থেকে অনতিদূরত্বে একটি থাকার জায়গায় গিয়ে দশ দিনের ভেতর মেরুদণ্ডে আরো দুটো ইঞ্জেকশন নিতে হাসপাতালে আসতে হতো। তারপর আবার পরের কোর্সের জন্য প্রস্তুতি। আমার প্রথম কোর্স পর্যন্ত আমার বড় দিদি আমার সঙ্গে ছিলেন। ওর বড় মেয়ের বয়স তখন মাত্র দশ মাস। ও চলে গেলে, মা এলেন এবং দু ভাই সঙ্গে থাকলেন। আমার মা এবং আমার তিন ভাই (ডক্টর তপন, মনোস্তত্ববিদ তরুণ ও কবি ও স্থপতি তুষার) আমার জন্য ঠিক কি কি করেছে তা লিখতে গেলে মহাকাব্য হয়ে যাবে। সবার বড় ভাই যুক্তরাষ্ট্র থেকে কঠিন এই ট্রিটমেন্টের জন্য অর্থসাহায্য করেছেন— বাবা তখন অবসরপ্রাপ্ত।
কেমোথেরাপিতে মাথার চুল, চোখের পাঁপড়ি ও ভ্রু হারিয়ে দেশে ফিরতে ফিরতে দ্বিতীয় বর্ষের সব ক্লাস শেষ। মাথায় স্কার্ফ জড়িয়ে দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস শুরু করলাম। তবে এক বছর পর কেমোর প্রভাবে পায়ের সমস্যা শুরু হলো, যার জের আজও টানছি। ১৯৯৫- এ অনার্স ফাইন্যাল ইয়ারের শুরুতে দুই পায়ে ‘বোন গ্রাফটিং’ অপারেশন করে টানা ছ’মাস শয্যাবন্দি থেকে, একশো নম্বরের পরীক্ষা না দিয়েই অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিলাম। তার আগে মাত্র তেরো দিন ক্লাস করতে পেরেছি। তার আগের ইয়ারেও সপ্তাহে একদিন ক্লাসে গিয়ে নোট আনতাম। তবু দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করলাম। মাস্টার্সে অবশ্য বেশ নম্বর নিয়ে ১৩৫ জনের ভেতর অষ্টম হলাম। আর অনার্সে ১০০ নম্বরের পরীক্ষা না দিয়েও ১২৫ জনের ভেতর ২৫তম হয়েছিলাম। তবে প্রথম বিভাগ পাওয়া হয়নি।
২০১৫ সালে দিল্লিতে আমার পায়ে আরো দুটো অস্ত্রোপচার হয়। সেখানকার ডাক্তার হাঁটুতে আরো দুটো সার্জারি করতে হবে বলে জানান। আর বেঙ্গালুরুর ডাক্তার হাঁটুতে একটি মাত্র সার্জারি করতে হবে বলেছেন। বাংলাদেশি এক ‘বিকল্প ধারার‘ ডাক্তার আমাকে রাত দশটার ভেতর ঘুমালে পা ঠিক হয়ে যাবে বলেছেন। মাঝে মাঝে এমন ঘুমালে অনেক ভাল বোধ করলেও নানা কাজ ও স্ট্রেসে লাইফস্টাইল চেঞ্জ করা হচ্ছে না। আমার ফুসফুসের অসুখ আর ফেরেনি এবং আঠারো থেকে ত্রিশ অবধি হার্মোনিয়াম না ছুঁলেও পরে আমি আবার শিক্ষকদের কাছে শিখে এখন গান-টানও করছি। অনার্স এবং মাস্টার্স পাশ করে একাধিক ইংরেজি সংবাদপত্র, কিছু জাতীয়-আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ও জাতিসংঘের একাধিক প্রকল্পে কাজ করেছি। দেশের বাইরে কাজও পেয়েছি তবে নানা কারণে যাওয়া হয়নি। লিখেছি— গল্প, কবিতা, অনুবাদ, উপন্যাস, প্রবন্ধ, গবেষণা, শিশু সাহিত্য মিলিয়ে ৪১টির মতো বই।
ক্যান্সার আমার জীবনে আর ফিরে না এলেও কাজের ভুবনে, সাহিত্যক্ষেত্রে বা সামাজিক মাধ্যমে কেউ কখনো কোন কাজে আমার সঙ্গে পেরে না উঠলে, এই ক্যান্সারের প্রভাবে তৈরি সামান্য পায়ের সমস্যা নিয়ে অনেক কটু কথা বলেছে ও নিন্দা-মন্দ করেছে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক
(সেন্টার ফর ক্যান্সার কেয়ার ফাউন্ডেশনের ‘এখানে থেমো না’ বইয়ে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে)