জিয়াউর রহমানের মতো একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার বীর উত্তম খেতাব বিগত আওয়ামী লীগ সরকার প্রত্যাহার করেছিল। সেটিও শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকেনি। সুতরাং ইতিহাসে যার যা অবস্থান, সেটি নির্ধারিত। নতুন ইতিহাস ও সংজ্ঞা নির্ধারণের নেপথ্যে যদি কোনো খারাপ উদ্দেশ্য থাকে, সেটি জনগণ প্রত্যাখ্যান করবে। কেননা, এখন যা করার চেষ্টা শুরু হয়েছে, তা বিগত সব উদাহরণ ছাপিয়ে যেতে চলেছে।
Published : 21 Mar 2025, 07:29 PM
একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরের শিরোনাম দেখে হয়তো আপনারও চোখ ছানাবড়া হয়েছে। আজ শুক্রবার, ২১ মার্চ, ‘মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি থাকছে না শেখ মুজিবসহ চার শতাধিক নেতার’— এই শিরোনামে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ সত্তুরের নির্বাচনে বিজয়ী চার শতাধিক রাজনীতিবিদের (এমএনএ বা এমপিএ) বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি থাকছে না। তাদের পরিচয় হতে যাচ্ছে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’। বিদ্যমান জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) আইন সংশোধনের চূড়ান্ত খসড়ায় এ প্রস্তাব করা হয়েছে। (সমকাল, ২১ মার্চ ২০২৫)।
এই খবরের অর্থ কি এই যে, বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের মতো নেতারা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না? তাদেরকে ‘সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা’ বলার মধ্য দিয়ে কি তাদের সম্মান বাড়ানো হচ্ছে নাকি অসম্মানিত করা হচ্ছে? দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৪ বছর পরে এই অসম্মান কি তাদের প্রাপ্য? এর মধ্য দিয়ে কি জাতি হিসেবে আমরা নিজেদেরকে খুব মহিমান্বিত করছি? যারা এই উদ্যোগ নিয়েছেন, তাদের ইনটেনশন বা উদ্দেশ্য কী? মুক্তিযুদ্ধের নতুন বয়ান ও নতুন ইতিহাস তৈরি করা?
অন্তর্বর্তী সরকার, যারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়, তারা একটি বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছে এবং দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও অর্থনীতি সচল রেখে দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি অবাধ-সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনাই যাদের প্রধান কাজ—তারা ঐতিহাসিকভাবে মীমাংসিত এমন একটি বিষয় নিয়ে কেন বিতর্ক উসকে দিচ্ছে? এর মধ্য দিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে আরও বেশি বিভাজন ও বিশৃঙ্খলা তৈরি হলে কার লাভ? নানারকম অস্থিতিশীলতা তৈরি করে নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করাই কি আসল উদ্দেশ্য? অন্তর্বর্তী সরকার যখন জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছে এবং যখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ চলছে—সেই সময়ে ১৯৭১ তথা মুক্তিযুদ্ধ ইস্যুতে এরকম একটি অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে সরকার কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে চাচ্ছে, যাতে করে তাদের ঐক্য ও সংস্কারের আলাপগুলোই অর্থহীন হয়ে পড়ে?
মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ শুরু হয়নি
মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ করে শুরু হওয়া কোনো ঘটনা নয়। বাংলাদেশ যে স্বাধীন হয়ে যাবে, সেটি ছিল অবধারিত। কেননা বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার আগে পাকিস্তানের দুই অংশের মাঝখানে ছিল ভারতের একটি বিরাট অঞ্চল। ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন দুই প্রান্ত মিলিয়ে একটি দেশ প্রতিষ্ঠা পৃথিবীর রাষ্ট্রব্যবস্থার ইতিহাসে উদ্ভট আইডিয়ার উদাহরণ— এটি যে কোনো সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ উপলব্ধি করতে পারেন। সুতরাং বাংলাদেশ আলাদা বা স্বাধীন হতোই। সেটি ১৯৭১ সালেই হোক, কিংবা আরও ১০ বছর পরে।
বাংলাদেশ যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যাবে— তার পেছনে এই ভৌগোলিক সংকট এবং পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নানাবিধ শোষণ-বঞ্চনার বাইরেও দুই পাকিস্তানের মধ্যে ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যগত নানা পার্থক্যও কারণ হিসেবে বিদ্যমান ছিল। ফলে আজ হোক কাল হোক, পাকিস্তানের দুই অংশের আলাদা হওয়া ছিল সময়ের ব্যাপারমাত্র। আরও স্পষ্ট করে বললে, এই প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে ভাষার প্রশ্নে ১৯৪৮ সালেই। তারপর ধীরে ধীরে, বায়ান্ন, চুয়ান্ন, ছেষট্টি, ঊনসত্তুরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তুরের নির্বাচন, নির্বাচনের পরে পশ্চিম পাকিস্তানের টালবাহনা এবং সবশেষে গণহত্যা চাপিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে বাঙালিকে যুদ্ধের মাঠে নিয়ে আসা— প্রত্যেকটি ধাপ গুরুত্বপূর্ণ। পঞ্চাশের দশক থেকে এর প্রতিটি ধাপে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন যে মানুষটি; যিনি এই ভূখণ্ডে মানুষের মনে স্বাধীনতার স্বপ্ন বুনে দিয়েছেন এবং ধীরে ধীরে সেই লক্ষ্য অর্জনের দিকে এগিয়ে গেছেন— তার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। এটি ঐতিহাসিকভাবে সত্য। দলমত নির্বিশেষে এই সত্য অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে ডাক দেয়া মানুষটির নামও শেখ মুজিবুর রহমান। ওই ভাষণটি অন্য কেউ দেননি। ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত প্রতিটি দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু দেশের লেখক, গবেষক ও ইতিহাসবিদদের লেখায় নয়, বরং অনেক খ্যাতিমান বিদেশি সাংবাদিক এমনকি পাকিস্তানের সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও লেখকদের লেখায়ও এটা স্পষ্ট যে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে মূলত বঙ্গবন্ধুর নামেই।
অনেকে প্রশ্ন তোলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু কেন সরাসরি স্বাধীনতার ডাক দিলেন না বা কেন তিনি ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা গণহত্যা শুরুর পর পালিয়ে না গিয়ে ধরা দিলেন? তার জবাব দিয়েছেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ। লিখেছেন: “অনেকে তখন মনে করতেন, শেখ মুজিব যদি ৭ই মার্চের ঘোড়-দৌড়-ময়দানের পঁচিশ লাখ লোকের সমাবেশে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া গবর্নর হাউস, রেডিও স্টেশন ও ক্যান্টনমেন্ট দখল করিতে অগ্রসর হইতেন, তবে একরূপ বিনা রক্তপাতে তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন করিতে পারিতেন। তাতে পরবর্তীকালে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ও নয় মাসের যুদ্ধ, তাতে ভারতের সাহায্য এসবের কিছুরই দরকার হইত না। কিন্তু বাস্তবতার দিক হইতে এটা সমীচীন হইত না এই জন্য যে তাতে সভায় সমবেত বিশ লাখ নিরস্ত্র জনতাকে সংগীন উঁচা করা সুসজ্জিত সামরিক বাহিনীর গুলির মুখে ঠেলিয়া দেওয়া হইত। তাতে নিরস্ত্র জনতাকে জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকাণ্ডের চেয়ে বহুগুণে বিপুল নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডের শিকার বানানো হইত। হত্যাকাণ্ডের বাদেও যেসব নেতা বাঁচিয়া যাইতেন, তাদের গ্রেফতার করা হইত। অতএব ৭ই মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা না করিয়া শেখ মুজিব যোগ্য জননেতার কাজই করিয়াছেন, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।” (আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, খোশরোজ কিতাবমহল/১৯৯৫, পৃ. ৫৬০)।
অতএব, দেশ স্বাধীন হওয়ার অর্ধ শতাব্দী পরে কোনো সরকার এসে যদি বলে যে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না; তিনি ছিলেন ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’, তাহলে সেটি শুধু মৃত বঙ্গবন্ধুর জন্যই নয়, বরং শহীদ, মৃত ও জীবিত সকল মুক্তিযোদ্ধা এবং দলমত নির্বিশেষে সকল দেশপ্রেমিক নাগরিকের জন্যই অবমাননার।
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব
পাকিস্তান সরকার সত্তুরের নির্বাচনের গণরায়কে কার্যত অস্বীকার করে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দুর্বার অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় এবং তাজউদ্দীন আহমদ এ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকবাহিনী গণহত্যা শুরু করলে তিনি তার কয়েকজন সহকর্মীসহ ভারতে চলে যান। ১০ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে তিনি এ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন এবং মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেন। মুক্তিবাহিনীর জন্য অস্ত্র সংগ্রহ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। বস্তুত ১৯৭১ সালের ৯ মাস পুরো মুক্তিযুদ্ধটি পরিচালিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নামে এবং তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে। এমনকি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যেদিন বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, তখন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকলেও তার পরদিন দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে এই বিজয়ের খবরের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর ছবিই ছাপা হয়েছে। সুতরাং যার নামে এবং যাদের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হলো, তারা মুক্তিযোদ্ধা নন বরং সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা—এমন একটি বিপজ্জনক ধারণা যার বা যাদের মাথা থেকে এল, তাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলা কি অনুচিত?
নতুন বয়ান?
মুক্তিযোদ্ধা মানেই যে তাকে অস্ত্র নিয়ে শত্রুর দিকে গুলি ছুড়তে হবে তা নয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের বিজয়ী জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের মধ্যে কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে সকলেই মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন। কেউ রণাঙ্গণে ছিলেন। কেউ সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের সকলেই মুক্তিযোদ্ধা। এখানে কে অস্ত্র হাতে গুলি করেছেন আর কে গুলি করেননি— সেই বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায়নের অর্থই হলো ঐতিহাসিকভাবে মীমাংসিত একটি বিষয় নিয়ে অহেতুক বিতর্কের জন্ম দেয়া। মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মানিত করা। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি গত পাঁচ দশক ধরে যে ধরনের বয়ান দেয়ার চেষ্টা করেছে— সেই বয়ানকে প্রতিষ্ঠিত করা।
কাদের ইন্ধনে এগুলো করা হচ্ছে, সেটি দেশের মানুষ বোঝে। মনে রাখা দরকার, কয়েক দশকের আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। এটি ছিল পরিকল্পিত সংগ্রাম। রাজনীতিবিদরাই জনগণকে পথ দেখিয়েছেন। সেখানে কার কী ভূমিকা, সেটি সবাই জানে। ফলে নতুন বয়ান তৈরি করলে সেটি ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। জিয়াউর রহমানের মতো একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার বীর উত্তম খেতাব বিগত আওয়ামী লীগ সরকার প্রত্যাহার করেছিল। সেটিও শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকেনি। সুতরাং ইতিহাসে যার যা অবস্থান, সেটি নির্ধারিত। নতুন ইতিহাস ও সংজ্ঞা নির্ধারণের নেপথ্যে যদি কোনো খারাপ উদ্দেশ্য থাকে, সেটি জনগণ প্রত্যাখ্যান করবে। কেননা, এখন যা করার চেষ্টা শুরু হয়েছে, তা বিগত সব উদাহরণ ছাপিয়ে যেতে চলেছে।
মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা কতবার বদলাবে?
ইতিহাসের একটা নির্মম সত্য এই যে, যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর সাথে সরাসরি যুদ্ধ করে যারা শহীদ ও আহত হয়েছেন; যারা যুদ্ধ করে অক্ষত থেকেছেন; যারা যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং টিমের সদস্য হিসাবে সশস্ত্র অবস্থায় কোনো এলাকার দায়িত্ব নিয়ে পুনরায় দেশে প্রবেশ করেছেন ও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন; যারা যারা দেশের ভেতরে থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে শত্রুর মোকাবেলা করেছেন; যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন— তারা যেমন মুক্তিযোদ্ধা, তেমনি প্রচুর সুবিধাবাদী লোকও মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। অনেকেই প্রশিক্ষণ নিয়েও যুদ্ধে যাননি; সীমান্ত এলাকায় ঘোরাঘুরি করেছেন এবং যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে নেতা সেজে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন। রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার আশায় অনেকে বয়স লুকিয়ে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়েছেন। এমনকি অনেক রাজাকারও জেনারেল ওসমানীর স্বাক্ষর করা সনদ জোগাড় করে নাম, পরিচয় ও ঠিকানা পালটে মুক্তিযোদ্ধা সেজেছিলেন— এমন অভিযোগও আছে। পরে যাচাই-বাছাইয়ে অনেকের সার্টিফিকেট বাতিল হয়েছে। এরকম বাস্তবতায় একাধিকবার মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞাও বদলে গেছে।
১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠনের সময় মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল এভাবে: freedom fighter means any person who had served as a member of aû force engaged in the war of liberation. অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধা অর্থ এমন কোনো ব্যক্তি যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধে নিয়োজিত কোনো বাহিনীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে এ সংজ্ঞা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় নিশ্চিত করা হতো।
২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর প্রকাশিত গেজেটে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নতুন করে নির্ধারণ করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। সে অনুযায়ী ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ‘১৯৭২-এর মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট আইন’ যুগোপযোগী আখ্যা দিয়ে জাতীয় সংসদে সংশোধন করা হয়। ওই আইনে বলা হয়, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হইবেন, যথা-(ক) যে সকল ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করিয়া ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে তাহাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করিয়াছিলেন। (খ) যে সকল বাংলাদেশি পেশাজীবী মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশে অবস্থানকালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ অবদান রাখিয়াছিলেন এবং যে সকল বাংলাদেশি নাগরিক বিশ্ব জনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করিয়াছিলেন। (গ) যাহারা মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) অধীন কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা দূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। (ঘ) মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) সহিত সম্পৃক্ত সকল এমএনএ বা এমপিএ, যাহারা পরবর্তীকালে গণপরিষদের সদস্য হিসেবে গণ্য হইয়াছিলেন। (ঙ) পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাহাদের সহযোগী কর্তৃক নির্যাতিতা সকল নারী (বীরাঙ্গনা)। (চ) স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সকল শিল্পী ও কলা-কুশলী এবং দেশ ও দেশের বাহিরে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে দায়িত্ব পালনকারী সকল বাংলাদেশি সাংবাদিক। (ছ) স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সকল খেলোয়াড় এবং (জ) মুক্তিযুদ্ধকালে আহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী মেডিক্যাল টিমের সকল ডাক্তার, নার্স ও চিকিৎসা সহকারী।’ এই সময় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার বয়সসীমাও ছয় মাস কমিয়ে সাড়ে ১২ বছরের গেজেটভুক্ত সবাইকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়া হয়।
২০২২ সালে হওয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ কাউন্সিল (জামুকা) আইনেও মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা যুক্ত করা হয়। সংজ্ঞায় বলা হয়, ‘যারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে গ্রামেগঞ্জে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন এবং ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে দখলদার ও হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন এবং যাদের বয়স সরকার নির্ধারিত বয়সসীমার মধ্যে তারা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হবেন।’
এ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার বয়স, সংজ্ঞা ও মানদণ্ড ১০ বারের বেশি পরিবর্তন করা হয়েছে। তিন দফা পরিবর্তন হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সনদের নমুনা। সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে সনদ প্রদানের কর্তৃত্ব এবং কর্তৃপক্ষও। বাঙালির সবেচেয়ে বড় অর্জন, সবচেয়ে গৌরবের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাষ্ট্রীয় অনাচার এবং সরকারভেদে রাজনৈতিক এজেন্ডা পরিবর্তনের কারণে বারবার মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নটি বিতর্কের মুখে পড়েছে।
অভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পরে গত ডিসেম্বর মাসে বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় আবারও পরিবর্তন আনা হয়। নতুন ওই সংজ্ঞায় মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণকারীরাই হবেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। অন্যদিকে বিশ্ব জনমত গঠনে ভূমিকা রাখা ব্যক্তিরা, মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী, চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী, শিল্পীসমাজসহ যারা মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন তাদের ‘যুদ্ধ সহায়ক’ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। সম্প্রতি এ বিষয়ে জামুকার সিদ্ধান্তের কথা গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে।
কেন এই বিতর্ক?
বাংলাদেশ হচ্ছে পৃথিবীর সেইসব বিরল দেশের একটি, যে একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয়েছে। লাখ লাখ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। যে গৌরব ও অহংকার তার প্রতিবেশী কোনো দেশের নেই। এরকম একটি বিশাল অর্জনের সৌভাগ্যবান যে জাতি, তারা তাদের স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরেও মুক্তিযোদ্ধার একটি সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা ঠিক করতে পারল না; মুক্তিযোদ্ধার ন্যূনতম বয়স ঠিক করতে পারল না; মুক্তিযোদ্ধার একটি সঠিক তালিকা করতে পারল না— এই লজ্জা কার? লজ্জা মূলত অতীতের সরকারগুলোর। কেননা তারা প্রত্যেকেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যবসা করেছে। নিজেদের ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতায় যাওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে।
তবে এই সকল বাস্তবতা মাথায় রেখেই এটা স্বীকার করতে হবে যে, বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তার নামে এবং তাজউদ্দীনদের নেতৃত্বেই ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এখানে কোনো ‘যদি’ বা ‘কিন্তু’ নেই।
সুতরাং, মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন যদি সংশোধন করতে হয়, সেখানে এক নম্বর এজেন্ডা হওয়া উচিত মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রণয়ন করা এবং ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া। সেখানে যাতে কোনোভাবেই রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য না পায়। কেউ যাতে স্থানীয় রাজনৈতিক বিরোধ ও টাকা-পয়সার প্রভাব খাটাতে না পারে— সে বিষয়ে তালিকা প্রণয়ন কমিটিকে সর্বোচ্চ সতর্ক, স্বচ্ছ ও সৎ থাকতে হবে। কিন্তু ঢালাওভাবে মুক্তিযুদ্ধকালীন এমএনএ বা এমপিএ, গণপরিষদ সদস্যসহ সবার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় বাতিল করা এমনকি বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের মতো জাতীয় নেতাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা না বলে সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে। কেননা এই জাতীয় নেতাদের সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা বলার মধ্য দিয়ে বাঙালির সবচেয়ে বড় অর্জন মুক্তিযুদ্ধকেই অবমাননা করা হবে— যা কারোরই কাম্য নয়।
অন্তর্বর্তী সরকার যখন জাতীয় ঐক্যের কথা বলছে এবং সেই লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ চলছে; দেশ যখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে এবং দেশের মানুষ যেখানে নিজেদের জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন; যখন দেশি-বিদেশি নানা চক্রান্তের কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে বলে অনেকে মনে করেন এবং যে পরিস্থিতিতে দলমত নির্বিশেষ সকলের একতাবদ্ধ থাকা প্রয়োজন; সেরকম একটি সময়ে মুক্তিযুদ্ধের মীমাংসিত একটি বিষয় নিয়ে বিতর্ক উসকে দিয়ে আখেরে সরকারের কোনো লাভ হবে না। বরং দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নেবে। এই মুহূর্তে এমন কোনো কাজ করা বা তাতে সমর্থন দেয়া উচিত হবে না, যা জাতিকে আরও বেশি বিভাজিত করে।