আওয়ামী লীগ চেয়েছে শর্তহীন স্তুতি— বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের। বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙিয়ে এই দল পুরো দেশটাকে একটা ভাগাড় বানিয়ে ফেলেছিল এবং তা বানাতে গিয়ে নিজেদের মনগড়া আইন গড়ে ও ভেঙে স্বৈরাচারী কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা কায়েম করেছিল।
Published : 15 Aug 2024, 07:51 PM
আমার বিশ্ববিদ্যালয়-জীবন, ছাত্র রাজনীতি ও লেখালেখি জীবনের প্রায় পুরোটাই কেটেছে আওয়ামী রেজিমে। ছাত্র ইউনিয়ন করতাম, ফলে, লম্বা সময় আমাদের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল ছাত্রলীগ। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর ছাত্রদলকে বিতাড়িত করে ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসগুলো 'দখল' করে নেয়৷ আমল বদলালেও, শিক্ষার্থী ও শিক্ষাবিরোধী রূপ যা ছিল, তা-ই রয়ে গেল। আমরা দেখলাম, অনেকেই ছাত্রদল থেকে ছাত্রলীগে প্রতিস্থাপিত হলো!
এই প্রক্রিয়ায় একদিন হলের ছাত্রলীগ-শাসিত এক কক্ষে ডেকে নিয়ে অস্ত্রের মুখে আমাকে ও আমার নিকটতম সাংগঠনিক বন্ধুকে ছাত্রলীগে যোগদান করতে জোর-জবরদস্তি করা হয়েছিল। ওই মারকাটারি রাজনীতি আমাদের প্রাণে সইত না বলে আমরা দুজনই সরাসরি প্রত্যাখান করেছিলাম। সন্ত্রাসবাদী রাজনীতি ততদিনে আমাদের দেখা হয়ে গেছে ক্যাম্পাস জীবনের শুরুতে। আমরা দেখেছি, ছাত্রদল কীভাবে পাততাড়ি গুটিয়ে পেছন দরজা দিয়ে পালিয়েছিল। আমাদের পরের আশঙ্কাও সত্য হয়েছিল— ছাত্রলীগের সেই বন্দুক দেখানো দাপুটে নেতারা ক্যাম্পাসে খুব বেশিদিন টিকতে পারেনি, নিজেদেরই উপদলীয় কোন্দলে ক্যাম্পাস ছেড়েছে; কেউ কেউ সনদও নিতে পারেনি। আমরা কিন্তু ঠিকই শিক্ষার্থীদের কাতারে রাজনীতি করে ক্যাম্পাস জীবন সম্মানের সঙ্গেই শেষ করেছি।
দল থেকে লীগ— ওই পটপরিবর্তনের কালেই কয়েকজন আমাদের ছেড়ে চলে গেল। কেন ও কীসের টানে, তা তখন বুঝিনি, পরে বুঝেছি। বদলে গেল ওদের জীবন দর্শনও। আর পুরো ক্যাম্পাস জীবনটাই পরে হয়ে উঠল ওদের জন্য বিভীষিকাময়। একটা পর্যায়ে আর দাঁড়াতেও পারেনি রাজনীতিতে ঠিকঠাক। ঠিক এ পর্যায়েই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ তথা কুখ্যাত ভিসিলীগের হাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় ছাত্রলীগেরই এক সময়ের কর্মী, আমাদের বন্ধু জুবায়ের আহমেদ। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রলীগের মধ্যেই দ্বিধাবিভক্তি চলে আসে৷ যারা ক্যাম্পাস জীবনের প্রায় শুরুর দিকে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিল কিংবা সমমনা বন্ধু হিসেবে আমাদের সঙ্গে চলত-ফিরত, তারা ক্যাম্পাস জীবনের শেষদিকে এই হত্যাকাণ্ডের ফলে সংঘটিত সন্ত্রাসবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয়। আফসোসের বিষয় ২০১২ সালের হত্যাকাণ্ডের বিচার ও রায় কার্যকর আজও রাষ্ট্র করতে পারেনি!
আওয়ামীপন্থি হয়েও, সেদিন যারা জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে আন্দোলন করেছিল, তাদের অনেকেই কিন্তু 'জুলাই হত্যাকাণ্ডে'র প্রতিবাদে ব্যাপক সরকারবিরোধী অবস্থান নেয় এই গণঅভ্যুত্থানেও। এগুলো হলো রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন। তো ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার কথা যারা বলছে, তারা এর থেকে শিক্ষা নিতে পারে, ভাবতে পারে যে, ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হবে নাকি সন্ত্রাসবাদী ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হবে।
রাজনীতি হবে জনকল্যাণমুখী। সেটা আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি কোনো কালেই। উল্টো মুক্তিযুদ্ধ-বঙ্গবন্ধু-উন্নয়নের নামে ভোটডাকাতি করে রেজিম টিকিয়ে রাখা আওয়ামী লীগ জনকল্যাণকে দলকল্যাণে-পরিবারকল্যাণে সংকুচিত করে ফেলছিল আরও। তাই সন্ত্রাস, পেশিশক্তি, গুম হত্যাকাণ্ড সবকিছুই হালাল হয়ে গিয়েছিল এই ব্যবস্থায়। গত আওয়ামী রেজিমের বিপক্ষে যখনই যেখানে আন্দোলনের বিজয় হয়েছে, তখনই মনে হতো এরপর তো আবার এদের প্রতাপ অন্যখানে শুরু হয়ে যাবে! তাই গণঅভ্যুত্থানের বিজয়-পথে মানুষ যখন একাট্টা হয়ে রাজপথে নেমেছে, তখন উল্টো মনে হয়েছে, আরেকটু ধাক্কা দিলেই এবার হয়ে যাবে! তখন বারবার মনে হয়েছে, এ লড়াইয়ে হয়তো থাকতে পারত ত্বকী, বিশ্বজিৎ, জুবায়ের, সাগর-রুনি, তনু, নুসরাত, মুনিয়া, আবরার প্রমুখ— যারা হত্যার শিকার হয়েছে আওয়ামী রেজিমে, ক্ষমতাবানদেরই মদদে এবং সবগুলো হত্যাকাণ্ডেরই হয় বিচার হয়নি অথবা রায় কার্যকর হয়নি। সাঈদ-মুগ্ধদের হারানোর শোক যেমন আন্দোলনকে শক্তি দিয়েছে, তেমনই দেশের বহু জায়গায় বিগত দিনে বিচার না পাওয়া শোকগুলো মিলিত হয়ে একটা সম্মিলিত শক্তি তৈরি করেছিল নিশ্চয়ই। স্বজন হারানোর স্বতন্ত্র বেদনা তাদেরও আছে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে জেগে ওঠা শোক তাদেরও আছে৷ রাজন্যের শোকই শুধু শোক নয়, সাধারণ্যের শোকও যে শোক— কর্তৃত্বপরায়ণ উন্নয়নবাদী হাসিনা রেজিম তা বোঝেনি। নইলে শহীদদের পরিবারের পাশে না দাঁড়িয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রোরেল-বিটিভি ভবনে যাওয়া একজন সরকারপ্রধানের অগ্রাধিকার হয় কীভাবে!
২.
আজ শোকাবহ ১৫ অগাস্ট৷ বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা! গত কয়েক বছরও ১৫ অগাস্ট এসেছিল। আজকের ১৫ অগাস্টের প্রেক্ষাপট গত ১৬ বছরের তুলনায় ভিন্ন। বঙ্গবন্ধুর দল ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো! ১৯৭৫ সালে ক্যু করেছিল সেনাবাহিনীর বিপথগামী অফিসাররা, এবার ছাত্র-জনতার প্রকাশ্য দিবালোকে বীরোচিত গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়েছে।
বিগত আওয়ামী রেজিমে লেখালেখির জীবন শুরু করা আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রসঙ্গে লিখেছি। তার রাজনৈতিক জীবনটি আশ্চর্য এক 'পাঠ্যপুস্তক', তার লিখিত 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'টি পড়লেই তা বোঝা যায়। কিন্তু, যা লিখতে চাইতাম তা লিখতে না পারার নানাবিধ কারণ ছিল, ভয়ের সংস্কৃতি তো অবশ্যই এর একটি কারণ। লিখতে গিয়ে মনে হতো, খালি ব্যাকস্পেস দিতে হচ্ছে, সেলফ সেন্সর হচ্ছে! একজন লেখক এমতাবস্থায় জীবন্মৃত হয়ে যান। অথচ, এই ১৬ বছরে এতো এতো বিগলিত চর্বিতচর্বণ পড়েছি যে, মনে হতো বাংলাদেশে কাক ও ক্ষমতা তোষণকারী চেতনাবাজ লেখকের সংখ্যা সমান!
আমি সবসময়ই বলি, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখতে, বলতে, বিহ্বল হতে আওয়ামী লীগ করার প্রয়োজন নেই। হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধু নির্দলীয় নন। তিনি পার্টিজেন। ঘটনাচক্রে তার দলটার নাম আওয়ামী লীগ, যার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ গত ১২-১৩ বছর ধরে বিক্ষুব্ধ ছিল, বিশেষত ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে মানুষের ভোটাধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলায়। ১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনীতে বাকশাল কায়েম করে বাংলাদেশকে বহুদলীয় শাসনব্যবস্থা থেকে একদলীয় শাসনব্যবস্থায় রূপান্তর করেন সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এসব ভাবলে, হতবিহ্বল হতে হয়! এমন একনায়ক তাকে কেন হতে হতো! কিন্তু, তার অতীতের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সদাসর্বদা আশান্বিত করেছে আমাকে। রাজনীতি করতেন বলে, তিনি নির্দলীয় হতে পারেন না এবং সে দলকে স্বভাবতই সবাই পছন্দ করবে না। কিন্তু, মৃত মানুষের আবার দল কী! তিনি যখন সবকিছুর উর্ধ্বে, তখন তার ওই রাজনৈতিক জীবনটাকে ক্রিটিক্যালি প্রত্যেকটি বাংলাদেশির পাঠ করা প্রয়োজন। কেননা, ওই জীবনের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজমন্ত্রটি রোপিত আছে। কিন্তু, আওয়ামী লীগ চেয়েছে শর্তহীন স্তুতি— বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের। বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙিয়ে এই দল পুরো দেশটাকে একটা ভাগাড় বানিয়ে ফেলেছিল এবং তা বানাতে গিয়ে নিজেদের মনগড়া আইন গড়ে ও ভেঙে স্বৈরাচারী কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা কায়েম করেছিল।
সেজন্যই, ভয়ডর ও দুশ্চিন্তা, নিবর্তনমূলক আইনের প্যাঁচে পড়ার হুমকি থাকার পরও, নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করেছি টানা ১৬ বছর। তাদের 'বিকল্প কে' নামক ঝুলানো মুলোটাকে প্রত্যাখ্যান করে গেছি বরাবর। সেজন্যই এ ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পথে পথে যে শিক্ষকরা অসামান্য অবদান রেখে শিক্ষার্থীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, তাদের সঙ্গে পথে হেঁটে যৎকিঞ্চিৎ ভূমিকা পালন করেছি। আমাদের সবারই নানা মাত্রিক ভূমিকায় 'বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক' আজ জনগণের কাছে একটি ভরসাযোগ্য নাম। আমি কদাপি বিকল্পহীনতা নিয়ে ভেবে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াইনি, আমি-আমরা চেয়েছি বাংলাদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর হয়ে শিক্ষার্থী হত্যাকাণ্ডের বিচার হোক। কিন্তু, সেসব দাবিকেও খুব হালকাভাবে নেওয়া হয়েছিল। একটা অপরাধ ঢাকতে আরও অসংখ্য অপরাধের জন্ম দেওয়া হয়েছিল। এজন্যই দ্রোহযাত্রা থেকে একদফায় পরিণত হয় আন্দোলন। আমরা জানতাম, মানুষই তার রাজনৈতিক বিকল্প গড়ে তোলে তার সময়ের প্রয়োজনে। বিকল্প নিয়ে দ্বিধাহীন মানুষ তাই গণঅভ্যুত্থান সফল করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুকে ভাঙানো, উন্নয়নের ত্যালত্যালে বয়ান আর টিকেনি জনস্রোতের কাছে।
৩.
বিগত রেজিম নিয়ে সবচেয়ে আতঙ্কবোধ করতাম এ কারণে যে, ওরা মুক্তিযুদ্ধ চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙিয়ে ব্যবসা করত, চুরি করত, ভূমি দখল করত, টাকা বিদেশে পাচার করত, তার নামে স্লোগান দিয়ে মানুষ মারত, খুন করত। আমার এক সহমর্মী নিকটজন দুর্দান্ত একটা মন্তব্য করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য দেখিয়ে, বিএনপি করতেন এক সময়, কিন্তু কী দারুণ শ্রদ্ধাবোধ: “এই যে বুড়োটা, তার নামে সবাই সব ভেঙে খেয়ে, দোকান খুলে ব্যবসা করে রাতে বাড়ি গিয়ে আরাম করে ঘুমায়, আর বুড়োটা ঝড়-বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থেকে রাত জেগে সারাদেশটা পাহারা দেন!”
বঙ্গবন্ধুর প্রতি নিবেদিত এতো অসামান্য ক্রিটিক্যাল কথা আমি অন্তত শুনিনি!
বঙ্গবন্ধুর পরিবার ও তার পার্টি এসব কখনই পরোয়া করেনি। দেশটাকে সম্পত্তি ভেবে লুটপাট করেছে। আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক আধিপত্য ও শেখ হাসিনা তার কর্তৃত্ববাদী সরকারি স্বৈরাচারের অহমিকায় পারেননি বঙ্গবন্ধুকে সবার মধ্যে সাংস্কৃতিকভাবে স্থায়ী করতে, নিরপেক্ষ রাখতে। লেসপেন্সাররা শুধু তেলবাজি-চাপাবাজি করে গেছে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ব্যবসা করে নিজেদের আখের গুছিয়েছে। চব্বিশের এই গণঅভ্যুত্থান তো বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে নয়; শেখ হাসিনা, তার সৃষ্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা, সরকার ও পার্টির বিরুদ্ধে। গত ১৬ বছরে বোঝার উপায় ছিল না কোনটা রাষ্ট্র, কোনটা সরকার। মানুষের এতো পুঞ্জীভূত ক্ষোভ যে, তা এদের অপশাসনের কারণে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বঙ্গবন্ধুর ওপর এসে পড়েছে।
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙা, বাংলাদেশের গৌরবান্বিত স্বাধীনতা সংগ্রামের আতুড়ঘর ধানমন্ডি-৩২-এর বঙ্গবন্ধুর সমস্ত স্মৃতির অগ্নিদগ্ধ দশা— বেদনাহত, হতবাক, হতাশ করেছে। মনে হয়েছে বঙ্গবন্ধুর যেন দ্বিতীয় মৃত্যু হলো! প্রথমবার তার আবেগান্বিত ভুলে, দ্বিতীয়বার তার মেয়ের মহিমান্বিত ভুলে। অথচ আওয়ামী লীগ ২০০১ সালে যখন নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা থেকে চলে গেছে, বঙ্গবন্ধুর ওপর এমন আক্রমণ আসেনি। যা এবার হয়েছে, তা নিন্দনীয় ও অসহনীয়। কিন্তু, সেবার ও এবারের পার্থক্যটা নিশ্চয়ই পরিষ্কার৷
বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিগুলো হয়তো শেষ, কিন্তু যারা ভাবছে তাকে নিশ্চিহ্ন করা সহজ— তারা রাজনীতির অআকখ কিছুই বুঝে না। আপনি যে পন্থি রাজনীতিই করেন না কেন, আন্তর্জাতিক মঞ্চে দাঁড়াতে গেলে তাকে আপনার লাগবে। এই বাংলাদেশ সৃষ্টিতে তার অবদানকে অস্বীকার করে আন্তর্জাতিক পরিসরে কোথাও আলাপ করতে গেলেই আপনি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ধরাশায়ী হবেন৷ এই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানেও বঙ্গবন্ধুর বহু ভাষণ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে উদ্ধৃতি তৈরি করা হয়েছে— ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না!’ অমন জাতীয়তাবাদী নেতা ও অনলবর্ষী বক্তার সমন্বয়ে নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিক বাংলার ইতিহাস তো বটেই, পৃথিবীর ইতিহাসেই আছেন হাতেগোনা কয়েকজন!
আবার, বঙ্গবন্ধুকে 'ধর্মগুরু' বানিয়ে তার সমালোচনা করতে দেবেন না যারা, তারাও অবাঞ্ছিত হবেন। বঙ্গবন্ধুকে বাঙালি 'জাতির পিতা' বানানো হয়েছে যেভাবে সেটাও একটা টার্মিওলজিক্যাল ভুল৷ আওয়ামী লীগারদের এসব আপনি বলতেই পারবেন না। বললেই ব্লাশফিমাস! 'ফাদার অব দ্য নেশন' মানে 'জাতির পিতা' না। কোনো সন্তান তার পিতার আগে জন্মাতে পারে না।
এটা নিয়ে আগেও লিখেছি। যদিওবা Nation শব্দটার অর্থ নিয়ে অনেক ঝামেলা/বিতর্ক আছে, রবীন্দ্রনাথসহ অনেকেই এ বিতর্ক করেছেন, তবে, Father of the Nation-এর যথার্থ অনুবাদ হওয়া উচিত ‘রাষ্ট্রপিতা’, গান্ধীকেও সে অর্থেই দলমত নির্বিশেষে ভারতে ‘রাষ্ট্রপিতা’ বলে এবং আমরা যে জাতিসংঘ বলি, সেটাও সংশোধন করে রাষ্ট্রসংঘ বলা দরকার।
বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু প্রশ্নে দলমত নির্বিশেষে এক হওয়ার সম্ভাবনা এতো ঘটনার পর অন্তত দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ পারেনি বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের করতে, পারবে বলেও মনে হয় না। কারণ, আওয়ামী লীগ যা করে তা বাড়াবাড়ি রকমের আরোপিত। সাংস্কৃতিকভাবে সৃষ্ট না। জোরাজুরি করে জনসম্মতি আদায় করা যায় না! ফলে, বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের সবার বানানোর দায় আসলে বাংলাদেশেরই।
আওয়ামী লীগ জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধের অবদানকে অস্বীকার করে বলে, বিএনপিও বঙ্গবন্ধুকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দেয় না। মর্যাদা পান না তাজউদ্দীন আহমেদের মতো নেতাসহ আরও অনেকে। জিয়াউর রহমান তো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ও অনেক পরে এসেছেন রাজনীতিতে, যতদিন বেঁচে ছিলেন বঙ্গবন্ধুকে অশ্রদ্ধা করে একটা কথা বলেননি বলেই জানি। কিন্তু, ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ পর্যন্তই আওয়ামী লীগের কত বড় বড় নেতা ছিলেন। তাদের প্রাপ্য মর্যাদাই দেয়া হয়নি, আর জিয়া তো প্রতিদ্বন্দ্বী। এসব করতে গিয়ে শুধু রাজপরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতি করা হয়েছে গত ৫০ বছর। উভয় পার্টিই তা করেছে। কিন্তু, এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি বন্ধ হওয়া জরুরি। বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বার্থেই জরুরি।
৪.
আজ মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু ব্যবসায়ীরা তেলবাজি করবে না, অযাচিত ধান্ধাবাজিময় স্তুতির বন্যায় ভেসে যাবে না দেশ, এটা দেখা স্বস্তিদায়ক। গত ১৬ বছর বঙ্গবন্ধু রুদ্ধ ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে চাটারদের খপ্পর থেকে মুক্ত করে পুরো বাংলাদেশের বানানোর জন্য এ সময়টাই সর্বোৎকৃষ্ট। অসৎ আওয়ামী লীগাররা নইলে আবার তার মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া শুরু করবে! আর যারা শোক পালনে বাধা দিচ্ছে, তাদের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের ২০২৩ সালের অগাস্টে ফেইসবুকে লেখা কথাটা প্রযোজ্য হোক: "শোক প্রকাশের স্বাধীনতা চাই!... শোক প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতেই হবে।"
শোক জানাই। শোকের দিনে, হাসিনাশাহীর হীরক রাজত্বহীন এ অদ্ভুত পালাবদলের কালে, আজ আমি মন শান্তি করে ৭ই মার্চের অমর মহাকাব্যটি শুনব!