আইএমএফের ঋণের শর্ত: সরকারের দায় ও জন উদ্বেগ

অর্থ ঋণের ক্ষেত্রে আইএমএফ বাংলাদেশকে অনেকগুলো শর্ত দিয়েছে। তার একটি হচ্ছে, দেশ থেকে অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে।

মঞ্জুরে খোদামঞ্জুরে খোদা
Published : 28 Nov 2022, 06:18 AM
Updated : 28 Nov 2022, 06:18 AM

ঋণ নেওয়ার অর্থ সংকটকে স্বীকার করা। প্রশ্ন হচ্ছে, সংকট কতটা গভীর ও গুরুতর? এ বিষয়ে সঠিক তথ্য না জানলে বা না জানালে তা মোকাবেলার কাজটি হবে কঠিন। শাসকের দুর্বলতা, অব্যবস্থাপনা ও ব্যর্থতার কারণে এই দুরাবস্থা তৈরি হলেও এর মোকাবেলা করতে হবে সকলে মিলেই। সে কারণেই সংকটের গভীরতা ও সম্ভাব্য বিস্তৃতি সম্পর্কে যেমন স্পষ্ট ধারণা দরকার এবং সেখান থেকে উত্তরণে অন্যদের ভূমিকাও পরিষ্কার করা জরুরী।

বাংলাদেশের ঋণের কেন দরকার হলো?

ঋণের দরকার হলো কারণ, দেশের আমদানি ও আভ্যন্তরীণ অন্যান্য খরচ মেটাতে অর্থের দরকার। ওই প্রয়োজনীয় অর্থ বা ডলারের সংকট থাকায় আইএফএফ ও বিশ্ব ব্যাংকের কাছে ঋণের আবেদন করতে হয়েছে। হঠাৎ করেই যেন দেশের আমদানি ব্যয়সহ অন্যান্য খরচ অনেক বেড়ে গিয়েছে। প্রায় প্রতিমাসে সরকারকে ৭-৮ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হচ্ছে এবং তা রিজার্ভ থেকে প্রদান করতে হচ্ছে। শোনা যায়, দেশে বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে ২৬.৩ বিলিয়ন ডলার। সেটা হলে তহবিলে যে অর্থ আছে তা দিয়ে চলবে মাত্র কয়েক মাস। বর্তমান রিজার্ভ শেষ হলে সেই সময়ের ঘাটতি মেটাতেই ঋণ করতে হচ্ছে। যদিও রিজার্ভের প্রকৃত পরিমাণ নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। দেশে বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ ২৬.৩ না ৩৪ বিলিয়ন ডলার তা নিয়ে স্ববিরোধী বক্তব্য পাওয়া যায়। ওই কারণে আইএমএফ-এর পক্ষ থেকে এই হিসেব পদ্ধতির পুনর্মূল্যায়ন করতে বলা হয়েছে।

বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস কী?

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস প্রধানত দুটি। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ এবং গার্মেন্টস রপ্তানি থেকে আয়। ওই আয়ে কি গত দুই-তিন বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে বা এই খাতে কি ব্যাপক কোনো ধস নেমেছে? পরিসংখ্যান থেকে এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বরং করোনাকালেও প্রবাসীরা দেশে অর্থ পাঠিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে অতীতের চেয়ে অধিক অর্থ পাঠিয়েছে। করোনাকালে রপ্তানিমুখী খাত কিছু সমস্যার মধ্যে দিয়ে গেলেও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে ধারাবাহিকতা রেখেছে।

দৈনিক যুগান্তরের এক প্রতিবেদন বলছে, “দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স। এ দুই খাতে আয় বাড়ছে। এদিকে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলা কমতে শুরু করেছে। এরপরও আমদানি ব্যয় কমেনি। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধির পরিবর্তে কমে যাচ্ছে। রিজার্ভ কমে গত রোববার ৩৬৮৫ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। করোনার সময় স্থগিত এলসির দেনা ও বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে।

জানা গেছে, গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স খাতে আয় হয়েছে ২১০৩ কোটি ডলার। রপ্তানিতে আয় হয়েছে ৫২০৮ কোটি ডলার। এই দুই খাতে ৭৩১১ কোটি ডলার আয় হয়। একই অর্থবছরে আমদানি বাবদ ব্যয় হয়েছে ৮২৫০ কোটি ডলার। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় হয়েছে ৯৩৩ কোটি ডলার। বাড়তি বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থেকে পরিশোধ হচ্ছে। এর বাইরে বৈদেশিক বিনিয়োগ বাবদ গত অর্থবছরে এসেছে ২১৮ কোটি ডলার। একই সময়ে বিদেশে চিকিৎসা, ভ্রমণ ও পড়াশোনায় এর চেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে। সব মিলে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হচ্ছে। এ কারণে ডলারের সংকটও প্রকট হচ্ছে।

আগে রপ্তানি আয় থেকে ৬০ ভাগ আমদানি ব্যয় মেটানো যেত, বাকি ৪০ ভাগ মেটানো হতো রেমিট্যান্স দিয়ে। এই ব্যয় মিটিয়েও কিছু ডলার থেকে যেত, সেগুলো রিজার্ভে জমা হতো। বলা হচ্ছে, বিশ্ববাজারে পণ্য মূল্য বৃদ্ধির কারণে রেমিটেন্সের উপর বাড়তি চাপ পড়ায় এই সংকট তীব্র হয়েছে।”

এই সংকটের কারণ কী?

এই সংকটের একটি প্রধান বিষয় বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও ব্যয়ের অসঙ্গতি। সম্প্রতি বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় ৫৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও এই আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির চিত্র-হিসেব কতটা সত্য সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ডলার সংকটের কারণ প্রসঙ্গে অর্থ পাচার প্রতিরোধ সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান কর্মকর্তা মাসুদ বিশ্বাস বলেন, “২০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য বাড়িয়ে দেখিয়ে কোনো কোনো পণ্য আমদানি করা হয়েছে।” তারমানে, এই বাড়াতি মূল্যের অর্থ দেশে আনা হয়নি, বিদেশে পাচার হয়েছে। এই অর্থ পাচারের কারণে ডলারের একটি বড় অংশ দেশে আসছে না।

তার সাথে দুর্নীতিগ্রস্থ আমলা-ব্যবসায়ী-রাজনীতিকরা অসাধু উপায়ে উপার্জিত অবৈধ অর্থও বিদেশে পাচার করেছে। পাচারকৃত অর্থ তারা বিদেশের ব্যাংকে জমা রেখেছে, সেখানে সম্পদ সৃষ্টি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ করেছে। গত এক দশকে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ জমা পড়েছে ৫ হাজার ২৯১ কোটি টাকা। হুণ্ডিসহ অন্যান্য অনৈতিক মাধ্যমেও সরকার রেমিট্যান্সের একটি বড় অংশ হারাচ্ছে।

এ তথ্যই দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ করে আসছে, মার্কিন প্রতিষ্ঠান জিএফআই। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে (২০০৯-২০১৮) ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ৮.২৭ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে। আর সরকার বৈদেশিক মুদ্রা সংকট মোকাবেলায় আইএমএফ-এর কাছ থেকে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ করছে। অথচ প্রতিবছর দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে তার প্রায় দ্বিগুণ অর্থ।

১৯৯০ সালে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা। বর্তমানে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকায়। অর্থাৎ ৩২ বছরে খেলাপি বেড়েছে ২৯ গুণ। যদিও কয়েক বছর আগে আইএমএফ-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, “বাংলাদেশে খেলাপি আড়াল করা হয়েছে। কেননা প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি।” তারা আরও বলেছিল, “সবমিলিয়ে বাংলাদেশের খেলাপি ঋণ হবে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা”। তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ঠিকমতো হিসেবে করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ হবে চার লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। এর সাথে হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক), ক্রিসেন্ট গ্রুপ ও বিসমিল্লাহ গ্রুপের মতো বড় বড় দুর্নীতি-লুটপাটের পুরনো আলাপ তো আছেই।

বাংলাদেশের মানুষের হাতে কি পরিমাণ অপ্রদর্শিত অর্থ আছে তার কোনো প্রকৃত হিসাব নেই। এনবিআর বলছে, স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৭ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে জরিমানা দিয়ে অবৈধ অর্থ বৈধ করার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা। আর গত এক বছরেই প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা অবৈধ অর্থ সাদা হয়েছে। টিআইবির প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের কালো টাকার পরিমাণ জিডিপির ১০ থেকে ৩৮ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করে। কি বিপুল দুর্নীতির চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে আমাদের অর্থনীতি।

অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে প্রধান করে গঠিত ব্যাংক সংস্কার কমিটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল ১৯৯৯ সালে। এ প্রসঙ্গে মাহমুদ বলেন, “রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহ রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা বণ্টনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হইয়াছে, যাহাও খেলাপি ঋণের অন্যতম কারণ। স্বার্থান্বেষী ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীসমূহের বিরোধিতা ব্যাংকিং খাত সংস্কারের সম্ভবত সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। এ কারণে সংস্কার কর্মসূচি সফল করতে হলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার।” মূলত এই অঙ্গীকারই কখনো দেখা যায়নি বলেই খেলাপি ঋণ ক্রমান্বয়ে বেড়েছে।

সুতরাং বর্তমান সংকটের জন্য সরকার আয়-ব্যয়ের এই অসঙ্গতির কথা বলে নিজেদের দায় এড়াতে পারে না। বিশেষজ্ঞদের মতে এই সংকটের একটি প্রধান কারণ বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার, লুটপাট, দুর্নীতি, অনিয়ম, অপচয় প্রভৃতি।

এই সংকটের জন্য রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ কতটা দায়ী?

বিশ্বে অর্থনৈতিক সংকটের জন্য রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ অবশ্যই একটা বড় কারণ তবে সব দায় আবার তাদের কাঁধে চাপানোও ঠিক নয়। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটের কথাই ধরা যাক। সেখানে ওই সংকট রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরুর পূর্বেই শুরু হয়েছিল। পরে সেটা গণঅভ্যুত্থানে রুপ নিলে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী রাজাপাকসে পদত্যাগ করেন আর ক্রমবর্ধমান জনরোষে রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া জুলাইয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।

রাশিয়া ইউক্রেইনে অভিযান শুরু করেছে এ বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি। আর শ্রীলঙ্কায় ৩১ মার্চ হাজার হাজার বিক্ষোভকারী প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগের দাবিতে তার বাসভবনে হামলার চেষ্টা করে। ১ এপ্রিল বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ায় গোটাবায়া দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করেন। তারমানে ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ সময়ে তখনো বিশ্ব অর্থনীতির সংকটের প্রভাব শুরু হয়নি।

সে জন্য বলছি, বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক সংকটের জন্য ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধ ও করোনাভাইরাসকে কতটা দায়ী করা যায়? এই করোনাকালীন দুর্যোগের সময়েই বাংলাদেশের কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে। দেশে অর্থনৈতিক সংকট থাকলে তো তা হওয়ার কথা নয়। আগেও বলেছি, করোনা ও যুদ্ধ অবশ্যই সংকটের একটি প্রধান কারণ কিন্তু বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ও প্রশাসনিক দুর্বলতা, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুর্নীতি, লুটপাট, অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা, অর্থ পাচার রোধে ব্যর্থতার দায়কে অস্বীকার করা যাবে না।

অর্থ পাচার বন্ধে আইএমএফ-এর পরামর্শই কি যথেষ্ট?

অর্থ ঋণের ক্ষেত্রে আইএমএফ বাংলাদেশকে অনেকগুলো শর্ত দিয়েছে। তার একটি হচ্ছে, দেশ থেকে অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে। কিন্তু এই শর্ত তাদেরকে কেন দিতে হলো? এটা তো আমাদের স্বার্থেই করার কথা। কিন্তু দিতে হয়েছে, কেননা সরকার এই অর্থ পাচারের হার কমাতে পারেনি বা চায়নি। আপাত নিরীহ চোখে বাংলাদেশের আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে আইএমএফ-এর এ সব শর্তই কি খারাপ? ওই বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলার বিষয়টি গোপন নয়।

এক নজর দেখে নেওয়া যাক আইএমএফ কী কী শর্ত দিয়েছে? তারা রিজার্ভ গণনাপদ্ধতি ঠিক করতে বলেছে। রিজার্ভ থেকে উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণদান বন্ধ করতে বলেছে। টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছাড়তে বলেছে। টাকা ছাপানোর অপচর্চা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। মূল্যস্ফীতি ও জিডিপির অস্বচ্ছ হিসাবপদ্ধতিতে সংস্কার করতে বলেছে। ৯০ দিনে ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলে খেলাপি ঘোষণার শর্ত দিয়েছে। ৬ থেকে ৯ শতাংশের সুদহারের সীমা বন্ধ করতে বলেছে। ব্যাংককে ‘আমলা’ নির্ভর না করা এবং কর, ভ্যাট বাড়াতে বলেছে। এছাড়াও জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি কমাতে বলেছে তারা।

আইএমএফ দেশ থেকে অর্থ পাচার বন্ধ করতে শর্ত দিয়েছে। ভালো কথা। কিন্তু এই অর্থ পাচার হয়ে যায় কোথায়, নিশ্চয়ই তারা তা জানে। তাহলে যেসব দেশে এই অর্থ পাচার হয় তাদের কেন এ বিষয়ে সতর্ক করা হয় না? তারা যেখানে বসে এই নির্দেশনা তৈরি করেন সেখানেই এই পাচারের বড় অংশ যায়। সেখানে পাচারকারীদের পরিবারের থাকে, তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যও আছে, তাদের ব্যাংক একাউন্ট আছে। সেখানে কেন নজর দেওয়া হচ্ছে না? আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাজ শুধু পরামর্শ দেওয়া নয়, পুঁজির নিরাপত্তায়ও ভূমিকা রাখা। আইএমএফ কি ওই ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকার রাখতে পারছে?

আইএমএফ বলে কথা নয়, অর্থ পাচার বন্ধের এ আলাপ অনেক দিনের। বাংলাদেশের সামাজিক প্রতিষ্ঠান, প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, অর্থনীতিক সংগঠন ও নাগরিকরা দীর্ঘদিন ধরে এ দাবি করে আসছে। এমনকি অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে কানাডায় সাড়া জাগানো ‘বেগমপাড়া ও লুটেরা বিরোধী’ সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। যে সংবাদ দেশের প্রায় সকল গণমাধ্যমে এসেছে। এমনকি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদেও ওই বিষয়ে আলাপ উঠেছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ওই বিষয়ে সরকারের আর কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক সংকট ও বিপর্যয় আজ আর ঠেকানো যচ্ছে না।

দুর্নীতিবাজদের দায় কেন জনগণ নেবে?

অর্থ পাচারকারী, বৃহৎ ঋণখেলাপি, কালো টাকার মালিক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে পথে বসানো, প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত লুটপাট, বৃহৎ দুর্নীতিবাজ মূলত ধনীকশ্রেণি। প্রধানত ব্যবসায়ী, সরকারি আমলা ও রাজনীতিক। এরা প্রায় সবাই বিভিন্ন সময় সরকারের কাঠামো ও ছত্রছায়ায় এ সব কাজ করছে। সেখানে ব্যতিক্রম বাদে প্রায় সকলেই এই প্রক্রিয়ার অংশীদার ও সুবিধাভোগী।

কথা হচ্ছে, আইএমএফ ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে সরকারকে যেসব শর্ত দিয়েছে তা পালন করতে গেলে গরীব এবং সাধারণ মানুষের জীবন-যাপনের ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে এবং তাদের জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়বে। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে যাদের কারণে এই সংকট সৃষ্টি হলো, সরকারের ঋণের প্রয়োজন হলো, তাদের জন্য সাধারণ মানুষকে কেন মূল্য দিতে হবে? সাধারণ মানুষ তো বিদেশে অর্থ পাচার করেনি। ঘুষ-দুর্নীতির সাথে যুক্ত নয়, তারা দেশের সম্পদ লুট করেনি। তাহলে তাদের কেন দায় নিতে হবে? বরং দুর্নীতিবাজ, লুটেরা ও পাচারকারীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে এই সংকট মোকাবেলা করতে হবে, দেশ পরিচালনা করতে হবে। আইএমএফ-বিশ্ব ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে দেশ পরিচালনা করলে জনগণকে বিপদে ফেলা হবে এবং দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় দেয়া হবে। সরকারের উচিত নয় সে কাজ করা, সে পথে হাঁটা।

সংকট মোকাবেলার উপায় কী?

অনেকে দেশের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় বড় বড় বিশেষজ্ঞদের সাথে বৈঠক করার পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু তার কি দরকার আছে? রাষ্ট্রের মেশিনারি ঠিকমতো চলতে দিলে, বাধা না দিলে এমনিতেই অনেক সমস্যার সমাধান হবে। অর্থনৈতিক সংকটের কারণ নিয়ম-নীতির অভাব নয় বরং নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করা। যাকে সুশাসন ও জবাবদিহিতা বলা হয়, তা কি দেশে আছে?

বিভিন্ন সময় দেশের পত্রপত্রিকায় দুর্নীতি, লুটপাট, পাচার সংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণসহ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এসব দেখে সরকার সতর্ক হলে আজ এতটা দুরাবস্থায় পড়তে হতো না। কিন্তু এখন কি ওইসব অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে? তাদেরকে আইনের আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হবে? যে কাঠামো এই ব্যবস্থার সহযোগী ও অবস্থার জন্য দায়ী, তাদের কাছে তা কতটা আশা করতে পারি?

সরকারের নীতিনির্ধারকেরা যখন বড়াই করে বলেছেন, আমরাই এখন বিদেশকে ঋণ দেব, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তারা আসলে প্রকৃত অবস্থা-বাস্তবতা থেকে কত দূরে আছেন। তা না হলে কিসের ভিত্তিতে এমন কথা বলেছেন? তাহলে কোথায় গেল তাদের সেই বাগাড়ম্বর ও রিজার্ভ-তহবিল? জাতিকে যে অতিরঞ্জিত উন্নয়নের গল্প দিয়ে বিভ্রান্ত করা হয়েছিল তা আজ পরিষ্কার।

এই সমস্যার সমাধান পুরোটা করা সম্ভব না হলেও বেশিরভাগটাই করা কঠিন নয়। অর্থ পাচার শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয় অন্যান্য অনেক দেশেরও এই সংকট রয়েছে। তারা কীভাবে সমাধান করছে? সব দেশই এক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি ও আইনি কাঠামোকে ব্যবহার করছে, আমাদের দেশেও সে উদ্যোগ নেওয়া জরুরী। অনেক আগে ‘ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল’ নামে এনবিআরের একটা উদ্যোগ-পরিকল্পনার কথা শুনেছিলাম, কিন্তু তার কোনো অগ্রগতি জানা যায়নি। আন্তর্জাতিক বাজারে আজকাল যেকোনো মুহূর্তে জিনিসের ‘দাম জানা, দাম ট্রাক করা’ মোটেই কঠিন কাজ নয়। একটি দক্ষ-চৌকষ দল সে কাজ করতে পারে। পণ্যের দাম বাড়া-কমানোর বিষয়টি নজরদারিতে রাখলে সহজেই অর্থ পাচারের অবৈধ-অনৈতিক পথ বন্ধ করা যাবে। এর জন্য অনেক অর্থের দরকার নেই। প্রয়োজন আন্তরিক সিদ্ধান্ত ও কার্যকর পদক্ষেপ।

দেশে যারা নব্য ধনী আছে, তাদের আয়ের উৎস অনুসন্ধান করা হোক। এমনকি পুরনো ধনীরাও কীভাবে তাদের সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি করেছে, তা তদন্ত করতে জাতীয় পর্যায়ে একটি শক্তিশালী টাস্কফোর্স গঠন করা হোক। আমলা, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী এমনকি সাধারণ পর্যায়েরও যারা সন্দেহভাজন আছেন, তাদের সম্পদের বিষয়ে তদন্ত করা হোক। এদের মধ্যে যারা অবৈধ ও অসঙ্গতিপূর্ণভাবে অর্থ-সম্পদ অর্জন করেছেন সেগুলোকে আইনি ও বিচারিক প্রক্রিয়ায় বাতিল করতে হবে। তাদেরকে বিচারের মুখোমুখী ও শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তা না হলে অবৈধ সম্পদ অর্জনের এ ধারা অব্যাহত থাকবে ও সংকট বাড়বে।