বাংলাদেশও কি শ্রীলঙ্কার পরিণতি বরণ করতে যাচ্ছে?

“শ্রীলঙ্কার সাথে রাজনীতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদি কোনো কিছুর মিল না থাকা সত্ত্বেও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে এসব রাষ্ট্রের তুলনা করা হচ্ছে কেন? তুলনার মূল কারণ অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, যা ১৯৪৮ সালে যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর শ্রীলঙ্কাকে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সঙ্কটে নিমজ্জিত করেছে।”

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 8 August 2022, 02:53 PM
Updated : 8 August 2022, 02:53 PM

শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হবার পর বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় এ দেশটিও শ্রীলঙ্কার মতো অর্থনৈতিক পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কিনা। এ সংক্রান্ত আলোচনায় গতি আসে আন্দোলনের মুখে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে দেশ থেকে পালিয়ে যাবার পর। আলোচনা শুধু দেশের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে উঠে আসে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেও। ওইসব মিডিয়া বিশ্বের যে ১৪/১৫টি দেশের অর্থনীতি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে বলে চিহ্নিত করেছে, বাংলাদেশ তাদের অন্যতম। বাংলাদেশ ছাড়া উপমহাদেশে আরও যে দুটি দেশকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হচ্ছে তার একটি পাকিস্তান, অপরটি মালদ্বীপ।

প্রশ্ন হচ্ছে, শ্রীলঙ্কার সাথে রাজনীতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদি কোনো কিছুর মিল না থাকা সত্ত্বেও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে এসব রাষ্ট্রের তুলনা করা হচ্ছে কেন? তুলনার মূল কারণ অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, যা ১৯৪৮ সালে যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর শ্রীলঙ্কাকে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সঙ্কটে নিমজ্জিত করেছে। এ বিষয়টির সাথে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার বেশ কিছু মিল রয়েছে। উল্লেখ্য, যে সমস্ত দেশকে অর্থনৈতিক ভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের দু-একটি বাদে কোনো দেশেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়ায়নি। কোনো কোনো দেশে রয়েছে সরাসরি কর্তৃত্ববাদী শাসন, যেমন লাওস। আবার কোনো কোনো দেশ গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে কর্তৃত্ববাদী, যেমন বেলারুশ।

ঝুঁকিপূর্ণ বেশিরভাগ দেশগুলোতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে কর্তৃত্ববাদী সরকার থাকলেও অর্থনৈতিক সঙ্কটে নিমজ্জিত শ্রীলঙ্কাতে রয়েছে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার দীর্ঘ ঐতিহ্য। উপমহাদেশে ভারত এবং শ্রীলঙ্কা– এ দুটি রাষ্ট্রে জন্মলগ্ন থেকে কখনোই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়নি। বিশ্বের অনেক গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে কর্তৃত্ববাদী শাসনের মতো দেশ দুটিতে নির্বাচনী ব্যবস্থাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি। বিরোধী দল কিংবা সিভিল সোসাইটির কেউ সেখানে মনে করেনি যে, নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ দুটিতে সরকার পরিবর্তন করা যাবে না। সঙ্কট মুহূর্তে পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মতো ওই দেশ দুটিতে সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে হস্তক্ষেপ করেনি। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, গণতন্ত্রের দীর্ঘ ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও নির্বাচিত একটি সরকারকে কেন বিক্ষোভের মুখে বিদায় নিতে হল? কেনইবা এ সরকারকে এমন চরম অর্থনৈতিক দুরাবস্থার মুখে পড়তে হল?

এর প্রধান কারণ, রাজাপাকসে সরকারের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, যার পরিণতি হলো এ অর্থনৈতিক সঙ্কট। এর ফলে জনগণের ক্ষোভ গিয়ে দাঁড়ায় রাজাপাকসে পরিবারের ওপর। এক দশকের বেশি সময় শ্রীলঙ্কা শাসন করেছে এ পরিবার। গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত হলেও নানা স্বৈরতান্ত্রিক উপাদান এ পরিবারের শাসনে শ্রীলঙ্কাতে দেখা গিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন, সংখ্যালঘুদের নিপীড়ন এবং গণমাধ্যমের ওপর মারাত্মক সব হামলার অভিযোগ রয়েছে। স্বৈরশাসকদের মতো নেতা এবং পরিবার-পূজার উপাদান রাজাপাকসে পরিবারের শাসনে প্রবল হয়ে উঠেছিল। এ পরিবারের অন্তত ছয় জন সদস্য আসীন ছিলেন বিভিন্ন মন্ত্রী পদে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং কাঠামোকে কাজে লাগিয়েই স্বৈরতান্ত্রিক পরিবারতন্ত্র কায়েম করেছিলেন রাজাপাকসেরা।

গণতান্ত্রিক কাঠামোর মাঝে স্বৈরতান্ত্রিক উপাদান শুধু যে শ্রীলঙ্কাতেই দেখা গিয়েছে বিষয়টা এরকম নয়। এ ধরনের উপাদান আমরা প্রত্যক্ষ করেছি ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলে ভারতে, বিশেষতঃ নকশাল আন্দোলন দমনের সময়। নরেন্দ্র মোদীর শাসনেও স্বৈরতন্ত্রের উপাদান স্পষ্ট। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত হবার পরেও এবং সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও শাসকগোষ্ঠী স্বৈরাচারী আচরণ করতে পারে। বস্তুত অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ এবং ব্যক্তি-পূজা রাজাপাকসে সরকারের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ফলে তামিল টাইগারদের পরাজিত করে তিন দশকের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটাবার ফলে যে রাজাপাকসে একসময় ছিলেন জাতীয় বীর, সেই তিনিই আজ পরিণত হয়েছেন দেশটির সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তিতে।

গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েও যে কর্তৃত্ববাদী শাসকের জন্ম হতে পারে, রাজাপাকসে হলেন তার ক্লাসিক উদাহরণ। তবে এটাও ঠিক, অর্থনৈতিক সঙ্কট না হলে তার সরকারের পতন ঘটত না। অর্থনৈতিক সঙ্কটে নিপতিত হবার আগে পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলিদের অনেকেই রাজাপাকসে সরকারের কর্তৃত্ববাদী আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। তবে যে বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে সেটা হলো, টিপিক্যাল কর্তৃত্ববাদী শাসন এবং রাজাপাকসের কর্তৃত্ববাদী আচরণের মধ্যে মোটা দাগে পার্থক্য রয়েছে।

টিপিক্যাল কর্তৃত্ববাদী শাসনে নির্বাচন হলেও, ওই নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের কোনো সুযোগ থাকে না বা সরকারের পরিবর্তন ঘটে না। অপরদিকে, রাজাপাকসে সরকারের স্বৈরাচারী আচরণ সত্ত্বেও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন এবং গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের ফলে নির্বাচনের মাধ্যমেই সরকার পরিবর্তনের সুযোগ ছিল। কিন্তু চরম অর্থনৈতিক দুরাবস্থার ফলে জনগণ আগামী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করবার ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। তারা মনে করতে থাকে, যেহেতু রাজাপাকসে সরকারের অব্যবস্থাপনার ফল হচ্ছে অর্থনৈতিক সঙ্কট, তাই এ সরকার পরিবর্তন করতে পারলেই সমস্যার সমাধান হবে। বস্তুত এ ধরনের চিন্তার ফলশ্রুতি হচ্ছে, রাজাপাকসে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণবিক্ষোভ এবং তার দেশ থেকে পলায়ন।

নানা মেগা প্রকল্পের জন্য বিপুল বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করবার পর ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে না পারা এবং আমদানি-নির্ভর দেশটির আমদানি করবার জন্য হাতে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা না থাকা অর্থাৎ, বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় (ফরেন রিজার্ভ) বিপদজনকভাবে নেমে আসা শ্রীলঙ্কার সঙ্কটের মূল কারণ। ২০১৯ সালে দেশটিতে যেখানে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় ছিল ৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ২০২২ সালের মে মাসে সেটি নেমে আসে ৫০ মিলিয়ন ডলারেরও কমে। ফলে সাময়িকভাবে শ্রীলঙ্কাকে ঋণের কিস্তি পরিশোধ স্থগিত ঘোষণা করতে হয়। উল্লেখ্য, দেশটির ৫১ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণের ৭ বিলিয়িন ডলার এ বছর পরিশোধ করবার বাধ্যবাধকতা দেশটির ওপর প্রচণ্ড অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করে। এ ঋণ পরিশোধ করতে পারবার ব্যর্থতার জন্য দেশটিকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়।

কোভিডের কারণে পর্যটন শিল্পে ধস, বাণিজ্য ঘাটতির ঊর্ধগতি (২০২০ সালের ৫ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২১ সালে ৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার) বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ে বড় প্রভাব ফেলে। এর পাশাপাশি বিশাল কর হ্রাস, সুদের হারে নিম্নমুখী সংশোধন এবং সার ও কীটনাশক আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে রাতারাতি কৃষিখাতে জৈব চাষে প্রবেশের হঠকারী সিদ্ধান্ত অর্থনৈতিক দুরাবস্থাকে ত্বরান্বিত করে। বৈদেশিক ঋণে যে সমস্ত বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল, সেগুলো সম্পন্ন হবার পর কতটুকু লাভজনক হবে, তা বিবেচনায় নিতে না পারবার ফলেও সঞ্চিত বিদেশি মুদ্রা থেকে ঋণ শোধ করতে গিয়ে সঞ্চয়ের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়।

পশ্চিম ঘেঁষা আন্তর্জাতিক মিডিয়া শ্রীলঙ্কার সমস্যার জন্য দ্রুত গণচীনকে দায়ী করে দেশটি চীনের ‘ঋণের ফাঁদে’ পড়েছে বলে ক্রমাগত উল্লেখ করতে থাকে। পশ্চিমা ঋণের মতো চীন প্রদত্ত ঋণের সাথে রাজনৈতিক, সামাজিক সংস্কারের শর্ত যোগ না থাকা সত্ত্বেও একে ‘ঋণের ফাঁদ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। অর্থনৈতিক ভাবে চীন শক্তিশালী হয়ে উঠবার ফলে পাশ্চাত্য এক সময় উন্নয়নশীল বিশ্বকে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে যে ভূমিকা পালন করত, চীন এখন অনেকটা ওই ভূমিকাই পালন করছে। তুলনামূলক বিচারে সহজ শর্ত এবং রাজনৈতিক সংস্কারের অঙ্গীকার যুক্ত না থাকবার ফলে উন্নয়নশীল বিশ্বের চীন থেকে ঋণ নেবার ঝোঁক স্পষ্ট। এসব কারণে শ্রীলঙ্কাও গণচীন থেকে ঋণ নিয়েছে, যদিও তা দেশটির মোট বৈদেশিক ঋণের মাত্র ১০ শতাংশ। সমপরিমাণ ঋণ শ্রীলঙ্কা নিয়েছে জাপান থেকেও। তবে ঋণের শর্ত অনুযায়ী, ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর ৯৯ বছরের জন্য চীনের কাছে ইজারা দেওয়া হয়। এ ধরনের ইজারা দেওয়ার আরও নজির অন্যান্য দেশে থাকলেও বিষয়টিকে বিশেষভাবে সামনে আনা হয় এটা বোঝাবার জন্য যে, চীন একটি নয়া-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং সাবেক ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোর চেয়েও চীনের ঋণ প্রক্রিয়া অধিক শোষণমূলক।

শ্রীলঙ্কার ১০ শতাংশের বিপরীতে চীনের কাছে বাংলাদেশের ঋণ মোট বৈদেশিক ঋণের ২৯ শতাংশের কিছু বেশি। গত ১০ বছরে ১২টি প্রকল্পের জন্য চীনের সঙ্গে ১৭ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি করেছে বাংলাদেশ। এসব ঋণ ২০৩১ সালের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৯ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার। যদিও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ কখনো ঋণ খেলাপি হয়নি, সামনেও হবার সম্ভাবনা কম, তারপরও আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে সুদ, আসলসহ এ বিপুল অঙ্কের ঋণ বাংলাদেশ পরিশোধ করতে পারবে কিনা এটি নিয়ে অনেকের মাঝে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। মূলত শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতাই এ শঙ্কার মূল কারণ। এছাড়া আকস্মিক কিছু বিষয়, যেমন বিদ্যুৎ সঙ্কট, ডলারের বিপরীতে টাকার মান গত তিন মাস যাবত ক্রমাগত পড়তে থাকে এবং রেকর্ড পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতি– দেশের অর্থনৈতিক গতিপথ নিয়ে জনগণকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে।

ডলার শুধু যে টাকার বিপরীতেই শক্তিশালী হচ্ছে তা নয় বরং বিশ্বের অধিকাংশ মুদ্রার বিপরীতেই দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে। এর মূল কারণ ডলারের তেজী ভাব ধরে রাখবার জন্য ফেডারেল রিজার্ভের (মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক) সুদের হার ক্রমশ বৃদ্ধি করা। রুশ-ইউক্রেইন যুদ্ধের অভিঘাত ইউরোপের মতো মার্কিন অর্থনীতিতেও পড়েছে। রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হলে এর পাল্টা প্রতিক্রিয়া যে মার্কিন অর্থনীতিতে পড়তে পারে তা নিয়ে মার্কিন নীতিনির্ধারকরা সচেতন ছিলেন না। ফলে আজকে গত ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি ঘটেছে মার্কিন অর্থনীতিতে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের প্রচেষ্টা হিসেবে ক্রমাগত সুদের হার বাড়িয়ে ডলারের তেজী ভাব ধরে রাখার চেষ্টা করছে ফেডারেল রিজার্ভ। ফলে বাংলাদেশ, পাকিস্তানের মতো দেশগুলো ডলারের বিপরীতে ক্রমশই মুদ্রামান হারাচ্ছে।

মুদ্রামান হারাবার সাথে সাথে ডলার দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে দেশি মার্কেটে। এটি আবার ডলারকে টাকার বিপরীতে আরও শক্তিশালী করে তুলছে। এ দুষ্প্রাপ্যতার কারণ হচ্ছে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৩ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড বাণিজ্য ঘাটতি। স্বাধীনতার পর আর কোনো অর্থবছরে আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে এত ফারাক হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী গত এক বছরে রপ্তানি আয় এসেছে ৪৯ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার আর আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৮২ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন। এ অর্থবছরে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য বা ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতি বেড়ে রেকর্ড ১৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। এর আগের ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে এ ঘাটতি ছিল ৪ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে ঘাটতি বেড়েছে চার গুণের বেশি। এসবের ফলে বিপুল পরিমাণ ডলার বাংলাদেশ থেকে বেরিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে চলে গিয়েছে। এর সাথে যোগ হয়েছে ভুয়া এলসি খুলে এবং অন্যান্য উপায়ে বিপুল পরিমাণ মুদ্রা দেশ থেকে পাচার করে দেওয়া। এর সবকিছুর অভিঘাত লেগিয়েছে অর্থনীতিতে, যা কিনা ব্যাংক এবং খোলা বাজার– দু-জায়গাতেই ডলারকে দুষ্প্রাপ্য করে তুলেছে।

ডলার সঙ্কটের ধাক্কা লেগিয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায়। বাংলাদেশে বিদ্যুতের ৫২ শতাংশ উৎপাদিত হয় প্রাকৃতিক গ্যাস হতে। গ্যাস-নির্ভর এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৪০ শতাংশই আমদানি-নির্ভর। ওমান এবং কাতার থেকে এসব কেন্দ্রের জন্য তরলীকৃত গ্যাস আসলেও বাংলাদেশকে স্পট মার্কেট থেকেও গ্যাস সংগ্রহ করতে হয় চাহিদা মেটাবার জন্য। রুশ-ইউক্রেইন যুদ্ধের ফলে ইউরোপীয় ক্রেতারা স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস কেনার পরিমাণ বাড়িয়ে দেবার ফলে গ্যাসের দাম বেড়ে গিয়েছে। এ বাড়তি মূল্য দিয়ে গ্যাস কিনবার মতো পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশ সরকারের হাতে নেই, যার ফলে কিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দিতে হয়েছে।

বিদ্যুৎ সঙ্কটের জন্য অবশ্য বিশেষজ্ঞরা ‘কুইক রেন্টাল’ পলিসিকে দায়ী করছেন– যার মধ্যে দিয়ে ব্যাপক অর্থ অপচয় করা হচ্ছে। এ ব্যবস্থায় বিভিন্ন বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি বিদ্যুৎ সরবরাহ না করেও সরকারের কাছ থেকে টাকা পাচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারের কাছ থেকে তারা পেয়েছে ১ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার। এসবের পাশাপাশি কয়লা সঙ্কটের কারণে দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায় কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যেকোনো সময় উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ৫২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এই কেন্দ্রের তিনটি ইউনিটের মধ্যে চালু আছে মাত্র একটি, তা থেকে উৎপাদিত হচ্ছে ২৭৫ মেগাওয়াট। এ ইউনিটও কয়লার অভাবে বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে, যার ফলে বিদ্যুৎ সঙ্কট আরও ঘনীভূত হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

বিদ্যুৎ সঙ্কট অব্যাহত থাকলে একদিকে যেমন তা শিল্প উৎপাদনে প্রভাব ফেলবে, তেমনি একই সাথে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের দাম বৃদ্ধি করবে। এটা একদিকে যেমন রপ্তানি বাণিজ্যে প্রভাব ফেলবে, তেমনি একই সাথে শ্রমিক ছাটাইয়ের পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। তবে বছরের শেষ নাগাদ রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ আরও কয়েকটি কেন্দ্রের বিদ্যুৎ এবং ভারতের আদানী গ্রুপের ১২০০ মেগাওয়াট জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটা হলে অর্থনীতির ওপর চাপ সাময়িক ভাবে কিছুটা কমবে বলে মনে করা হচ্ছে– যদিও তা অর্থনীতির মূল সঙ্কটকে দূর করবে না।

মুদ্রা বাজারে ডলারের প্রাপ্তিজনিত যে অর্থনৈতিক সঙ্কট, তা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের কাছে চারশ কোটির বেশি ডলার ঋণ চেয়ে অনুরোধ জানিয়েছে। আল জাজিরা জানাচ্ছে, বিশ্ব ব্যাংক এবং এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের কাছেও একশ কোটি ডলার করে ঋণ চেয়েছে সরকার। এই যখন অবস্থা, তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী গত এক বছরে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে মোট খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। অপরদিকে, ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) অর্থ পাচারের যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৮ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার৷ এছাড়া সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের খোলা একাউন্টের পরিমাণ ৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২০২১ সালে দাঁড়িয়েছে ৯৫১ মিলিয়ন ডলার। তাহলে দেখা যাচ্ছে, অর্থ মন্ত্রণালয় দুর্নীতি রোধ করতে অতটা আগ্রহী নয়, যতটা না আগ্রহী বিভিন্ন বিদেশি প্রতিষ্ঠান হতে ঋণের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করতে।

বাংলাদেশে দুর্নীতির আরেকটি পদ্ধতি হচ্ছে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীর গতি। ফলে বড়, মাঝারি, ছোটসহ প্রায় প্রতিটি প্রকল্প বাস্তবায়নে মূল বরাদ্দের কয়েকগুণ বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এর রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ এক সময় পর পর কয়েক বছর বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্র ছিল। ওই অবস্থা থেকে বাংলাদেশ বের হয়ে আসতে পারলেও এখনো বিশ্বের শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর কাতারেই রয়ে গিয়েছে। যে শ্রীলঙ্কার সাথে বাংলাদেশের তুলনা কেউ কেউ দিতে চাচ্ছেন, সেই শ্রীলঙ্কা দুর্নীতি সূচকে বাংলাদেশ থেকে ভালো অবস্থানে রয়েছে। ২০২১ সালে দুর্নীতি সূচকে শ্রীলঙ্কা যেখানে ছিল ১০২তম অবস্থানে, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৭তম।

বিশ্ব বাজারে তেলের দাম পড়তে শুরু করলেও এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলারের সন্তোষজনক অবস্থানে থাকলেও এর কোনো প্রতিফলন অর্থনীতিতে দেখা যাচ্ছে না। এ দেখা না যাবার মূল কারণ, দুর্নীতিকে একটি সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসবার জন্য যেসব কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন তার অনুপস্থিতি। ফলে সরকারি কর্মকর্তাদের কৃচ্ছ্রতা সাধনের যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা আসলে কতটা বাস্তবায়িত হবে তা নিয়েও জনমনে সংশয় রয়েছে।

দেখা গিয়েছে, যেসব দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে সেসব দেশে দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতি তুলনামূলক বিচারে কম। এ সমস্ত দেশের জনগণও সঙ্কটকালীন সময়ে সরকারের সাথে সংসক্তি বোধ করে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ অনেক কিছু অর্জন করলেও গণতন্ত্রকে এখনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারেনি। অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার সাথে রাজনীতির বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই দুর্নীতি দমন ইত্যাদির মাধ্যমে অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলা এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথে জনগণের সংযুক্তি বোধ তৈরির জন্য গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দান অতীব জরুরী।