একটি উপনির্বাচনে একজন প্রার্থীর মার খাওয়ার আপাত ছোট ঘটনার এতখানি আন্তর্জাতিক মনোযোগ পাওয়া এবং সরকারের এতখানি ক্ষুব্ধ হওয়ার পটভূমি একই।
Published : 25 Jul 2023, 05:11 PM
হিরো আলমকে কখনো সামনাসামনি দেখিনি। সম্ভবত ২০১৭ সালে প্রথম ইউটিউবে দেখেছি নিজে মডেল হয়ে ও অন্য মডেল নিয়ে চটুল গানের সঙ্গে অঙ্গভঙ্গি করেন, নিজেও হালকা কর্কশ গলায় কিছুটা বেসুরে গেয়ে থাকেন। সাধারণ মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য শ্রমজীবী তরুণের নিজের শখপূরণসহ বাণিজ্যিক কার্যক্রম হিসেবে নিয়ে আপত্তি করিনি, আগ্রহীও হইনি।
এর পর মনযোগ কাড়লেন ২০২২ সালে, যখন রবীন্দ্রসঙ্গীত বিকৃত সুরে-বাণীতে গেয়ে মিউজিক ভিডিও বের করার ফলে আপত্তি উঠলো। সেগুলো বন্ধ করার জন্য উকিলের নোটিশ পেলেন এবং পুলিশ তাঁকে ডেকে পাঠালো। একজন উকিল নোটিশটি দিয়েছিলেন সঙ্গীতবিকৃতি ও রুচিবিকৃতির দ্বারা ‘গণউৎপাত সৃষ্টির অপরাধ’ উল্লেখ করে, ভিডিওগুলো নেট থেকে অপসারণের দাবি জানিয়ে। গিটার হাতে শরীর সঞ্চালন করে ‘আমার পরান যাহা চায়’ গানটির ভুলভাল নিকৃষ্ট ভিডিও বেশি আপত্তি তুলেছিল।
সে সময় আন্তর্জাতিক মিডিয়া বিবিসি, ডয়েচে ভেলে ও সংবাদ সংস্থা এফপি মারফত খবর হয়েছিল যে, হিরো আলমকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এবং পুলিশ কর্মকর্তা সাংবাদিকদের কাছে ব্যাখ্যা দেন যে গ্রেফতার নয়, অভিযোগ ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। হিরো আলম মুচলেকা দিয়েছেন যে, তিনি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গান গাইবেন না, অন্য শিল্পীর গান অনুমতি ছাড়া ভিডিও করবেন না এবং পুলিশসহ কোনো সংস্থার পোশাক আইনি অনুমতি ছাড়া গায়ে চড়িয়ে অভিনয় করবেন না।
আমার তখনই মনে হয়েছিল অমসৃণ পথে অগ্রসর হলেও বিদ্যালয়ে সম্ভবত অষ্টম শ্রেণীর কম শিক্ষা নিয়েও এই তরুণের মধ্যে ভবিষ্যতে বিখ্যাত কিছু উপাদান আছে। শুরুতে কেবল অপারেটরের অধীনে কাজ করতেন এবং নিজে মিউজিক ভিডিও বানাতে শুরু করেন। সেগুলো নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাসিঠাট্টা উপহাস করা হতো। তিনি দমতেন না। ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বগুড়া জেলার নিজ এলাকায় প্রার্থী হন। বোঝা যায়, মিউজিক ভিডিওয় তাঁর ভবিষ্যৎ না থাকলেও এবং পারিবারিক উচ্চতা ও তুলনামূলক প্রতিভার অভাবে মাইকেল জ্যাকসনের মতো এ পথে না এগুতে পারলেও বুদ্ধি, কঠোর শ্রমশীলতা ও তীব্র উদ্যম তাঁকে কোথাও না কোথাও এগিয়ে দেবে।
গানের জন্য পুলিশের সাইবার অপরাধ ইউনিট তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে মুচলেকা নিয়েছিল। রবীন্দ্র-নজরুলের গান গাইবেন না সে মুচলেকা কেন পুলিশের কাছে দিতে হবে ভেবে বিরক্ত হয়েছিলাম। সাইবার পরিসরে তাঁর গানের ভিডিও প্রকাশ হওয়ায় ‘অপরাধটা’ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পড়েছে। এই দৃষ্টান্ত দেশে শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অশনি সংকেত হয়ে উঠতে পারে। উকিল-পুলিশ না হয়ে সমাজে শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে যাঁরা কাজ করেন বা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রতিষ্ঠানের উচিত ছিল বিষয়টা হাতে নেওয়া এবং হিরো আলমকে বুঝিয়ে নিবৃত করা।
মনে পড়ছে দুই যুগ আগে খ্যাতিমান ব্যান্ড শিল্পী মাকসুদ রবীন্দ্রনাথের দাদরা তালে কীর্তনাঙ্গের ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’ মিষ্টি গানটির শুধু কথা ঠিক রেখে সুর ছন্দ গায়কী তছনছ করে রেকর্ড করলে সঙ্গীতের গুণী ব্যক্তিরা আপত্তি করেছিলেন সংবাদপত্রে লিখে। কিছু তর্কবিতর্কও হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর ৬০ বছর পর কপিরাইট উঠে যাওয়ায় পশ্চিমবঙ্গেও শিল্পীদের কেউ কেউ ‘ফিউশন’, ‘অ্যাডাপটেশন’, ‘রিমিক্স’, ‘আধুনিক পরিবেশনা’ ইত্যাদি নানা অভিধায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরবিকৃতি ও শৈল্পিক রসভঙ্গ করে চলেছেন। এর কোনো পুলিশি সমাধান নেই। বরং সঙ্গীতের সমজদাররা একমত যে, রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির উৎকর্ষ, এর নিজস্ব শক্তি ও সৌন্দর্যের গুণে তা টিকে থাকবে অহেতুক অপটু মেরামতির হাত বাঁচিয়ে। কালজয়ী শিল্পের ক্ষেত্রে এটাই ভরসা। পারফর্মিং শিল্পের উপস্থাপনায় নতুনত্ব আসবে কিন্তু চিরায়ত শিল্পসৃষ্টির মৌলিক রূপ বদলানো যায় না। কয়েকজন নামকরা গায়ক-গায়িকা রবীন্দ্রসঙ্গীতের ‘আধুনিকায়নের’ চেষ্টা চালাচ্ছেন, ধোপে টিকবে কি-না তা দেখার অপেক্ষা। তবে শিক্ষাবঞ্চিত দুর্বল হিরো আলম এক কথাতেই নিবৃত্ত হয়েছেন। হিরো আলমকে দেখা গেছে তাঁর বিভিন্ন উদ্যোগে যেখানেই শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত নাগরিকদের উপহাস ও আক্রমণের শিকার হয়েছেন, তিনি অপরের প্রতি সম্মান রেখে নিজের বুদ্ধিমতো যুক্তি দিয়ে ভদ্রভাবে মোকাবেলা করেছেন। সাংস্কৃতিক মহল থেকে বলা হয়েছে, সমাজে রুচির দুর্ভিক্ষের কারণে হিরো আলমের মতো একটা লোকের উদ্ভব। রাজনৈতিক মহল থেকে তাঁর সংসদ সদস্যপদে দাঁড়ানোর যোগ্যতার প্রশ্ন তুলে বিষোদ্গার করা হয়েছে। এঁদেরকে হিরো আলম যখন ‘স্যার’ সম্বোধন করে জবাব দেন তখন তাঁর আচরণই তুলনামূলক উন্নত বলে মানতে হয়।
চলতি বছরই হিরো আলম তিনটি উপনির্বাচনে দাঁড়িয়ে প্রতিবারই হেনস্থা হন কিন্তু দুটিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। শেষটি রাজধানীর গুলশান-বনানী-ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে গঠিত ঢাকা-১৭ সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে ১৭ জুলাই ভোট চলাকালে ভোটকেন্দ্রের সামনের রাস্তায় ফেলে পেটায় বিজয়ী আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ব্যাজধারী কর্মীরা। দেশে সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে বহু মানুষ হতাহত হয়েছে। কিন্তু বিরাট এক বিস্ময় সৃষ্টি হলো যখন এই ২৮ বছরের যুবকের প্রহৃত হওয়ার নিন্দা উচ্চারিত হলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সর্বোচ্চ মহল থেকে। এমন আগে কখনো হয়নি। ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক টুইট বার্তা দিলেন, ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র দিনের সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন, ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, ফ্রান্স প্রভৃতি ১২টি দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিশন যৌথ বিবৃতি দিল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ আন্তর্জাতিক কিছু মানবাধিকার সংগঠনও বিবৃতি দিল। এদের কথা প্রায় একই রকম, তা হলো স্মরণ করানো যে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে সহিংসতা ছাড়া অংশ নেওয়া প্রতিটি ব্যক্তির মৌলিক অধিকার, ঘটনাটির নিরপেক্ষ তদন্ত করে হামলাকারীদের জবাবদিহির আওতায় আনা এবং আসন্ন নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয় সেজন্য সংশ্লিষ্ট সকল মহলের সহযোগিতা কামনা করা।
এই বক্তব্যে কোনো মহলের আপত্তি করার কিছু নেই। কিন্তু এত বড় আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া কেন? কয়েকজন মন্ত্রী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানালেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন ‘মগের মুল্লুক পাইছে’ বলে উক্তি করলেন। জাতিসংঘ অবাসিক সমন্বয়ককে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে অসন্তোষ জানানো হয়েছে। রাষ্ট্রদূতদের যুক্ত বিবৃতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, এমনটা কূটনৈতিক আচরণ সংক্রান্ত ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন।
কূটনৈতিক আচরণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতির বিতর্কটা কূটনৈতিকভাবেই ফয়সালা হোক। আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, একটি উপনির্বাচনে একজন প্রার্থীর মার খাওয়ার আপাত ছোট ঘটনার এতখানি আন্তর্জাতিক মনোযোগ পাওয়া এবং সরকারের এতখানি ক্ষুব্ধ হওয়ার পটভূমি একই। একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। তা হলো বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এবং গণতান্ত্রিক অনুশীলন ও নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা মারাত্মকভাবে খর্ব হওয়ার বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহল বিশেষত পশ্চিমা মহল গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে এই দুটি প্রশ্নে উন্নতির জন্য চাপ দিচ্ছে। আগের চেয়ে এ প্রচেষ্টা এখন সংহতভাবে হচ্ছে। আর সেটা সরকার গ্রহণ করতে পারছেন না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীরও এটা না বোঝার কারণ নেই। তবে তিনি সাংবাদিকদের কাছে বলার সময় সচেতনভাবে অথবা ক্ষুব্ধ হয়ে সমান্তরাল দৃষ্টান্ত টানতে চেয়েছেন যে, আমেরিকায় (বন্দুক চালিয়ে) যখন-তখন লোক মেরে ফেলে, ফ্রান্সে এত লোক (বিক্ষোভকারীরা) আক্রান্ত হলো, বিদেশী মিশনগুলো একযোগে বা জাতিসংঘ কি বিবৃতি দিয়েছে?
এই দৃষ্টান্তগুলো অপরাধমূলক ঘটনা বা পুলিশি বাড়বাড়ির প্রতিবাদে বিক্ষোভ যা সংশ্লিষ্ট দেশের আইনে সুরাহা করা হয়। বাংলাদেশে এখন সার্বিকভাবে নির্বাচনের মান, স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন।
এক সপ্তাহ আগে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের আন্ডার সেক্রেটারি জবরদস্ত কূটনীতিক আজরা জেয়া প্রতিনিধিদল নিয়ে এসে এ বিষয়ে আলাপ করে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে আশ্বাস পেয়ে গেলেন। তার পরই উপনির্বাচনে হিরো আলমের ঘটনায় তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানান দেয় যে, আশ্বাস পেলেও তাঁরা আশ্বস্ত হননি। এবং চাপ সরাবেন না। হিরো আলম এখানে ব্যক্তিমাত্র নয়, নির্বাচনে একজন প্রার্থী, বাংলাদেশে বর্তমানে মৌলিক নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকারের প্রতীক এবং আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার মাপকাঠি। এটাই হিরো আলমের প্রতি আন্তর্জাতিক মনোযোগের রহস্য।