"মুক্তিযোদ্ধাদের দায়িত্ব কী ছিল? প্রথমত যুদ্ধ করা, দ্বিতীয়ত পাকিস্তানিদের হটানো, তৃতীয়ত দেশটাকে স্বাধীন করা। তিনটি জিনিসই তো হয়েছে। হ্যাঁ আমাদের চারিত্রিক অবক্ষয় অনেক হয়েছে। কিন্তু তার মানে এই না দেশটা রসাতলে চলে গেছে।”
Published : 06 Oct 2023, 12:01 PM
যুদ্ধদিনের নানা ঘটনা জানতেই এক বিকেলে মুখোমুখি হই বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ হাবিবুল আলমের। আলাপচারিতার শুরুতেই একাত্তরে ঢাকার ভেতরে আলোচিত একটি অপারেশনের ঘটনা তুলে ধরেন তিনি।
তার ভাষায়, “মে ১৯৭১। মাস তখনও শেষ হয়নি। আমরা মতিনগর ক্যাম্পে। সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ স্যার ডেকে বললেন, “আলম, তোমাকে ঢাকায় যেতে হবে, একটা স্পেসিফিক কাজ নিয়ে। তুমিসহ ১৭ জনকে সিলেক্ট করে নাও।”
শুনে আমি তো এক্সাইটেড।
বললাম, স্যার কী কাজ?
বিস্তারিত কিছু বললেন না। এটুকু বললেন, “এটা একটি সিরিয়াস কাজ। কাজটা করেই তোমাকে ফিরে আসতে হবে। হায়দার (ক্যাপ্টেন এটিএম হায়দার) তোমাকে ডিটেইল বলবে। তুমি বাদলকে (শহীদুল্লাহ খান বাদল) ১৭ জনের নাম দাও।”
চিন্তাভাবনা করে আমার দুই নম্বর ও মায়ার তিন নম্বর প্লাটুন থেকে বাছাই করে ১৭ জন ঠিক করলাম। আমিসহ ওই তালিকায় ছিল মুক্তিযোদ্ধা আলী আহমেদ জিয়াউদ্দীন, মাহবুব আহমদ (শহীদ), শ্যামল, ভাষণ (অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর ছেলে), আনোয়ার রহমান (আনু), মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী (মায়া), ফতেহ আলী চৌধুরী, আবু সাঈদ খান, ইঞ্জিনিয়ার সিরাজ, গাজী গোলাম দস্তগীর, তারেক এম আর চৌধুরী, নজিবুল হক, ধানমন্ডির রেজা, আড়াইহাজারের আব্দুস সামাদ, রূপগঞ্জের জব্বার ও ইফতেখার।
মূলত ঢাকার ভেতরে ওটাই ছিল সেক্টর টু-এর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম অপারেশন। বলা হলো, যারা অ্যাকশন করবে শুধু তারাই হিট করে দ্রুত হেডকোয়ার্টারে ফিরে আসবে। বাকিরা ঢাকাতেই থেকে যাবে।”
কোথায় অপারেশন করতে হবে, সেটা কি নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল?
“হ্যাঁ। অপারেশনের নাম ছিল, ‘হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, হিট অ্যান্ড রান।’ খবর ছিল ওয়ার্ল্ড ব্যাংক টিম ও ইউএনএইচসিআরের প্রধান প্রিন্স সদরুদ্দীন আগা খান এসে সেখানে উঠবেন। পাকিস্তান সরকার তাদের আশ্বস্ত করেছিল যে ঢাকায় সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে এবং তা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। টার্গেট ছিল ওই ধারণাটাই পাল্টে দেওয়ার। পাশাপাশি জানানো যে, ঢাকা শান্ত নয় এবং পাকিস্তানি সেনাদেরও নিয়ন্ত্রণে নেই।
ঢাকায় এসে কয়েকটা জায়গায় ভাগ হয়ে থাকি। উঠলাম ইস্কাটনের দিলু রোড, সেগুনবাগিচায় বারীন মজুমদারের মিউজিক কলেজ ও ৩০ নম্বর হাটখোলায়।
কিন্তু অপারেশন করতে এমন কাউকে লাগবে যে ভালো গাড়ি চালাতে পারে। তখন ভাষণ বলল তার এক মামা আছেন, নাম মুনির আলম মির্জা (বাদল) ফটোগ্রাফার হিসেবে তিনি কাজ করতেন চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে।
এছাড়া মতিনগর থেকে শহীদুল্লাহ খান বাদল বলে দিয়েছিল ঢাকার ছেলে কামরুল হক স্বপনের কথা। অপারেশনে দরকার হলে যেন তাকে নিই। ফাইনালি বাইরে থেকে এ দুজনকেই সঙ্গে নিলাম। প্রথমে ভাষণও সঙ্গে ছিল। অতঃপর আমি, মায়া ও জিয়া অ্যাকশনের জন্য প্রস্তুত হই।
অপারেশনে একটা গাড়ি লাগবে। কীভাবে পাই?
গুলশান এক নম্বরে এখন যেটা পুলিশ প্লাজা তার পাশেই একটা কালভার্ট ছিল। তার আগেই খানিকটা জংলার মতো জায়গা, পাশেই একটা মসজিদ। তেজগাঁয়ের ভেতর দিয়ে গুলশানে আসার ওটাই ছিল রাস্তা। গুলশান এলাকায় তখন ম্যাকসিমাম ছিল ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট আর বিহারীরা। ওখানে অবস্থান নিলেই বিহারীদের একটা গাড়ি পাবো। এমন চিন্তা থেকেই সেখানে অবস্থান নিই। আমার সঙ্গে বাবার গাড়িটাও ছিল। আর বাদল ভাই নিয়ে এসেছিলেন একটা সাদা মাজদা গাড়ি।
৭ জুন ১৯৭১। বিকেলের দিকে রাস্তায় কয়েকটা গাড়ি থামাতে যাই। যেটাই ধরছি ভাষণ নিষেধ করছে। এটা আমার বন্ধু, এটা আমার চাচার ওমুক...এমনটাই বলছে। ফলে মেজাজ যায় খারাপ হয়ে। মায়াকে বললাম, ‘চল প্যাকআপ করি’।”
তাহলে ওইদিন আর অপারেশন হলো না?
“না। সিদ্ধান্ত নিলাম ভাষণকে বাদ দেওয়ার। কিন্তু সরাসরি কিছু না বলে তাকে বললাম, ‘তুই হাতিরপুলের দিকটায় চেক করতে থাক’। একদিন গ্যাপ দিয়ে আমরা ৯ জুন আবার গুলশানে যাই, ওই আগের জায়গাতেই।
তখন ডাকসান ১০০০ মডেলের নীল রঙের একটা গাড়ি চালিয়ে একজন যাচ্ছিল। আমরা ওটা চেজ করে এখন গুলশান দুই নম্বরে রাশিয়ান অ্যাম্বাসি যেখানে, গাড়িটাকে ওখানে থামালাম। বাদল (ক্যামেরাম্যান) ভাই দ্রুত গাড়ির ড্রাইভারকে সরিয়ে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। স্বপন সামনে তার পাশে বসে। পেছনে এক পাশে জিয়া, আরেক পাশে মায়া। মাঝখানে ওই ড্রাইভারকে চোখ বেঁধে বসায়। ওদের গাড়ির পেছনে আমার গাড়িও এগোয়।
গুলশান এক নম্বরের ওই কালভার্টের কাছে আসতেই ওদের গাড়ি থেমে যায়।
কী হয়েছে?
ওরা বলে, ড্রাইভার চিনে ফেলছে সবাইকে।
আমি আর স্বপন তাকে নামিয়ে কালভার্টের নিচে নিয়ে যা করার করে ফেললাম। ওটাই ছিল প্রথম ক্যাজুয়ালটি। এরপর আমার গাড়িটা ছেড়ে দিয়ে আমি ওদের গাড়িতে চড়ে বসি। চলে আসি সিদ্ধেশ্বরীতে, বাদল ভাইয়ের বাড়িতে।
সিদ্ধেশ্বরী থেকে শাহবাগে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের দিকে যাব। রওনা দেই মাগরিবের ঠিক আগে। হোটেলের সামনে এখন যে ভাস্কর্যটা আছে সেখানে ছিল একটা বড় গাছ। প্রেসিডেন্ট ভবন (বর্তমান সুগন্ধা) পেছনে ফেলে ওই গাছটির সামনে আসি। কপালটা নেহায়েত ভালো ছিল। আমরা কিন্তু জানি না তারা কখন আসবে। তারা ভেতরে নাকি বাইরে তাও জানা নেই।
হঠাৎ সাইরেন বাজার শব্দ পাই। দেখি পুলিশের এসকর্ট গাড়ি ময়মনসিংহ রোড হয়ে আসছে। পেছনে পুলিশের আরও দুই-তিনটি গাড়ি। শেষে একটি বা দুটো সাদা শেভ্রোলেট গাড়ি নজরে এলো। বুঝে যাই ওই গাড়িতেই রয়েছে বিশ্ব ব্যাংকের অতিথিরা। গাড়িগুলো আমাদের পাশ দিয়েই হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ঢোকে।
আমরা বাইরে। মেইন রোডে হোটেলের ছোট গেটে এসে আমাদের গাড়ি থামে। দেখি দেওয়ালের ওপরে অনেক মানুষের ভিড়। ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে স্লোগান দিচ্ছে তারা। কিন্তু কেউই আমাদের দিকে খেয়াল করল না।
বাদল ভাইকে বললাম আপনি গাড়ি স্টার্ট করেই রাখেন। স্বপন বের হলো, আমি বাঁ পাশ ও মায়া ডান পাশ থেকে বের হলাম। জিয়াও বের হয়ে আসে। জিয়া, মায়া ও আমার কাছে গ্রেনেড। পিস্তল ছিল স্বপনের কাছে।
আমি গ্রেনেডের পিন খুলতেই দেখি জিয়া তার হাতের একটি গ্রেনেড ছুঁড়ে মেরেছে। সাদা শেভ্রোলেট গাড়িটি উল্টে গেল। আমি দ্বিতীয় গ্রেনেড আর মায়া ছুঁড়ল তৃতীয় গ্রেনেডটি। এর মধ্যে জিয়া তার দ্বিতীয় গ্রেনেডটি সদরুদ্দিনের গাড়ির ওপরে ছুঁড়ে দেয়। গ্রেনেডটি গাড়ির পাশের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকেই বিস্ফোরিত হয়। দেখলাম গাড়ির পেছন দিকটা একটু ওপরে উঠেই আবার নিচে পড়ে গেল। মায়া আরেকটি গ্রেনেড ছোড়ে, কিন্তু সেটা হোটেলের প্রবেশ পথে গিয়ে পড়ে।
এরপর কি ঘটল– যদি জানতে চান কিছুই বলতে পারব না। ভেতরে ছিল ওয়েস্ট পাকিস্তান পুলিশ ও আর্মি। এটুকু শুধু বলতে পারব বিপদের মধ্যে ছিলাম তখন। কারণ ফায়ারিং শুরু হবে।
এর আগেই দ্রুত গাড়িতে এসে সাকুরা মার্কেটের সামনে থেকে ঘুরে আবার ফেরত আসি। তখন দেখি দেওয়ালের ওপর থাকা পাবলিক একজনও নেই। টেনিস ক্লাব পর্যন্ত রাস্তায় অসংখ্য স্যান্ডেল, লুঙ্গি, টুপি পড়ে আছে।
আমরা দ্রুত কাকরাইল মসজিদ থেকে ডানদিক দিয়ে চলে যাই মনিং নিউজের অফিসে। সেখানেও একটি গ্রেনেড লপ করলাম। কারণ ওরা পাকিস্তানের পক্ষে উল্টাপাল্টা নিউজ ছাপাচ্ছিল। অতঃপর শেষ টার্গেট ছিল জামায়াতে ইসলামীর নায়েবের বাড়ি। রমনা থানার দিকে ছিল বাড়িটি। সেখানেও একটি গ্রেনেড ছুঁড়েই আত্মগোপনে চলে যাই। পাকিস্তানি সেনারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘটেছে অপারেশনের ঘটনাগুলো।”
এরপরই কি ফিরে গেলেন?
“হ্যাঁ। মায়া ও জিয়াকে নিয়ে নির্দেশমতো পরদিনই মতিনগরে ফিরে যাই। ১১ জুন সকালে দেখা হয় খালেদ মোশাররফের সঙ্গে। তিনি দেখে হাসলেন। খুব খুশি হয়েছিলেন। কিছু বলার আগেই বললেন, খবর পেয়ে গেছি। তখন জানলাম বিবিসি ওইদিন রাত আটটার নিউজেই খবরটি প্রচার করে। এবিসি, অলইন্ডিয়া রেডিও, ভয়েস অব আমেরিকাও খবরটি সম্প্রচার করে। ওই অপারেশনের কারণেই প্রিন্স সদরুদ্দীন আগা খান ও তার টিম ভয়ে দ্রুত করাচি ফিরে যায়। ফলে ঢাকার ভেতরে প্রথম ওই অপারেশনটিতে পুরোপুরি সফল হয়েছিলাম।”
হাফিজুল আলম ও ফাতেমা বেগমের তৃতীয় সন্তান হাবিবুল আলম। তাদের আদি বাড়ি নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলার পেড়লী গ্রামে। বাবা ছিলেন পিডব্লিউডির ইঞ্জিনিয়ার। ১৯৫৭ সালে চাকুরি ছেড়ে তিনি ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন, ১/৩ দিলু রোড, নিউ ইস্কাটনে। ফলে আলমের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই।
লেখাপড়ায় হাতেখড়ি মগবাজার প্রিপারেটরি স্কুলে। পরে ভর্তি হন রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে। তিনি এসএসসি পাশ করেন ১৯৬৮ সালে। অতঃপর ওখান থেকেই ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে অনার্সে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ভূগোল বিভাগে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। একাত্তরে তিনি ট্রেনিং নেন ভারতের মতিনগর ক্যাম্পে, দুই নম্বর প্লাটুনে।
হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল অপারেশনের সাতদিন পরই তিনি, মায়া ও জিয়া একটা করে গ্রুপ নিয়ে ঢাকায় ঢোকেন। গ্রুপগুলো সমন্বয়ের দায়িত্ব ছিল শাহাদাত চৌধুরীর (প্রয়াত সাংবাদিক। সর্বশেষ সাপ্তাহিক ২০০০-এর সম্পাদক ছিলেন)।
হাবিবুল আলমরা পুরো টিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোড় ও ফার্মগেটে অপারেশন করেন। জুলাই মাসের ১৯ তারিখ ঢাকায় প্রথমবারের মতো একইসাথে ৫টি পাওয়ার স্টেশনে অ্যাটাক করেন, অগাস্টের ১১ তারিখ বিকেলে দ্বিতীয়বারের মতো তারা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বিস্ফোরণ ঘটান, ওই মাসেরই ১৪ তারিখে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউসহ ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় স্বাধীন দেশের ফ্ল্যাগ ওড়ান।
২৫ অগাস্ট ধানমন্ডি ১৮ নম্বরের অপারেশনে হাবিবুল আলমের সঙ্গে ছিলেন গেরিলা বদি, স্বপন ও কাজী কামালুদ্দীন ও রুমী। ২৭ অগাস্ট শাহাদাত চৌধুরীসহ তিনি চলে যান মেলাঘরে। ২৯ অগাস্ট ঢাকায় সব গেরিলাদের গোপন আস্তানা ও বাসায় পাকিস্তানি আর্মি রেইড দেয়। সবাই ধরা পড়লে ঢাকায় তাদের গোপন আস্তানাগুলো চিহ্নিত হয়ে যায়। ফলে একাত্তরের ২৯ অগাস্ট থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় সকল ধরনের গেরিলা অপারেশন বন্ধ ছিল। অক্টোবর থেকে আবারও নতুন দল পাঠানো হলে ঢাকায় গেরিলা অ্যাকটিভিটি নতুন করে শুরু হয়। ওই সময়টায় হাবিবুল আলমসহ শাহাদাত চৌধুরী, এনায়েত রাব্বী প্রমুখ কে-ফোর্সে জয়েন করেন।
ডিসেম্বরের ২ তারিখ পর্যন্ত তারা ছিলেন নির্ভরপুরে। অতঃপর চলে আসেন রূপগঞ্জে, মায়ার গ্রুপে। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে বিকেলের দিকে ওই গ্রুপের সঙ্গেই ঢাকায় ঢোকেন।
কথা ওঠে ক্র্যাক প্ল্যাটুন প্রসঙ্গে। এর অন্যতম সদস্য হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক অকপটে বলেন, “স্পেসিফিকভাবে যদি বলা হয় ক্র্যাক প্ল্যাটুন– এটা মনে হয় ঠিক নয়। আসলে ক্যাপ্টেন হায়দার যা নির্দেশ দিতেন আমরা তার চেয়েও বেশি করে ফেলতাম। এগুলো দেখার পর তিনি বলেন, এদের মাথা ক্র্যাক নাকি। হায়দার ভাই একবার খালেদ মোশাররফকে বলেন, ‘স্যার দিজ আর অল ক্র্যাকস’। মনে হচ্ছে এদের দিয়েই হবে।”
ওই থেকেই আমরা ক্র্যাক প্ল্যাটুন বলেই আসছি। বিশেষ করে মায়ার গ্রুপই ক্র্যাক প্ল্যাটুন সেরকম কোনো বিষয় ছিল না। যুদ্ধের পরে আমরা মাথায় সাদা ফেট্টি বাধলাম। জিপ গাড়িতেও লিখলাম ক্র্যাক প্ল্যাটুন। এগুলো ছবিতেও পাবেন। তবে এটা ঢাকার সব গেরিলাকে বলা হতো না।
বাংলাদেশ স্বাধীন– এই ঘোষণাটি রেডিওতে ইন্ডিয়ান আর্মি ঘোষণা করবে। এ খবর পেয়ে হাবিবুল আলমরা তাদের আগেই বাঙালি অফিসারদের মাধ্যমে সেই ঘোষণা দেওয়ার উদ্যোগ নেন।
কীভাবে তা সম্ভব হয়েছিল?
তার ভাষায়, “১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। রাত তখন ১২টা। আমরা তখন নারিন্দায়।
ওখানেই দেখা হয় শহীদ নামে আমাদের এক টো-আইসির সঙ্গে। সে জানায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে– সকালে ইন্ডিয়ান আর্মি রেডিওতে এমন ঘোষণা করবে। শুনেই মেজাজটা খারাপ হয়ে যায়।
শাহাদাত চৌধুরীর বাসা হাটখোলায়, নারিন্দার কাছাকাছি। তাকে খবরটি জানিয়ে একটা স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে অনুরোধ করি। পরিকল্পনা হয় সকাল ৭টা বা সাড়ে ৭টার মধ্যে রেডিওতে হায়দার ভাই ঘোষণা করবেন। শাহাদাত ভাইয়ের ছোট ভাই ফতেহ আলী চৌধুরী। তাকেও খবর পাঠিয়ে চলে আসি শাহবাগে, রেডিও অফিসে। খানিক পরেই আরেকটি গাড়িতে চলে আসে ফতেহ।
রাত তখন সাড়ে তিনটা। অর্থাৎ ১৭ ডিসেম্বর। ইন্ডিয়ান আর্মি অ্যানাউন্স করবে সকাল ৯টায়। রেডিও অফিসের গেইটে নক করতেই এক বুড়ো পিয়ন বেরিয়ে আসেন।
বললেন, কী চান?
হাতে পিস্তল দেখে উনি বুঝে গেলেন। জিজ্ঞেস করতেই বললেন ইন্ডিয়ান আর্মি সন্ধ্যা রাতে এসেই দেখে গেছে। সকালে আবার আসবে।
খবরটি যে সত্য পরিষ্কার হয়ে গেলাম।
তাকে বললাম ইন্ডিয়ান আর্মির আগেই রেডিও অন করতে হবে।
কাকে দিয়ে অন করা যায়?
তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, শামসুল হুদা চৌধুরী সাহেব পারবেন।
কোথায় থাকেন তিনি?
বললেন– কাছেই, ইস্কাটনে গুলবক্সের বাড়িতে।
বাড়িটি আমার চেনা। তাই দ্রুত চলে যাই।
ওই বাড়ির তিন তলায় থাকেন তিনি। দরজায় নক করতে একটা চেনা মুখ দরজা খুলে দেয়। ফেমাস সিঙ্গার লায়লা আরজুমান্দ বানু। তিনি যে শামসুল হুদা চৌধুরীর স্ত্রী জানা ছিল না।
আমি আর ফতেহ মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে বলি– শামসুল হুদা চৌধুরী সাহেবকে দরকার।
কিছুক্ষণ পর তিনি আসলেন। টেবিলে পিস্তলটা রেখে বললাম– ইন্ডিয়ান আর্মি নাকি অ্যানাউন্স করবে। কিন্তু তার আগেই আমরা ঘোষণাটি দেব। খবর পেয়েছি একমাত্র আপনিই রেডিওটা অন করতে পারবেন। সকাল ৮টার মধ্যে রেডিওটা অন হতে হবে। আটটা দশে আমরা অন এয়ারে যাব। মেজর হায়দার ভাই এনাউন্স করবেন। আপনি সব অ্যারেজমেন্ট করেন।
শুনে উনি হেসে বললেন– ঠিক আছে করে দেব।
মিষ্টি খেতে দিয়ে উনি টেলিফোনে কয়েক জায়গায় কথা বলে কয়েকজনকে আসতে বললেন।
তাকে আরও বললাম, ইন্ডিয়ান আর্মি আসলে আমরা ট্যাকেল দেব।
শুনে উনি বললেন, রাখো রাখো ওটা নিয়ে তোমাদের চিন্তা করতে হবে না। ইন্ডিয়ান আর্মি আসলে আমার কাছে পাঠিয়ে দিও। যা বলার আমিই বলে দেব।
সকাল তখন ছয়টার মতো বাজে। তিনি বললেন, সাড়ে সাত বা পৌনে আটটার মধ্যে মোটামুটি সব রেডি হয়ে যাবে।
সাতটার দিকে রেডিওতে শাহাদাত চৌধুরী ও হায়দার ভাই চলে আসেন। ঘোষণাটি লিখলেন শাহাদাত ভাই ও কাদের মাহমুদ। হায়দার ভাই একটু কারেকশন করে নেন। কিন্তু অ্যানাউন্স করবে কে? তখন ফতেহকে বলা হলো।
১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১, সকাল ৮টা ১০ মিনিট। স্বাধীন দেশের রেডিওতে প্রথম ফতেহ চৌধুরী অ্যানাউন্স করেন। এরপর মেজর হায়দার বাংলায় ঘোষণা দিয়ে বলেন– দেশ স্বাধীন হয়েছে এবং বাঙালিরা এখন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন নাগরিক। মুক্তিযোদ্ধাদের করণীয় কি কি তাও তুলে ধরেন তিনি। এরপরই শুরু হয় রেডিওর নিয়মিত অনুষ্ঠান।
ইন্ডিয়ান আর্মি কি এসেছিল?
হ্যাঁ। ঘোষণার সময়টাতেই দুইজন অফিসারসহ ইন্ডিয়ান এক লেফটেনেন্ট কর্নেল আসেন। তাদের শামসুল হুদা চৌধুরীর রুমে পাঠিয়ে দিই। উনি কি কি যেন বললেন। দেখি তারা খুব খুশি হয়ে চলে যাচ্ছে। তাদের তিনি বলেছিলেন এমন– ঘোষণা তো এখন করা যাবে না। ট্রান্সমিট করতে ট্রান্সমিটার লাগবে। ট্রান্সমিটারে একটা ক্রিস্টাল নেই। মিরপুরে এইচআর ট্রান্সমিটার সেকশন থেকে ওটা আনতে পাঠিয়েছি। তিন-চার ঘন্টা সময় লাগবে। আপনারা তখন আসেন।
শুনে তারাও চলে যান। পরে আর আসেননি রেডিওতে।
টেলিভিশনেও কি একইভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল?
মুচকি হেসে বীরপ্রতীক হাবিবুল আলম হ্যাঁ সূচক জবাব দেন। অতঃপর বলেন, রেডিও সেন্টার থেকে বিকেলের দিকে সেখানে যাই। আগেই চলে যায় ফতেহ আলী চৌধুরী।
দেখা করি এজাজ আহমেদের সঙ্গে। তিনি পরিচালক ছিলেন তখন। দেখা হয় খালেদা ফাহমী, সাকিনা আকতার, শিল্পী কেরামত মওলা, এম এ ওয়াহিদ এবং আবদুল্লাহ আল-মামুনের সঙ্গেও। এ সময় সঙ্গে ছিলেন সাংবাদিক শাহাদাত চৌধুরী ও মেজর হায়দারও।
ঘোষণা পাঠের আগে টেলিভিশনে দেখানো হয় বাংলাদেশের পতাকা। কীভাবে? একটি কাঠের খুঁটিতে পতাকা টাঙানো হয়। পেছনে রাখা হয় একটা টেবিল ফ্যান। সেটা ছেড়ে দিলে পতপত করে উড়তে থাকে পতাকা। স্টুডিওর বিশাল ক্যামেরা দিয়ে সেটা ধারণ করে প্রচার করা হলো টেলিভিশনে।
রেডিওর মতোই ফতেহ প্রথমে অ্যানাউন্স করেন। পরে মেজর হায়দার বাংলায় ঘোষণা ও করণীয় তুলে ধরেন। অতঃপর গোপীবাগের তরুণ মুক্তিযোদ্ধা আতিকুর রহমান টিপু ইংরেজিতে ওই ঘোষণা পাঠ করেন।
স্বাধীন দেশে রেডিও-টিভির ঘোষণার সঙ্গে থাকতে পেরেছি এটিই গর্বের। আমার কাছে বিজয়ের পর এটি ছিল আরও একটি বিজয়।
স্বাধীন দেশে নিজের ভালোলাগা এই বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রকাশ করেন ঠিক এভাবে, “অনেকেই প্রশ্ন করে। বায়ান্ন বছর হয়ে গেল আপনাদের প্রত্যাশা কী ছিল? তখন খুব হাসি লাগে। মুক্তিযোদ্ধাদের দায়িত্ব কী ছিল? প্রথমত যুদ্ধ করা, দ্বিতীয়ত পাকিস্তানিদের হটানো, তৃতীয়ত দেশটাকে স্বাধীন করা। তিনটি জিনিসই তো হয়েছে। হ্যাঁ আমাদের চারিত্রিক অবক্ষয় অনেক হয়েছে। কিন্তু তার মানে এই না দেশটা রসাতলে চলে গেছে।”
তিনি আরও বলেন, “দেশ চালাবার দায়িত্ব তো নিশ্চয়ই মুক্তিযোদ্ধাদের নয়। পলিটিশিয়ানদের ছিল। তারা কীভাবে চালিয়েছেন, কী করেছেন– সেটা ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে। তবে কষ্ট হয়– ‘যখন দেখি চালের দাম বেড়ে গেছে, যখন দেখি লুটপাট হচ্ছে। কিন্তু এগুলো ঠিক করার দায়িত্ব তো আমাদের না। পলিটিশিয়ানরা যদি তাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে না পারে তাহলে দেশের মানুষ কষ্ট পাবেই।”
কী করলে দেশ এগোবে?
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা অকপটে বলেন, “প্রথমত কাজে স্বচ্ছতা আনতে হবে। দ্বিতীয়ত চুরি বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি বুরোক্রেসিকে অনেক বড় বানানোও সঠিক হবে না।”
প্রজন্মের প্রতি পাহাড়সম আশা বীর প্রতীক হাবিবুল আলমের। চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন, “তোমরা মোবাইল ব্যবহার কমিয়ে একটু বই পড়। এখন তো দেশের ভেতরেই শুধু কম্পিটিশন না, বাইরের সঙ্গেও কম্পিটিশন। তাই পড়তে হবে, জানতে হবে। জানাটা বইয়ের ভেতরেই থাকে। আল্লাহ সোবাহানাওয়াতালাহ সবকিছুর বিকল্প দিয়েছেন। শুধু একটা জিনিসেরই বিকল্প নাই। সেটা হচ্ছে ইলম বা পড়ালেখা। তাই তোমাদের প্রথম দায়িত্ব লেখাপড়া করা, দ্বিতীয় দায়িত্ব লেখাপড়া করা, তৃতীয় দায়িত্বও লেখাপড়া করা।”