'স্বীয় জিহ্বা শাসনে' রাখার দিন কি তবে শেষ!

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষণের আপাত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া যাই হোক এর সুদূরপ্রসারী প্রভাবে সরকার আর আওয়ামী লীগই হবে টার্গেট। মাননীয় মন্ত্রী কি সেটা বুঝতে পেরে সাবধান হবেন? নাকি এমন ঢালাও প্রলাপ চলতেই থাকবে?

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 21 August 2022, 06:51 PM
Updated : 21 August 2022, 06:51 PM

কথায় বলে, 'স্বীয় জিহ্বাকে শাসনে রাখিবে'। ছেলেবেলায় এই প্রবাদ বাক্য পড়ে বড় হওয়া বাঙালি- এখন তা ভুলে গেছে। যার পদ-পদবী যতো বড়, তার জিভ ততো সংযত হলেই মঙ্গল। কিন্তু আমাদের সমাজে এখন আর কেউ তা মানেন না। এই মানা না মানা ব্যক্তিগত বিষয় হলেও, এর প্রভাব কিন্তু ব্যক্তিপর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকে না।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলে যে পদ প্রতিবেশী দেশে তার নাম ‘বিদেশ মন্ত্রক’। ওই পদবীটাই আমার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়। পররাষ্ট্র ব্যাপক অর্থে প্রচলিত হলেও ইংরেজি ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স’ এর সাথে এটি যায় না। এই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আর মন্ত্রী সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখা দরকার, আমরা সবে ডানা মেলতে শুরু করেছি। আমাদের ভিত্তি যখন ধীরে ধীরে মজবুতের পথে, তখন এমন পদে আসীন মানুষটি হবার কথা চৌকস বিজ্ঞ আর প্রমিতভাষী।

ভাষা যে কি সংঘাতিক একটা বিষয় আর মুখের কথা যে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ বা আত্মঘাতী হতে পারে, তা বুঝিয়ে বলার দরকার পড়ে না। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজকাল প্রায়ই সংবাদ শিরোনামে পরিণত হচ্ছেন সেই ভাষার জন্যই। এই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আমি একাত্তরের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। সে সময়কাল এখন অনেকের চোখে কেবলই অতীত। আর সরকারি দলের একতরফা ইতিহাসের ঠেলায় এর গুরুত্ব প্রায় শূন্যের কোঠায় । কিন্তু ওই বীজতলাই আমাদের ভিত্তি। সে সময়কার নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল নাজুক। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে উপহাস করতো। ইউরোপে বিশেষত পশ্চিম ইউরোপে ফ্রান্স বাদে মিত্র নেই বললেই চলে। সেই সময় আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা কেউ এবং আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি বেফাঁস কথা বললেই তা বারুদ হয়ে উঠতে পারতো। কিন্তু তারা পূর্ব অভিজ্ঞতার অভাব থাকার পরও কী দারুণভাবে সবকিছু ম্যানেজ করেছিলেন। এমন একটা গল্প আছে ফারুক চৌধুরীর লেখায় ।

প্রয়াত কূটনীতিবিদ ফারুক চৌধুরী ছিলেন আপদমস্তক একজন ভদ্রলোক। উচ্চ মেধা আর প্রজ্ঞাবান মানুষটির দু-একটি লেখা পড়লেই বুঝবেন কেমন ঝানু ছিলেন তিনি। তিনি লিখেছেন, একবার ইসলামিক দেশগুলোর এক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে চেপে ধরেছিলেন তানজানিয়ার রাষ্ট্রপতি। তার অভিযোগ বঙ্গবন্ধু মুসলিম দেশ পাকিস্তান ভেঙ্গে ঠিক করেননি। এক থাকলেই ভালো হতো। ফারুক চৌধুরী লিখেছেন, সবাই অধীর আগ্রহে দেখছিলেন বঙ্গবন্ধু এর জবাবে কী বলেন। তিনি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তানজানিয়ার প্রেসিডেন্টের কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন, “বন্ধু তা হলে তো আরব দেশগুলো একটা দেশ হলেই ভালো হতো। ভালো হতো উপমহাদেশ একটি রাষ্ট্র থাকলে? তা কি হয়েছে? তা যদি না হয় তো বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে কী দোষ করলো?” এরপর তিনি এর বিশদ ব্যাখ্যা দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন।

একেই বলে কূটনীতিক শিষ্টাচার ও ভদ্রতা। আমাদের সমাজ নাকি অনেক এগিয়েছে। দেশ এগিয়ে চলেছে। তাহলে মন্ত্রী কেন কথা বলবেন, মান্ধাতার আমলের মন্ত্রীর মতো? যা কিনা সরকারকে বিব্রত করে? এই যে তিনি এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল এর কারণ কী? তিনি গিয়েছেন জন্মাষ্টমীর সভায় ভাষণ দিতে। সেখানে তিনি বলবেন, ভগবান শ্রী কৃষ্ণের কথা। সেদিকে না গেলে কথা হওয়া উচিৎ ছিল সম্প্রীতি আর সহাবস্থান নিয়ে। এমন না যে তিনি তা বলেন নি। কিন্তু ওই যে একটু বেশি বলার অভ্যাস, সে কারণে ছিটকে পড়লেন আপন বলয় থেকে। অহেতুক ভারত প্রসঙ্গ এনে যা যা বলেছেন, তা শেখ হাসিনার সরকারের জন্য কোনওভাবেই ভালো হতে পারে না।

সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে কেউ যদি মহররমের কোন আলোচনা সভায় যান সেখানে কি তিনি শিয়া প্রধান ইরানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করবেন? বা খ্রিস্টান সভায় গিয়ে বলবেন পোপ বা রোমের ভ্যাটিকান নগরীর সাথে সম্পর্কের কথা? বৌদ্ধ পূর্ণিমায় গিয়ে কি মিয়ানমার বা রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে হবে? তাহলে কী কারণে সেদিন চট্টগ্রামে ভারতের সাথে সম্পর্কের কথা এলো? কেনই বা বলতে হলো ভারতকে তিনি অনুরোধ করেছেন, ‘এই সরকারকে টিকিয়ে রাখার’।

রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব বা সরকারকে অসহায় করে তোলার এমন নজির বিরল। এর ফলে এখন বিএনপিসহ বিরোধীশক্তি যৌক্তিকভাবেই প্রশ্ন তোলার অধিকার পেয়ে গেছে। কারণ ‘আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার জন্য ভারত নির্ভরতার’ ব্যাপারে তাদের দীর্ঘদিনের অভিযোগের ভিত্তি খোদ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীই তো গড়ে দিলেন।

তবে আমার মনে হয়েছে এতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজনকে অপমান করা হয়েছে। চট্টগ্রাম আমার জন্মভূমি। আমি এই সভা আয়োজনের পুরোটাই সহজেই অনুমান করতে পারি। এমন একটা সভাতে দাঁড়িয়েই এরশাদপত্নী ও বর্তমান বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ প্রথম জন্মাষ্টমীর ছুটি ঘোষণা করেছিলেন। পরে যা এরশাদ বহাল করেন। কিন্তু তা যে লোক দেখানো তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা। যেটি এখন আর এড়িয়ে যাওয়া বা রদ করা অসম্ভব। যাই হোক, এই জন্মাষ্টমীর সভায় মানুষ যায় ধর্মের কথা শুনতে। ভগবানকে আরাধনা করতে।

রাজনৈতিক কারণেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিন্দুরা জানমালের বিষয়ে মন্ত্রীর কাছে আশ্বাস শুনতে চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক। কারণ বিগত দুর্গাপূজায় মূলত আমাদের শান্তি নামের কাঁচের ঘর ভেঙ্গে গেছে। বেশিরভাগ মানুষ এখনো শান্তি আর সহনশীলতায় বিশ্বাসী বলে সংখ্যালঘু নির্যাতন ব্যাপক আকার ধারণ করেনি।

কিন্তু পরিষ্কার উস্কানি ছিল তাও আবার সরকারি দলের কিছু নেতা ও প্রশাসনের একটি পর্যায়ের কাজের মধ্যে। এসব কারণে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরং সংখ্যালঘুদের জানমাল আর ভালো থাকার কথা বললেই মানুষ খুশি হতেন। সেটা না করে, তিনি কেন ভারতের কথা বললেন! এর মানে কী এই যে, তিনি জন্মাষ্টমীতে ওই সভায় উপস্থিত হিন্দুদের ভারতের ভক্ত অনুরাগী মনে করেছেন? তিনিও কি মৌলবাদীদের মতো এটা অবচেতনে এটা মনে করেন যে, হিন্দুরা এক পা ভারতেই দিয়ে রেখেছে?

জন্মাষ্টমীর সভায় উপস্থিত নিরীহ ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা কি আসলেই জানতে চায় সরকার টিকিয়ে রাখার দায় ভারতের কিনা? তার বক্তব্যে আরও একটি বিষয় খেয়াল করার মতো। সেটি হলো তিনি বলার চেষ্টা করেছেন, ভারতে বিজেপি শাসনে আসার পর থেকে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বা উস্কানি লেগেই আছে। যা আমাদের অপছন্দ। বিশ্বব্যাপী এনিয়ে বাদানুবাদ আর প্রতিবাদও আছে।

কিন্তু তিনি মনে করিয়ে দিলেন সেখানে অন্যায় হলেও নাকি শান্তির স্বার্থে সংখ্যালঘুরা চুপ থাকেন। সত্যি বলতে কি এমন প্রলাপ, দেশ বা জাতির ভাবমূর্তি তো বটেই, সরকারের জন্যও প্রবল আত্মঘাতী।

জানি না কেন কী কারণে হঠাৎ তিনি এমন করে কথা বলছেন। মাত্র কয়েক দিন আগেই ‘মানুষ বেহশতে আছে’ বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন। মানুষ এটা নিয়ে মশকরা করেছেন। হাসাহাসি করেছেন। দ্রব্যমূল্যের এই উর্ধ্বগতির বাজারে নাভিশ্বাস উঠে যাওয়া মানুষ তার এ কথায় বিরক্ত হয়েছেন।

আমার মনে হয়, জিহ্বা শাসনে রাখার প্রবাদটি এখন কাচের ফ্রেমে বাঁধিয়ে দেয়ালে রাখার সময় এসে গেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষণের আপাত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া যাই হোক এর সুদূরপ্রসারী প্রভাবে সরকার আর আওয়ামী লীগই হবে টার্গেট। মাননীয় মন্ত্রী কি সেটা বুঝতে পেরে সাবধান হবেন? নাকি এমন ঢালাও প্রলাপ চলতেই থাকবে?

সিডনি, অস্ট্রেলিয়া