Published : 08 Sep 2015, 07:44 PM
মিরপুরের ব্যবসায়ী আফতাবউদ্দিন হত্যা মামলায় শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাৎ বাহিনীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা রাজনৈতিক হয়রানিমূলক দাবি করে প্রত্যাহারের আবেদন করা হয় গত বছর। গণমাধ্যমে এ বিষয়টি প্রচারিত হলে পরে জনমতের চাপে ওই আবেদনটি প্রত্যাহার করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর উইং। হেরোইন পাচারকারীকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে, রাজনৈতিক কর্মসূচীতে যার ন্যূনতম অংশগ্রহণ নেই বরং অবৈধ অস্ত্র হাতে ধরা পড়া সেই সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাকে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক দাবি করে তা প্রত্যাহার করা হয়। যৌতুকের দাবিতে মারধরের অভিযোগে স্ত্রীর দায়ের করা মামলাও রাজনৈতিক হয়রানিমূলক বলে প্রত্যাহার করা হয়েছে। অনাচারের এ রকম ভুড়ি ভুড়ি দৃষ্টান্ত এ সরকারের আমলে গত বছরগুলোতে হয়েছে।
সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলাও রাজনৈতিক হযরানিমূলক বলে তা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেয়ার খবর গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। ওই উদ্যোগের অংশ হিসাবে ফৌজদারি আইনের সংশ্লিষ্ট কয়েকটি ধারা পুন:সংশোধনের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর গত ২২ নভেম্বর ওই ধারা সংশোধনের জন্য প্রস্তাব দিয়ে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন।
ওই বিষয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, ইতোমধ্যে "রাজনৈতিক হয়রানিমূলক" মামলা প্রত্যাহার সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি ৩০টি সভায় দুদকের দায়ের করা ৩৪৭টি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাতে এখনও পর্যন্ত সম্মতি দেয়নি। দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন এ আইন সংশোধন দুদকের ক্ষমতাকে খর্ব করবে। 'দ্য ক্রিমিনাল ল এ্যমেন্ডমেন্ট এ্যক্ট '-এর ১০ ধারার ৪ উপধারা অনুযায়ী দুদকের মামলা প্রত্যাহারের ক্ষমতা কেবল দুদকের।
আইনসভা অর্থাৎ সংসদ আইন পাশ করবে, আইন সংশোধন করবে। সবকিছুর নিয়মতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক পথ রয়েছে। বৈধতা দেয়ার বিভিন্ন আইনি সুযোগ রয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্রের নাম করে যেন প্রকৃত অভিযোগের মামলাগুলো হয়রানিমূলক অভিহিত করে তা প্রত্যাহারের চেষ্টা করা না হয়। এমনিতেই একশ্রেণীর বিচারকদের দুর্নীতি, অনিয়ম, অধিকাংশ প্রসিকিউশনের আইনজীবীদের আইন ও বিচার কার্যক্রম সম্পর্কে অজ্ঞতা দুদকের দায়ের করা মামলাগুলোকে দুর্বল করে দিচ্ছে। মামলার বিচারকাজ পতিত হয়েছে দীর্ঘসূত্রিতার ঘেরাটোপে। তারপর এখন এই গোদের উপর বিষ ফোঁড়া। তার উপর সরকারের এই সিদ্ধান্ত। যদিও এ সিদ্ধান্তটি সম্পর্কে এখনো বিস্তারিত, নিশ্চিত কিছু জানা যায়নি।
আইনপেশা ও আইন সাংবাদিকতার সূত্রে হলমার্ক ও ডেসটিনির অভিযুক্তদের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে আদালত পাড়ায়। কথা বলতে হয়েছে তাদের এবং তাদের কৌশুলিদের সঙ্গে। আর মামলাগুলোর নথিপত্র, সংশ্লিষ্ট আইনগুলোও ঘাঁটতে হয়েছে ভালোভাবে। দুর্নীতি দমন কমিশন আইনে কোন শুনানি নেয়ার এখতিয়ারই হাকিম আদালতের নেই অথচ ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালত ডেসটিনির কর্তাদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার মামলায় জামিন দিয়েছিল, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের তুমুল বাধা সত্ত্বেও। যদিও পরে ওই জামিন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত বাতিল করে দেয়। সে সময় মহানগর হাকিম আদালত থেকে পাওয়া ওই জামিনে একজন মন্ত্রীর কারসাজি ছিল বলে আদালত পাড়ায় সবার মুখে মুখে আলোচনা ছিল। আর সেই সময় দেখেছি বর্তমান সরকার ও দুর্নীতি দমন কমিশনের স্নায়ুযুদ্ধ। দেখেছি দুদকের এক বিভাগের সঙ্গে অন্য বিভাগের কাজের সমন্বয়হীনতা।
গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে আমাদের শাসকবর্গ নিজেদের ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থে নানাভাবে কাঁচি চালিয়েছেন বাংলাদেশের সংবিধানে। তেমনি করে সংসদে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন রকমের বিল এনে তা পাশ করে আইনও করেছেন। আমাদের দেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল সাবেক ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে নানা রকম হয়রানিমূলক মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। এই কর্কট রোগ দীর্ঘদিন ধরে পুষে রাখায় বাংলাদেশের গণতন্ত্র কখনোই মজবুত ভিত পায়নি। দুর্নীতি, কালো টাকা, পেশির প্রাবল্য থাকছেই। আর সে কারণে পশ্চিমাদের চোখ দিয়ে দেখা কথিত সূচকের উন্নয়নও ফল ও বলহীন হয়ে যাচ্ছে ।
আমাদের দেশে বিচারবিভাগ এখন নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক বটে, কিন্তু এ বিভাগটির স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা মেলেনি এক বিন্দুও। বিচারবিভাগ সরকারের সঙ্গে চেনা-অচেনা নানা রকমের আপোষ রফা করে থাকে। তাই সরকার আর ক্ষমতাসীনরা 'ময়দানের অন্ধকারে যে যার মতো করে আপন আপন ভাব ভালোবাসা সেরে নেয়'। তারপরও আমাদেরকে এই চরিত্রের রাষ্ট্রেই বাস করতে হয়।
প্রত্যাহার প্রস্তাবের মামলাগুলোর মধ্যে অধিকাংশই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা। আর আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, সাংসদ তো রযেছেনই। এসব মামলার অধিকাংশই বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরোর দায়ের করা বিগত সরকার আমলের। শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের নেতা ও সাংসদদের বিরুদ্ধে অনেক দুনীর্তি মামলাই হয়রানিমূলক ঠিকই। আর সেগুলি প্রত্যাহারের জন্য সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধন করা যেতে পারে অবশ্যই। কিন্তু এই সংশোধনের প্রক্রিয়া যেন হয় আইনসম্মতভাবে। বিচার বিভাগকে কোনভাবেই প্রভাবিত করে নয়। অথবা দুদকের ক্ষমতাকে কোনভাবেই খর্ব করে নয়। বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরোর অধিকাংশ মামলাতেই আদালতগুলো ৯৯ ভাগ মামলায় আসামিদেরকে খালাস দেন। কারণ শাস্তি দেয়ার মতো কোন সাক্ষ্য প্রমাণ উঠে আসে না। রাজনৈতিক হয়রানিমূলক না হলেও অধিকাংশ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ সুষ্ঠুভাবে করা যায় না। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে ব্যর্থ হয়। অথবা রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীসহ আদালতের কর্মচারীরা দুর্নীতির অভিযোগের ওই সব আসামিদের বাঁচানোর জন্য নিজেরাই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
সুনীতি, দুর্নীতি দুই সখীর মতো গলায় গলায় চলে এখানে। মানুষের মধ্যে থাকে সুমতি, কুমতির দ্বন্দ্ব। কিন্তু এসবই ব্যক্তি পর্যায়ের একটি প্রপঞ্চ মাত্র। বাজার অর্থনীতির যুগে যখন সারা পৃথিবীর বাণিজ্যিক গিল্ড কথিত উন্নয়নশীল বিশ্বের রাষ্ট্রকাঠামোর শিক্ষা পদ্ধতি, শাসন পদ্ধতি, আইন, সবকিছুর চরিত্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় তখন দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা খুবই কঠিন একটি বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এই কঠিন অবস্খার মধ্যেই দুদকের আপাত সফল ও সাহসী কার্যক্রমের সাম্প্রতিক বেশ কিছু ঘটনা আমরা লক্ষ্য করেছি। বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর বিদেশে পাচার করা প্রায় তের কোটি টাকা তারা দেশে ফিরিয়ে এনেছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে বলে বর্তমান সরকারের পদত্যাগকারী মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনসহ এক ডজন ব্যক্তিকে আসামি করা হচ্ছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রচারিত হয়েছে। তাই আমরা আশা করবো রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের কর্মটি করতে গিয়ে যেন অরাজনৈতিক প্রকৃত অভিযোগের মামলা প্রত্যাহারের জন্য দুদদকে চাপ প্রয়োগ করা না হয়। আর এই প্রত্যাহারের আবেদনটি যেহেতু আদালতের কাছে যাবে আদেশের জন্য তাই আদালতকেও যেন কোন প্রকার বাধ্য করা বা চাপ না দেয়া হয়।
প্রকাশ বিশ্বাস: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আদালত প্রতিবেদক।