Published : 17 Apr 2022, 06:49 PM
একটি শহর কিভাবে অকার্যকর হয়ে পড়ে, তার দৃষ্টান্ত হতে পারে ঢাকার ভয়াবহ যানজট। এই বিপদ সঙ্গে নিয়েই নগরবাসীকে চলতে হচ্ছে। মহামারী পেরিয়ে যখন সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেল- তখন থেকেই আবার অসহনীয় ঠেকছে ঢাকার রাস্তার শ্বাসরোধ করা পরিস্থিতি। এই দুঃসহ যন্ত্রণা কমাতে নীতি-নির্ধারকরা যে বিশেষ ভাবিত তার প্রমাণ দেখা যায় না। অবশ্য ভিআইপি প্রটোকলের কারণে তাদের যানজটে ভুগতে হয় কমই।
কর্তৃপক্ষ আন্তরিক থাকলে, মানুষের যখন নাভিশ্বাস অবস্থা তখন রাস্তা-ফুটপাতের একটা অংশ দখলদারদের কব্জায় চলে যেত না। যে সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি থমকে থাকে, সেখানে বাজার বসে যাওয়াকে বিস্ময়করই বলতে হবে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, হেঁটেও ভোগান্তি কমাতে পারছেন না নগরবাসী।
চার শ বছরের পুরনো এ শহরে কোনও পার্কিং ব্যবস্থাপনা নেই। রাস্তায় বাস-প্রাইভেটকার রেখে যানজটকে দুর্বিষহ করে তোলা হচ্ছে।
রাস্তা-ফুটপাত দখলমুক্ত রাখা গেলে, কার্যকর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা থাকলে যানজট অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে আনা যেত- সেটি নীতি-নির্ধারকরা ভালো করেই জানেন। কিন্তু চাঁদাবাজির ভাগাভাগি বন্ধ না হলে এসব বাস্তবায়ন করবে কে?
সম্প্রতি স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম সড়কে দোকান বসানো ও গাড়ি রাখাকে যানজটের জন্য দায়ী করে বলেছেন, "এগুলো বন্ধে পুলিশকে কঠোর হতে হবে"। যানজট প্রসঙ্গে সরকারের দায়িত্বশীলরা বছর ঘুরে এমন কাছাকাছি ধরনের বক্তব্যই দিয়ে আসছেন। প্রতিবার মনে হবে- ঘটনাগুলো নতুন ঘটছে এবং তারা প্রথম জানছেন। বক্তৃতাবাজি চললেও প্রতিবন্ধকতামুক্ত সড়ক অধরাই থেকে যাচ্ছে।
সহজ সমাধানযোগ্য বিষয়ে নজর না থাকলেও, যানজট কমাতে সরকারের কর্মপন্থা অবশ্য একটি পথে মিলে যায়। সেটি হচ্ছে অবকাঠামো নির্মাণ, যার ফলে এই শহরে ঘুরে ফিরে আসছে মেগাপ্রকল্প। অথচ কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেও ঢাকার চারপাশে নৌ-যোগাযোগের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যায়নি।
যানজট নিরসনের মন্ত্র জপে ফ্লাইওভার, ইউলুপসহ নানা উদ্যোগে কাড়ি কাড়ি অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে। এসব প্রকল্প যদি যৌক্তিক হতো তাহলে আজ যানজট সহনীয় থাকতো। এরপরও আরও ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের কাজ চলছে। পরিকল্পনা রয়েছে পাতাল রেলের।
কাজের কাজ না হলেও যানজট, দূষণ, জরুরি পরিষেবার ব্যাঘাতের মতো ভোগান্তি বাড়াতে জুড়ি নেই এসব প্রকল্পের। বাস-র্যাপিড ট্রানজিট ও মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ ভোগাচ্ছে কয়েক বছর ধরে। এসব প্রকল্প চলাকালে সঙ্কুচিত রাস্তায় শুরু হয় দুর্ভোগের। কাজ শেষ হলে প্রকল্প এলাকায় জনচাপ ও যানবাহন- দুটোই বেড়ে যায়। কিন্তু ঢাকাকে ঘিরে এসব পরীক্ষা চলবেই, কারণ মেগা প্রকল্পে মেগা লাভেরও সুযোগ থাকে। রাজনৈতিক প্রচারণায়ও সুবিধা পাওয়া যায়।
জনসংখ্যার তুলনায় ঢাকায় রাস্তার পরিমাণ এমনিতে খুবই কম। বিশ্বব্যাংকের হিসাব বলছে, ২০৩৫ সাল নাগাদ রাজধানীর জনসংখ্যা দাঁড়াবে সাড়ে তিন কোটিতে। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে অচল হয়ে পড়া একটি শহরে রাস্তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগও থাকবে না। সে কারণেই ভাবনা মানেই নির্মাণ- এ প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে কার্যকর সমাধান খুঁজতে হবে।
সরকারকে এটি বুঝতে হবে যে, বিদ্যমান ব্যবস্থায় পরিবর্তন না এনে কেবল নির্মাণযজ্ঞ চালিয়ে সংকট কমানো যাবে না। বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরের যানজট দীর্ঘমেয়াদে নিরসন সম্ভব না। বাইরে পর্যাপ্ত নাগরিক সুবিধা না থাকায় জনচাপ ঢাকাকে ঠেলে দিচ্ছে স্থবির শহরের দিকে। সেজন্য ঢাকার বাইরে সমান সুযোগ তৈরির পাশাপাশি অনলাইনে সেবা বাড়ানো, যাতায়াত সহজ করার মতো সমন্বিত উদ্যোগ দরকার।
এর আগে সহজ ও স্বল্প ব্যয়ের বিকল্প হতে পারে কর্মঘণ্টা সমন্বয়। বছরের পর বছরের নানা পরিকল্পনা কাজে না আসলেও এই প্রক্রিয়া ঢাকাকে অনেকটা মুক্তি দিতে পারে। এবং বাস্তবতা যে পথে যাচ্ছে, ঢাকাকে একদিন কর্মঘণ্টা সমন্বয় করতেই হবে। সেটি যত আগে করা যায় ততই মঙ্গল।
ঢাকার যানজট মূলত অফিস সূচি কেন্দ্রিক; যা সকালে শুরু হয়, চলে সন্ধ্যার পর পর্যন্ত। দুপুরে বেশ কিছু এলাকা অনেকটা ফাঁকা হয়ে যায়। রাতে কয়েকটি পয়েন্ট ছাড়া গাড়ি থামতে হয় না। পিক আওয়ারের ব্যস্ততাকে নন-পিক আওয়ারে ভাগ করে দিতে পারলেই সড়কের গতি দ্বিগুণ বাড়ানো সম্ভব।
সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায়, ঢাকাকে বাঁচতে হচ্ছে সড়ক যাতায়াতের উপর। দুই কোটি মানুষ মূলত তিন-চারটি প্রধান সড়কের ওপর নির্ভরশীল। বাইরে থেকে আসা লাখো মানুষের চাপও সামলাতে হয় রাজধানীকে। ভবিষ্যতে জনচাপ আরও বাড়বে, যানবাহনও বাড়ছে। গতবছরই ঢাকার রাস্তায় যোগ হয়েছে দেড় লাখের বেশি গাড়ি। এমন শহরে প্রায় সবাই একটি নির্দিষ্ট সময়ে অফিসে গেলে এবং কর্মস্থল ছাড়লে যানজট নিরসন কঠিন। সে কারণে পুরনো ধাঁচের সকাল-বিকালের অফিস সূচি পাল্টে শিফটিংয়ে যেতে হবে। ভিন্ন ভিন্ন সূচিতে রাতে ৩০-৪০ শতাংশ কর্মঘণ্টা ভাগ করে দেওয়া যেতে পারে।
আমাদের উপলব্ধি করতে হবে- মানুষের জীবনে সময়ের বাধা থাকবে না, এমন একটি সমাজ বাস্তবতা আসন্ন। বহুমুখী ব্যস্ততা যেভাবে ধেয়ে আসছে, তাতে এক দশক পর মানুষ ঘড়ি দেখে বিশ্রামে যেতে পারবে কিনা তা নিয়েই ভাবতে হবে। ২৪ ঘণ্টার সচল দিন যখন দুয়ারে কড়া নাড়ছে, তখন কাজের ক্ষেত্রে সময়ের সীমা যতোটা সম্ভব উন্মুক্ত হওয়া উচিত। এর সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে ঢাকার মতো জনবহুল নগরী অগ্রণী হতে পারে।
ঢাকায় মানুষের যে জীবনধারণ পদ্ধতি তাতে ২৪ ঘণ্টা না হোক, অনায়াসে ১৪ ঘণ্টা অফিস সচল রাখা সম্ভব। দিনের জট কমাতে চাইলে এটি করতেই হবে। সেক্ষেত্রে সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও অর্থনৈতিক ভিন্নতা বিবেচনা করে কর্মঘণ্টা সমন্বয় করতে হবে। প্রযুক্তির উৎকর্ষতা একে সহজ করে দিতে পারে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকায় নিবন্ধিত প্রাইভেটকারের সংখ্যা ৩ লাখ ১৭ হাজার, বাস ৩৭ হাজার, মোটরসাইকেল ৯ লাখ ১৪ হাজার। সবমিলিয়ে যানবাহনের সংখ্যা ১৮ লাখের বেশি, যার সাড়ে ১১ লাখই যুক্ত হয়েছে গত এক দশকে।
সকাল ৮টার দিকে নগরী ব্যস্ত হতে থাকে, ফলে বিপুল সংখ্যক যানবাহনের চাপ কয়েক ঘণ্টা চলতে থাকে। আবার বিকাল ৪টা থেকে কর্মস্থল ছাড়ার ব্যস্ততা শুরু হলে একই চিত্র দেখা যায়। ফলে অফিস থেকে মোটামোটি দূরত্বে থাকা একজন কর্মজীবী মানুষের বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়। অথচ কাছাকাছি সময়ে দুই ধাপে সহজেই অফিস চালানো যায়। ঢাকার জন্য এটি নতুন কিছুও না, কিন্তু প্রয়োজন পরিকল্পিতভাবে একে কাজে লাগানো।
ঢাকায় কিছু অফিস শিফটিংয়ের মাধ্যমে রাতেও কাজ চালাচ্ছে। কিন্তু ব্যাপকভাবে এই প্রক্রিয়া চালু না হলে তা ফলপ্রসূ হবে না। কারণ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত অফিসগুলো একসাথে সচল থাকা জরুরি।
যদি দুই শিফটেও অফিস চালানো যায়, তা কাজের গতি বাড়াবে। সকাল ৮টা থেকে বিকাল চারটা, দুপুর ২টা থেকে রাত ১০ টা; এভাবে সূচি নির্ধারণ করে অফিসে প্রবেশ ও বের হওয়ার যানবাহনকেও আলাদা করা সম্ভব। দিনে ১৪ ঘণ্টা সেবা পেলে অফিসগুলোতে সেবাপ্রত্যাশীদের চাপও একসাথে তৈরি হবে না। আর যাতায়াতে ভোগান্তি কমলে অফিসগুলোও কর্মীদের কাছ থেকে আরও ভালো কাজের প্রত্যাশা করতে পারবে।
বর্তমান ব্যবস্থাপনায় স্কুল, আদালত, ব্যাংক, মার্কেটসহ সরকারি-বেসরকারি অফিস প্রায় একই সময়ে ছোটে। ধরন অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য ভিন্ন ভিন্ন সময় নির্ধারণ করে দেওয়া যায়। সিংহভাগ প্রতিষ্ঠানেই সাপ্তাহিক ছুটি শুক্র-শনিবার। ফলে এই দুই দিন রাস্তা অনেকটা ফাঁকা থাকে। কর্মীদের যে কোন দিন সাপ্তাহিক ছুটি নেওয়ার সুযোগ দিয়ে অফিস প্রতিদিনই চালু রাখা যেতে পারে, কিংবা সেক্টর অনুযায়ী ছুটির দিন আলাদা হতে পারে। করোনাভাইরাসের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কর্মীদের হোম অফিসের সুযোগ রাখা যেতে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে দীর্ঘদিনের কাঠামো ভেঙে এসব সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন হতে পারে। তবে যানজট যেখানে নগরীর প্রধানতম সমস্যা, তার থেকে মুক্তির পথ পেলে নগরবাসী তা নিশ্চয়ই গ্রহণ করবে।
এই প্রক্রিয়ায় কিছুটা বাড়তি জনবল প্রয়োজন হতে পারে। বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে, নিরাপত্তায় বাড়তি গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু যানজটে যে পরিমাণ ক্ষতির মুখে পড়ছে ঢাকা, তার তুলনায় এসব নগন্য।
২০১৮ সালে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় ঢাকা মহানগরীতে যানজটে প্রতিদিন ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়া ও বছরে ৩৭ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির তথ্য বেরিয়ে আসে। পিক আওয়ারে গণপরিবহনের গতিবেগ ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটারে নেমে এসেছে, যা পায়ে হেঁটে চলার গড় গতির সমান।
এর আগের বছর বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১০ বছরে ঢাকায় যান চলাচলের গড় গতি ঘণ্টায় তিনগুণ কমে গেছে।
সম্প্রতি যানজটের ক্ষতি নিঃসন্দেহে আরও বেড়েছে। এর ভয়াবহতা দূষণ ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে।
সম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র জোড়-বিজোড় গাড়ির জন্য আলাদা দিন ঠিক করার প্রস্তাব দিয়েছেন। কর্মঘণ্টা সমন্বয় করে অফিসে শিফটিং করা গেলে এমনিতেই গাড়ি বিভাজন হয়ে যাবে। ফলে ব্যক্তিগত গাড়ি যেভাবে ঢাকার রাস্তার প্রায় পুরোটা খেয়ে ফেলে সেটিও নিয়ন্ত্রণ হবে। তাতে অফিসগামী ব্যক্তিদের গাড়ির চাপে নগরীর অন্য সব কাজ থমকে যাবে না।
রাতে কর্মঘণ্টা বাড়াতে চাইলে নিরাপদ গণপরিবহনও বাড়াতে হবে। গণপরিবহনে আধুনিক সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলে যানজট এড়াতে ছোট গাড়ির নির্ভরতা থেকে নিশ্চয়ই অনেকে বেরিয়ে আসবেন। আর গণপরিবহন বাড়লে যানজট নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে না। যত্রতত্র পার্কিংয়ের সুযোগ বন্ধ করলেও ছোট গাড়ির উৎসাহ কমবে।
তবে কর্মঘণ্টা সমন্বয়ে বাড়তি কর্মসংস্থানের সম্ভাবনার পাশাপাশি শ্রম-শোষণের ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে। সেজন্য অতিরিক্ত কাজের ভার যেন শ্রমিকের উপর না আসে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে ঘণ্টা হিসেবে শ্রমমূল্য নির্ধারণ করে দিলে শ্রমিক তার ন্যায্য পাওনা পাবেন।
যানজটের যন্ত্রণা থেকে মানুষের মুক্তি প্রয়োজন। এই সমস্যাকে নিয়তি বানিয়ে না ফেলে কর্মঘণ্টা সমন্বয়ের মত বিকল্প সমাধানগুলো নিয়ে ভাবুন।