Published : 16 Apr 2022, 12:15 AM
(স্লাভো জিজেক ইউরোপিয়ান গ্র্যাজুয়েট স্কুলের দর্শনের অধ্যাপক এবং ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের বার্কবেক ইনস্টিটিউট অব দ্য হিউম্যানিটিজের আন্তর্জাতিক পরিচালক। তার সাম্প্রতিক গ্রন্থের নাম হ্যাভেন ইন ডিসঅর্ডার । জিজেকের এ নিবন্ধটি প্রজেক্ট সিন্ডিকেট নামের একটি মতামত ভিত্তিক অনলাইনে মার্চের শেষ সপ্তাহে প্রকাশ হয়েছে।)
বাজার ও জাতীয় স্বার্থের লৌহকঠিন যুক্তিতে গড়ে ওঠা পৃথিবীতে বাস্তবিক রাজনীতির 'গভীর' কৌশলবিদদের বিহ্বল করে দিয়েছে ভ্লাদিমির পুতিনের দখলদারিত্বের পূর্বানুগামী যুদ্ধ। বৈশ্বিক পুঁজিবাদের অধীনে সাংস্কৃতিক, জাতিগত ও ধর্মীয় সংঘাতই যে একমাত্র অবশিষ্ট রাজনৈতিক সংগ্রাম তা বিস্মৃত হওয়াই ছিল তাদের ভুল।
ইউক্রেইনে রাশিয়ার আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে আমরা যুদ্ধ ও বৈশ্বিক রাজনীতির এক নতুন স্তরে প্রবেশ করছি। পারমাণবিক বিপর্যয়ের উচ্চতর ঝুঁকি ছাড়াও আমরা ইতোমধ্যে পারস্পরিকভাবে জোরালো বৈশ্বিক সংকটগুলোর একটি নিখুঁত ঝড়ের মধ্যে আছি– অতিমারী, জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়, এবং খাদ্য ও পানির স্বল্পতা। এই পরিস্থিতি একটি প্রাথমিক উন্মাদনাকে প্রকাশ করে: যে সময়ে মানব জাতির টিকে থাকা বাস্তুতান্ত্রিক (এবং অন্যান্য) বিষয়সমূহের দ্বারা হুমকিগ্রস্ত, এবং যখন সেসব হুমকির মোকাবেলাকে অন্য সবকিছুর চাইতে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত তখন আমাদের মূল উদ্বেগ হঠাৎ– আবারও– একটি নতুন রাজনৈতিক সংকটের দিকে মোড় নিয়েছে। বৈশ্বিক সহযোগিতা যখনই আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে বেশি প্রয়োজন তখন 'সভ্যতার সংঘাত' একটি প্রতিশোধ নিয়ে ফিরে এসেছে।
এটা কেন ঘটে? এমন যখন প্রায়ই ঘটে তখন হেগেল এরকম প্রশ্নের উত্তর দিতে অনেক দূর যেতে পারেন। ফেনোমেনোলজি অফ স্পিরিট– এ হেগেল মালিক ও শ্রমিকের দ্বান্দ্বিকতাকে বর্ণনা করেছেন। দুই পক্ষই নিজ নিজ 'আত্মচেতনা' থেকে জীবন অথবা মৃত্যুর সংগ্রামে আটকে গেছে। যদি প্রত্যেকেই জেতার জন্য তার নিজের জীবন বাজি রাখতে প্রস্তুত থাকে এবং দুজনেই যদি তাতে অটল থাকে, সেখানে কেউই জয়ী হয় না; একজন মারা যায় এবং যে টিকে থাকে তার নিজ অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আর কেউ থাকে না। সারকথা হলো- সকল ইতিহাস ও সংস্কৃতি একটি ভিত্তিগত আপসের ওপর নির্ভর করে। আর এ আপসের ব্যাপারটা হলো এরকম যে, চোখে-চোখে, মুখোমুখি মোকাবেলায় এক পক্ষ (ভবিষ্যৎ শ্রমিক বা চাকর) ঘটনার শেষ পর্যন্ত যেতে অনিচ্ছুক হওয়ার মাধ্যমে 'নিজের চোখ সরিয়ে নেয়' (অর্থাৎ লড়াই বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ায়) ।
তবে হেগেল এও লিখেছেন যে, রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কোনো চূড়ান্ত কিংবা স্থায়ী সমঝোতা হতে পারে না। সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্রসমূহের মধ্যকার সম্পর্ক আসলে স্থায়ীভাবে সম্ভাব্য যুদ্ধের ছায়ায় থাকে, যেখানে শান্তির প্রতিটি পর্যায় একটি অস্থায়ী সন্ধির চেয়ে বেশি কিছু নয়। প্রতিটি রাষ্ট্র তার নিজ সদস্যদের শৃঙ্খলিত করে ও শিক্ষা দেয় এবং তাদের মধ্যে নাগরিক শান্তির নিশ্চয়তা দেয়, এবং এই প্রক্রিয়া একটি নৈতিকতার জন্ম দেয়। এ নৈতিকতা অনুযায়ী, দেশের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করাকে সবচেয়ে 'বীরত্বসূচক' কাজ বলে মনে করতে শেখানো হয়। একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে অপর রাষ্ট্রের মধ্যকার এরকম বন্য-বর্বর সম্পর্কই আবার রাষ্ট্রের ভেতরে বসবাসরত নাগরিকদের নৈতিক জীবনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
উত্তর কোরিয়া এই যুক্তির সবচেয়ে স্পষ্ট দৃষ্টান্ত, তবে চীনও যে একই দিকে যাচ্ছে তার চিহ্ন রয়েছে। চীনা বন্ধুদের মতে (যারা অবশ্যই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থাকতে চান), চীনা সামরিক জার্নালগুলোর অনেক লেখক এখন অভিযোগ করেন যে, দেশটির সেনাবাহিনী তার লড়াইয়ের সক্ষমতাকে যাচাই করার জন্য সত্যিকারের কোনো যুদ্ধ করেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানে ইরাকের মতো জায়গাগুলোতে তার সেনাবাহিনীকে স্থায়ীভাবে যাচাই করছে, সেখানে চীন ১৯৭৯ সালে ভিয়েতনামে তার ব্যর্থ হস্তক্ষেপের পর সেরকম কিছুই করেনি।
একই সময়ে চীনের আনুষ্ঠানিক গণমাধ্যম আরও প্রকাশ্যে ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছে যে চীনের সাথে তাইওয়ানের শান্তিপূর্ণ একীভবনের সম্ভাব্যতা হ্রাস পাওয়ার কারণে দ্বীপটিতে একটি সামরিক 'মুক্তি'র প্রয়োজন হবে। এর মতাদর্শিক প্রস্তুতিস্বরূপ চীনা গণমাধ্যমগুলো- তাইওয়ানের হয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে যুদ্ধ করবে (তাদের বিরুদ্ধে) তা নিয়ে ক্রমাগত অভিযোগমূলক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে বেশি করে জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেম ও বিদেশি সবকিছুর প্রতি সংশয়ের আহ্বান জানিয়ে আসছে। গত শরতে চীনা কর্তৃপক্ষ জনগণকে দুই মাস টিকে থাকার জন্য 'যদি দরকার হয়' সেজন্য যথেষ্ট সরবরাহ মজুদ করার পরামর্শ দিয়েছে। অনেকেই এই অদ্ভূত সতর্কবাণীকে আসন্ন যুদ্ধের একটি ঘোষণা হিসেবে বিবেচনা করেছেন।
এই প্রবণতা আমাদের সভ্যতাগুলোকে সভ্য করে তোলার জরুরি প্রয়োজনের বিরোধী। আমাদের প্রতিবেশের সম্পর্ককেও এটি ভিন্ন বা নতুনভাবে দেখতে শেখাচ্ছে। দেশে দেশে মানুষে-মানুষে সংহতি ও সহযোগিতার দরকার এখন। অথচ এর বদলে গোষ্ঠিগত ধর্মীয় ও জাতিগত 'বীরত্বসূচক' সহিংসতা এবং নিজেদের নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের জন্য নিজেদেরকে (ও পৃথিবীকে) ত্যাগ করার তৎপরতা সংহতির লক্ষ্যকে আরও বেশি জটিল করেছে।
২০১৭ সালে দার্শনিক আল্যাঁ বাদিউ বলেছেন, "ভবিষ্যৎ যুদ্ধের সীমারেখা ইতোমধ্যে বোধগম্য। তিনি ধারণা করেছেন, "…এক দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের পশ্চিমা-জাপানি গ্রুপ, অন্য দিকে চীন ও রাশিয়া, সর্বত্র আণবিক অস্ত্র। আমাদেরকে লেনিনের বক্তব্য স্মরণ করতেই হয়: 'হয় বিপ্লব যুদ্ধকে প্রতিরোধ করবে নয়ত যুদ্ধ বিপ্লবকে উসকে দেবে।' এভাবে আমরা সামনের দিনের রাজনৈতিক কাজের সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষাকে সংজ্ঞায়িত করতে পারি: ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রথম অনুমানটির– বিপ্লব যুদ্ধকে প্রতিরোধ করবে– বাস্তবায়ন হওয়া উচিত, দ্বিতীয় অনুমানটি নয় – যুদ্ধ বিপ্লবকে উসকে দেবে। কার্যতভাবে দ্বিতীয় অনুমানটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাশিয়াতে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে চীনে বাস্তব রূপ নিয়েছিল। কিন্তু কীসের বিনিময়ে! আর কোন দীর্ঘমেয়াদী পরিণতিতে!"
বাস্তবিক রাজনীতির সীমাবদ্ধতাসমূহ
আমাদের সভ্যতাগুলোকে সভ্য করে তোলার জন্য দরকার আমূল সামাজিক পরিবর্তন– আদতে একটি বিপ্লব। তবে একটি নতুন যুদ্ধ একে উসকে দেবে তা আমরা প্রত্যাশা করতে পারি না। অধিকতর সম্ভাব্য ফলাফল হচ্ছে আমরা যাকে সভ্যতা বলে জানি তার অবসান, যারা টিকে থাকবে (যদি কেউ থাকে) তারা ছোট ছোট স্বৈরাচারী দলে সংগঠিত থাকবে। আমাদের কোনো বিভ্রান্তি লালন করা উচিত নয়: কিছুটা মৌলিক অর্থে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, যদিও এখন এর বেশিরভাগই প্রক্সিদের দ্বারা চালিত হচ্ছে।
শান্তির বিমূর্ত আহ্বান যথেষ্ট নয়। 'শান্তি' এমন কোনো পরিভাষা নয় যা আমাদেরকে আমাদের প্রয়োজন অনুসারে মূল রাজনৈতিক তফাতকে নির্দিষ্ট করার সুযোগ দেয়। দখলদাররা সবসময়ই সর্বান্তকরণে তাদের দখলকৃত এলাকায় শান্তি চায়। নাৎসি জার্মানি দখলকৃত ফ্রান্সে শান্তি চেয়েছিল, ইসরায়েল দখলকৃত পশ্চিম তীরে শান্তি চায়, এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেইনে শান্তি চান। তাই এতিয়েন বালিবার একবার বলেছিলেন, "শান্তিবাদ কোনো বিকল্প নয়।" আরেকটি মহাযুদ্ধ ঠেকাবার একমাত্র উপায় হচ্ছে এমন 'শান্তি'কে এড়িয়ে চলা যার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতিনিয়ত স্থানীয় যুদ্ধের দরকার হয়।
এমন পরিস্থিতিতে আমরা কার ওপর আস্থা রাখতে পারি? শিল্পী ও চিন্তকদের ওপর, নাকি বাস্তবিক রাজনীতির বাস্তববাদী চর্চাকারীদের ওপর আমাদের বিশ্বাস স্থাপন করা উচিত? শিল্পী ও চিন্তকদের সমস্যা হচ্ছে যে, তারাও যুদ্ধের ভিত্তি তৈরি করে দিতে পারেন। উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসের যথার্থ পংক্তিকে স্মরণ করুন: "তোমার চরণে ছড়িয়ে দিয়েছি আমার স্বপ্নগুলো,/ ধীরে পা ফেলো কারণ আমার স্বপ্নগুলোয় তুমি পা ফেলছো।" কবিদের বেলায় এই পঙক্তিগুলো আমাদের প্রয়োগ করা উচিত। তারা যখন আমাদের চরণে তাদের স্বপ্নগুলো ছড়িয়ে দেন তখন তাদের সেগুলো যত্নসহকারে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত, কারণ আসল লোকেরা সেগুলো পড়বে এবং তার ওপর ভিত্তি করে কাজ করবে। মনে রাখুন একই ইয়েটস ক্রমাগত ফ্যাসিবাদের সাথে মিতালি করেছেন, ১৯৩৮ সালের অগাস্টে জার্মানির ইহুদী-বিরোধী ন্যুরেমবার্গ আইনের প্রতি তার সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন।
কবিদের শহর থেকে বের করে দেওয়া উচিত- এই দাবির কারণে প্লেটোর সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। সাম্প্রতিক দশকগুলোর অভিজ্ঞতার নিরীখে প্লেটোর ওই উপদেশ যুক্তিযুক্ত, কেননা এখন পুতিনের ঘরোয়া মতাদর্শী আলেক্সান্ডার ডুগিনের ন্যায় কবি ও 'চিন্তকগণ' জাতিসত্ত্বা নির্মূলের প্রেক্ষিত তৈরি করেছেন। কবিতা ছাড়া এখন কোনো জাতিসত্ত্বার নির্মূল হয় না, কারণ আমরা আপাতভাবে একটি মতাদর্শ-উত্তর যুগে বাস করি। যেহেতু জনগণকে ব্যাপক সহিংসতার জন্য চালিত করার মত শক্তি মহান ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শগুলোর নেই, তাই একটি বৃহত্তর পবিত্র অভিপ্রায় দরকার। ধর্ম কিংবা জাতিসত্ত্বাগত সংশ্রব সুনিপুণভাবে এই ভূমিকা পালন করে (বিকারগ্রস্ত নাস্তিক যারা আনন্দের জন্য গণহত্যা চালায় তারা বিরল ব্যতিক্রম)।
বাস্তবিক রাজনীতি কোনো ভালো পথপ্রদর্শক নয়। এটি মতাদর্শের একটি নেহায়েত অজুহাতে পরিণত হয়েছে, যেটি প্রকাশ্যে ঘটে চলা অপরাধকে ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য প্রায়ই পর্দার অবয়বে কিছু লুক্কায়িত মাত্রাকে আহ্বান করে। একটি পরিস্থিতিকে 'জটিল' হিসেবে বর্ণনা করার মাধ্যমে প্রায়ই এই দ্বৈত রহস্যময়তার জানান দেওয়া হয়। একটি স্পষ্ট সত্যকে– একটি বর্বর সামরিক আগ্রাসনের কথা ধরুন – আপেক্ষিক করা হয় একটি 'আরও বেশি জটিল প্রেক্ষাপট'কে আহ্বান করার মাধ্যমে। আগ্রাসনের কাজটি সত্যিকার অর্থে প্রতিরক্ষার কাজ।
ঠিক এটাই আজ সংঘটিত হচ্ছে। রাশিয়া স্পষ্টতই ইউক্রেইনকে আক্রমণ করেছে, এবং স্পষ্টতই অসামরিকদের টার্গেট করছে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করছে। আর তারপরও ভাষ্যকাররা ও পণ্ডিতরা আগ্রহ সহকারে এর নেপথ্যের 'জটিলতা'কে খুঁজছেন।
জটিলতা আছে অবশ্যই। কিন্তু সেটি এই মূল সত্যকে পরিবর্তিত করে না যে- রাশিয়া এটি করেছে। আমাদের ভুল ছিল যে, আমরা পুতিনের হুমকিকে যথেষ্ট আক্ষরিকভাবে ব্যাখ্যা করিনি; আমরা ভেবেছি তিনি শুধু কৌশলগত প্রভাব ও ব্রিংকম্যানশিপের খেলা খেলছেন। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের উক্তিতে বিখ্যাত কৌতুকটির কথা মনে পড়ে যায়ঃ "গ্যালিসিয়ার স্টেশনে একটি রেলগাড়িতে দুই ইহুদীর দেখা হলো। একজন শুধালো, "কোথায় যাচ্ছেন?" উত্তর মিললো, "ক্রাকৌ।" "কী মিথ্যুক আপনি!" অপরজন বললো। "আপনি যদি বলেন আপনি ক্রাকৌ যাচ্ছেন তাহলে আপনি আমাকে বিশ্বাস করাতে চান যে আপনি লেমবার্গ যাচ্ছেন। কিন্তু আমি জানি আপনি আদতে ক্রাকৌ যাচ্ছেন। তাহলে আমার কাছে মিথ্যা বলছেন কেন?"
পুতিন যখন সামরিক হস্তক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছেন তখন আমরা তাকে আক্ষরিকভাবে নেইনি। যখন তিনি বলেছেন- তিনি ইউক্রেইনকে শান্ত করতে ও 'বিনাৎসিকৃত' করতে চান, তখন উল্টো, বিমর্ষ 'গভীর' কৌশলবিদদের ভর্ৎসনাকে মনে হয়েছে- "আপনি কেন আমাকে বলেছেন আপনি লিভিভ দখল করতে যাচ্ছেন যখন সত্যিকার অর্থে আপনি লাভিভ দখল করতে চান?"
এই দ্বৈত রহস্যময়তা বাস্তবিক রাজনীতির সমাপ্তিকে প্রকাশ করে। নিয়ম অনুযায়ী বাস্তবিক রাজনীতি (কারোর) নৈতিক অথবা রাজনৈতিক নীতিমালার প্রতি বাধ্যতামূলক কূটনীতি ও বৈদেশিক নীতির অকপটতার বিরোধী। তথাপি বর্তমান পরিস্থিতিতে বাস্তবিক রাজনীতিই অকপট। এটি ভাবা অকপট যে, অপর পক্ষে শত্রুরাও একটি সীমিত বাস্তবসম্মত চুক্তির লক্ষ্যে আছে।
শক্তি ও স্বাধীনতা
শীতল যুদ্ধের সময় পারস্পরিকভাবে নিশ্চিত বিনাশের (মিউচুয়ালি এশিউরড ডেস্ট্রাকশন – ম্যাড) মতবাদ দ্বারা পরাশক্তির আচরণের নিয়মগুলোকে স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা হয়েছিল। প্রত্যেক পরাশক্তি নিশ্চিত থাকতো যে সে যদি কোনো পারমাণবিক আক্রমণ শুরু করে তাহলে অপর পক্ষ পূর্ণ বিধ্বংসী শক্তি দিয়ে তার জবাব দেবে। ফলে কেউ কারোর সাথে কোনো যুদ্ধ শুরু করেনি।
বিপরীতক্রমে, উত্তর কোরিয়ার কিম জং উন যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর কোনো ধ্বংসাত্মক আঘাতের বিষয়ে কথা বলেন, তখন তিনি তার অবস্থানকে কোথায় দেখেন- সে বিষয়ে ভাবতেই হয়। তিনি এমনভাবে বলেন যেন তিনি জানেন না যে তিনিসহ তার দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। তিনি যেন একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন খেলা খেলছেন, যাকে বলে নাটস (নিউক্লিয়ার ইউটিলাইজেশন টার্গেট সিলেকশন), যার মাধ্যমে শত্রু পালটা আক্রমণ করার পূর্বেই তার পারমাণবিক সক্ষমতাকে সুচারুভাবে ধ্বংস করা যেতে পারে।
গত কয়েক দশক ধরে এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমএডি ও নাটসের মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছে। যদিও মনে হয় রাশিয়া ও চীনের সাথে দেশটি তার সম্পর্কের বেলায় এমএডি যুক্তির ওপর আস্থা রেখে চলছে, তথাপি ইরান ও উত্তর কোরিয়ার বেলায় অনেক সময় নাটস কৌশল অবলম্বন করতে প্রলুব্ধ হয়েছে। একটি সম্ভাব্য কৌশলগত পারমাণবিক আক্রমণ শুরু করার ঈঙ্গিতের মাধ্যমে পুতিন একই যুক্তি অনুসরণ করেছেন। একই পরাশক্তির দ্বারা সরাসরিভাবে সাংঘর্ষিক দুটি কৌশলকে একযোগে সক্রিয় করার বিষয়টি তার সকল কল্পনাশ্রয়ী চরিত্রের সত্যতার প্রমাণ দেয়।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের বাকি সবার জন্য ম্যাডনেস একটি কানাগলি। পরাশক্তিগুলো যখন তাদের বৈশ্বিক নিয়মগুলোর নিজস্ব সংস্করণকে আরোপ করার চেষ্টা করে তখন প্রক্সির ব্যবহারকে নিরীক্ষা করার মাধ্যমে তারা একে অন্যকে ক্রমাগতভাবে পরীক্ষা করছে। ৫ মার্চ পুতিন রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলোকে 'যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য' হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তবে রাশিয়া যে তার আর্থিক প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছে এবং পশ্চিম ইউরোপে হাইড্রোকার্বন সরবরাহ অব্যাহত রাখছে সেটির ওপর জোর দেওয়ার মাধ্যমে তিনি তখন থেকে পুনর্বার উল্লেখ করেছেন যে পশ্চিমের সাথে অর্থনৈতিক বিনিময় অব্যাহত থাকা উচিত।
অন্য কথায় পুতিন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি নতুন মডেলকে আরোপিত করার চেষ্টা করছেন। শীতল যুদ্ধের বদলে উষ্ণ শান্তি থাকা উচিত: স্থায়ী হাইব্রিড যুদ্ধের একটি অবস্থা যেখানে শান্তিরক্ষা ও জনহিতকর মিশনের আড়ালে সামরিক হস্তক্ষেপের ঘোষণা দেওয়া হয়।
তাই "ইউক্রেইনের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলের নির্দিষ্ট এলাকার অধিবাসী যারা রাশিয়ান ভাষায় কথা বলা ও পড়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছে, যারা ধর্মপালনের স্বাধীনতার মর্যাদা চায় এবং যারা তাদের অধিকার ও স্বাধীনতা লঙ্ঘনকারী ইউক্রেইনীয় কর্তৃপক্ষের কার্যকলাপকে সমর্থন করে না তাদেরকে সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে পর্যাপ্ত মানবিক ব্যবস্থাসমূহের প্রতি তার অকুণ্ঠ ও জোরালো সমর্থন" প্রকাশ করার মাধ্যমে ১৫ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ান ডুমা (সংসদ) একটি ঘোষণা প্রচার করেছে।
অতীতে আমরা লাতিন আমেরিকা কিংবা মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে হস্তক্ষেপের বেলায় একই যুক্তি কতবার শুনেছি? রাশিয়া যখন ইউক্রেইনের শহরে শেল নিক্ষেপ করছে ও প্রসূতি বিভাগে বোমা ফেলছে তখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বহাল থাকা উচিত। ইউক্রেইনের বাইরে স্বাভাবিক জীবন চলা উচিত। এর অর্থ হলো বিশ্বের বিচ্ছিন্ন অংশগুলোতে অনিঃশেষ শান্তিরক্ষামূলক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে একটি স্থায়ী বৈশ্বিক শান্তি বজায় রাখা।
এমন এক পরিস্থিতিতে কেউ কি মুক্ত থাকতে পারে? হেগেলকে অনুসরণ করে বলতে হয় আমাদের উচিত বিমূর্ত ও বাস্তব স্বাধীনতার মধ্যে একটি পার্থক্য তৈরি করা, যা স্বাধীনতা ও মুক্তির বিষয়ে আমাদের ধারণার সাথে সংগতিপূর্ণ হয়। সামাজিক নিয়ম ও প্রথার বাইরে একজন যা চায় তা করতে পারার সক্ষমতা হচ্ছে বিমূর্ত স্বাধীনতা; বাস্তব স্বাধীনতা হচ্ছে সেই স্বাধীনতা যা নিয়ম ও প্রথার দ্বারা অর্পিত হয় এবং বজায় থাকে। আমি একটি ব্যস্ত রাস্তায় কেবল তখনই মুক্তভাবে হাঁটতে পারি যখন আমি যৌক্তিকভাবে নিশ্চিত হতে পারি যে রাস্তায় অন্যরা আমার প্রতি ভব্যতার সহিত আচরণ করবে– যেমন চালকরা ট্রাফিক নিয়ম মেনে চলবে এবং অন্য পথচারীরা আমাকে ছিনতাই করবে না।
তবে সংকটের সময়ে বিমূর্ত স্বাধীনতাকে অবশ্যই হস্তক্ষেপ করতে হবে। ১৯৪৪ সালের ডিসেম্বরে জ্যঁ পল সার্ত্রে বলেছিলেন: "জার্মান দখলদারিত্বে আমরা যতটা মুক্ত ছিলাম ততটা আর কখনোই ছিলাম না। আমরা আমাদের সকল অধিকার হারিয়েছিলাম, এবং প্রথমেই হারিয়েছিলাম আমাদের বাকস্বাধীনতা। আমাদের মুখের ওপর তারা আমাদের অপমানিত করেছিল… আর এজন্যই রেজিস্ট্যান্স ছিল একটি সত্যিকারের গণতন্ত্র; সৈনিকের জন্য, তার ঊর্ধ্বতনের জন্যও, শৃঙ্খলার মধ্যে একই বিপদ, একই একাকিত্ব, একই দায়িত্ব, একই স্বাধীনতা।"
সার্ত্রে স্বাধীনতার বর্ণনা দিচ্ছিলেন, মুক্তির নয়। যখন যুদ্ধ-পরবর্তী স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছিল- তখনই মুক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আজকে ইউক্রেইনে যারা রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়ছে তারাই মুক্ত এবং তারা মুক্তির জন্য লড়ছে। তবে এই পার্থক্য কতক্ষণ স্থায়ী হবে সে প্রশ্নকে এটি তুলে ধরে। আরও কয়েক লক্ষ মানুষ যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে তাদের মুক্তি রক্ষার জন্য তাদের অবশ্যই মুক্তভাবে নিয়ম ভঙ্গ করতে হবে তখন কী হবে? এটাই কি ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ট্রাম্পীয় দুর্বৃত্তদের মার্কিন ক্যাপিটলে হানা দিতে চালিত করেনি?
অত বড় খেলা নয়
আজকের দুনিয়ার জন্য একটি উপযুক্ত শব্দের ঘাটতি রয়েছে আমাদের। দার্শনিক ক্যাথেরিন মালাবু মনে করেন আমরা পুঁজিবাদের "বিশৃঙ্খল আবর্তনের" সূচনাকে প্রত্যক্ষ করছি- "বিকেন্দ্রিকৃত মুদ্রা, রাষ্ট্রের একাধিপত্যের অবসান, ব্যাংকগুলোর দ্বারা মধ্যস্থতার ভূমিকা পালনের অসারতা এবং বিনিময় ও লেনদেনের বিকেন্দ্রীকরণের মত ঘটনাগুলোকে আমরা আর কীভাবে বর্ণনা করবো?"
এসব ঘটনা হয়ত আকর্ষণীয় শোনায়, তবে রাষ্ট্রের একাধিপত্যের ক্রমাগত বিনাশের ফলে বেপরোয়া শোষণ ও আধিপত্যের ওপর রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত সীমাও হারিয়ে যাবে। এনার্কো-ক্যাপিটালিজম যখন স্বচ্ছতাকে লক্ষ্যবস্তু করে তখন এটি "একযোগে ডেটার বিরাট আকারের অথচ অস্বচ্ছ ব্যবহার, ডার্ক ওয়েব,এবং তথ্যের জালিয়াতিকে অনুমোদন করে।"
বিশৃঙ্খলায় এই পতনকে রোধ করার জন্য মালাবু মত দিয়েছেন যে নীতিগুলো ক্রমশ "ফ্যাসিবাদী বিবর্তনের পথকে অনুসরণ করে…এর সাথে যুক্ত অত্যধিক নিরাপত্তা ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধি। এমন ঘটনা এনার্কিজমের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। বরঞ্চ, এগুলো নির্দিষ্টভাবে রাষ্ট্রের অন্তর্ধানকে ইঙ্গিত করে, একবার যখন তার সামাজিক কার্যক্রমকে সরিয়ে ফেলা হয়, তখন এটি তার শক্তিগুলোর অসারতাকে সহিংসতার ব্যবহারের মাধ্যমে প্রকাশ করে। উগ্র-জাতীয়তাবাদ এভাবে জাতীয় কর্তৃত্বের মৃত্যু গ্লানির ইঙ্গিত দেয়।"
এসব পরিভাষায় দেখলে ইউক্রেইনের পরিস্থিতি একটি জাতি-রাষ্ট্রের আরেকটি জাতি-রাষ্ট্রকে আক্রমণ করা নয়। বরং ইউক্রেইনকে আক্রমণকারী রাশিয়া দেশটির জাতিগত পরিচয়কেই অস্বীকার করে। ভূরাজনৈতিক প্রভাব বলয়ের পরিভাষায় আক্রমণকে জায়েজ করা হয় (যেটি অনেক সময় জাতিগত বলয়ের ঊর্ধ্বে চলে যায়, যেমনটি সিরিয়ায় হয়েছে)। রাশিয়া তার 'বিশেষ সামরিক কার্যক্রম' এর জন্য 'যুদ্ধ' শব্দটি ব্যবহার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এটি কেবল তার হস্তক্ষেপের বর্বরতাকে লঘু করার জন্য নয়, বরং এটা স্পষ্ট করার জন্য যে, পুরাতন অর্থে জাতি-রাষ্ট্রের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাত বলতে যে 'যুদ্ধ'কে বোঝায়- ইউক্রেইনের ক্ষেত্রে সেটি প্রযোজ্য নয়।
ক্রেমলিন আমাদেরকে বিশ্বাস করাতে চায় যে এটি তার রাজনৈতিক প্রভাব বলয় হিসেবে যা বিবেচনা করে সেখানে কেবলই 'শান্তি' রক্ষা করছে। প্রকৃতপক্ষে এটি ইতোমধ্যে রাশিয়া প্রক্সিদের মাধ্যমে বসনিয়া ও কসোভোতেও হস্তক্ষেপ করছে। ১৭ মার্চ বসনিয়ায় রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ইগর কালাবুকভ ব্যাখ্যা করেছেন যে "যদি [বসনিয়া] কোনো জোটের সদস্য হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, সেটি একটি আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আমাদের প্রতিক্রিয়া একটি ভিন্ন ব্যাপার। আমরা কী আশা করি তা ইউক্রেইনের উদাহরণে দেখা যায়। যদি কোনো হুমকি আসে, আমরা জবাব দেবো।"
সর্বোপরি রাশিয়ান পররাষ্ট্র মন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এটাও ইঙ্গিত করেছেন যে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর অনিয়মিত মানবিক হস্তক্ষেপের দ্বারা শান্তি বজায় রাখার মাধ্যমে সমগ্র ইউরোপকে নিরস্ত্র করাই হবে একমাত্র বোধগম্য সমাধান। একই ধারণা রাশিয়ান সংবাদপত্রে ভরপুর। একটি ক্রোয়েশিয়ান প্রকাশনার সাথে সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে রাজনৈতিক ভাষ্যকার দিমিত্রি এভস্তাফিয়েভ ব্যাখ্যা করেছেন: "এক নতুন রাশিয়ার জন্ম হয়েছে যা আপনাকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয় এটি আপনাকে, ইউরোপকে, একটি অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করে না। রাশিয়ার তিনটি অংশীদার আছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারত। আপনি আমাদের কাছে একটি পুরস্কার যাকে আমাদের ও আমেরিকানদের মধ্যে ভাগ করা হবে। আপনি এখনো বুঝতে পারেননি, যদিও আমরা এর কাছাকাছি চলে আসছি।"
পুতিনের পোষা দার্শনিক ডুগিন ক্রেমলিনের অবস্থানকে ঐতিহাসিক আপেক্ষিকতাবাদের একটি অদ্ভূত সংস্করণের ওপর দাঁড় করিয়েছেন। ২০১৬ সালে তিনি বলেছেন:
"উত্তরাধুনিকতা দেখায় যে সকল তথাকথিত সত্যই বিশ্বাসের ব্যাপার। তাই আমরা যা করি তা বিশ্বাস করি, আমরা যা বলি তা বিশ্বাস করি। আর এটি সত্যকে সংজ্ঞায়িত করার একমাত্র পন্থা। তাই আমাদের বিশেষ রাশিয়ান সত্য আছে যা আপনার গ্রহণ করা দরকার… যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ আরম্ভ করতে না চায়, আপনার স্বীকার করা উচিত যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর কোনো অনন্য সর্দার নয়। আর সিরিয়া ও ইউক্রেইনের পরিস্থিতিতে রাশিয়া বলে, 'না, তুমি আর কোনো সর্দার নও।' পৃথিবী কে চালায় এটা সেই প্রশ্ন। একমাত্র যুদ্ধই সত্যিকার অর্থে ঠিক করে দেয়।"
এটি একটি সুস্পষ্ট প্রশ্নকে তুলে আনে: সিরিয়া ও ইউক্রেইনের জনগণের কী হবে? তারাও কি তাদের সত্য ও বিশ্বাসকে বেছে নিতে পারে না, নাকি তারা বিগ 'বস'দের কোনো খেলার মাঠ কিংবা যুদ্ধক্ষেত্র? ক্রেমলিন বলবে তারা ক্ষমতার বৃহৎ বিভাজনকে প্রভাবিত করে না। চার প্রভাব বলয়ের মধ্যে আছে কেবল শান্তিরক্ষাকারী হস্তক্ষেপ। যখন চার বড় মোড়ল তাদের বলয়ের সীমানা নিয়ে একমত হতে পারে না, তখনই শুধু যুদ্ধ ঠিকমত সংঘটিত হয়– যেমন তাইওয়ান ও দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের দাবি।
একটি নতুন জোট-নিরপেক্ষতা
তবে আমরা যদি আমাদের পরিবেশের প্রতি হুমকি দ্বারা চালিত না হয়ে শুধু যুদ্ধের হুমকি দ্বারা চালিত হই তখন আমাদের পক্ষ জয়লাভ করলে আমরা যে মুক্তি পাবো তার হয়ত মূল্য থাকবে না। আমরা একটি অসম্ভব পছন্দের সম্মুখীন হয়েছি- আমরা যদি শান্তি বজায় রাখার জন্য আপস করি তাহলে আমরা রাশিয়ান সম্প্রসারণবাদকে পুষ্ট করছি, যেটি কেবলই সমগ্র ইউরোপের 'নিরস্ত্রীকরণ'কে চরিতার্থ করবে। তবে আমরা যদি সম্পূর্ণ সংঘর্ষকে অনুমোদন করি তাহলে আমরা একটি নতুন বিশ্ব যুদ্ধে পতিত হওয়ার উচ্চ ঝুঁকি নেবো। যে লেন্স দিয়ে আমরা পরিস্থিতি বিবেচনা করি তা পরিবর্তন করাই একমাত্র সত্যিকারের সমাধান।
বৈশ্বিক উদারনৈতিক-পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যখন স্পষ্টতই বিভিন্ন স্তরে একটি সংকটের দিকে অগ্রসর হচ্ছে তখন ইউক্রেইনের যুদ্ধকে মেকিভাবে ও ভয়ংকরভাবে সরলীকৃত করা হচ্ছে। জলবায়ু সংকটের মতো বৈশ্বিক সমস্যাগুলো বর্বর-স্বৈরাচারী দেশসমূহ এবং সভ্য, মুক্ত পশ্চিমের মধ্যকার সংঘাতের গতানুগতিক আখ্যানে কোনো ভূমিকা রাখে না। আর তারপরও এমন সমস্যাগুলোরই প্রতিক্রিয়া হচ্ছে নতুন যুদ্ধ ও বৃহৎ শক্তির সংঘাত। যদি একটি বিপদাপন্ন গ্রহে টিকে থাকাই ইস্যু হয় তখন কারোর উচিত অন্যদের চেয়ে একটি দৃঢ়তর অবস্থান তৈরি করা। সত্যকে স্পষ্ট করার মুহূর্ত থেকে অনেক দূরে, এবং মূল বৈরিতা যখন উন্মোচিত হয় তখন বর্তমান সংকট হচ্ছে গভীর প্রতারণার একটি মুহূর্ত।
আমাদের যখন ইউক্রেইনের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেওয়া উচিত- তখন আমাদের যুদ্ধের আকর্ষণকে অগ্রাহ্য করতেই হবে, যা স্পষ্টতই তাদের কল্পনাকে আচ্ছন্ন করেছে যারা রাশিয়ার সাথে একটি সম্মুখ সংঘর্ষের জন্য চাপ দিচ্ছে। একটি নতুন জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনের মতো কিছু দরকার, এই অর্থে না যে চলমান যুদ্ধে দেশগুলোর নিরপেক্ষ থাকা উচিত, বরং আমাদের উচিত 'সভ্যতার সংঘাত' এর সামগ্রিক ধারণাকে প্রশ্ন করা।
স্যামুয়েল হান্টিংটন, যিনি 'সভ্যতার সংঘাত' পরিভাষাটির পত্তন করেছিলেন, তার মতে, সভ্যতার সংঘাতের মঞ্চ তৈরি হয়েছিল শীতল যুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে, যখন 'মতাদর্শের লৌহ পর্দা'কে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছিল 'সংস্কৃতির মখমলের পর্দা' দ্বারা। প্রথম দর্শনে, এই অন্ধকারের দৃষ্টিভঙ্গিকে ইউরোপে কমিউনিজমের পতনের প্রতিক্রিয়ায় ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামার উত্থাপিত ইতিহাসের পরিসমাপ্তি থিসিসের একদম বিপরীত হিসেবে মনে হতে পারে। ফুকুইয়ামার এই ছদ্ম-হেগেলিয়ান ধারণার চেয়ে অধিকতর ভিন্ন আর কী হতে পারে যে মানবজাতির দ্বারা উদ্ভাবিত সর্বোত্তম সামাজিক ব্যবস্থাটি অবশেষে পুঁজিবাদী উদারনৈতিক গণতন্ত্রের দ্বারা মূর্তিমান হয়েছিল?
আমরা এখন দেখতে পাই যে, দুইটি দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ: 'সভ্যতার সংঘাত' হলো সেই রাজনীতি যা 'ইতিহাসের শেষে' এসেছে। বৈশ্বিক পুঁজিবাদের সাথে খাপ খায় এমন ধরনের সংগ্রাম হচ্ছে জাতিগত ও ধর্মীয় সংঘাত। 'রাজনীতি-উত্তর' যুগে– যখন যথাযথ রাজনীতি ক্রমাগতভাবে বিশেষজ্ঞ সামাজিক প্রশাসন দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়– সংঘাতের একমাত্র অবশিষ্ট স্বাভাবিক উৎসগুলো হচ্ছে সাংস্কৃতিক (জাতিগত, ধর্মীয়)। আমাদের সমাজগুলোর বিরাজনীতিকরণ থেকেই 'অযৌক্তিক' সহিংসতার উত্থান ঘটে।
এই সীমিত দিগন্তের মাঝে এটা সত্য যে, যুদ্ধের একমাত্র বিকল্প হচ্ছে সভ্যতাগুলোর মধ্যে (ভিন্ন ভিন্ন 'সত্যের' মধ্যে, যেমনটা ডুগিন বলেছেন, অথবা এখনকার অধিকতর জনপ্রিয় পরিভাষা ব্যবহার করলে, ভিন্ন ভিন্ন 'জীবনধারার' মধ্যে) একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। এর অর্থ হচ্ছে জোরপূর্বক বিবাহ, সমকামভীতি, অথবা যে সকল নারী প্রকাশ্যে একাকি চলতে সাহস করে তাদের ধর্ষণ অন্য কোনো দেশে ঘটলে তা সহনীয়, যতক্ষণ পর্যন্ত দেশটি বৈশ্বিক বাজারের সাথে সম্পূর্ণভাবে একীভূত থাকে।
যেকোনো মূল্যে রুশভীতির বিপক্ষে মতপ্রকাশের মাধ্যমে– এবং আমাদের সংগ্রাম যে বৈশ্বিক হওয়া উচিত সেটি অবশ্যই স্বীকার করার মাধ্যমে নতুন জোট-নিরপেক্ষতার দিগন্তকে প্রসারিত করতে হবে। রাশিয়ার মধ্যে যারা এই আগ্রাসনের প্রতিবাদ করছেন তাদেরকে আমাদের সমর্থন দেওয়া উচিত। তারা কেবল বিমূর্ত দলভুক্ত আন্তর্জাতিকতাবাদী নন; তারা সত্যিকারের রাশিয়ান দেশপ্রেমিক– যারা সত্যিই তাদের দেশকে ভালোবাসেন এবং ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে তার জন্য গভীরভাবে লজ্জিত হয়েছেন। 'আমার দেশ, সঠিক হোক কিংবা ভুল' এটি বলার চেয়ে নৈতিকভাবে জঘন্য ও রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক আর কিছু হয় না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ইউক্রেইন যুদ্ধে প্রথম হতাহত হয়েছে বিশ্বজনীনতা।