Published : 29 Mar 2022, 03:54 PM
এক.
৫১ বছরে দাঁড়িয়ে স্বদেশ। আমার জন্মভূমি বাংলাদেশ। আমার বালক বেলায় পরাধীনতার গ্লানি মোছানো মায়ের মুখ। আমি একাত্তর দেখেছি। আমি সপরিবারে শরণার্থী হয়েছিলাম। আমি দেখেছি বাঙালি মা-বাবা, ভাই-বোন কেমন করে থাকতেন কলকাতার অদূরে সল্টলেকের পানির পাইপের ভেতর। মাথার ওপর ছাদহীন ঘরে থেকেছি আমরাও। তখন আমরা শরণার্থী হলেও আমাদের মাথার ওপর ছিলেন বঙ্গবন্ধু। নেতার দায়িত্বে ছিলেন শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও তাদের সঙ্গীরা। সহজ ছিল না এই যুদ্ধ। আজ মুখে মুখে আমরা যাই বলি না কেন সে যুদ্ধ ছিল ভয়ংকর। একদিকে আমেরিকা, চীন আর তাদের বন্ধু পাকিস্তান। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধার দল, ভারত আর রাশিয়া। ওই লড়াইয়ে আমরা না জিতলে ইতিহাস হতো ভিন্ন। হয়তো দুনিয়া থেকেই চলে যেত বাঙালি নামের এক জাতি। অথবা বাঁচতে হতো আত্মসম্মান ও মর্যাদাহীন এক দাস জাতি হয়ে। স্যালুট বঙ্গবন্ধু ও তার সহযোগী নেতাদের। স্যালুট জানাই ওই সব ছিন্নবস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের যারা দু-বেলা না খেয়েও যুদ্ধ করেছিলেন। যাদের রক্তে, ত্যাগে আজ আমরা স্বাধীন দেশের গর্বিত নাগরিক।
দুই.
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরও ষড়যন্ত্র থামেনি। কত ধরনের ষড়যন্ত্র! পাকিস্তান তখনো মনে-প্রাণে বিশ্বাস করছে– তাদের ভাষায়, গাদ্দার ভিখারী কালো বাঙালিরা কোনদিনও দাঁড়াতে পারবে না। পারবে না মাথা তুলতে। উগ্র ভুট্টো তখনো সমানে চক্রান্ত করে যাচ্ছেন। দেশের ভেতর সক্রিয় মাওবাদী নামে চৈনিক রাজনীতির সমর্থকেরা। তাদের পেছনে জোট বেঁধেছিল স্বাধীনতাবিরোধীরা। কোথা থেকে অস্ত্র ও টাকা পেত– সে সব ষড়যন্ত্র ধীরে ধীরে উন্মোচিত হলেও তখন আমরা বুঝতাম না। এরপর শুরু হয়েছিল জাসদের রাজনীতি। সে আরেক অধ্যায়। জাসদ নিয়ে কিছু বলাও মুশকিল। জাসদ ও তার আদর্শ মরে ভূত হলেও তাদের সমর্থকেরা আছেন। নকশাল আন্দোলন দেখা তরুণ আমি। আমার আত্মীয়দের অনেকে ওই আন্দোলনে যোগ দিয়ে পরে ফিরেছিলেন সাধারণ জগতে। আমি একসময় ভারতে গজিয়ে ওঠা আনন্দমঠের আনন্দমার্গীদেরও দেখেছি। সেসব ব্যর্থ আন্দোলনের নায়ক-খলনায়ক কিংবা সমর্থক পথ হারানো কর্মীরা সব আগুন নিভে যাবার পর আর এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করতেন না। কিন্তু আমাদের জাসদ থামতে নারাজ। এখন তাদের বেশিরভাগই আওয়ামী জোটে ভিড়লেও উল্টোদিকে আছে অনেকে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে জাসদের ভুল-ভ্রান্তি মনে না রাখলে ইতিহাস থেকে যাবে বিতর্কিত। এদের কথা শুনলে এদেশ এগোতে পারত না।
তিন.
বাংলাদেশের ইতিহাসে সামরিক শাসন এক অনিবার্য ব্যাধি হয়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমান, তারপর একের পর এক মিলিটারি ক্যু। দেশের কাঁধে সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে বসা এরশাদ দেশে দুর্নীতি আর বিচারহীনতা প্রাতিষ্ঠানিক করে দিয়েছিলেন। ওই স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত হতে সংগ্রাম আর রক্তপাত দেখেছি আমরা। কিন্তু এখানে একটা কথা বলতেই হয়, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ত্যাগ আর জীবনদান ইতিহাস এখনো সেভাবে ধারণ করেনি। যখন যে সরকার আসে, তারা তাদের ইচ্ছেমতো বদলে নেয় ইতিহাস। বাংলাদেশে একাধিকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা বিএনপি ষড়যন্ত্র আর পাকিস্তানি ধারার প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে গিয়ে না পারলো দেশের উন্নতি করতে, না পারলো নিজেদের ঘর ঠিক রাখতে। জাতির চরম সৌভাগ্য যে, ওয়ান ইলেভেনের মাধ্যমে তারা অপসারিত হবার পর দেশ শাসনে এসেছিল আওয়ামী লীগ।
চার.
ঠিক তখন থেকেই পাল্টে যেতে থাকল দেশ। বলাবাহুল্য, ততদিনে বিশ্ব রাজনৈতিক অর্থনীতিতে লেগেছে নতুন হাওয়া। বিশ্বায়নের হাওয়ায় সব দেশ, সব জাতি বসবাস করতে শুরু করেছে গ্লোবাল ভিলেজে। হঠাৎ খুলে যাওয়া পৃথিবীর জানালায় মুখ রাখা এই অনুন্নত গরীব দেশটির প্রয়োজন ছিল এক সঠিক নেতার। দরকার ছিল বলিষ্ঠ, কোমল আর দেশদরদী ভূমি সন্তানের। ওই মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা যেন প্রকৃতির এক উপহার। তিরতির ঢেউয়ে তরতর করে বয়ে চলা নৌকা বাংলাদেশকে নিয়ে চলল সামনের দিকে।
পাঁচ.
এটাই আজকের বাংলাদেশ। আজ সকল অপসংস্কৃতি, দুর্নীতি, সামাজিক অন্যায়ের পরও মাথা তুলে আছে স্বদেশ। তার শির নেহারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির। এত রক্ত, ত্যাগ, অপমান আর দুঃশাসনের জবাব দিয়েছে মাটি। ইতিহাস হয়েছে শুদ্ধ। জাতি হয়েছে পরিশুদ্ধ। আজকের বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম জানেই না কাকে বলে পরাধীনতা। এই দেশ, এই পতাকা, এই অর্জন হোক সকলের। দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশ হোক সবার।
জয়তু বাংলাদেশ।