Published : 27 Nov 2012, 06:40 PM
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির সংখ্যা রেকর্ড গড়েছে। আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের পোশাক কারখানা তাজরীন ফ্যাশনসে শনিবার (২৪-১১-২০১২) সন্ধ্যার পর আগুন লাগে। রাত পোহাতে না পোহাতেই সেখান থেকে বেরিয়ে আসে লাশের মিছিল। দেখে স্তম্ভিত হয় বাংলাদেশ। সরকারি হিসেবেই লাশের সংখ্যা ১১০টি। ঘটনাটি এতো ব্যাপক যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং শোকবার্তা পাঠান, বিশ্বের প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলোয় এ খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হয়। ঘটনাটির অভিঘাত কতটা গভীর তা বোঝা যায় তাজরীনে উদ্ধার তৎপরতা শেষ হওয়ার আগেই নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে। এতে বলা হয় ওয়াল-মার্টের বিবেচনায় তাজরীন অরেঞ্জ শ্রেণিভুক্ত। অর্থাৎ কারখানাটি সবচেয়ে খারাপের ঠিক আগের ধাপে রয়েছে। ওয়াল-মার্ট হচ্ছে বিশ্বের নাম করা তৈরিপোশাক ক্রেতা। এরই মধ্যে ওয়াল-মার্ট এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় একটি কোম্পানির সঙ্গে ক্রয় চুক্তি বাতিল করেছে। এই কোম্পানিটিই ওয়াল-মার্টের সঙ্গে ক্রয়চুক্তি করে তাজরীনকে পোশাক বানাতে দিয়েছিল। এটি একটি বিপদ সংকেত। ক্রয় চুক্তি বাতিল কেবল তাজরীনে সীমাবদ্ধ না থেকে এখন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের উপর আঘাত হানার সম্ভাবনা্ও বেড়ে গেল। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্বার্থপক্ষের উদ্যোগের ফলে মধ্যযুগীয় বর্বর কায়দায় শ্রমিক নিষ্পেষণকারীদের কাছ থেকে তৈরিপোশাক আমদানির উপর সেদেশে কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে। এই বিধিনিষেধের সূত্রেই মার্কিন কর্মকর্তাদের এদেশের পোশাক কারখানার পরিবেশ বা কমপ্লায়েন্স নিয়ে দরকষাকষি করতেও দেখা যায়। বলাবাহুল্য বিদেশী এসব কর্মকর্তা অথবা ক্রেতারা কোনো ঋষিতুল্য ব্যক্তি নন। তাদেরও লক্ষ্য সর্বোচ্চ মুনাফা। তবে তাদের দেশের নিয়মকানুন মানতে তারা বাধ্য হন। এই বাধ্যবাধকতার জন্যই পোশাক ক্রয়ের সময় কমপ্লায়েন্স সংক্রান্ত 'নিয়ম মাফিক' কাগুজে সনদও তাদের প্রয়োজন হয়। কাগুজে কমপ্লায়েন্স দেখিয়ে এতোদিন যেভাবে সাত খুন মাফ হয়ে আসছিলো এখন তা কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ তাজরীনের ঘটনা সব কিছু উলঙ্গ করে ফেলেছে।
সোমবার দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার থেকে একাধিক পোশাক কারখানায় ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ডের বর্ণনা দিলেন। শ্রমিকদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশের পাশাপাশি নানা বিষয় তুলে আনেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী জানান, তাজরীনের ঘটনার পরদিন অপর এক পোশাক কারখানায় সুমী নামে এক শ্রমিক ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করে। তিনি জানান, সুমীর এ ঘটনা প্রকাশ না পেলে এসব আগুনের ঘটনার কারণ অন্যভাবে ভাবতেন তিনি। সুমীর আগুন দেওয়ার চেষ্টা এমন সময়ে ঘটে যখন তাজরীনে লাশের স্তুপ দেখে দেশবাসী স্তম্ভিত। সুমীর কাণ্ড বিস্ময় সৃষ্টি করে বটে!! সংসদে ষড়যন্ত্রের আশঙ্কাও প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। ষড়যন্ত্র হতেই পারে। মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে ক'জন রাজাকারের বিচার যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে তখন জামায়াত-শিবির মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা নাশকতার নানা পথ বেছে নিতেই পারে। সোমবার পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-এর নেতারাও সংবাদ সম্মেলন করে বরাবরের মতো দেশী বিদেশী চক্রান্তের কথা বলেন। এতো জটিল করে না ভেবেও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব তৈরি করা যায়। তাজরীনকে বিপাকে ফেলতে তাদের ব্যক্তিগত অথবা ব্যবসায়ীক প্রতিপক্ষও এসব ঘটিয়ে থাকতে পারে। অথবা শ্রমিক নেতারা যেমন বলছেন, 'আগুণের পেছনে তাজরীনের মালিকই জড়িত।' যত ধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্বই সাজানো হোক না কেন এ কারখানার মালিককের 'পাপ' এতে স্খলন হয় না। এ অগ্নিকাণ্ডের পরপর 'ঠিক মতো বিকল্প সিঁড়ি না থাকলে কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার' সরকারি ঘোষণায় থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ে। তাজরীনে নিয়মমাফিক সিঁড়ি থাকলে এতো প্রাণহানি ঘটতো না বলে সব গণমাধ্যমেই মন্তব্য করা হয়েছে। আর অগ্নিকাণ্ডের সময় কারখানায় তালা দিয়ে রাখার ঘটনা সব সময় হতে দেখা যায়। এটি যে মালিকদেরই নির্দেশ তাও বুঝতে অসুবিধা হয় না। নাশকতা হোক আর নিছক দুর্ঘটনাই হোক বিকল্প সিঁড়ির ব্যবস্থা না করার গাফিলতির দায় এড়াতে পারেন না তাজরীনের মালিক। সোমবার দাতা অর্থায়নে কর্মরত এক গবেষণা সংস্থার কর্তারা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'ঘটনাটি কীভাবে মোকাবেলা করা হচ্ছে তার উপর এ খাতের ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল।' জানি তাদের এ আশঙ্কা কানে তুলবেন না এদেশের পোশাক শিল্পের মালিকরা। তারা তো সব্যসাচী। তারা এক হাতে শ্রমিকের টুটি চেপে ধরে অন্য হাতে পশ্চিমাদের জুতা মোছেন। তাই তারা ভাবতেই পারেন এবারও ধামাচাপা দিয়ে 'ম্যানেজ' করে ফেলা যাবে। কিন্তু এতো বড় মর্মান্তিক ঘটনার পর তাজরীন কর্তৃপক্ষের অপরাধ আড়াল করার মতো জোব্বা আদৌ তারা খুঁজে পাবেন কি?
পোশাক শিল্প এদেশের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের প্রধান খাত। বাংলাদেশের অধিকাংশই ধনি হয়েছেন এ শিল্পের মুনাফায়। শুধু শ্রমিক শোষণই নয়, ভর্তুকির নামে এ শিল্পের মালিকরা এদেশের করদাতাদের টাকাও আত্মসাৎ করে থাকেন। এতো সুযোগ সুবিধা আর কোনো খাতে দেওয়া হয়নি। তাই পোশাক শিল্পে বেপরোয়া মুনাফা লোটায় কোনো ছাড় দিতে চান না তারা। পরিস্থিতি সামাল দিতে দমন পীড়নের সব পন্থা ভাবা হলেও তাজরীনের মালিককে কাঠগড়ায় তোলার কথা ভাবা হবে না। এটি বিস্ময়কর এ কারণে যে তাজরীনের মালিক এখন তারেদই গলার কাটা হয়ে উঠেছে।
এক কালের সুপারহিট সিনেমা 'গোলাপী এখন ট্রেনের' কাহিনী হয়তো সবার মনে আছে। সিনেমায় শাসক গোষ্ঠীর স্বার্থে ছেলেকে বিষ খাওয়ায়। অর্থাৎ স্বার্থ রক্ষায় ক্ষমতাশালীরা প্রয়োজনে সব কিছুই করতে পারে। এতো দিন মুনাফার স্বার্থে শ্রমিক পেটানো হয়েছে। আর যখন কোনো কারখানা মালিকই স্বার্থপরিপন্থী হয়ে ওঠে তখন তাকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে কেন! এমনিতেই শ্রমিক স্বার্থবিরোধী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের এ নিয়ে কূটনৈতিক পর্যায়ে টানাপোড়েনও আছে। এই টানাপোড়েনে এ অগ্নিকাণ্ড ঘি ঢেলেছে। মনে রাখা দরকার কোনো মহানুভবতার জন্য ওয়াল-মার্ট তড়িঘড়ি করে ক্রয়চুক্তি বাতিল করেনি। সেদেশে যে এ নিয়ে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয় এ তারই বহিঃপ্রকাশ। তাই বাংলাদেশের ভাবমূর্তি রক্ষায় এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের গ্রেপ্তার করা হোক। তাজরীনের মালিকের পক্ষে কী কী গাফিলতি আছে তা্ও গভীরভাবে খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ শুধুমাত্র 'ষড়যন্ত্র আছে' বলে মালিক পক্ষের গাফিলতিকে এড়ানো সম্ভব নয়।
কর্তা ব্যক্তিরা ষড়ডন্ত্রকারীর অনুসন্ধানে ব্যস্ত। কারণ তারা এখনও পোশাক শিল্পে বেপরোয়া মুনাফা অর্জনে মালিকদের স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা থাকায় বিশ্বাসী। 'বিকল্প সিঁড়ির' জন্য সরকার হুঙ্কার দিলেও সিঁড়ির অভাবে এতো মানুষ মারা যাওয়ার জন্য তাজরীন কারখানার মালিককে আইনের মুখোমুখি করা হয়নি। তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। এ নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষ হলে হয়তো ব্যাটন-বুলেট-বেয়নেট দিয়ে আবারও দমন করা হবে। তবে ক্রেতাদের সামাল দেবেন কিভাবে? ওরা তো শিল্প পুলিশের আওতা মুক্ত। কোনো কারণে পোশাক রপ্তানি বন্ধ হলে সব ওলোটপালট হয়ে যেতে পারে। পতনও হতে পারে সরকারের। তাই মালিকপক্ষকেও আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর কথা ভাবা জরুরি।
মুজতবা হাকিম প্লেটো: সাংবাদিক।