Published : 14 Mar 2022, 07:17 PM
জ্বালানি তেলের দাম আগেই বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে হু–হু করে বাড়ছে ভোজ্য তেলের দামও। সরষের তেল তো বেটেই, ঢাকার খোলা বাজারে সয়াবিন তেল, পাম তেল, সূর্যমুখী তেল, সব কিছুরই দাম লিটার প্রতি এক লাফে ৭০ থেকে ৮০ টাকা বেড়েছে। সয়াবিন তেলের দাম খোলা বাজারে ১২০ থেকে বেড়ে ১৮০–২০০ টাকায় ঘোরাফেরা করছে। এই দামবৃদ্ধির পেছনে কালোবাজারি এবং মজুদ করে রাখার প্রবণতাকে দায়ী করছেন মানুষ। অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা ও ব্যবসায়ীদের কারসাজিকেও দায়ী করছেন অনেকে।
কারণ যাই হোক, ফল হলো তেলের দাম কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ ছাড়াই বর্তমানে মাত্রা ছাড়িয়েছে। এতে নিম্নআয়ের মানুষেরা চরম দুর্ভাগে পড়েছে। তেল ছাড়া কি আর রান্না হয়? আমাদের ভাজি–ভর্তা–ঝোল–চচ্চড়ি, চাটনি সব কিছুতেই তেল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডাল রান্না করতেও তেল লাগে। তেল ছাড়া আমাদের চলে না। এদিকে তেলের দাম যেভাবে বেড়েছে, তাতে অনেকের পক্ষেই তেলে হাত দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এতে করে মানুষের মধ্যে অসহায়তাজনিত ক্ষোভ বাড়ছে।
তেলে দাম বাড়লেও মন্ত্রী–মিনিস্টাররা আছেন তেলবাজিতে। তারা নিজেই নিজেদের তেল দিচ্ছেন। নিজেদের ভূমিকার প্রশংসা করছেন। তাদের উদ্যোগের কারণেই নাকি 'তেলের দাম লাগামের মধ্যে আছে'। না হলে সেটা জেট প্লেনের গতিতে নাগালের উপরে উঠতো। যাহোক, তেলের দাম নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই, তাতে দাম কমবে না। আর দাম বাড়ার কারণে গরিব–মেহনতি মানুষের রান্নায় তেলের ব্যবহার কমলেও মধ্যবিত্ত ও সুযোগসন্ধানী উচ্চবিত্তদের দৈনন্দিন জীবনে তেলের ব্যবহার হ্রাস পাবে না।
চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে, বেশি তেল খাওয়া স্বাস্থ্যের করে ক্ষতি। আর অভিজ্ঞতা–বিজ্ঞান বলে, বেশি তেল মারা আনে সফলতা ও উন্নতি! বর্তমানে তেলবাজি ছাড়া সমাজ চলে না। রাষ্ট্র চলে না। যোগ্যতার তেমন কোনো মূল্য নেই। কে কত বেশি তেল দিতে পারেন তাই এখন যোগ্যতার মাপকাঠি। আমাদের দেশে ক্ষমতাধররা তেলবাজিকে বড়ো বেশি মূল্য দেন। সামনে যেতে হলে একমাত্র যোগ্যতা হচ্ছে তেলবাজি। ব্যবসা, বাণিজ্য, নেতৃত্ব, পোস্টিং, প্রমোশন এসবই তেলবাজির বৃত্তে আটকে গেছে।
যারা বুক চিতিয়ে জোর গলায় বলেন, 'আমি তেল পছন্দ করি না, তেল মারতে পারি না'—তারা আসলে সত্য বলেন না। আসল ব্যাপার হলো, তিনি তেল মারা খুবই পছন্দ করেন, গোপনে তিনি তেল ঠিকই মাখেন, কিন্তু অন্যের তুলনায় তা যথেষ্ট বলে বিবেচিত হয় না। কিংবা কোনো কারণে তেলে কাজ হয় না। তেলে কাজ না হলে আমরা খামোখাই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠি। তেলের ওপর ঝাঁঝ মেটাই। তেল–দাতাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করি। তেল মারতে পারি না বা তেল মারা পছন্দ করি না—এ কথা বলা আসলে তেল মারার সুযোগ না পাওয়া বা তেল মেরেও কাজ না হওয়ার ব্যর্থতাজনিত ক্ষোভ বা রোষ। এটা আমাদের বুঝতে হবে। উপলব্ধি করতে হবে। কাজেই মুখে যে যা–ই বলি, আসলে আমরা প্রত্যেকেই কমবেশি তেলবাজ। দক্ষতা আর কার্যকারিতার ঘাটতি থাকতে পারে। তাই বলে তেল–বিমুখ কেউই নই।
তেলের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বর্তমান যুগে সব মানুষই স্বীকার করে। তেল আবিষ্কার ও তেল ব্যবহার করতে শেখার পর মানুষের তেলের ওপর নির্ভরতা দিন দিন বেড়েই চলছে। একই সঙ্গে বাড়ছে তেল–বন্দনা। যুগে যুগে তেল নিয়ে তেলেসমাতি কাণ্ডও কম হয়নি। তেল নিয়ে কী সাংঘাতিক ঘটনা হতে পারে, তা আমরা দেখেছি মধ্যপ্রাচ্যে। স্রেফ তেলের দখল নেওয়ার জন্য বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ আমেরিকা ইরাকসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্য তছনছ করে দিয়েছে।
বর্তমান জামানায় তেল ছাড়া সবকিছু অচল। তেল আছে তো সব আছে, তেল নেই তো কিছু নেই। তেল ছাড়া কোনো কাজ হয় না। ভাজি–ভর্তা–ঝোল, জ্বালা–জ্বলা–উত্তাপ আর উন্নতি–অগ্রগতি–পদোন্নতি—সবকিছু নির্ভর করে তেলের ওপর। তেল ছাড়া বাতি জ্বলে না, গাড়ি চলে না, বিমান ওড়ে না, উনুন জ্বলে না, জীবনও চলে না। তেল বেঁচে থাকবার অনিবার্য উপাদান, জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। তেলচর্চা, তেলের ব্যবহার ও পর্যাপ্ত তেল সংস্থানের ওপর নির্ভর করে মানুষের সাফল্য। তেল আছে বলে জীবন আছে। তেল ফুরিয়ে গেলে জীবনপ্রদীপও নিভে যায়।
আর তাই সমাজে তেল মারা লোকের অভাব নেই। কে, কাকে কতটুকু তেল মেরে নিজের অবস্থা পাকাপোক্ত করবে, স্বার্থসিদ্ধি করবে, নেক নজরে আসবে, তা নিয়ে ব্যস্ত সবাই। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো—যাকে তেল মারা হয় অর্থাৎ তোষামোদ করা হয়, সেও এতে খুব খুশি হয়। এ ধরনের তেলপ্রেমিদের কারণেই একটা দেশ, একটা সমাজ, একটা সম্প্রদায়, একটা প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের পথে। এটা নিয়ে কারো হুঁশ নেই।
বর্তমানে বাঙালি মানেই—উচিত কথা বললে মুখ কালো আর তেল দিতে পারলে খুব ভালো। তেল মারা প্রসঙ্গে একজন তেলবিশারদ লেখক বলেছেন, 'তিলে তেল হয়, কৈয়ের তেলে কৈ ভাজা, তেলা মাথায় তেল দেওয়া। এক তেল নিয়ে কম রঙ্গ হয়নি এই বঙ্গে। এখনো যে হচ্ছে না, তা নয়। হচ্ছে এবং আগের চেয়ে বেশিই হচ্ছে। তবে তেল এখন শুধু আর রঙ্গ নয়, এটি আমাদের দেহ ও সমাজের একটি অঙ্গ। সময়টাই এখন তেলের। চারদিকে শুধু তেল, তেল আর তেল। একটু ভালোভাবে তাকালেই দেখা যায় সবার গা থেকে এখন ঘাম নয়, ফোঁটায় ফোঁটায় তেল ঝরছে। আমরা সবাই এখন একেকটি তেলের বিশাল বিশাল আধার। আর কিছু নয়, সর্বোত্কৃষ্ট জায়গায় কীভাবে এ তেলের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যায়, তা জানার জন্যই আমরা সবাই এখন হন্যে হয়ে ছুটছি। তেল মারতে মারতে একেক জনের গায়ের চামড়া তুলে ফেললেও আমরা ক্ষান্ত হই না। উদ্দেশ্য হাসিল না হওয়া পর্যন্ত খুঁজতে থাকি আর কাকে তেল মারা যায়। বর্তমানে তৈলবিদ্যা যে যত বেশি আয়ত্ব করতে পারি জীবনে সে ততটাই উন্নতি করি। আমরা বিশ্বাস করতে শিখি তেলহীন বিদ্যা ফুটো পয়সার মতোই অচল।
আমাদের বিশ্বাস, চিন্তা–চেতনা, অস্তিত্ব, সমাজ, সংসার, আকাশ, বাতাস, চাঁদ, জোছনা, সূর্য এখন তেল–নির্ভর হয়ে পড়েছে। অন্যকে কীভাবে তেল মারা যায় তার কায়দাকানুন জানতেই আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। নিজের জ্ঞান–বুদ্ধিকে শাণিত করতে নিজেকে তেল মারার কথা আমরা চিন্তাও করি না। তেলখেকো বাজারি কুকুরের গায়ে যেমন লোম থাকে না, সর্বত্র এভাবে তেল মারামারির ফলে আমাদের সমাজ–সংসারও আজ লোমহীন হয়ে পড়েছে। আমাদের বিচার–বুদ্ধিতে জট লেগেছে, মরিচা ধরেছে। তবে মরিচা সারাতেও কিন্তু তেল লাগে। এটা যে কোন তেল, তা আমরা জানি। কিন্তু এখানে আমরা তা মারি কি?
আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে মহামহিম হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তেলের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে এক অনবদ্য ধ্রুপদী প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তেল প্রসঙ্গে সেই প্রবন্ধটির অংশবিশেষ উল্লেখ করা যেতে পারে—
তৈল যে কী পদার্থ, তাহা সংস্কৃত কবিরা কতক বুঝিয়াছিলেন। তাহাদের মতে তৈলের অপর নাম স্নেহ—বাস্তবিক স্নেহ ও তৈল একই পদার্থ। আমি তোমায় স্নেহ করি, তুমি আমায় স্নেহ করো অর্থাত্ আমরা পরস্পরকে তৈল দিয়া থাকি। স্নেহ কী? যাহা স্নিগ্ধ বা ঠান্ডা করে তাহার নাম স্নেহ। তৈলের ন্যায় ঠান্ডা করিতে আর কিসে পারে! সংস্কৃত কবিরা ঠিকই বুঝিয়াছিলেন। যেহেতু তাহারা সকল মনুষ্যকেই সমানরূপ স্নেহ করিতে বা তৈল প্রদান করিতে উপদেশ দিয়াছেন।
বাস্তবিকই তৈল সর্বশক্তিমান, যাহা বলের অসাধ্য, যাহা বিদ্যার অসাধ্য, যাহা ধনের অসাধ্য, যাহা কৌশলের অসাধ্য—তাহা কেবল একমাত্র তৈল দ্বারা সিদ্ধ হইতে পারে। যে সর্বশক্তিময় তৈল ব্যবহার করিতে জানে সে সর্বশক্তিমান। তাহার কাছে জগতের সকল কাজই সোজা, তাহার চাকরির জন্য ভাবিতে হয় না। ওকালতিতে পসার করিতে সময় নষ্ট করিতে হয় না। বিনা কাজে বসিয়া থাকিতে হয় না, কোনো কাজেই শিক্ষানবিশ থাকিতে হয় না।…শেষে মনে রাখা উচিত, এক তৈলে চাকাও ঘোরে, আরেক তৈলে মনও ফেরে।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ব্যাপকতর অর্থে তেলের যে মানে, যে বিষয়ে আলোচনা করেছেন, গত প্রায় ১০০ বছর ধরে আমাদের সমাজে তেলের সেই একই ভূমিকা রয়ে গেছে। আশা করা যায়, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তা বহাল থাকবে। কারণ, তেল দিতে পারা মানুষগুলোকে সবাই ভালোবাসে। আর তেল আরেকজনকে গলানোর সবচেয়ে ভালো উপায়।
তবে তেল মারার বিদ্যায় পারদর্শী হয়েও যারা জীবনে সফল হতে পারেননি, এমন অভাগাও সমাজে আছে। তেমন একজন সম্প্রতি ফেইসবুকে লিখেছেন, "বুঝ হওয়ার পর থেকে গত পরশু পর্যন্ত তেল মাখতে মাখতে ড্রাম শেষ করে ফেলেছি। এখন আর আমার কাছ থেকে কেউ তেল আশা করবেন না!"
আমাদের তৈলাক্ত সমাজে তেল নিয়ে সমাজে নানা রকম হেঁয়ালি বা ধাঁধাঁ তৈরি হয়েছে।
দুই সহকর্মী নিজেদের মধ্যে ধাঁধাঁর খেলা খেলছিলেন। এক জন অপর জনকে জিজ্ঞেস করলেন, অফিসের বস আর মাটির প্রদীপের মধ্যে মিল কোথায়?
সহকর্মী খানিকক্ষণ ভেবে বললেন, জানি না!
এবার প্রশ্নকর্তা বললেন, তুমি যতক্ষণ তাকে তেল দেবে, সে ততক্ষণই তোমাকে আলোর পথ দেখাবে!
তেল মারা বা তোষামোদী নিয়ে খুবই বিখ্যাত একটা গল্প হলো বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক ডায়োজেনেসের। রাজা ডেনেসের তোষামোদ করতেন না বলে তাকে খুব কষ্ট করে দিন কাটাতে হতো, যখন অ্যারিস্টোপাস নামে আরেকজন দার্শনিক রাজাকে খুশি করে খুবই আরামে–আয়েশে ছিলেন। তো একদিন অ্যারিস্টোপাস বাড়িতে এসে দেখলেন ডায়োজেনেস শাক দিয়ে ভাত খাচ্ছেন। অ্যারিস্টোপাস ঠাট্টা করে বললেন, 'একটু তোষামোদী শিখলে তোমাকে শাক দিয়ে ভাত খেতে হতো না।'
ডায়োজেনেস উত্তরে বললেন, 'আর তুমি যদি কষ্ট করে শাক দিয়ে ভাত খাওয়াটা শিখতে তাহলে তোমাকে অমন তোষামোদী করতে হতো না।'