Published : 13 Mar 2022, 06:38 PM
"পরের ভঙ্গি নকল করে নটের মত কেন চলিস?"
এটি ছড়ার না কবিতার, সেটা সাহিত্যের বিচার। তবে সামাজিক বিচারে এটা হলো তিরস্কার, মহা তিরস্কার। কেন, তোর নিজের এলেম নেই, পরের বিদ্যা নিয়ে কেন নিজের পণ্ডিতি জাহির করতে চাস? কবি কামিনী রায়ের এমন চরম তিরস্কারেও আমাদের হুঁশ ফেরেনি, আমরা সচেতন হইনি। আমরা নিজস্বতার চর্চা না করে পরস্ব নিয়ে পড়ে আছি। নিজের শক্তির দিকে ভ্রূক্ষেপও না করে পরের কাছে গিয়ে তাদের সামান্য প্রসাদ পাওয়ার আশায় কাতর চোখে তাকাই। নিজের বাহুতে আস্থা নেই, পরের অঙ্গুলি হেলনেই আমাদের ডান-বাম, বাম-ডান দোলাচল। আমরা ওপরের দিকে চাই না, পাছে শক্তিশালী কারো চোখে চোখ পড়ে যায়। নিচের দিকে তাকাতেই আমাদের পরম প্রশান্তি। অথচ অমন প্রচণ্ড একটা একাত্তুরের আমরাই স্রষ্টা, অমন দুরন্ত একটা বায়ান্নর আমরাই উদ্যোক্তা।
সারা বিশ্বের আর কোনো জাতিরই এমন হীরন্ময় অর্জন নেই, এমন বিস্মৃত বিসর্জনও নেই। একজন বাঙাল নীরদ সি চৌধুরী লন্ডনে বসে বাঙালি চরিত্র বিশ্লেষণ করেছেন 'আত্মঘাতী' হিসেবে। বিতর্কিত এই মহাপণ্ডিত লেখক যে উদ্দেশ্যেই স্বজাতির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করুন না কেন, সেটা হিসেবে না এনেও মোটাদাগে বলা যায়, বাঙালি সত্যিই আত্মঘাতী। 'ভাত খেয়ে পাত কানা' করার মতো কাজগুলো তারা অবলীলায় করতে পারে। কে যেন মোক্ষম এক কৌতুক বানিয়েছিল এ নিয়ে। সেটা হলো, বাঙালির দোজখে দারোগা লাগে না। একজন উঠতে গেলে তিনজনে তার পা ধরে টেনে নামায়। কৌতুকই বটে। তবে খুব করুণ কৌতুক। আত্মঘাত প্রবণতাকে বিশ্লেষণ করার মতো চরম কৌতুক।
তবে কি বাঙালির নিজস্বতা বলতে কিছু নেই? আছে তো। শূন্যে থুতু ছোড়ার ব্যাপারে আমরা খুবই পারদর্শী। সে থুতু এসে নিজের গায়ে পড়লেও কিছু আসে যায় না। পরচর্চা বাঙালির একান্তই নিজস্ব সম্পদ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আর বছরের পর বছর ধরে উপভোগ করার মতো।
বাঙালি চরিত্র সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের অমোঘ উক্তি: 'সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী/ রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি।'
নিজের এই দুই লাইন কবিতাকে বিশ্বকবি ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, "আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না, আড়ম্বর করি, কাজ করি না, যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না, যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না, ভুরি পরিমাণ বাক্য রচনা করিতে পারি, তিল পরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না, আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতা লাভের চেষ্টা করি না, সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি, পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধুলি নিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিক্স এবং নিজের বাকচাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহবল হইয়া ওঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য।'
সত্যি কিনা জানি না, তবে পাকিস্তানের এক সময়কার স্বৈরশাসক আয়ুব খানের বাঙালি বিষয়ক একটি অভিজ্ঞান ছিল। ছোটবেলায় মুরব্বিরা বাঙালি চরিত্র নিয়ে (অবশ্যই নিজের চরিত্র বাদে) আক্ষেপ করতে গিয়ে আয়ুব খানের `উক্তি'টি উদ্ধৃত করতেন। আয়ুব খান নাকি কোনো একসময় বলেছিলেন, "বাঙালি ব্যাঙের মতো। এদের এক পাল্লায় মাপা যায় না।"
উক্তিটি যদি আয়ুব খানের নাও হয়ে থাকে, তাতে ক্ষতি নেই। কারণ বাঙালি চরিত্র বিশ্লেষণে `বাঙালির দোজখে দারোগা না লাগা'র সে কৌতুকের মতো এটাও এক মোক্ষম উক্তি।
বাঙালি আসলে কখনো স্বাধীন হতে চায় না। নিজেকে মানার মানসিকতা তাদের কখনো ছিল না, এখনো নেই। স্বাধীন হতে গেলে যে নিজেকে মানতে হয়, এটা আমরা জানি না। স্বাধীনতা বলতে আমরা যা বুঝি, সেটা হলো নিজের ইচ্ছেমতোই সব কিছু করতে পারার ঢালাও সুবিধা। তা করতে না পারলে নিজেকে কোনোভাবেই স্বাধীন মনে করতে পারি না।
সাধারণভাবে বলতে গেলে বাঙালি আর একাত্তর সমার্থক। পৃথিবীর আর সব মানুষের কাছে একাত্তর একটি খ্রিস্টিয় বছর মাত্র। কিন্তু বাঙালির কাছে এটা এক মহা জীবনযুদ্ধের বছর। একাত্তর মানে এক সাগর রক্ত, বাঙালির রক্তে সাত সমুদ্র আর তেরো নদীর উচ্ছ্বাস। একাত্তুর মানে চেতনার মহাকাশে বিকশিত সত্ত্বার অগুণতি নক্ষত্রপিণ্ড, মহাদেশতুল্য হিমবাহ গলিয়ে দেয়ার প্রজ্জ্বলিত ক্রোধের মশাল। কিন্তু একাত্তর বাঙালিকে শেষ পর্যন্ত কী শিক্ষা দিল? কিংবা যা শিক্ষা দিল, মাত্র এক বছরের মাথায় তা কোথায় চলে গেল? কখন যেন আমরা সে 'পুনর্মুষিকোভবঃ' হয়ে গেলাম!
৭৩ কি ৭৪-এ আমাদের কৈশোরে স্বাধীন বাংলার টাকার মধ্যে লেখা দেখেছিলাম, 'টাকার মাথায় টুপি চাই'। 'সালাম সালাম হাজার সালাম' এর মতো কালজয়ী গানটির প্যারোডি শোনা গেল: 'ছিলাম ছিলাম ভাল ছিলাম পাক শাসনের আমলে'। পরাজিত বিধ্বস্ত স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সন্তর্পণ আত্মপ্রকাশ ঘটা শুরু হয়েছিল এভাবেই। প্যাঁচার মতো সূর্যালোক থেকে সরে গিয়ে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসেছিল ওরা। ৭৫-এ বাঙালির দঙ্গলে শালপ্রাংশুসম ব্যক্তি এবং ব্যক্তিত্বটিকে সবংশে নিপাত করা হলো। আমাদের `ভূতের পা পেছন দিকে' হাল শুরু হলো। রাতারাতি পাল্টে ফেলা হলো নিজের নাম-পরিচয় আর জাত-গোষ্ঠীর খতিয়ান পর্যন্ত। সেটা এখন কলঙ্কিত ইতিহাস, একটা স্বাধীন জাতির সর্বনাশের ষোলোকলা পূর্ণ হওয়ার লজ্জাস্কর ইতিবৃত্ত।
তবে এর মধ্যেও মজা রয়েছে। রাজনীতির মজা। আমাদের কিছু লোকের তালেবান হওয়ার শখ দেখা গেল। তারা বাংলাকে আফগানিস্তান বানানোর স্বপ্নে বিভোর হলো। আরেক দলকে দেখা গেল চীনা হয়ে যাবার খায়েশ পোষণ করতে। বড় বড় শহরগুলোর দেয়ালে দেয়ালে লেখা স্লোগান দেখা গেল। একদল লিখেছে, 'আমরা সবাই তালেবান/বাংলা হবে আফগান।'
আরেক দল লিখে বসলো, চীনের চেয়ারম্যান নাকি তাদেরও চেয়ারম্যান। দেশটাকে স্বাধীন করল আপামর বাঙালি। আর কিছু বাঙালি আফগান আর কিছু বাঙালি চীনা হওয়ার জন্যে খেপে উঠল।
সোজা কথা হলো এই দুই শ্রেণির কাছে একাত্তুর, আমাদের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ এসব কিছুই নয়। এরা নিজস্বতায় বিশ্বাসী নয়, পরস্বতাই তাদের ধ্যানজ্ঞান। সেটা কোথাও ধর্মের নামে, কোথাও শ্রেণিচেতনার দোহাই দিয়ে। উন্মূলতা নইলে প্রকট হয়ে প্রকাশ পাবে কী করে? সাধে কি দেড়শ বছর আগে বাংলার ওই নারী কবি তীব্র তিরস্কারের ঝঙ্কার তুলেছিলেন, পরের ভঙ্গি নকল করে নটের মতো কেন চলিস?
অনুকরণপ্রবণতাই কেবল নয়, আমাদের আছে আত্মমর্যাদাবোধহীনতাও। সেখানেও নিজস্বতাকে একপাশে ঠেলে পরস্বলোলুপতার উদগ্র ঝাঁজ। নিজের গড়পরতা পাঁচফুটি চেহারা আমাদের পছন্দ হয় না। যত লম্বা হয়, পছন্দের পাত্র হিসেবে ততই আনন্দ, ততই মুগ্ধতা। তাই আমরা বলি, 'পাঠানের মতো লম্বা', 'ইউরোপিয়ানের মতো ফরসা'। অর্থাৎ নিজেদের গড়পরতা শারীরিক বৈশিষ্ট্য আমাদের নিজেদের কাছেই বিতৃষ্ণার, অশ্রদ্ধার।
বলছিলাম, আমাদের পরস্বপ্রিয়তার কথা। আমরা নিজের ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্যে বুকের রক্তে বসন্ত রঞ্জিত করলাম, কৃষ্ণচূড়া আমাদের ভাষার অপরার্থ হয়ে উঠল, অথচ আমাদের সে ভাষা কেবল আটকে গেল একটা বিশেষ দিনের বিশেষ একটু ক্ষণের মধ্যে। সাধারণ বাঙালি একুশের উদযাপন শুরু করে একুশের গান দিয়ে, শেষ করে হিন্দি গানের ধুমধারাক্কা দিয়ে। রাষ্ট্রীয় অঙ্গনে ইংরেজি ভাষার ছড়াছড়ি। বাংলার সঙ্গে কারণে অকারণে ইংরেজি জুড়ে দিতে পারলেই মহা স্মার্ট হওয়া যায় বলে এক বদ্ধমূল ধারণা গেড়ে আছে আমাদের মনে।
আচ্ছা, ইংরেজি না হয় আমাদের এক সময়ের রাজার ভাষা ছিল। ইংরেজি শিখে সে সময়ের হিন্দু-মুসলমান জাতে উঠে যেত, খান বাহাদুর রায়বাহাদুর উপাধির সঙ্গে সঙ্গে হু হু করে বাড়ত বৈষয়িক উন্নতির জোয়ারও। ইংরেজ তাড়াতে এক সময় বাঙালি কোমর বেঁধে নামলেও ইংরেজি তাড়ানোর কথা কখনো স্বপ্নেও চিন্তা করেনি। ব্রিটিশ চলে গেল কিন্তু বাঙালির ইংরেজি চর্চা বন্ধ হলো না। ইংরেজি তার দোর্দণ্ড প্রতাপ ধরে রাখল পুরো উপমহাদেশে। কিন্তু আমি উর্দু ভাষার কথা ভাবি। পাকিস্তানের কোনো অংশের ভাষা উর্দু নয়, ভারতের কিছু অংশের ভাষা ওটা। কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার পর সে উর্দুই কিনা পাকিস্তানের সব আঞ্চলিক ভাষাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে প্রধান ভাষার মর্যাদা পেতে চলেছিল! আর বাঙালি করল কী? আচমকা খেপে উঠে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতার মুখের ওপর বলে দিল, 'না উর্দু নয়, বাংলা'। এরপরেরটা তো বাঙালির বিশ্বজয়ী এক ইতিহাস। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ওদিকে আমরা সাধারণ বাঙালিরা বিহার থেকে আসা মুসলমানদের স্থানীয় উর্দুভাষায় কথা বলার মকশ করি ওদের কাছে নিজেদের পারঙ্গমতা দেখানোর জন্যে। ওরা বাংলা অবলীলায় বললেও আমাদের কিছু মানুষ তাদের সঙ্গে বাতচিত করে ওদের ভাষায়। যেন ওদের ভাষাটা ওদের সঙ্গে বলতে পারলে ওরা খুব সমীহ দেখাবে।
সামগ্রিকভাবে দেখতে গেলে এটা হয়তো খুব বড় কিছু নয়। কিন্তু বাংলাদেশে যেখানে যেখানে বিহারী কলোনি আছে, সে সব এলাকায় এমনটাই ঘটে থাকে। আর এখান থেকেও উঠে আসে আমাদের হালকা মন-মানসিকতার পরিচয়।
কিন্তু আমাদের, বাঙালিদের সব কিছুই কি নেতিবাচক? ইতিবাচকও তো আছে। ৫২, ৬২, ৬৬, ৬৯, ৭১…এবং এমনকী ৯০-ও। কিন্তু এত বড় বড় অর্জনের পরেও এমন মানসিক দৈন্যদশা কেন আমাদের? আমরা কেন পারি না একই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ধারায় চলতে? কেন বার বার রক্তে স্নান করে পরিশুদ্ধ হওয়ার পরীক্ষা দিতে হয় আমাদের, বাঙালিদের!
শুরু করা লাইনটি দিয়ে শুরু করা কবিতাটা পুরোটাই পড়া যাক-
"পরের মুখে শেখা বুলি পাখির মতো কেন বলিস?
পরের ভঙ্গি নকল করে নটের মতো কেন চলিশ?
তোর নিজত্ব সর্বাঙ্গে তোর দিলেন দাতা আপন হাতে,
মুছে সেটুকু বাজে হলি, গৌরব কি বাড়ল তাতে?
অলীক, ফাঁকি, মেকি সে জন নামটা তার কদিন বাঁচে?
পরের চুরি ছেড়ে দিয়ে আপন মাঝে ডুবে যারে,
খাঁটি ধন যা সেথায় পাবি, আর কোথাও পাবি নারে।"