কুকুরগুলো না খেয়ে মারা যাচ্ছে। এখানে আমাদের নিজেদের দায়-দায়িত্বহীনতার সঙ্গে রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার অভাবকেও দায়ী করা যায় কী?
Published : 26 Nov 2024, 08:20 PM
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের কুকুরগুলো না খেয়ে মারা যাচ্ছে— এমন একটি সংবাদ বেশ আলোড়ন তুলেছে ব্যক্তিগত পরিমণ্ডল থেকে অন্তর্জালে। খবরের সত্যতা নিরূপণের মতো কঠিন কাজটি আমাদের অনেকের পক্ষে করা সম্ভব নয়। তাই আমরা বেশ বিচলিত এই ভেবে যে, একুশ শতকে এসে খাবারের অভাবে কোনো প্রাণী এভাবে মারা যাবে? ঘটনার প্রকটতা এতটাই গভীর যে, ব্যক্তিগতভাবে আমাকে আমার পরিবারের কাছে মোটামুটি জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে শুধু এই কারণে যে, ফি বছর সেন্ট মার্টিনে যাওয়া হয় আমার। তাই আমি হয়তো ভালো বলতে পারব ঘটনাটা সম্পর্কে।
কিন্তু আমি আসলে এর কোনো সদুত্তর দিতে পারিনি। আসলে কি পরিমাণ কুকুর না খেয়ে মারা যাচ্ছে এবং কেন মারা যাচ্ছে?
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের এই চলমান ঘটনাকে বোঝার জন্য আমরা নিঝুম দ্বীপের উদাহরণ নিয়ে আসতে পারি শুধু একটি ধারণা পাবার জন্য। যদিওবা এটা অনেকটা আপেলের সঙ্গে কমলালেবুর তুলনা করার মতো। তবুও দুইটাই যেহেতু ফল, তাই তুলনা চলে আসতে পারে। নিঝুম দ্বীপ বাংলাদেশের একটি অন্যতম জাতীয় উদ্যান। এটি নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলায় অবস্থিত একটি লোকালয়, যেখানে স্থলপথে যাওয়া যায় না। ওই বিচারে এটিও দ্বীপ। আবার সুন্দরবনের পর যেসব জায়গায় ম্যানগ্রোভ বন আছে, তাদের মধ্যেও নিঝুম দ্বীপ অন্যতম।
জীববৈচিত্র্যে নিঝুম দ্বীপে হরিণের উপস্থিতি প্রাকৃতিক নয়। যদিওবা নিঝুম দ্বীপের যেসব ছবি আমরা দেখে থাকি, তাদের মধ্যে ঘন জঙ্গলে এক পাল চিত্রা হরিণ বিচরণ করছে, তা বেশ জনপ্রিয়। উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনীর মতো বনায়ন শুরুর পর উর্বর দ্বীপে গাছের প্রাচুর্য চলে আসে। একে মোক্ষম হিসেবে ধরে ১৯৭৮ বা ১৯৮০ (সঠিক তথ্য নিরূপণ সম্ভব হয়নি) সালে তিন থেকে চার জোড়া হরিণ নিয়ে আসা হয়। এই শুরু। এর পর হরিণের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে এবং এই সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ হাজারের মধ্যে হবে বলে ধারণা করা হতো।
এমন একটি পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল যে হরিণের সংখ্যা সীমিত বা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সুন্দরবন থেকে বাঘ ধরে নিয়ে আসার পরিকল্পনাও করা হয়েছিল। এরপর সেটা করা হয়েছিল কিনা, তা আমার জানা নেই। কিন্তু এমন একটি সমাধানের কথা পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়। কিন্তু নিকট অতীতের খবর পর্যালোচনা করে দেখা যায়, হরিণের বিচরণ কমে গেছে।
এটা আমাদের সঙ্গেও হয়েছে। অনেক আশা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল হরিণের ছবি তোলার জন্য। তাও আট বছর আগের কথা। দিনরাত জেরবার করে একপাল হরিণেরও দেখা পাইনি। ছবিও তোলা হয়নি। এখানে যে ব্যাখ্যার মুখোমুখি হতে হলো, তা হলো হরিণরা এখন লোকালয়ের আশপাশে আর আসে না। কিন্তু আমরা যতটা পেরেছি, দু-দিন ধরে বনের গহীন থেকে গহীনে গিয়েছি, হরিণের দেখা মিলেছে, কিন্তু হরিণের পাল দেখা যায়নি। নিজেদের কাছে এর উত্তর একটাই— আর এত হরিণ হয়তো নেই। আগে ছিল।
হরিণ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে জনবসতির সংখ্যা, জনসংখ্যা, অনাচার, বিনা অনুমতিতে বৃক্ষ নিধনের মতো তথ্যগুলো পাওয়া যায়। তার মানে এখানে আমাদের অবদান মুখ্য হিসেবে গণ্য করা যায়। হরিণের প্রয়োজনীয় খাবার না থাকলে তারা মারা পড়বেই। সেটা মানুষের হাতে যেমন, তেমনি প্রাকৃতিকভাবেও। হরিণ খাওয়ার চল যে মানব সম্প্রদায়ের নেই, তা তো আর বলা যায় না।
মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। সেন্ট মার্টিনে হরিণ নেই। কিন্তু কুকুর আছে। সংখ্যায় নিঝুম দ্বীপের হরিণের সংখ্যার আশপাশে না হলেও আছে। এই দ্বীপে কুকুর হয়তো মানুষের সঙ্গেই এসেছে কোনো না কোনো দিন, কোনো না কোনোভাবে। কুকুরের সঙ্গে গৃহস্থালির সংযোগ প্রাচীন— এটা শুধু বাংলাদেশ বলে নয়। কুকুর থাকতেই পারে। কিন্তু দেখি দেখি করে বিগত ২৪ বছরে অনেকবার এ দ্বীপে যাওয়ার অভিজ্ঞতায় যে সত্যটি নিজের কাছে উপলব্ধি হয় তা হলো আগে অধিবাসীদের বাড়িতে বা তার কাছাকাছি কুকুর দেখা যেত। সংখ্যায় খুব যে বেশি তাও নয়, তবে ছিল। এই কুকুরগুলোর খাবার ছিল মাছের উচ্ছিষ্টাংশ। সেন্ট মার্টিন আদতেই একটা জেলেপল্লী ছিল। খুব বেশিদিন আগের কথাও নয় যখন অধিবাসীদের অর্থনীতির মূলে ছিল মাছ ধরা। ভোরে জেটির দুই পাড়ে জেলে নৌকাগুলো ভিড়ত। স্থানীয়রাও এখান থেকেই ক্রয় করতেন। বাকি মাছগুলো মূলত শুটকি করে রাখা হতো, নয়তো টেকনাফে পাঠিয়ে দেওয়া হতো, যেহেতু দ্বীপে কোনো হিমাগার ছিল না। বরফ দিয়ে সাময়িকভাবে হিমায়িত করা হলেও তা ছিল মূলত স্বল্পকালীন সংরক্ষণের জন্য।
মাছের উদ্বৃত্ত অংশের খাদক ছিল এই কুকুরগুলো। সারাদিন দেখা না গেলেও সকালে তাদের আনাগোনা ছিল মাছের আশায়। খাবারের জন্য প্রাণীরা অভিবাসন করে। গ্রেট মাইগ্রেশন শুধু মানব ইতিহাসের অংশ নয়। প্রাণীদের মধ্যে এটা আছে আদি থেকেই। তাই এত এত খাবার কুকুরগুলোর জন্য নিত্যদিনের ভূরিভোজ। কুকুরের সংখ্যা বৃদ্ধির শুরুটা হয়তো এখান থেকেই। চাহিদার তুলনায় খাদ্যের প্রাচুর্য! এটা ওই সময়ের কথা যখন দ্বীপে যাওয়ার জন্য টেকনাফ থেকে কাঠের নৌকাই ছিল ভরসা। যে জেটি এখন দেখতে পাওয়া যায় তার আগে বাঁশের সাঁকোর মতো একটা নড়বড়ে জেটি ছিল। সৌরবিদ্যুৎ ছিল না। কিছু জায়গায় বা স্থাপনায় জেনারেটর দিয়ে দিনের বিশেষ কিছু সময় বিদ্যুৎ পাওয়া যেত। সব মোবাইল কোম্পানির নেটওয়ার্ক ছিল না। শুনে প্রাগৈতিহাসিক যুগের কথা মনে হতে পারে, কিন্তু এটা দুই হাজার সালের পরের কথা বলছি।
খাদ্যাভাব না থাকার কারণে কুকুরের সংখ্যার দিকে কেউ নজর দেয়নি। যেহেতু গাঁটের পয়সা খরচ হচ্ছে না, তাই কতগুলো কুকুর আছে, কুকুরের সংখ্যা কত বাড়ল, তা হয়তো আমরা কেউই খেয়াল করতাম না। কুকুর তার প্রজনন সক্ষমতার চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চলতে থাকল।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা সীমিত করার জন্য নানাবিধ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ‘ছেলে হোক আর মেয়ে হোক, দুটি সন্তানই যথেষ্ট’— এমন প্রচারের মধ্য দিয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির লাগাম টানার জন্য চেষ্টা করা হয়েছে এবং আমরা লাগাম টেনেছিও। তাই জনসংখ্যার বিস্ফোরণ একটা সময় থেমে গেছে।
সেন্ট মার্টিনেও এটা হতে পারত কুকুরের ক্ষেত্রে। এটা কোনো বিশেষ উদ্যোগ নয়। স্থানীয় প্রশাসন চাইলেই কাজটা করতে পারত। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ ঠেকাতে যেমন মানুষ মারা হয়নি, তেমনই কুকুরের সংখ্যা সীমিত রাখার জন্য তাদের মেরে ফেলারও দরকার হতো না। দরকার হতো কিছু উদ্যোগের। কুকুরগুলো যে সমস্যা— এই উপলব্ধি ঘটে কুকুরের খাদ্য অপ্রতুল হতে শুরু করার পর।
কুকুরের বন্ধ্যাকরণ কোনো রকেট সায়েন্স নয়। প্রতিষেধক দেওয়াও খুব খরচের নয়। সরকারি কাঠামো তো ছিল (এখনও আছে কিনা নিশ্চিত নই)। পৌরসভা কর্তৃপক্ষ রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুর ধরে নিয়ে যাবে— এমন মাইকিং শোনার পর বাড়ির আশপাশে ঘুরঘুর করা ‘লালু’কে নিয়ে গিয়ে টিকা দিয়ে এনেছিলাম আমি। অনেক ছোটবেলার কথা। পৌরসভা থেকে আধুলির থেকে কিছুটা বড় টিনের লকেটের মতো একটা নম্বর প্লেট দেওয়া হতো, যা থাকলে লালুদের কুকুর ধরা অভিযান থেকে বাঁচিয়ে দিত।
সেন্ট মার্টিনের কুকুরের সংখ্যা নিয়ে যে আলোচনা, তা কতটা নিরপেক্ষ তা-ও প্রশ্নসাপেক্ষ। কুকুর গণনা হয়েছে কিনা তা জানা যায়নি। তাই কুকুরের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার যে অভিযোগ— তা স্থানীয় প্রশাসন, জনগণের দায়িত্বহীনতার বহিঃপ্রকাশ হতে পারে। কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপে স্থানীয় প্রশাসনের অংশগ্রহণ জরুরি ছিল, ঠিক তেমনি স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও এগিয়ে আসতে পারতেন। জনগণের কথা না হয় নাইবা বললাম।
এখন যেহেতু সেন্ট মার্টিন একটি বহুল চর্চিত বিষয় দেশজুড়ে। তাই কুকুরের না খেয়ে মরে যাওয়াটা অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না। কিন্তু এই আলাপ নিঝুম দ্বীপের হরিণের ক্ষেত্রে ততটা আলোচিত হয়েছিল কিনা সেটাও একটা ব্যাপার। হরিণ হয়তো আমরাই ভক্ষণ করেছি অনেকখানি, আড়ালে-আবডালে।
ওই আদি প্রশ্ন, কুকুরগুলো না খেয়ে মারা যেতে পারে কি? পারে। মারা যাওয়ার সম্ভবনা প্রচুর। এখানে আমাদের নিজেদের দায়-দায়িত্বহীনতার সঙ্গে রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার অভাবকেও দায়ী করা যায় কী?
অনুশোচনা বা আক্ষেপ যা-ই বলা হোক, এখানে আমরা ভীষণভাবে পরাজিত। বন্ধ্যাকরণ না করে কুকুর মেরে, অন্য জায়গায় সরিয়ে এ সমস্যার সমাধান নেই। তাহলে ‘সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট’ বলে সবকিছু প্রকৃতির ওপর ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর কী-বা করার থাকে?