Published : 13 Apr 2021, 02:18 AM
শিশু-কিশোরদের ঘন ঘন আইনস্টাইন, বিল গেইটস, রবীন্দ্রনাথ বা এরকম পৃথিবীর অতি সফল মানুষগুলোর কাহিনী শোনালে তারা বিরক্ত হতে পারে। পাশের বাড়ির ছেলে বা মেয়েটির মতো ভালো আপনার সন্তান হচ্ছে না কেন তাকে সে কাহিনী শুনিয়েও কাজ নেই। তারচেয়ে বরং সন্তানের ভেতরে কিভাবে একটা সৃজনশীল ও অনুসন্ধিৎসু মন ও মনন তৈরি করে দেওয়া যায় সম্ভব হলে সে চেষ্টা চালান। এ কাজটি মা-বাবাই সবচেয়ে ভালো করতে পারেন, কোনও কবি-সাহিত্যিক বা সেলিব্রেটি নয়। তারা কখনো বাবা-মার বিকল্প হতে পারেন না। তাই, আপনার কাজটি তাঁরা করে দেবেন ভেবে থাকলে আপনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। তাছাড়া, পৃথিবীতে আপনার চেয়ে বড়ো কোন শুভাকাঙ্ক্ষী আপনার সন্তানের হতে পারে না, এ বিষয়টিও আপনাকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে হবে।
সন্তানকে মানুষ করতে সেলিব্রেটি, শিক্ষক, মনোবিদের কাছে পাঠানোর আগে নিজেদের চেষ্টা করাটা জরুরী। আপনার সন্তানকে শুরুতেই তাদের মুখাপেক্ষী করলে বরং তাদের বেচা-বিক্রি বাড়বে, বিজ্ঞাপন বাড়বে, ব্যবসার প্রচার-প্রসার হবে, এবং খুব সম্ভবত আপনার শিশু সন্তান তাদের চালচলন নকল করার চেষ্টা করবে। তাতে শেষফল কিন্তু অশ্বডিম্ব। কারণ, শিশুদের কাছে সুশিক্ষিত বাবা-মার চেয়ে বড় কোন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে না। কারো অন্ধ অনুকরণ কখনোই আপনার শিশুর জীবনে দীর্ঘমেয়াদী সুফল বয়ে আনবে না। আপনার সন্তানের সাফল্য আপনারই হাতের মুঠোয়। তাছাড়া অন্যের বাণিজ্যের সম্প্রসারণে আপনার সন্তানকে ব্যবহার করার সুযোগই বা দেবেন কেন? সফল মানুষের আশপাশে ঘুরে মূল্যবান সময় নষ্ট করলেই কি কেউ জীবনে সফল হয়ে যায়? তারা আপনার সন্তানকে ততটুকু ভালোবাসবেন, যতুটুকু তাদের নিজেদের উন্নয়নে দরকার। এটা কমন সেন্স! নিচের উদাহরণটি পড়ুন।
আমি যখন স্কুলে পড়ি তখন আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। ওর বাবা-মা নাকি ওকে বলে দিয়েছিলেন আমার সাথে ছাড়া আর কারো সাথে না মিশতে। প্রতিদিন বিকেলে সে আমার বাসায় আসতো। ঘণ্টাখানেক আমরা একসাথে কাটাতাম। সে আমাকে সপ্তাহে দু-তিনবার রেস্টুরেন্টে ডিম-পরোটা-কাবাব ইত্যাদিও খাওয়াতো যাতে আমি তার সাথে মিশতে আরও উৎসাহী হই। ওর বাবা-মা এ খাতে তাকে নিয়মিত টাকা পয়সা দিতেন। সরকারি চাকরি করতেন ওর বাবা।
আমি বরাবরই ক্লাসের শীর্ষ কয়েকজনের মধ্যে থাকতাম। আর, আমার সাথে তার খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও সে কেবল কোনভাবে পাশ করতো। শেষতক তৃতীয় শ্রেণিতে বিএ পাশ করে পড়ালেখার পাঠ চুকিয়েছে সে বন্ধু। সে আমাকে অনেকভাবে ফলো করার চেষ্টা চালালেও শেষতক তা কাজে আসেনি, বরং হতাশ হয়েছে। আরেকজনকে অন্ধ অনুসরণের শেষ ফল কখনওই ভালো হয় না। এর মূল কারণ হলো, প্রতিটি মানুষই কোন না কোনভাবে আলাদা। তাই, একজনের ফর্মুলা আরেকজনের উপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না।
আরেকটি প্রাসঙ্গিক ছোট্ট ঘটনা বলছি। আরও দুইটি পরিবারের সাথে মিলে কানাডায় রকি পর্বতমালা দেখতে গিয়েছিলাম আমরা। সাথে আমাদের ছোট ছেলে আয়মানও ছিল। তখন তার বয়স মাত্র পাঁচ। ওই দুই পরিবারের একজনের আয়মানের কাছাকাছি বয়সী একটা বাচ্চা ছিল বলে সে পুরোসময় তাদের সাথেই থেকেছে। আমরা যে পাহাড়ের শীর্ষে উঠেছিলাম তা অন্তত পনেরো তলা ভবনের উচ্চতার। পাহাড়ের শরীর- ছোট-বড় পাথরে ঢাকা। পাহাড়টি বেশ খাঁড়াও।
সেই পাহাড় থেকে নামার সময় দেখলাম ওই ভদ্রলোক এবং তার স্ত্রী তাদের বাচ্চাটিকে শক্ত করে ধরে সাবধানে নামছেন, আর আমাদের আয়মান নামছে নিজের মতো করে। দৃশ্যটা দেখে ভয়ে গা শিউরে উঠলো। কারণ, কোনওভাবে তার পা ফসকে গেলে সে মারাত্মক আঘাত পেতে পারে, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। আমার স্ত্রী তো রীতিমতো দোয়া-দরূদ পড়তে শুরু করেছিল সেই রুদ্ধশ্বাস মুহূর্তগুলোতে। অন্যের হাতে বাচ্চা দিলে কি পরিণতি হতে পারে ভেবে দেখুন। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। তাছাড়া, কিশোর আলোর অনুষ্ঠানে নাইমুল আবরার নামের এক কিশোর কতটা অবহেলায় প্রাণ হারিয়েছে তা তো দেশবাসী দেখেছেন। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ছেলেটা ছটফট করলেও অনুষ্ঠানের আয়োজকরা তাতে গুরুত্ব দেননি। এ হত্যাকাণ্ডের দায়ও মনে হয় না কাউকে নিতে হবে। এমন নজির অসংখ্য।
তাই বলছি, আপনি বা আপনারা কারও বাবা-মা হয়ে থাকলে আগে নিজেরাই শিখে নিন সন্তান কিভাবে মানুষ করতে হয়। তারপর সে শিক্ষা যতটা পারেন সন্তানের কাজে লাগান। মনে রাখবেন, শিশুরা শুনে যতটা শেখে, তারচেয়ে অনেক বেশি শেখে দেখে। যেমন, আপনি যদি কথায় কথায় মিথ্যা কথা বলেন, আর একইসাথে সন্তানকে সত্যবাদী হবার তকমা দেন, তাতে কি কোন কাজ হবে? সে ধরনের পরিবেশে সে সত্যবাদী হবার চেয়ে বিভ্রান্তই হবে বেশি।
আবার, কিছু একটা শেখাতে গিয়ে সন্তানকে যেন বেশি চাপাচাপি না করেন। অতিরিক্ত চাপে মেজাজ বিগড়ে দিলে তারা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটিয়ে বসতে পারে। আমেরিকার টেক্সাসে এক বাঙালি পরিবারের মর্মান্তিক ঘটনাটা না জেনে থাকলে পত্রিকার পাতা থেকে পড়ে নেবেন। সে কাহিনী পড়েই এ লেখা মাথায় এলো।