Published : 03 Jan 2021, 02:21 AM
স্বাধীন বাংলাদেশ। মুক্ত মানুষ। মুক্ত সমাজ। যেখানে মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে সংগঠিত হয়ে উঠে মানুষ। তাকে পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জায়গা তৈরি করতে হয়। সম্প্রসারণ করতে হয়। এ বিনির্মাণে প্রয়োজন হয় মতের ভিন্নতা। বিতর্ক গড়ে তুলতে হয়। মানুষের গতিশীল সমাজের বৈশিষ্ট্য রক্ষায় বিতর্কের আকাশ খোলা রাখতে হয়। মতপ্রকাশে কুণ্ঠা থাকলে, মতপ্রকাশের পরিবেশ সৃষ্টি করা না গেলে, প্রতিষ্ঠিত মতকে প্রাধান্য দিয়ে চিন্তার রাজ্য বন্ধ করে রাখলে বিতর্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয় না। সবার সামনে স্বাধীনতার অবাধ সুযোগ অবারিত থাকে না। বিতর্কের মাধ্যমে বের হয়ে আসবে সত্য ও সুন্দর। সত্য ও সুন্দরের পথ ধরে মানুষ নিজেকে বিকাশে নিয়োজিত থাকবে। সৃজনশীলতার দ্বার খুলে যাবে। নিজের মধ্যে থাকা অসীম ক্ষমতার সন্ধান পাবে। ক্ষমতায় মানুষ নির্মাণ করবে তার বাসযোগ্য পৃথিবী। মুক্তচিন্তা ও সৃজনশীলতার অচলায়তন কেটে যাবে। অন্ধকারের ভয় থাকবে না। নতুন সষ্টির আনন্দ চিন্তাতে নানা শ্রমনিষ্ঠ উদ্যোগে সামাজিক অগ্রগতি ও মানবিক আলোকিত ধারার নব জাগরণ ঘটবে।
বাংলাদেশে চিন্তার স্বাধীনতা মুক্তবুদ্ধির চর্চাকে প্রতি পদক্ষেপে বাঁধাগ্রস্ত করার পরিবেশ বিরাজ করছে। সমাজে চিন্তার স্বাধীনতা এবং ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়লে সমাজ স্থবির হয়ে পড়ে। জড় পদার্থে পরিণত হয়ে পড়ে। সাংস্কৃতিক অগ্রগতি বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। সুপরিকল্পিত কার্যক্রমে প্রতিহিংসার দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। ভিন্নমত বিদ্বেষী গোষ্ঠী অসহিষ্ণু হয়ে মানুষের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করে তুলছে। নিজেদের শাসনকে মজবুত করতে কণ্ঠ রোধের সম্ভাব্য সবকিছু করতে পিছুপা হচ্ছে না। সরকারের চরম দলীয় মানসিকতায় দেশের মাটিতে যেন মুক্ত চিন্তার চর্চা ও ভিন্নমত প্রকাশের ক্ষেত্রে মরুভূমির গুল্মলতা ছাড়া অন্যকিছু যেন জন্মাতে না পারে তার পরিবেশ সৃষ্টিতে প্রবলভাবে শক্তি প্রকাশ করে থাকে। বর্তমান প্রজন্মই নয়, আগামী প্রজন্ম যেন স্থবিরতা থেকে মুক্ত হতে না পারে তার জন্য চক্রান্তের পর চক্রান্ত চলমান। প্রকাশ্যে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই পরিবর্তন করা হচ্ছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। বিশেষ নিরাপত্তা আইনে সাধারণের মানবাধিকার হুমকির মুখে ফেলে দেয়া হচ্ছে। সুস্থ চিন্তা-চেতনা, ইতিবাচক মুক্তবুদ্ধির চর্চা মনের ভালবাসা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার ফলে গভীরতর সামাজিক ব্যাধির প্রকাশ ঘটছে।
দেশে সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিবান মানুষদের ওপর প্রথম আঘাত নেমে আসে যশোরে উদীচীর সম্মেলনে বোমা হামলা দিয়ে। তারপর একের পর এক রমনা বটমূলের পহেলা বৈশাখ, ঢাকায় সিপিবির জনসভা, ঢাকায় আহমদিয়া মসজিদের জামাত, সাতক্ষীরায় গুড় পুকুরের মেলা, সিলেটে মাজারের ওরশ, বাণিয়াচরের গির্জার প্রার্থনা, ময়মনসিংহে সিনেমা হলে হামলার লম্বা লাইন। সংস্কৃতিবান ব্যক্তি হিসেবে খ্যাতরা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাকিদের হিংস্রতার কাছে নিরাপত্তাহীন ছিল বর্তমান আমলে সেই একই অবস্থা বিরাজ করছে। মুরতাদ ঘোষণা, চাপাতির নিচে মাথা দেয়া, জীবন বিপন্ন হওয়ায় দেশছাড়া চলমান। দাউদ হায়দার থেকে তসলিমা নাসরিন জীবন রক্ষায় দেশান্তরী। হুমায়ুন আজাদ থেকে অভিজিৎ চাপাতির তলায় জীবনদান। শামসুর রাহমান কেবল থেকে মানিকরা বোমা হামলায় ছিন্ন ভিন্ন। প্রবীররা হাত পা হারানো এবং কুসুমকুমারীরা সতীত্ব হারিয়েছে। যুক্তির আলো, বিতর্কের সৌন্দর্য, প্রশ্নের শক্তি সহ্য করা সম্ভব না হওয়ায় একটার পর একটা প্রজেক্টের বাস্তবায়ন চলছে। ধারাবাহিক কার্যক্রমের মাধ্যমে নির্ভীকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্য অনেক, লক্ষ্যবস্তুও অনেক। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্যোগের ঘনঘটা।
শিক্ষা মানুষের সংস্কৃতিবোধকে জাগ্রত করে। স্বদেশ প্রেমকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বহুদিন আগেই আমরা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণ পরিচয়কে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছি। এই বাদের ফলে জীবনের খাতা থেকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে হারিয়ে ফেলেছি। এখন "বইয়ের পাতায় প্রদীপ জ্বলে/ বইয়ের পাতা স্বপ্ন বলে/ যে বই জুড়ে সূর্য উঠে/ পাতায় পাতায় গোলাপ ফোটে/ সে বই তুমি পড়বে।" এসব বই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ক্রমান্বয়ে দেশের সাধারণ শিক্ষাকে বিচিত্র এক সংস্কৃতি চর্চার দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। যে সংস্কৃতি চর্চার প্রতি মৌখিক বিরূপ কথা বলা হচ্ছে তার বিস্তারে শাসক শ্রেণির আগ্রহ সাধারণের বোধগম্যের বাইরে থেকে যাচ্ছে। সাধারণের কোনো চিৎকারই শাসকগোষ্ঠীর কান পর্যন্ত পৌঁছায় না বিজ্ঞানমনস্ক, দেশপ্রেমমূলক বাঙালি জাতীয়তাবোধসম্পন্ন শিক্ষার্থীর কথা প্রচার না করে ধর্মমনষ্ক শিক্ষার্থী তৈরি করতে শাসক শ্রেণি নিবেদিত। ক্ষমতার গরিমায় শাসক শ্রেণি নিজেদের অন্ধত্ব প্রকাশ করে চলেছে।
আমাদের দেশে শাসক শ্রেণি নিজেদের কথাই নিজেরা শুনতে পায়, মনে রাখে না। সব কথাই আগেকার সনদের উপর লিখে দেওয়া 'টু হুম ইট মে কনসার্ন' এর মতো। এখন যেখানে প্রয়োজন তা উচ্চারণ করেই দায়িত্ব শেষ করে রাখা। ক্ষমতার মসনদে বসলে একরকম কথা আর বাইরে থাকলে অন্যরকম কথা। বিশেষ ক্ষমতা আইন নিয়ে কতদিন কত কথা হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতায় বসলেই তখন আর অতীতের কথা মনে পড়ে না। বাতিলের কোনো ভাবনাই মাথার মধ্যে আসে না। প্রয়োগ করে কীভাবে ক্ষমতাকে নিরুপদ্রব রাখা যায় সেই চিন্তায় বিভোর হয়ে পড়ে। মানবাধিকার নিশ্চিত করায় কোনো দায় থাকে না। সব দায় গিয়ে পড়ে ক্ষমতার বাইরে থাকা মানুষদের ওপর। তারা সংগ্রাম করে, আন্দোলন করে, বাতিলের অঙ্গীকার করে, মানবাধিকার রক্ষায় সোচ্চার হয় কিন্তু মসনদে বসলে সব ভুলে আইনের প্রয়োগ করতে থাকে। দেশের সিংহভাগ মানুষ ৭২-এর সংবিধানে ফেরত যেতে চায়। সবাই চায় কিন্তু সংবিধানে ফেরত যাওয়া হয় না। সংবিধান প্রণেতাদের সুযোগ থাকার পরও ৭২-এর সংবিধানে ফেরত যাওয়া হয় না। সংবিধানের কপালে বিসমিল্লাহ এবং বুকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নিয়ে 'ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র' হিসেবে বেঁচে আছে। দেশে গুম, এনকাউন্টার, ক্রসফায়ার ইত্যাদির যে সংস্কৃতি চলমান তারও একই অবস্থা। একই গল্প একইভাবে সবাই বলে চলে। বাতিল করার জন্য বা রক্ষা করার জন্য সব একই পীড়নের জন্য পার্থক্য কিছু থাকে না। এই এক জায়গায় প্রচণ্ড মিল। বর্তমানের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যে পুরানো পথে হাঁটবে তা নিশ্চিত করে বলা যায়। যারা আজ আইন করে পীড়নের পথ ধরেছে তারাই ক্ষমতার বাইরে বাতিলের আন্দোলন সংগ্রাম করবে।
সাধারণ জনগণ আমাদের রাজনীতিকদের নিজেদের ওপর বিশ্বাসের বহর দেখে মুক্তচিন্তা চর্চার পরিবেশ নিয়ে শংকিত হয়। নিজেরা চেয়ারে বসলে এক চিন্তা আর চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেই ভাবনার পরিবর্তন হয়ে যায়। এখন তো আর অ্যানালগের যুগ নয়। এটা হলো ডিজিটাল যুগ। একবার মুখ থেকে কোনো কথা বের হয়ে গেলে তা ইথারের কোনো না কোনো জায়গায় থেকে যায়। এ কথা দায়িত্বপ্রাপ্তরা মনে রাখতে চায় না। ক্ষমতার জোরে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। একবার বলে প্রাকৃতিক গ্যাস রফতানি করলে জীবন দিয়ে দেব আবার বলে মাটির নিচে প্রাকৃতিক গ্যাস জমা করে রেখে লাভ কী? কোনটা যে মনের কথা বোঝা দায়! একবার বলে সিন্ডিকেট ভেঙ্গে ফেলার কথা আবার বলে বেশি ঘাটাঘাটি করলে বাজার থেকে পেঁয়াজই উধাও হয়ে যাবে। বাজারে পেঁয়াজ ২৬০ টাকা কেজি আর সাধারণ জনগণকে বলা হচ্ছে পেঁয়াজের বাজার যেটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল, সেটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ডিজিটাল এ যুগে সাধারণ জনগণকে বোকা ভাবার কী দারুণ প্রতিযোগিতা?
দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য মুক্তবুদ্ধির চর্চার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করে প্রবলভাবে এগিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ লক্ষণীয়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে রাজধানী সর্বত্র 'আমি'র তাণ্ডব চলমান। 'আমি'র মধ্যে দেশপ্রেম, 'আমি'র মধ্যে মানবপ্রেম। বিশেষ কোনো পরিবেশ আমাদের সামনে এসে পড়লেও তার মধ্যে 'আমি'র গুরুত্ব অনেক অনেক বেশিই থাকে। দেশে কয়লার ব্যবহার দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। প্রতি বছর এই কয়লার চাহিদা পূরণের জন্য কয়লা আমদানি করতে হয়। অথচ দেশের উন্নত মানের কয়লা না তুলে আগামী প্রজন্মের জন্য জমা করে রাখা হয়েছে। পরিবেশ বিবেচনায় কয়লার ব্যবহার এখনই প্রশ্নের মুখে আর আগামী প্রজন্মতে কী অবস্থা হবে তা অনুমান করেও শাসকশ্রেণি কয়লাকে রেখে দিয়েছে। দেশে কয়লা তোলার পদ্ধতি নিয়ে একটা বিতর্ক আছে। যুক্তি দিয়ে সেই বিতর্কের শেষ করার চাইতে ট্রেডিং ব্যবসায় অনেক অনেক লাভ বিবেচনায় দেশের উন্নতমানের কয়লা রেখে দিয়ে বিদেশ থেকে নিম্নমানের কয়লা ক্রয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
মধ্যযুগের একটা গান আছে "আপন আপন করে তুই হারালি তোর যা ছিল আপন" রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের ওপর নিবিড় বিশ্বাস চিন্তার স্বাধীনতায় মুক্তবুদ্ধির চর্চার প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপন লোকের ভিড়ে দুর্নীতির আকর সৃষ্টি হয়েছে। ব্যক্তিস্বার্থে মানুষ ক্ষমতাকে ব্যবহার করে আমি'র জয়গান করে চলেছে। এই জয়গানের মধ্যে উন্নয়ন ও অগ্রগতি চলছে। যেখানে লোকসানের অজুহাতে পাটকলগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, স্টিলমিল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, চিনিকলগুলো বন্ধের পাঁয়তারা চলছে। দুর্নীতিকে সহনীয় পর্যায়ে রাখা যাচ্ছে না। বিদেশে অর্থ পাচার বন্ধ করা যাচ্ছে না। অনিয়মগুলো রুখতে পারা যাচ্ছে না। শেয়ার বাজার ও ব্যাংক লুটেরাদের শাস্তি দেওয়া যাচ্ছে না। শুক্তির ভিত্তিতে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার কারণে ব্যর্থতার চিত্রটা এমন। সত্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টির জন্য মুক্তবুদ্ধির চর্চা অবারিত হওয়া প্রয়োজন। দেশের সহজ সরল জনগণকে পুঁজি করে স্বার্থপর ক্ষুদ্র গোষ্ঠীভিত্তিক চিন্তা চেতনা পরিহার করে সংস্কারের দাসত্ব স্বীকার করে নতুন প্রাণের প্রেরণা সৃষ্টিতে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।