Published : 27 Dec 2020, 02:14 AM
সম্প্রতি দেশের ৪২জন বিশিষ্ট নাগরিক নির্বাচন কমিশনের গুরুতর অসদাচরণের এবং আর্থিক অনিয়মের উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বরাবরে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন। অভিযোগপত্রে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ এর অধীনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে তদন্ত করে দোষী নির্বাচন কমিশনারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করা হয়েছে। এ ধরনের চিঠি তারা প্রধানমন্ত্রীকেও দেবেন বলে জানিয়েছেন।
এ অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী বক্তব্য রেখেছেন। দেশের বিশিষ্ট আইনজ্ঞ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছেন এবং সবশেষে সিইসি নুরুল হুদা সাহেব সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ খণ্ডনের নিমিত্তে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। এই সবকিছু মিলেই বিষয়টি বেশ গুরুত্ব বহন করছে।
স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে কী ছিল রাষ্ট্রপতি বরাবরে সুধীজনদের লিখিত অভিযোগ পত্রে?
রাষ্ট্রপতি বরাবরে লিখিত অভিযোগে যেসব প্রধান প্রধান আর্থিক অনিয়মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা হল,
১.নির্বাচন কমিশনারদের বিশেষ বক্তা হিসেবে ২কোটি টাকা গ্রহণ ।
২. নিয়োগের নামে ৪ কোটি ৮ লাখ টাকার দুর্নীতি।
৩. নিয়মবহির্ভূত ৩টি করে গাড়ি ব্যবহার।
৪. ইভিএম ক্রয়ের ক্ষেত্রে অনিয়ম।
আর প্রধান অসদাচরণ সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে– একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের গুরুতর অনিয়ম ও অসদাচরণের কথা। উল্লেখ করা হয়েছে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে, খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে, সিলেট –বরিশাল– রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অসদাচরণের কথা।
মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রে যারা স্বাক্ষর করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন এমিরেটস অধ্যাপক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একাধিক উপদেষ্টা, শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ, মানবাধিকার কর্মী, স্থপতি, আইনজীবী, শিল্পী, সাবেক সচিবসহ অনেক ব্যক্তিত্ব।
অভিযোগ দাখিলের পর তারা ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনও করেছেন। পত্রিকা মারফতে জানলাম সেই সম্মেলনে বলা হয়েছে যে, নির্বাচন কমিশনারদের আর্থিক অনিয়ম ও অসদাচরণের কারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল এর সুপারিশ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি তাদের পদ থেকে অপসারণ করবেন বলে তারা আশা করছেন। তারা আরো বলেছেন, "এখন আর নির্বাচন হয় না, নির্বাচন নির্বাচন খেলা হয়"।
জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনের অসদাচরণের কথা এবারই প্রথম নয়। এর আগেও বহুবার এসেছে। যখন যে দল হেরেছে তারাই বলেছে। তবে ইসি কর্তৃক ব্যাপক আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ এমনভাবে আগে এসেছে কিনা মনে পড়ে না।
অভিযোগকারীদের সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য "এখন আর নির্বাচন হয় না নির্বাচন নির্বাচন খেলা হয়"- এর প্রেক্ষিতে বলা যেতে পারে, এর জন্য দায়ী কে?
যতদূর মনে পরে বর্তমান নির্বাচন কমিশন (এ কে এম নুরুল হুদা কমিশন) এর পূর্বসূরী কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদ কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহতার প্রতীক হিসাবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিল। বর্তমান কমিশনের মত রকিব কমিশন একই পদ্ধতিতে ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতির নিয়োগ পেয়েছিল। রকিব কমিশনের বিরুদ্ধে বড় অপবাদ উত্থাপিত হয়েছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে নিয়ে। প্রধান বিরোধীদল বিএনপি- জামাত জোট ছাড়া সে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তৈরি হয়েছিল বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় অধিক সংখ্যক সংসদ সদস্য নির্বাচনের বিশ্ব রেকর্ড। সেই নির্বাচন হয়েছিল প্রায় ভোটারবিহীন।
পত্র–পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী- নির্বাচন কমিশন তাই করেছিল, যা সরকার চেয়েছিল। ফলে 'জাতীয় নির্বাচন সম্পর্কে দেশের মানুষের বিশ্বাসের অপমৃত্যু' ঘটেছিল। মোটকথা তখনকার জনমত অনুযায়ী, বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়ে গিয়েছিল রকিব কমিশন। নির্বাচন কমিশন সরকারের তাবেদারী হবে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের চাহিদা অনুযায়ী কাজ করবে-মানুষের মধ্যে এমন বিশ্বাসের জন্ম দিয়ে গিয়েছিলেন তারা।
সেই কমিশনের বিলুপ্তিক্ষণে বিদায়ী সিইসি কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, "নতুন নির্বাচন কমিশন তাদের মতোই হবে এবং তাদের মতোই কাজ করবে।" সে সময় আমাদের এক বন্ধু কলামনিস্ট তার কলামে যা লিখেছিলেন তার মর্মার্থ এমন যে–
রকিব সাহেবের প্রত্যাশা, সরকার তাকে যা বলেছিল তিনি তাই করেছিলেন এবং নতুন সিইসিও তাই করবেন। তিনি ভোটারবিহীন নির্বাচন আয়োজন করেছিলেন। ৫% ভোটকে ৪০% করে দেখেছিলেন। নতুন সিইসিও তাই দেখাবেন। তিনি নির্বাচন আয়োজন করে বিনোদন ভ্রমণে চলে গিয়েছিলেন নতুন সিইসিও তাই যাবেন।
সেই সময়ে রাকিব সাহেবের সেই কথার জবাবে নতুন সিইসি এ কে এম নুরুল হুদা প্রথম সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তিনি নতুন ইসির প্রতি মানুষের আস্থা তৈরি ভিত্তি স্থাপন করবেন। তিনি তার কমিশনকে নিরপেক্ষ রাখবেন। সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অর্থবহ করবেন। উৎসবমুখর নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করবেন। তিনি দৃঢ়ভাবে উল্লেখ করেছিলেন যে 'আমরা যে কোনো প্রভাব হস্তক্ষেপ কঠোরভাবে মোকাবেলা করবো,আইন–বিধি বাইরে কোনো কিছুকেই প্রশ্রয় দেবো না'।
তার এই কথা শুনে 'তাই যেন হয় সিইসি' শিরোনামের একটি লেখায় আমি তাকে সাধুবাদ জানিয়ে ছিলাম।
পরবর্তীতে আমাদের আশা–আকাঙ্ক্ষা এবং বিদায়ী সিইসি রকিব সাহেবের ভবিষ্যৎবাণীর মধ্যে কোনটি প্রতিফলিত হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রাসঙ্গিক হলেও সেসব পুরনো কথা। আবার বর্তমান ইসির বিরুদ্ধে অভিযোগের কথায় ফিরি।
নির্বাচন কমিশন বা ইসি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতি বরাবর অভিযোগ দাখিল এবং সংবাদ সম্মেলনের পর সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রী জনাব ওবায়দুল কাদের বলেছেন, "বিএনপি নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে। তারা নানা অনিয়ম অসদাচরণের অভিযোগ এনে মূলত নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কিত করতে চায়। তাদের এ অপচেষ্টাও হালে পানি পাবে না'।
'নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার এই অপকৌশল এরইমধ্যে মরচে ধরে গেছে ভোঁতা হয়ে গেছে' বলেও তিনি মন্তব্য করেন, যা পত্র পত্রিকায় ফলাওকরে প্রচারিত হয়েছে।
সরকারি দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রীর বক্তব্য দেশবাসির কাছে যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। তবে খটকা লাগল এখানেই যে, অভিযোগপত্রে যারা স্বাক্ষর করেছেন তাদের সিংহভাগই রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ ব্যক্তিত্ব বলে পরিচিত। কেউ কেউ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও থাকতে পারেন ।তবে এ ক্ষেত্রে তা কি খুব বেশি গুরুত্ব বহন করে?
ওদিকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে তদন্ত করে দোষী নির্বাচন কমিশনারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতিকে যে অনুরোধ করা হয়েছে সে বিষয়ে রাষ্ট্রপতির তরফ থেকে এখনো কিছু বলা না হলেও দেশের আইনজ্ঞদের মধ্যে শুরু হয়ে গেছে বিতর্ক। মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছেন দুইপক্ষ। এক পক্ষ বলছেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল এর এখন অস্তিত্বই নেই। ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে এর বিলুপ্তি করে অন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। আবার অন্যপক্ষ বলছেন, অস্তিত্ব আছে। আপিল বিভাগের রায়ে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থাকে পুনর্বহাল করা হয়েছে।
সবশেষে সংবাদ সম্মেলনে সিইসি উল্লেখ করেন যে, তাদের বিরুদ্ধে প্রশিক্ষণ ব্যয়ের, আর্থিক অনিয়মের ও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির এবং বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহারের যে অভিযোগ করা হয়েছে তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ভিত্তিহীন। জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে অসদাচরণের যে অভিযোগ আনা হয়েছে তাও অসত্য। তিনি আরো বলেন, নির্বাচনের প্রতি মানুষের আস্থা আছে। তাদের সময়কার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তুমুল প্রতিদ্বন্দিতামূলক। সে নির্বাচনে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ভোট পড়েছে। সবশেষে তিনি এও বলেন যে, বিশিষ্টজনদের অভিযোগ ভিত্তিহীন ও বিবেচনাপ্রসূত নয়।
অভিযোগ, বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্য, সংবাদ সন্মেলন-পাল্টা সংবাদ সন্মেলন-সে যাই হোক বলার অপেক্ষা রাখেনা নির্বাচন কমিশনাররা রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। তারা সাংবিধানিক পদধারী। তাদের সম্মান যেমন একাধারে রাষ্ট্রের সম্মান। তেমনি অন্যভাবে দেখলে বলতে হবে তারা যদি তাদের উপর অর্পিত পবিত্র দায়িত্বের অপব্যবহার করেন, পদবীর অবমাননা করেন- তবে রাষ্ট্রের নৈতিকতার ভিত নড়ে যেতে পারে।
আবার এটাও তো সত্য যে, দেশের রাষ্ট্রপতি/প্রধানমন্ত্রী দল–মত নির্বিশেষে সকলের জন্য ভরসার স্থল। ইসি সম্পর্কে যখন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা অভিযোগ করেন- তখন ধারণা করা যেতে পারে, এটি হাওয়া থেকে আসেনি। তাদের অভিযোগ বিশেষ করে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ বিশদভাবে খতিয়ে দেখা উচিত এবং ফলাফল দেশবাসীর কাছে উন্মোচন করা উচিত। নির্বাচন কমিশনের সম্মান যেমন দেশের সম্মান, তেমনি তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী ৪২জন বিশিষ্ট নাগরিকের সম্মানকেও খাটো করে দেখার উপায় নেই।
জাতীয় নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের আর্থিক অনিয়ম ও নির্বাচন–অনুষ্ঠানের অসদাচরণের বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখা হবে। খতিয়ে দেখা হবে এর যথেষ্ট সত্যতা রয়েছে কিনা নাকি শুধু অভিযোগের জন্য এই অভিযোগ। সত্যতা প্রমাণ হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ আর তা না হলে যারা তাদের কলঙ্কিত করার 'অপকৌশল' অবলম্বন করেছেন তাদেরও ছাড় দেওয়ার উপায় নেই– এটাই প্রত্যাশা।