Published : 18 Nov 2020, 02:59 AM
কয়েকদিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কুশল বরণ চক্রবর্তীকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে হত্যার হুমকি দিয়েছে মৌলবাদী গোষ্ঠী। খুব কাছাকাছি সময়ে একাত্তর টেলিভিশন বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন তারা। বেশ কয়েকদিন ধরে দলবল নিয়ে বেশ দাপিয়ে বেড়ানোর পর লালমনিরহাটের পাটগ্রামে একজন আপদমস্তক ভদ্রলোককে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার মত নৃশংতা করে কিছুদিন তারা খানিকটা চুপসে গিয়েছিলেন।
তাদের চুপসে থাকাটা আপাততই, তারা চুপ থাকবেন না, যেকোনও মুহূর্তে জেহাদি জোসে জেগে উঠবেন, সে সন্দেহ ছিলই। সাকিব আল হাসানকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাইভে এসে ধারালো অস্ত্র নিয়ে হত্যার হুমকি দেওয়ার পর সেটি আবার পরিষ্কার হলো।
গত ১৫ বছরের ইতিহাস ঠিক এই ধারাবহিকতাতেই চলছে। বাংলাদেশে শান্তি আছে বা ছিল এই ধারণা যেন কেউ না করতে পারে, সে দায়িত্বটি তারা খুব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছেন। কাজটি করতে গিয়ে এই এরাই কখনো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষককে হত্যার হুমকি দিচ্ছেন, কখনো মুক্তবুদ্ধি চর্চার গণমাধ্যম বয়কট করতে বলছেন, আবার কখনো কোরান অবমাননার ধোঁয়া তুলে, ভদ্রলোক পিটিয়ে হত্যা করছেন। শিক্ষক থেকে খেলোয়াড়, বেকার তরুণ-কিশোর থেকে এমনকি মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিও এদের রোষানল থেকে বাঁচতে পারছেন না।
এই যে কুশল বরণ চক্রবর্তীকে হত্যার হুমকি দেওয়ার সময় তারা বলেছে, বাংলাদেশকে আবারো পাকিস্তান বানাতে চান। এটাই মূল কথা। এর সঙ্গে আর যাই হোক ইসলাম রক্ষার কোনও সম্পর্ক নেই। অথচ এই এক কথা ও এক পথে সব মৌলবাদী একাত্ম হচ্ছেন। পাঠক, আমার কথা মিলিয়ে দেখুন, এরা সবাই ইসলাম রক্ষার কথা বার বার সামনে আনেন। তার পর একটু একটু করে নৃশংস হন। একদিন দেশ নাড়িয়ে দেওয়ার মত নাশকতা করে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেন।
প্রমাণিত সত্য হচ্ছে, উগ্র মৌলবাদীরা আসলে শান্তির বাংলাদেশ দেখতে চান না। তা সে কুশলের হত্যার হুমকিদাতাই হোক আর হলি আর্টিজানের হামলাকারীই হোক কিংবা লালমনিরহাটের জুয়েলের মরদেহ পোড়ানের সঙ্গে জড়িতরাই হোক। এরা মূলত সবাই একদলে। আমি যতটুকু ইসলাম জানি, সেখান থেকে বলতে পারি তাদের কোন কাজে মহানবীর আদর্শ নেই। পাটগ্রামে জুয়েলের হত্যার পর বোধ করি, সেই সত্য খুব সাধরণ মানুষের মধ্যেও দৃঢ় হয়েছে।
আপাতত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, উগ্রবাদের সামনে বুঝি অসহায় সম্প্রীতির বাংলাদেশ। 'আপাতদৃষ্টিতে' বললাম কারণ, আমি মনে করি বাংলাদেশ মোটেও অসহায় নয়। এটা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। আজকের এই পরিস্থিতি অন্য কোনও উদ্দেশ্যে বানানো, সেটা নেহায়েত কৃত্তিম। সত্যবাদের সঙ্গে সেই কৃত্তিমতার ন্যূনতম সম্পর্ক নেই।
একটা গল্প মনে করিয়ে দিলেই পাঠকের সামনে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লার লালসালুর কথা মনে আছে! সেই যে, দেশের শস্যহীন একটা এলাকা থেকে মজিদ নামের এক লোক আসলো গ্রামে। তারপর একটা অখ্যাত কবরের ওপর লালুসালু টাঙিয়ে দিল, বিখ্যাত পীরের মাজার হিসেবে। তারপর ধর্মের দোহাই দিয়ে গ্রামের মানুষের ওপর প্রভাব বিস্তার করলো।
ধর্মের প্রভাবেই অর্থনৈতিক ভীত শক্ত হলো মজিদের। বিয়ে করলো একটা অল্পবয়সী মেয়েকে। তার পরেও চেয়ে থাকলো হাসুনির মায়ের নগ্ন বাহুর দিকে। কেউ এর প্রতিবাদ করতে এলে ধর্মের অস্ত্রে তাকে বধ করলো। অসহায় হলো পুরো গ্রামের মানুষ। কিন্তু লালসালুর পরতে পরতে ওয়ালীউল্লাহ বুঝিয়ে দিলেন কীভাবে সত্যবাদের ওপর মিথ্যার পরত চড়ায় মৌলবাদী মজিদ।
একইভাবে বাংলাদেশের ওপর উগ্রবাদের পরত দিচ্ছে একটি শ্রেণি। যেকারণে পুরো দেশটাকে অসহায় মনে হচ্ছে। এর যে যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই, তা নয়। যেমন ধরুন, একরকম প্রকাশ্যেই, গত ১৫ বছর ধরে জঙ্গিবাদের ভয়ে সিটিয়ে আছে বহু সম্ভাবনা। বহু শতবর্ষী মিলন মেলা বন্ধ। একের পর এক বন্ধ হয়ে গেছে সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র। সিনেমা হল। এই অসহায়ত্ব দুর্বল করে দিচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যকেও। কারণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূলভিত্তিই ছিল মুক্তবুদ্ধির চর্চা। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই যে, এটি চিরসত্য নয়।
এখন জাতির সামনে কোটি টাকার প্রশ্ন আমরা কী মৌলবাদের ভয়ে আটকে থাকবো? এতে সাধারণ মানুষের কী লাভ? আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, কোন লাভই নেই। বলতে চাই এতে জয়ী হবে উগ্রবাদ। আবারো যদি কুশল চক্রবর্তীর কাছে ফিরি তাহলে কী দেখবো? দেখবো তাকে হুমকি দেওয়া হয়েছে সৈয়দ শাহজাদা নামের একটা ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে। আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, এই নামের প্রকৃত কেউ হুমকি দিচ্ছে না। এটি নিঃসন্দেহে একটি ফেইক অ্যাকাউন্ট। এই হুমকিদাতারা কখনো সত্যের সামনে আসে না। ষড়যন্ত্র, হামলা- যা করার পেছন থেকে করে। আততায়ী বলা যায়।
অন্যভাবে বললে বলা যায়, মৌলবাদ শান্তিপ্রিয় মানুষের একটি অজানা বিপদের নাম। যেটা সামনে থেকে আসে না। তাই একে ভয় পেয়ে সুবিধা হবে না। প্রতিদিন এরকম নানা অজানা বিপদের আশঙ্কা নিয়েই আমরা ঘুরি। যদি ভাবি মৌলবাদ আমাদের সেরকম আরেকটি ভয়, তাহলে অজানা বিপদের তালিকাটা একটু বাড়ে। কিন্তু মনে খানিকটা জোর পাওয়া যায়। যেকোনও বিপদ মোকাবেলার প্রস্তুতি নেওয়া যায়। পাঠক ভাবুন, সড়ক দুর্ঘটনার মত বিপদের বিপক্ষেও তো মানুষ একাত্ম হয়ে লড়ছে। একই সূত্রেতো উগ্রবাদের বিপক্ষেও একাত্ম হওয়া যায়!
সন্দেহ নেই, দেশে অশান্তির বিষ ছড়াচ্ছে মৌলবাদ। তাই প্রশ্ন হচ্ছে, একদিকে ২০ কোটি মানুষ অন্যদিকে গুটিকয় মিথ্যাবাদী। কে থাকবে? সত্যবাদের সামনে নানা সম্ভাবনা চকচক করছে। যেমন ধরুন, নদী বিধৌত পলিমাটিতে বেড়ে এই সব মানুষের উগ্র হয়ে ওঠার সুযোগ নেই। তার ইতিহাস বলছে হাজারো ত্যাগের পরেও সে শান্তিপ্রিয়। চাইলেও তার শেকড় তাকে উগ্র হতে দেবে না। শুধু ভয় কাটিয়ে একাত্ম হলেই নিশ্চিহ্ন হবে উগ্রবাদ।