Published : 16 Nov 2020, 01:27 PM
করোনাভাইরাস মহামারীর সময়ে এসে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার অদক্ষতা ও বেহাল দশা প্রকটভাবে ধরা পড়েছে। প্রকৃতপক্ষে করোনাপূর্বকাল থেকে জনগণের চিকিৎসা সেবা নিয়ে হাহাকার ও ব্যাপক অসন্তোষ ছিল। ভুক্তভোগী মানুষের কাছে মনে হচ্ছে বা প্রতীয়মান করে তোলা হয়েছে- স্বাস্থ্যখাতে লাগামহীন দুর্নীতি, ডাক্তারদের আমনবিক আচরণ, চিকিৎসাকে ব্যবসায় পরিণত করা এর মূল কারণ।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ব্যয় নিজের পকেট থেকে মেটাতে গিয়ে প্রতি বছর ৫২ লাখ মানুষ তলিয়ে যাচ্ছে দারিদ্র্যের অতলে। বর্তমানে স্বাস্থ্যখাতের মোট ব্যয়ের ৬৭ শতাংশ ব্যক্তি নিজের পকেট থেকে (OOP) বহন করে। এই উচ্চ OOP ব্যয় চিকিৎসাসেবা পাওয়ার সুযোগ সীমিত করছে, সেবা প্রাপ্তিতে ব্যাপক অসমতা তৈরি করছে। জনগণ ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়ছে। গরু, ছাগল, জমি-জমা বিক্রি করে চিকিৎসা খরচ মেটাচ্ছে। আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য ওয়ার্ল্ড হেলথ রিপোর্ট ২০১০-এর পরামর্শ মতে ওওপি ব্যয় ২০ শতাংশের সীমায় থাকতে হবে। বাংলাদেশে ব্যয় তিনগুণ বেশি।
গত ৪৯ বছরে বাংলাদেশে বাজেটে স্বাস্থ্যখাতের জন্য বরাদ্দ রয়েছে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি'র ১ শতাংশেরও কম যা পৃথিবীর সবগুলো দেশের মধ্যে নিম্নতমদের একটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাদের মতো একটা দেশের স্বাস্থ্যখাতে জিডিপির অন্তত ৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখার সুপারিশ করে। এই সংস্থার মতে একটি দেশের স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ হওয়া উচিত। স্বাস্থ্যখাতে এবারের বরাদ্দ মোট বাজেটের আকারের তুলনায় মাত্র ৫ দশমিক ১ শতাংশ। সেই স্বাস্থ্য বাজেটের অনুন্নয়ন ব্যয় ৬০ শতাংশের ওপর হওয়ায় প্রকৃতপক্ষে রোগীর সেবার জন্য বরাদ্দ খুবই কম। ২০২০-২১ অর্থ বছরে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ২৯২৪৭ কোটি টাকা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুসরণ করলে এ বছরের বাজেটে (জিডিপির অনুপাতে) স্বাস্থ্যখাতে যে বরাদ্দ পাওয়ার কথা তার থেকে এক লাখ ২৯ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা কম বরাদ্দ। এই করোনাকালেও স্বাস্থ্যখাত অগ্রাধিকার পায়নি। বছরের পর বছর অপর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দের কারণে সরকারি স্বাস্থ্যখাতের এই বেহাল দশা, ভঙ্গুর অবস্থা। সরকারি হাসপাতালের কথা বলতেই চোখে ভেসে ওঠে, ময়লা-আবর্জনা, দুর্গন্ধময় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, জনভোগান্তি, দালাল-হকারদের দৌরাত্ম্য ইত্যাদি নিয়ে এক মানবিক অসহায়তার করুন দৃশ্য। নাই ঔষধ, নাই চিকিৎসা সামগ্রী, নাই পরীক্ষা সুবিধা। সেখানেও সেবা নিতে গেলে দুই-তৃতীয়াংশ খরচ হয় নিজের পকেট থেকে। এই শূন্যস্থানে গড়ে উঠেছে মানহীন, অনিয়ন্ত্রিত বিশাল একটি বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা।
বাংলাদেশের এখনও (২০১৭ সালে) মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় ৩৬ মার্কিন ডলার যা প্রতিবেশী দেশগুলির তুলনায় সবচেয়ে কম। এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রস্তাবিত মাত্রা ৮৫-১১২ ডলারের এক তৃতীয়াংশ। মাথাপিছু স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় এবং এতে সরকারের অংশীদারিত্ব হলো যে কোন দেশের পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থার টেকসই আর্থিক ব্যবস্থাপনার দৃঢ় সূচক। ২০১২ সালে গৃহীত স্বাস্থসেবা অর্থায়ন কৌশলপত্রে ২০৩২ সালের মধ্যে এই মাথাপিছু ব্যয়ে ব্যক্তির নিজস্ব ৬৭ শতাংশ ব্যয় কমিয়ে ৩২ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। গত আট বছরে স্বাস্থ্যখাতে সরকারি বিনিয়োগ সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের পথে না এগিয়ে উল্টোমুখে হাঁটা দিয়েছে।
ধারাবাহিক চিত্তাকর্ষক তথ্যে, 'স্বাস্থ্য খাত দুর্নীতির খনি এবং মন্ত্রণালয় বাজেট বরাদ্দ বাস্তবায়নে অক্ষম' তকমায় ভূষিত হয়েছে। সরকারি সংস্থার প্রতিটি অর্থের জবাবদিহিতা নিশ্চত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি কোথায়? দুর্নীতি দমনে অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সংস্থার ভূমিকা কী? রাষ্ট্রের প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতির উৎসব চলছে যা ধ্বংস করতে হবে। বাজেট বাস্তবায়নে দুর্নীতি ও অদক্ষতা কি একা স্বাস্থ্যখাতের জিনে প্রোথিত আছে? গত কয়েক আর্থিক বছরে দেখা গেছে, স্বাস্থ্য বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ অব্যবহৃত রয়েছে। এটি কী বাজেট প্রণয়নে দায়সারা ভাবের জন্য না বাস্তবায়নে অদক্ষতার জন্য? অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে ঘাটতি বাজেট সমন্বয় করার কৌশল!
বাজেট বাস্তবায়নে অদক্ষতা আরোপিত বাজেটের প্রণয়নের দুর্বলতার সাথে জোরালোভাবে সম্পর্কিত। বার্ষিক স্বাস্থ্য বাজেটের সাথে জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি, স্বাস্থ্যসেবা অর্থায়ন কৌশলপত্র (২০১২-৩২) এবং বাংলাদেশের স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত উন্নয়ন কর্মসূচি (২০১৬-২১)-র গুরুতর সমন্বয়হীনতা রয়েছে। আমাদের বাজেট তৈরি হয় কঠোর ইনপুট-কেন্দ্রিক, সেবা প্রদান বা ফলাফলকে বিবেচনায় রাখা হয় না। আরোপিত বাজেটে স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয় না। কমিউনিটিকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াতে সম্পৃক্ত করা জরুরি। সুনির্দিষ্ট ও দ্রুত তথ্যের উপর ভিত্তি করে নির্মোহ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আমাদের একটি জাতীয় বৃহদায়তন ও সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা ডেটা বেইজ (অটোমেশন) তৈরি করতে হবে। স্বাস্থ্য পরিকল্পনাকারী ও ব্যবস্থাপকদের বাজেট প্রণয়নের অতিশয় বৃহৎ প্রক্রিয়ার নীতিমালা অনুধাবনে এবং বাজেট গঠন, তদারকি ও বাস্তবায়নের কর্মকৌশলে দক্ষ করে তৈরি করা অপরিহার্য। বাজেটে অর্থ ছাড় সহজ করা এবং সময়সীমা থাকা উচিত। স্বাস্থ্য বাজেট বাস্তবায়নে অন্তঃমন্ত্রণালয় এবং আন্তঃমন্ত্রণালয়ে অনেক চিহ্নিত ও অজ্ঞাত বাধা রয়েছে যেগুলি দূর করতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুই অধিদপ্তরের কাজের ওভারল্যাপিং বাজেটের অপচয় ও বাস্তবায়নে সংকট তৈরি করছে। অবশ্যই বাজেটের সদ্ব্যবহার ও বাস্তবায়নের অদক্ষতা দূর করতে হবে। তবে বিশ্ব ব্যাংকের মূল্যায়ন বলছে বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ এতটাই কম যে দক্ষতা বৃদ্ধিতে খুব একটা হেরফের ঘটবে না।
আরেকটি গুরুত্বপূ্র্ণ বিষয় হচ্ছে স্থানীয়ভাবে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রেগুলির আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে প্রতিটা সরকারি প্রতিষ্ঠানকে স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত অর্থ সরকারি ট্রেজারিতে জমা করতে হয়। সেটা ল্যাব টেস্ট, অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া বা অন্য কোন ব্যবহারকারীর ফি হতে পারে। সরকারি আর্থিক ব্যাবস্থাপনার নীতি পরিবর্তন করে স্থানীয়ভাবে সংগৃহিত অর্থ স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ব্যবহারের অধিকার দিতে হবে। সেবা প্রদানকারীদের আর্থিক, জনবল পরিচালনায় ও সেবা প্রদানে স্বাধীনতা/স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। একই সাথে অর্থ ব্যয় ও পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা সৃষ্টি পূর্বশর্ত। এটা সেবা প্রদানকারীদের মধ্যে দায়িত্ববোধ তৈরি করবে ও প্রতিষ্ঠানে দক্ষতা ও সেবার মান উন্নত হবে।
স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে জনগণকে আর্থিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার জাতীয় কৌশল কী হবে? চিকিৎসা নিতে জনগণের আর্থিক ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য বীমা ও অনান্য আর্থিক ব্যবস্থাপনার স্বরূপ কেমন হবে? স্বাস্থ্যসেবায় স্বচ্ছতা স্থাপন না করে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিদ্যমান দুর্বল অবকাঠামোয় স্বাস্থ্য বীমা কাজ করবে না। আর আমাদের সামনে তো উদাহরণ আছে, পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যাপক ও প্রবল বীমা ব্যবস্থা থাকা স্বত্বেও (যুক্তরাষ্ট্র) কোটি মানুষকে চিকিৎসা সুযোগের মধ্যে আনতে পারছে না। শক্তিশালী সরকারি স্বাস্থ্য বাজেট সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী স্বাস্থ্য বাজেট জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ করতে বাধা কোথায়? আমরা কোন পথে এগিয়ে গেলে জিডিপির ৫ শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ করতে পারব?
স্বাস্থ্যখাতে কাঙ্ক্ষিত বাজেট বৃদ্ধি করতে পারলে, তার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে শক্তিশালী প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো। যা সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রশস্ত পথ তৈরি করবে। স্বাস্থ্যসেবায় আনবে শৃংখলা, গড়ে দেবে সুশৃংখল রেফারেল পদ্ধতি। হাহাকার ও অসন্তোষ কমিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণের জায়গা করে দেবে।
এটি এখন স্পষ্ট যে, উপেক্ষিত ও অপ্রতুল বাজেট বরাদ্দের স্বাস্থ্য খাতকে উন্নত মানসম্পন্ন ও নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে সক্ষম করে তুলতে সর্বাগ্রে প্রয়োজন ব্যাপক স্বাস্থ্য বাজেট বৃদ্ধি। এই অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রয়োজন সুউচ্চ রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও দৃঢ় নেতৃত্ব।