Published : 09 Nov 2020, 01:09 PM
"৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমেই বাংলাদেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছিল। যে জাতীয়-আন্তর্জাতিক কারণে ৩ নভেম্বরে স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করা হয়েছিল, সেই চক্রান্তকে ব্যর্থ করে দিয়ে এদেশের দেশপ্রেমিক সিপাহী এবং জনগণ ৭ নভেম্বরে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে দেশে সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতাকে সুসংহত করেন। একই সঙ্গে গণতন্ত্রের যে পথ, সেই পথের নতুন সূচনা করেন।"
কথাগুলো কে বলতে পারে বলে মনে হয় আপনার? বিএনপি নেতাদের ভেতর সবচেয়ে মিষ্টিভাষী পরিমিত মির্জা ফখরুল। জ্বী, তিনি বলেছেন এ কথা। বিএনপি তাদের স্বভাবসুলভ কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক। আমাদের আপত্তি আছে এক জায়গায়। এদেশ স্বাধীন হয়েছে আজ ৪৯ বছর। আগামী বছর জাতি সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করার আশায় বুক বেঁধে আছে। এই স্বাধীনতা এমনি এমনি আসেনি। দেশের ইতিহাস বা অতীত নিয়ে যারা একবিন্দুও জানেন তাদের অজানা নয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল কতটা ত্যাগ আর সংগ্রামের। উপমহাদেশের বড় দুই দেশ- নিকটতম প্রতিবেশী ভারত আর একদা আমরা যাদের অংশ ছিলাম সেই পাকিস্তানের একটিও আমাদের মতো করে স্বাধীনতা লাভ করেনি। তাদের স্বাধীনতা এসেছিল চুক্তির মাধ্যমে। আমরা তেমন কোনো চুক্তির ভেতর দিয়ে স্বাধীন হইনি।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ একটি জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। এক কোটি মানুষ দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। আমি নিজে পরিবারসহ শরনার্থী ছিলাম। আমরা ব্যাংকার পিতা, স্নেহময়ী জননী আর দুই দিদির যে কষ্ট আর দুঃখ তেমন বা তার চেয়ে বেশি ত্যাগ আর কষ্ট করা কোটি কোটি বাঙালি কেন এসব মুখ বুঝে সহ্য করেছিল? প্রয়াত সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ নেতারা কেন এত পরিশ্রম করেছিলেন? কেন আমাদের জাতির জনক নয় মাস ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে? সবই কি দেশকে পরাধীন রাখার জন্য? বা দ্বিতীয়বার স্বাধীন হবার আশায়?
অথচ মির্জা ফখরুল ইসলাম অবলীলায় বলে দিলেন দ্বিতীয়বার দেশ স্বাধীন হয়েছিল ১৯৭৫ এর ৭ নভেম্বর। ফখরুল সাহেব নিশ্চয়ই জানেন কেন এবং কি ঘটেছিল সে দিন। আমরা যারা তখন যৌবনের দ্বারপ্রান্তে নিজের চোখে দেখেছি কতটা ভণ্ডামি আর কাপুরুষতায় ডুবে গিয়েছিল দেশ। সে সময়কার দ্য টাইমস ছিল দুনিয়ার সেরা ম্যাগাজিন। চালু ও জনপ্রিয়। তারা ঠাট্টা করে লিখেছিল, বাংলাদেশ নাকি দ্য ক্যু ক্যু ল্যান্ড। কথাটা ব্যঙ্গ করে বলা হলেও মিথ্যা ছিল না। কে যে কখন গদীতে আর কে যে খলনায়ক বোঝা যেত না। এই ফাঁকে বাংলাদেশ হয়ে গিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা শূন্য। ভালো করে বললে বলতে হবে বীর শূন্য। খালেদ মোশাররফ, কর্ণেল হুদা, বিগ্রেডিয়ার জামিলের মতো দেশপ্রেমিক বীরদের সরিয়ে দিয়ে রাস্তা সাফ করেছিল পাকিস্তানপ্রেমীরা। বঙ্গবন্ধুর খুনী আর ঘাতক দালালেরা মিলে এই দেশকে আওয়ামী শূন্য ও মুক্তিযুদ্ধ শূন্য করার অপচেষ্টা সার্থক করার দিনটিকে ফখরুল বলছেন দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবস।
সে সময়কালে জাসদ আর গণবাহিনীর ভূমিকাও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। কর্নেল তাহেরকে যারা হিরো করতে চান বা হিরো বানিয়ে উপন্যাস প্রবন্ধ লেখেন তারা কৌশলে কথাগুলো এড়িয়ে চলেন। কেউ একবারের জন্যও বুক ঠুকে বলতে পারেন না কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো মিথ্যা। একথা বহুল প্রচলিত যে, কর্নেল তাহের নাকি বঙ্গবন্ধুর লাশ বঙ্গোপসাগরে ফেলে দিতে বলেছিলেন। সে কথা মিথ্যা এমন কোনো কঠিন প্রমাণ এখনো হাজির করতে পারেননি তারা। আর এটা তো সবাই জানেন সে সময়কালে জাসদ ও কর্নেল তাহের না থাকলে জিয়াউর রহমান সামনে আসা তো দূরে থাক জানেও বাঁচতে পারতেন না। তাকে গৃহবন্দী থেকে মুক্ত করা তাহেরকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়েছিলেন কে বা কারা?
এই তথ্যগুলো ফখরুল সাহেবের অজানা কিছু না। জেনেশুনে তারা এমন মিথ্যাচার করেন বলেই বিএনপির আজ এই পরিণতি। আজ যে কোণঠাসা ও গৃহবন্দী বিএনপি তার কারণ এই মিথ্যাচার।
মির্জা ফখরুলের জানা আছে এবং এটা মনে রাখা উচিত হাজার চেষ্টা করেও তারা ইতিহাস পাল্টাতে পারেননি। বাংলাদেশের জনগণ তাদের প্রত্যাখান করেছে কি করে নাই সে তর্কে না গিয়েও বলি আপনারা দেশের খোলনলচে বদলানোর পরিকল্পনা করলেও পারেননি। বাংলাস্তান বানানোর ষড়যন্ত্র সফল হয়নি উল্টো জনসমর্থন থাকার পরও কাগজের মতো গুটিয়ে গেছে আপনাদের দল। আর সেই আপনি এই কঠিন সময়ে এমন একটা কথা বললেন যা আপনাদের নেতা জিয়াউর রহমান বা তার সঙ্গীদের কারো মুখ থেকেও বের হয়নি। আমাদের রাজনীতির এই এক কাল, এ এক অপরাধ। নেতারা যখন যা মুখে আসে বলে ফেলেন। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা বা দায়িত্ববোধহীন কথাবার্তাই সবগুলো রাজনৈতিক দলের জন্য অভিশাপ। সে অভিশাপ আরও একদফায় সত্য প্রমাণ করলেন মির্জা ফখরুল। না আপনারা পারলেন আপনাদের নেতাকে মুক্ত করতে, না একটা মিছিল করে দেখাতে। এমন কথা মানা কঠিন যে কেবল ভয়ভীতির জন্য আপনারা পারেননি। তেমন হলে ধর্মভিত্তিক দলগুলো এভাবে রাস্তায় নামতে পারত না। পারত না ছাত্র-ছাত্রীরা। আপনারা নিজেদের দুর্বলতার কারণে, ভুল রাজনীতির কারণে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে পারেননি। একাধিকবারের প্রধানমন্ত্রী এখনো বাইরে আছেন সরকারের বদান্যতায়।
সে আপনি আজ এই যে একটা ভুল কথা বললেন এর জন্য একদিন আপনাকে সময়ের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবেই। এই দেশ আর ইতিহাস এটা মনে করিয়ে দেয়, কাউকে ছাড় দেয়নি এই মাটি। এই মাটি রক্তভেজা মাটি। এই মাটির তলায় ঘুমিয়ে আছেন লাখো মুক্তিযোদ্ধা। এই দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার পৃথিবীর বিস্ময়। দুনিয়া এই ইতিহাস আজ অবনত মস্তকে স্বীকার করে। আমেরিকা চীন এমনকি পাকিস্তানও আমাদের স্বাধীনতা ও অর্জনকে সম্মান করতে বাধ্য হয়েছে। আর আপনি বলছেন আমরা নাকি দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছিলাম। এর জন্য কি আপনার বিচার চাওয়া অনুচিত?
রক্ত দিয়ে কেনা ত্রিশ লাখ শহীদের প্রাণ ও অজস্র মা-বোনের ইজ্জতের বদলে পাওয়া স্বাধীনতার প্রতি আপনাদের অবমাননা সবসময় পীড়াদায়ক। এর আগে গয়েশ্বর বাবু করেছেন, এবার আপনি। মির্জা ফখরুল কি এ জন্য ক্ষমা চাইবেন জাতির কাছে?