Published : 08 Nov 2020, 08:24 PM
অবশেষে মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ডনাল্ড ট্রাম্প হেরে গেছেন। বিজয়ী হয়েছেন জো বাইডেন। ট্রাম্প হেরে যাওয়ায় বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন। খুব অল্প ভোটের ব্যবধানে হারলেও নতুন রেকর্ড গড়েছেন বিদায়ী মার্কিন ডনাল্ড ট্রাম্প। ভেঙেছেন গত তিন দশকের পুরনো রেকর্ডও। ১৯৯২ সালে রিপাবলিকান প্রার্থী জর্জ এইচডব্লিউ বুশ ডেমোক্র্যাট দলের বিল ক্লিন্টনের কাছে পরাজয়ের পর আর কোনও মার্কিন রাষ্ট্রপতিই দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে পরাজিত হননি। এবার সেই রেকর্ড ভেঙেছেন ডনাল্ড ট্রাম্প।
মার্কিন নির্বাচনী ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যাচ্ছে জর্জ বুশের পর শেষ তিন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটন, জর্জ ডাব্লু বুশ (জুনিয়র), এবং বারাক ওবামা প্রত্যেকেই টানা দু–বাবের জন্য রাষ্ট্রপতি পদে আসীন থেকেছেন। কিন্তু সেই রেকর্ড আর ধরে রাখতে পারলেন না ট্রাম্প। যদিও ট্রাম্পই প্রথম নন এর আগেও আরও একাধিক মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে তাদের জনবিরোধী কাজের জন্য দ্বিতীয় দফার নির্বাচনেই ছুঁড়ে ফেলেছে আমেরিকার জনগণ।
এদিকে গত ১০০ বছরের রেকর্ডে মাত্র চার জন রাষ্ট্রপতি পুনরায় নির্বাচিত হতে ব্যর্থ হয়েছেন। জর্জ ডাব্লু বুশ ছাড়াও এই তালিকায় নাম রয়েছে জিমি কার্টার, জেরাল্ড ফোর্ড, হারবার্ট হুবারের নাম। এর মধ্যে ১৯৮০ সালে রিপাবলিকান রোনাল্ড রিগনের কাছে হেরেছিলেন ডেমোক্র্যাট জিমি কার্টার। এছাড়া ১৯৭৬ সালে আবার জিমি কার্টারের কাছেই পরাজিত হন রিপাবলিকান জেরাল্ড ফোর্ড। আর ১৯৩২ সালে ডেমোক্র্যাটিক ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের কাছে পরাজিত হন রিপাবলিকান হারবার্ট হুভার।
আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অপররাপর দেশগুলোতে এবার একটু বেশিই মাতামাতি হয়েছে। এর কারণ অবশ্য ট্রাম্প। একজন অশিষ্ট, দুর্বিনীতি, খামখেয়ালি সুবচনবর্জিত রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ট্রাম্প বিশ্বব্যাপী কুখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। এমন নয় যে অন্যসব মার্কিন রাষ্ট্রপতি ফেরেস্তা ছিলেন এবং তাদের তুলনায় ট্রাম্প খুব খারাপ কাজ করেছেন। মার্কিন রাষ্ট্রপতিরা সচরাচর যেমন হয়, ট্রাম্প তেমনই ছিলেন। আসলে ডনাল্ড ট্রাম্প ধিকৃত হয়েছেন তার কথা ও আচরণের কারণে।
ট্রাম্পের আগে যারা রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন নীতির দিক থেকে তাদের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য ছিল না। গোটা বিশ্বকে ভয়ভীতি দেখানো ও হুমকি–ধমকি দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা ট্রাম্পের চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন না। যুদ্ধ বাধানো, বিভিন্ন দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ, মানুষ হত্যা, সরকার ফেলে দেওয়া, অস্ত্র ব্যবসা, উত্তেজনা সৃষ্টি ও জিঁইয়ে রাখা, গোয়েন্দাগিরি- এসব ক্ষেত্রে তাদের কেউ কেউ বরং ট্রাম্পের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন।
অতীতের দিক ফিরে তাকালে দেখা যায়, জর্জ বুশ সিনিয়র গদিতে বসেই ইরাকে হামলা চালিয়েছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক যুদ্ধের জন্য তিনি আলোচিত। সুদর্শন, মিষ্টভাষী ও বিনয়ী রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটন আফগানিস্তান ও সুদানে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিলেন। জর্জ বুশ জুনিয়র ছিলেন বাবার চেয়েও অনেক বেশি যুদ্ধবাজ। তিনি বিশ্বাস করতেন, যুদ্ধই আমেরিকান রাষ্ট্রপতির প্রধান কাজ। ইরাক ও আফগানিস্তানকে তিনি তছনছ করেছেন। নোবেল শান্তিজয়ী ওবামার শাসনামলের শেষ দিকে মার্কিন ড্রোন থেকে ঘণ্টায় তিনটি করে বোমা লিবিয়া, আফগানিস্তান ও অন্যান্য স্থানে পড়ত। ট্রাম্প এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন মাত্র। তিনি ইরানের সঙ্গে যুদ্ধপরিস্থিতি তৈরি করেছেন। ইরানের সবচেয়ে শক্তিধর জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করেছেন। চীনের সঙ্গে চরম বৈরিতামূলক সম্পর্ক সৃষ্টি করছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে উল্টো পথে হেঁটেছেন। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যারিস চুক্তি থেকে আমেরিকাকে বের করে নিয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গেও বিবাদে লিপ্ত হয়েছেন এবং সংস্থাটি থেকে আমেরিকাকে সরিয়ে নিয়েছেন।
ট্রাম্প সরাসরি যুদ্ধ করেননি, কিন্তু বিশ্বময় যুদ্ধের উত্তেজনা বাড়িয়েছেন। প্যালেস্টাইনিদের অধিকার পদদলিত করেছেন। আমেরিকায় হিটলারের বিভীষিকাময় কনসেনট্রেশন ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন।
একথা ঠিক যে, জো বাইডেনের জয়ে একেবারে নতুন কিছু ঘটবে না। ট্রাম্পের আমলে বদলে নেওয়া বেশ কিছু নিয়ম তিনি পুরোপুরি পরিবর্তন করতে পারবেন না। যেমন, অভিবাসন নীতি। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা হয়তো শিথিল করতে পারেন, কিন্তু এই নীতিকে আমূল বদলে দিতে তিনি পারবেন না। ওয়ার্ক–ভিসার কয়েকটি বিভাগে কিছুটা রদ বদল করতে পারবেন, কিন্তু মার্কিন কর্মক্ষেত্রে বিদেশিদের একচেটিয়া রাখতে পারবেন না। ট্রাম্প তার শাসনকালে যে যে নীতি–নিয়ম চালু করেছেন তা পুরোপুরি বাদ দিতে পারবেন না। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মত বাইডেন ডেমোক্র্যাট দলের হলেও তার বাণিজ্যিক কৌশল কিন্তু প্রায় ট্রাম্পেরই মত। সেক্ষেত্রে বাণিজ্যনীতিতেও খুব একটা বদল ঘটার সম্ভাবনা কম।
তবে জো বাইডেনের জয়ে আমেরিকা ট্রান্স–আটলান্টিক জোটের সূচনা করে মিত্র ও অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে পুনরায় সংযোগ স্থাপন হতে পারে। এমনকি পারষ্পারিক সম্মানও বাড়তে পারে মিত্রশক্তির দেশগুলির মধ্যে। কিছুটা হয়ত বদলাবে মার্কিন ভিসা চিত্র। তবে তিনিও তো আমেরিকান, তাই দিনের শেষে তিনি আমেরিকান নীতিই গঠন করবেন তা বলাই বাহুল্য।
প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান যত কমই হোক, আমেরিকার রাষ্ট্রপতি পদে জো বাইডেনের বিজয়ের পর বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি নেমে এসেছে। চার বছর আগে ট্রাম্প আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে সিন্দাবাদের দৈত্যে পরিণত হয়েছিলেন। বিভেদ, উস্কানি, চণ্ডনীতির পাশাপাশি তিনি সমস্ত সৌজন্যতা-শালীনতাকে বিসর্জন দিয়ে আধুনিক আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন শ্বেত আধিপত্যবাদীদের রাষ্ট্রপতি। মুসলিম বিদ্বেষ, সীমান্তে মানবাধিকার লঙ্ঘন, নিজ দেশে বিভেদ সৃষ্টির মতো কাজগুলো তিনি করেছিলেন জোরেশোরে। এমন ব্যক্তির পরাজয়ে সত্য, সুন্দর ও ন্যয়ের পূজারীরা তাই আনন্দ-উল্লাস করতেই পারেন।
এখন স্বাস্থ্য সংকট, অর্থনৈতিক সংকট, বর্ণবাদ সংকট, জলবায়ু সংকট এবং প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের সংকট মোকাবিলায় ডেমোক্র্যাটদের গলদঘর্ম হতে হবে। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং অনিশ্চয়তা কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছে। এই অর্থনৈতিক ক্ষত ও ক্ষতি সারিয়ে তোলা হবে নতুন সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ। একইসঙ্গে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ, কার্যযকর টিকা উদ্ভাবনে বিনিয়োগ, টিকা ব্যবস্থাপনা, বৈষম্য নিরসন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, শিক্ষার্থীদের ঋণ, অভিবাসন এবং আরও অনেক বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
ডেমোক্র্যাট পার্টি ও জো বাইডেনের জন্য সামনের দিনগুলো কিন্তু মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ হবে না। ভয়াবহ করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যেও এবার বিপুল সংখ্যক ভোটার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দিয়ে রেকর্ড করেছেন। মোট ভোট পড়েছে গতবারের থেকে ১ কোটির মতো বেশি, যা কিনা প্রায় ৬–৭ শতাংশ। তবে এই নির্বাচন নিয়ে যা হলো, তা আমেরিকার মতো একটা দেশের পক্ষে ভালো বিজ্ঞাপন নয়। তার প্রধান কারণ অবশ্যই ট্রাম্প। আগাম ভোটের তুরুপের তাসে হেরে গিয়েও হার না–মানার খেলায় নেমেছেন তিনি।
মার্কিন দেশে এখনও তিনি দুমাসের ওপর ক্ষমতায় থাকবেন। ভোটফল বেরিয়ে গেলেও সে দেশে ক্ষমতার হাতবদল হয় পরের বছর। সুতরাং ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা। আদালতে না গিয়ে যদি গণতন্ত্রকে ক্ষমা করেন, তা হলে পরীক্ষা শুরু বাইডেনের। এত কৌশলের পরেও সেনেটে ডেমোক্র্যাটদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সম্ভব হয়নি। সেনেট উভয় দলের আসন সংখ্যা সমান সমান। রিপাবলিকানরা এই সুযোগ যে নেবে তা বলাই বাহুল্য। অন্তত সামনের দুবছরের জন্য। ওবামা এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন তার রাজত্বের শেষ দুই বছরে। এবারের নির্বাচনে মার্কিন দেশে বিভাজন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ফলে বাইডেন আর রাতের ঘুমে জমিয়ে নাক ডাকার সুখ পাবেন বলে মনে হয় না।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি হিসেবে জো বাইডেন নির্বাচিত হওয়ার পর প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ট্রাম্পের হটকারী নীতি থেকে আমেরিকার মানুষ কি এবার মুক্ত হবে? গণতন্ত্র ও মানবতার সুরক্ষা, ফ্যাসিবাদ ও বর্ণবাদের অবসান, বিশ্বব্যাপী বিরাজিত যুদ্ধ–উত্তেজনার উপশম, চলমান অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলা, বিশ্বব্যাপী আমেরিকার অর্থনৈতিক উপনিবেশ গড়ার নীতির অবসান ইত্যাদি ঘটাতে পারবেন কি? এক্ষেত্রে ট্রাম্প নয়, আমেরিকায় যে নিপীড়ক হোয়াইট এস্টাবলিশমেন্ট আসলে সব ক্ষমতার অধিকারী, তাদের মোকাবেলা বাইডেন করতে পারবেন কি? করার ব্যাপারে তিনি নিজে কি আগ্রহী? এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন।
তবে জো বাইডেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ায় একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়, আমেরিকার মানুষ, সেই সঙ্গে বিশ্বের মানুষ ডনাল্ড ট্রাম্পের হটকারী নীতি, হুঙ্কার ও বিরক্তিকর বক্তৃতা থেকে মুক্তি ও স্বস্তি পাবে! সেটাই বা কম কি? তাই জো বাইডেনের জয়ের চেয়ে ট্রাম্পের পরাজয়টাই বিশ্বব্যাপী অনেক বেশি আলোচিত হচ্ছে।