Published : 07 Oct 2020, 02:59 PM
নিয়ম অনুযায়ী নভেম্বর মাসের ৩ তারিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান পার্টির ডনাল্ড ট্রাম্প এবং ডেমোক্রেটিক পার্টির জো বাইডেন। এবার এক বিশেষ পরিস্থিতিতে আমেরিকার এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। করোনাভাইরাসের আক্রমণে সবচেয়ে বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন ওই দেশে। করোনায় নাস্তনাবুদ আমেরিকার জনজীবন এবং অর্থনীতি। নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হতে পারবে কি না, সে ব্যাপারেও সংশয় তৈরি হয়েছিল। তবে এখন নির্বাচন হওয়া নিয়ে সম্ভবত আর তেমন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই। সীমিতভাবে হলেও দুই প্রার্থীই নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন, চালাচ্ছেন।
আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ থাকে দুনিয়াব্যাপী। কার হাতে পরের চার বছরের জন্য শক্তিধর ওই রাষ্ট্রটির ক্ষমতা যাবে তা জানার আগ্রহ সবার থাকাটাই স্বাভাবিক। এবারও তার ব্যতিক্রম নেই। নির্বাচনের ফলাফল, জয়-পরাজয় নিয়ে রাজনৈতিক পণ্ডিত থেকে শুরু করে সাধারণ জানাবোঝা মানুষদেরও মধ্যেও নানা রকম হিসাব-নিকাশ চলছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জনমত জরিপও চলছে। প্রায় সব জনমত জরিপেই জো বাইডেন এগিয়ে থাকলেও নিশ্চিত করে কেউ-ই বলতে পারছেন না যে শেষ হাসি কে হাসবেন।
এর আগের নির্বাচনে জনমত জরিপে এগিয়ে থাকলেও পরাজয় বরণ করতে হয়েছে ডেমোক্রেটিক দলের হিলারি ক্লিনটনকে। হিলারির পরিচিতি ও অন্য সব ঔজ্জ্বল্যের কাছে পিছিয়ে থাকা ডনাল্ড ট্রাম্পই নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিছুটা অস্থিরমতি ও পাগলাটে স্বভাবের ব্যবসায়ী ট্রাম্প আমেরিকার মতো দেশের প্রেসিডেন্ট হবেন – এটা অনেকের কাছেই অস্বাভাবিক ছিল। কিন্তু মার্কিন ভোটার এবং নির্বাচন ব্যবস্থা এই অনুজ্জ্বল ব্যক্তির হাতেই শিরোপা তুলে দিয়েছিল।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ট্রাম্প গত চার বছরে এমন কিছু করেননি বা করতে পারেননি, যার জন্য আমেরিকার জনগণ দ্বিতীয় মেয়াদের জন্যও তাকেই বেছে নিতে উদগ্রীব হয়ে উঠবে। বরং চার বছরে তিনি নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে থেকেও অনেক সময় উল্টাপাল্টা কথা বলছেন। সাংবাদিকদের চটিয়েছেন। তার ওপর অখুশি মানুষের সংখ্যাই বেশি। তাকে নিয়ে অস্বস্তি তাড়িয়ে বেড়িয়েছে খোদ রিপাবলিকান দলকেও। তাসত্ত্বেও তিনি দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন এবং নির্বাচনে জয়লাভেরও আশা করছেন। এ এক অদ্ভুত অবস্থা এবং ব্যবস্থা। হেরে গেলে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার স্পষ্ট অঙ্গীকারও তিনি করেননি। উল্টো আদালতে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন। আদালত যাতে তার পক্ষে থাকে সেজন্য অনুগত একজনকে বিচারপতি নিয়োগের ঘোষণাও তিনি দিয়েছেন।
দেশ-দুনিয়া সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখেন এবং আমেরিকায় আত্মীয়-স্বজন থাকায় নিয়মিত যোগাযোগ আছে, আমার পরিচিত এমন একজনের কাছে আমেরিকার নির্বাচন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, ট্রাম্প আবার ফিরে আসছে, এটা প্রায় নিশ্চিত। তার মতে, ডেমোক্রেটরা প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল করেছে। জো বাইডেন এবং তার রানিংমেট কমলা হ্যারিস – দুজনের কেউ-ই ক্যারিশমেটিক নেতা নন। ট্রাম্পের থেকে ভালো – তবে এতটা ভালো নন যেটা ভোটে জেতার নিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে। তাছাড়া ট্রাম্পের সময়কালে আমেরিকা কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েনি। বরং মধ্যপ্রাচ্য থেকে সৈন্য গুটিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
নির্বাচনের ফলাফল অনুকূলে আনা এবং তা ধরে রাখার জন্য দুই পক্ষের তরফ থেকেই তৎপরতা চলছে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর ট্রাম্প এবং বাইডেন প্রথম সরাসরি বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন। এই বিতর্কে ট্রাম্প অত্যন্ত অভব্য ও উশৃঙ্খল আচরণ করে নিজের অবস্থান আবারও দুর্বল করেছেন। বিতর্কে বাইডেনও 'অসাধারণ' কিছু করেছেন তা নয়। তবে ট্রাম্প যেহেতু বেশি খারাপ করেছেন সেহেতু মানুষের বিবেচনায় এগিয়ে আছেন বাইডেন। অনেকেই মনে করছেন, প্রথম বিতর্কে ট্রাম্প হেরেছেন বলেই বাইডেন জিতেছেন। বিতর্কের পর দুটি সংস্থার পরিচালিত জনমত জরিপেও বাইডেন জাতীয়ভাবে ট্রাম্পের তুলনায় ১৪ পয়েন্টে এগিয়ে আছেন। এর আগে এই ব্যবধান আরও কম ছিল। তবে এসব জনমত জরিপের ওপর ভোটের ফল কতটা প্রভাব ফেলে সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
বিতর্কের দুদিন পর ট্রাম্প করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন বলে জানা যায়। ট্রাম্পের এই অসুস্থতার খবরও ভোটের ফল তার জন্য নেতিবাচক হতে পারে বলে কেউ কেউ মনে করছেন। ট্রাম্প আগাগোড়া করোনাভাইরাস নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন। তিনি এই মহামারীর বিপদকে খাটো করে দেখে মার্কিনিদের বেশি সমস্যায় ফেলেছেন বলেও অনেকে মনে করেন। তার খামখেয়ালিপনা এবং দায়িত্বহীন মন্তব্যের কারণে নাগরিকদের মধ্যে এক ধরনের উদাসীনতা ছিল। সেজন্য পৃথিবীতে আমেরিকায় করোনাভাইরাস আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ট্রাম্প নিজে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর এই ব্যাধি নিয়ে তার ভাবনায় কোনো পরিবর্তন এসেছে কি না, সেটাও স্পষ্ট নয়। বরং তিনি সত্যিকার অর্থে কতটুকু অসুস্থ, তিনি কোনো ঝুঁকিতে আছেন কি না তা নিয়েও এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি করা হচ্ছে। তার চিকিৎসক কিংবা ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের বক্তব্যের সঙ্গে ট্রাম্পের নিজের কথার মধ্যে অমিল লক্ষ করা গেছে। তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। তিনি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সমর্থকদের সাক্ষাৎ দিয়ে নিজেকে ফিট প্রমাণ করতে চাইলেও ওটা করে তিনি অন্যদের জন্য স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করেছেন বলে সমালোচিত হচ্ছেন। করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ায় ভোটে তার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে, সে হিসাব-নিকাশও চলছে।
তবে ট্রাম্প এসব কিছুরই তোয়াক্কা করেন না। তিনি নিজে যা ভালো মনে করেন, তা-ই করেন। নিন্দা-সমালোচনা গায়ে মাখেন না। তিনি হয়তো ধরেই নিয়েছেন যে এবারও গতবারের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে। জনপ্রিয় ভোটে তিনি বাইডেনের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও ইলেকটোরাল ভোটে তিনি নির্বাচিত হবেন।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পদ্ধতি কিছুটা জটিল। জনগণের সরাসরি বা প্রত্যক্ষ ভোটে নয়, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন কার্যত ইলেকটোরাল কলেজ নামে পরিচিত একদল কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ ভোটে। ইলেকটোরাল কলেজের মোট ভোটের সংখ্যা ৫৩৮। যে প্রার্থী ২৭০টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পাবেন তিনিই নির্বাচিত হয়ে পরবর্তী চার বছর দেশ শাসনের ক্ষমতা পাবেন। ভোটারদের কাছ থেকে একজন প্রার্থী যে ভোট পান তাকে বলা হয় পপুলার ভোট। আর ইলেকটোরাল কলেজের ভোটকে বলা হয় ইলেকটোরাল ভোট। ২০১৬ সালের নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটন পপুলার ভোট ৩০ লাখ বেশি পেয়েও ইলেকটোরাল ভোট ২৭০টি না পেয়ে পরাজিত হন। কোনো একটি রাজ্যে যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি পপুলার ভোট পাবেন, তিনি ওই রাজ্যের সবগুলো ইলেকটোরাল ভোট পাবেন। কোন রাজ্যে কতজন ইলেকটোরাল নির্বাচক থাকবেন, সেটা নির্ধারিত হয় রাজ্যের জনসংখ্যার ভিত্তিতে।
সবচেয়ে বেশি ইলেকটোরাল ভোটার আছেন ক্যালিফোর্নিয়ায়, ৫৫ জন। টেক্সাসে ৩৮ জন। নিউইয়র্ক এবং ফ্লোরিডায় ২৯ জন করে। ইলিয়নয় ও পেনসিলভানিয়ায় ইলেকটোরাল ভোট ২০টি করে। ছোট ছোট রাজ্য এবং ডিস্ট্রিক্ট অফ কলম্বিয়ায় ইলেকটোরাল ভোটার আছেন ৩ জন করে। আমেরিকায় ছোট বড় মিলিয়ে রাজ্য সংখ্যা ৫০টি। এরমধ্যে কয়েকটি রাজ্য ব্যাটল গ্রাউন্ড বা নির্বাচনী রণক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত। বেশিরভাগ অঙ্গরাজ্যেই নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের অনুকূলে ভোট দিয়ে থাকে। কোনো কোনো রাজ্য রিপাবলিকানদের দুর্গ আবার কোনো কোনোটি ডেমোক্রেটদের। রিপাবলিকানদের প্রভাবিত রাজ্যগুলো রেড বা লাল এবং ডেমোক্রেটদের গুলো ব্লু বা নীল রাজ্য বলে পরিচিত। কিছু অঙ্গরাজ্য আছে যেগুলোর ভোট যেকোনো প্রার্থীর অনুকূলে যেতে পারে। এগুলোকে বলা হয় সুইং স্টেট বা দোদুল্যমান রাজ্য। এই রাজ্যগুলোই মূলত প্রার্থীদের জয়পরাজয় নির্ধারণ করে।
সব মিলিয়েই বাইডেন সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন বলে মনে করা হচ্ছে। তারপরও কেন ট্রাম্প জয়ের আশা করছেন? ধারণা করা হচ্ছে, এবার ভোটের ফলাফল নির্ধারিত হবে আদালতে। করোনাভাইরাসের কারণে এবার অনেকেই পোস্টাল ভোট দিচ্ছেন। আর পোস্টাল ভোট যারা দিয়েছেন বা দিচ্ছেন তাদের মধ্যে বাইডেনের সমর্থক বেশি। এই তথ্যটি ট্রাম্পের কাছেও আছে। তাই শুরু থেকেই তিনি পোস্টাল ভোট নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে আসছেন। সবচেয়ে বড় কথা, নির্বাচনে হেরে গেলে বিজয়ী প্রার্থীর কাছে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন কি না, এই প্রশ্নের সন্তোষজনক সদুত্তর ট্রাম্প দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। জটিলতা সৃষ্টি করে ক্ষমতায় থেকে যেতে চান বলেই শেষে নিরূপায় ভোটারদের শেষমুহূর্তের সিদ্ধান্তে ভোটের হাওয়া বদলে যায় কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।