২০১৩ থেকে ২০২২, এক দশকও পার হয়নি। নারীর প্রতি হেফাজতিদের বৈষম্যমূলক আচরণের জবাব পাওয়া গেল। সেই শাপলা চত্বরেই হাজার হাজার মানুষ সাফ জয়ী বৈচিত্র্যময় বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলকে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানাতে জড়ো হয়েছে।- লিখেছেন মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, প্রাক্তন ইউজিসি অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
Published : 24 Sep 2022, 12:07 AM
দুপুর একটা পঞ্চাশ থেকে টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রেখেছি। বাংলাদেশের অদম্য নারী ফুটবল টিম দেশে ফিরবে– সাফ ফুটবলের চ্যাম্পিয়ন হয়ে, সোনার কাপ হাতে নিয়ে। ফাইনালে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সেরা দল নেপালের বিরুদ্ধে বাংলার নারীরা ৩-১ গোলের ব্যবধানে জয়লাভ করেছে কাঠমান্ডুর দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে, প্রায় পনেরো হাজার নেপালি দর্শকের সামনে। ফিফা আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিং-এ বাংলাদেশ নারী ফুটবলের অবস্থান নেপাল থেকে ছিল ৪৫ ধাপ পেছনে। এবারের সাফ প্রতিযোগিতার আগে বাংলাদেশের নারীরা আটবার মুখোমুখি হয়েছে নেপালের বিরুদ্ধে। জয়ের সাক্ষাৎ পায়নি– ছয়বার পরাজয় এবং দু-বার ড্র। ভারতের র্যাঙ্কিং নেপালের চেয়েও ৪৫ ধাপ ওপরে। ভারতের বিরুদ্ধে মোট পাঁচবার ফাইনালে খেলে জয় অধরাই থেকে গেছে নেপালি নারী দলের। এই প্রেক্ষাপটে ২০২২ সালের সাফ নারী ফুটবল প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের নারীদের সোনার কাপ জেতার চিত্রটি দেখে নেয়া যাক। গ্রুপ ম্যাচে মালদ্বীপকে ৩-০, পাকিস্তানকে ৬-০, ভারতকে ৩-০ গোলে পরাজিত করে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেমিফাইনালে ভুটানকে ৮-০ গোলে পরাজিত করে ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। অপর গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন নেপাল সেমিফাইনালে ভারতকে ১-০ গোলে পরাজিত করে। কে জিতবে ফাইনাল? পরিসংখ্যান বলছে নেপাল। কিন্তু না, ৩-১ গোলের ব্যবধানে নেপালকে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল। পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে মোট গোল হয়েছে ৫৯টি। এর মধ্যে বাংলাদেশের মেয়েরা গোল করেছে ২৩টি। শুধু শ্রেষ্ঠ দলের সোনার মেডেল নয়, গোটা টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ আট গোল করে বাংলাদেশের অধিনায়ক সাবিনা পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ খেলোয়ারের পুরস্কার, শ্রেষ্ঠ গোলকিপার হয়েছেন আমাদের রুপনা চাকমা। যেখানে বাংলাদেশের নারীরা ২৩ গোল দিয়েছে প্রতিপক্ষ দলগুলোর জালে, সেখানে রূপনা চাকমা আগলে রেখেছিলেন বাংলাদেশের গোলপোস্ট। নেপালের বিরুদ্ধে ফাইনালে তার হাত ছুঁয়ে একটি মাত্র গোল বাংলাদেশের জালে প্রবেশ করতে পেরেছে। সোনালি মুকুটের এখানেই শেষ নয়। গোটা টুর্নামেন্ট জুড়ে ফেয়ার প্লে বা পরিচ্ছন্ন খেলার পুরস্কারটিও অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
ছাদখোলা বাস চলতে শুরু করেছে সোনার মেডেল জিতে নেয়া গ্রাম-বাংলার মেয়েদের নিয়ে। অনেকগুলো টিভি চ্যানেলের রিপোর্টার তাদের সব আবেগ ও ভালবাসা ঢেলে দিয়ে ধারা-বর্ণনা করে চলেছেন ক্লান্তিহীন ভাবে। বলতেই হবে শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশে নারীদের এমন অর্জনে শুভ মানুষের বাঁধ ভাঙ্গা উচ্ছ্বাস সৃষ্টিতে নতুন প্রজন্মের সংবাদকর্মীদের বিপুল অবদান রয়েছে। বিমানবন্দর ও আশেপাশে জড়ো হওয়া ভালবাসা-আবেগে উচ্চকন্ঠে বিজয়ধ্বনিতে উত্তাল হাজার হাজার মানুষের প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে চলছে আগের রাতে ছাদ কেটে তৈরি করা বিআরটিসির লাল-সবুজের ডাবল-ডেকার। যেমনটা আশা করেছিলেন কলসিন্দুরের মেয়ে সানজিদা তার ফেসবুক বার্তায়। দলনেতা সাবিনার দুহাতে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা সাফ ফুটবল বিজয়ের ট্রফি, হাস্যোজ্জ্বল বিজয়ী মেয়েদের সবার হাতে বাংলাদেশের পতাকা। চোখের সামনে একের পর এক ঘটে যাওয়া কেমন এক ঐন্দ্রজালিক দৃশ্য।
মন চলে গিয়েছিল একাত্তরের রণাঙ্গনে। এই ৭৩ বছর বয়সে ওই সময়ের ২২ বছরের এক যুবকের রক্তে উঠেছে প্রবল দোলা। পেটের ভেতর থেকে মোচড় দিয়ে উঠে আসা আনন্দ-আবেগে বারবার চোখ ভিজে আসছিল। ক্লান্ত হয়ে শেষ বিকেলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভেঙ্গে দেখি সন্ধ্যা নেমেছে। গন্তব্য বাফুফে ভবনে এখনো পৌঁছতে পারেনি হ্যারি পটারের স্বপ্নের বাস। সন্ধ্যে ৭টা। আঁধার একটু গাঁড় হয়েছে। বাস ঘুরছে মতিঝিলের শাপলা চত্বর। আলো-আঁধারিতে দৃশ্যমান হলো শাপলা চত্বর ঘিরে হাজারো মানুষের ভিড়। এদের কণ্ঠে নিনাদিত একাত্তরের রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’। দুঃখী গ্রাম-বাংলার বিজয়ী মেয়েদের প্রতি অভিনন্দন বার্তা। আলোর গতির চাইতে উচ্চতর আর কোনো গতি হতে পারে না। আমাদের মন চলে যায় কোন গতিতে? মনে পড়ে গেল আরেক শাপলা চত্বরের দৃশ্য। এবারে বলব এই প্রবন্ধের শিরোনাম বিষয়ে।
২০১৩ সালের ৫ মে। সারা দেশ থেকে কওমি মাদ্রাসার কিশোর-যুবা শিক্ষার্থীদের শাপলা চত্বরে জড়ো করেছে হেফাজতের ধর্ম ব্যবসায়ীরা। মিথ্যার বাতাবরণে নানাভাবে উত্তেজিত করে এদের নিয়ে আসা হয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকায়, শাপলা চত্বরে। এদের সাথে মিলে-মিশে ঢুকে পড়েছে জামায়াত-শিবির ও লুকিয়ে থাকা নানা নামের জঙ্গি নাশকতাকারীরা। নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসি কার্যকর করার জন্য একটি ব্লাসফেমি আইন প্রণয়ন এবং জনসম্মুখে নারী-পুরুষের মেলামেশা নিষিদ্ধকরণ– প্রধানত এই ছিল হেফাজতের দাবি। এর আগে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার শাহবাগ চত্বরে সূচনা হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পুনর্জাগরণের। ওই সময়ে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত আসামী জামায়েত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার বিচারের রায় ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। কবি মেহেরুন্নেসাকে হত্যা, আলুব্দি গ্রামে ৩৪৪ জন মানুষ হত্যাসহ মোট ৬টি অপরাধের ৫টি প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে। কিন্তু এতগুলো হত্যা, ধর্ষণ, সর্বোপরী গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ মেনে নিতে পারেনি। রায়ের প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রথমে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ঢাকার শাহবাগে জড়ো হতে শুরু করে এবং দিনকয়েকের মধ্যে বিপুল সংখায় বিভিন্ন বয়সী আপামর জনসাধারণ শাহবাগ চত্বরকে এক জনসমুদ্রে পরিণত করে। এর অনুসরণে সারা দেশে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু হয়ে যায়। কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা বাংলাদেশ। সবার কন্ঠে ধ্বনিত হয় ‘জয় বাংলা’। ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ তারিখে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩ সংশোধন করে সংশোধনী আইন সংসদে পাশ হয়। এই সংশোধনীর ফলে সংক্ষুব্ধ পক্ষের হয়ে কাদের মোলার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ সরকার পায়। ভাবা যায়, এই সংশোধনের আগে এমনসব রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের আপিল করার সুযোগ ছিল না?
মুখ্যত যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি থেকে বাঁচাতে শুধু জামায়েত-হেফাজত নয়, বিএনপিসহ সকল দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সেদিন মাঠে নেমেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় সরকার পতনের লক্ষ্যে শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশ ঘটানো হয়। তাদের ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। পঁচাত্তরের ১৫ অগাস্ট পরবর্তী দুই যুগের বেশি সময় ধরে যে রাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তিকে লালন করেছে, জনতার প্রতিবাদের হাত থেকে রক্ষা করেছে, সেখানে এবার বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসে। সাউন্ড গ্রেনেড ও প্রবল ফাঁকা গুলিবর্ষণে জেহাদীরা শাপলা চত্বর ছেড়ে পলায়ন করে। এরই ফলে ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে খুন এবং অন্যান্য যুদ্ধাপরাধের জন্য আব্দুল কাদের মোল্লাকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ প্রদান সম্ভব হয়েছে। ২০১৩ সালে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের ১২ তারিখে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুঁলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় কাদের মোল্লার।
২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে ‘জনসম্মুখে নারী পুরুষের মেলামেশা নিষিদ্ধকরণ’– এমন দাবিই আল্লামা নামে পরিচিত হেফাজতের শীর্ষ নেতা ১৯৭১ সালে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী শাহ আহমদ শফীর একমাত্র দাবি ছিল না। ২০১৩ সালের ১৬ জুলাই একটি দৈনিক পত্রিকায় বাংলাদেশের প্রখ্যাত লেখক-প্রাবন্ধিক প্রয়াত সৈয়দ আবুল মকসুদ তার কলাম ‘সহজিয়া কড়চায়’ লেখেন ‘তেঁতুল তত্ত্ব’। এই তেঁতুল তত্ত্বের প্রবক্তা তথাকথিত আল্লামা শফীর বক্তব্যের ব্যবচ্ছেদ করেন তীক্ষ্ণ বাক্যবানে। তিনি বলেন, “১০ হাজার বছর বঙ্গীয় নারী মুখ বুজে অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছে। এখন আর কোনো নতুন অপমান সইতে সে প্রস্তুত নয়।” সৈয়দ আবুল মকসুদের এই অমোঘবাণী সত্য হতে শুরু করেছে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ মানুষের জীবনদান ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় লম্পট সহযোগীদের দ্বারা ধর্ষিত প্রায় চার লক্ষ নারীর করুণ আর্তনাদের সাক্ষী হয়ে জন্ম নেয়া বাংলাদেশে। বাংলার প্রত্যন্ত জনপদ কলসিন্দুর, মরাচেঙ্গী, পাথালিয়া, পলাশপুর, সবুজবাগ গ্রামের মেয়েরা কীভাবে জেগে উঠেছে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে কলসিন্দুর গ্রাম থেকে উঠে আসা সানজিদার ফেসবুকে দেয়া বক্তব্যে:
“পাহাড়ের কাছাকাছি স্থানে বাড়ি আমার। পাহাড়ি ভাইবোনদের লড়াকু মানসিকতা, গ্রাম বাংলার দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষদের হার না মানা জীবনের প্রতি পরত খুব কাছাকাছি থেকে দেখা আমার। ফাইনালে আমরা একজন ফুটবলারের চরিত্রে মাঠে লড়বো এমন নয়, এগারোজনের যোদ্ধাদল মাঠে থাকবে, যে দলের অনেকে এই পর্যন্ত এসেছে বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলংকার বিক্রি করে, অনেকে পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে। আমরা জীবনযুদ্ধেই লড়ে অভ্যস্ত। দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের জন্য শেষ মিনিট পর্যন্ত লড়ে যাবো।”
সানজিদার এই দৃঢ় প্রত্যয়ের প্রমাণ গ্রাম-বাংলার মেয়েরা রেখেছে ফাইনালে। তবে তা শুধু সাফ ফুটবলের স্বর্ণ জয় নয়, তার প্রতিটি কথার পেছনে খেটে খাওয়া মানুষের হার না মানার সংকল্প আছে– তাই আঠারো কোটি মানুষের খাদ্য জোগায় তারা, আমাদের প্রধান রপ্তানিখাত গার্মেন্টস শিল্পকে সচল রাখে, বিদেশে রক্ত পানি করা পরিশ্রমে তাদের পাঠানো বিদেশি মুদ্রা বাংলাদেশের অর্থখাতের প্রাণভোমরা আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভ গড়ে তোলে, বাঁচিয়ে রাখে।
শাপলা চত্বরের দুটো চিত্র আমরা দেখলাম। যেখানে ২০১৩ সালে হেফাজতের প্রধান দাবির মধ্যে ছিল জনসম্মুখে নারী-পুরুষের মেলামেশা নিষিদ্ধ করা, ওই শাপলা চত্বরেই হাজার হাজার মানুষ সাফ জয়ী বৈচিত্র্যময় বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের প্রাণঢালা অভিনন্দন জানাতে জড়ো হয়েছে। বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলকে উষ্ণ অভিনন্দন, শুধু সাফ জেতার জন্য নয়। অভিনন্দন একারণেও যে তোমরা বাংলাদেশ ও দেশের বাইরে লক্ষ কোটি মানুষকে জানিয়ে দিয়েছ যে যতদিন তোমরা সঙ্গবদ্ধ আছো এই শাপলা চত্বর বা বাংলাদেশের কোনো স্থানে বাংলাদেশবিরোধী ধর্মান্ধ শক্তি জয়ী হবে না। বহু জাতির নারী-পুরুষ নিয়ে গড়া বাংলাদেশের মানুষ তা হতে দেবে না।
আরও দুটি কথা বলে আজকে লেখা শেষ করি। ফাইনালে খেলা বাংলাদেশ দলটির গ্রুপ ছবিটির দিকে মনযোগী চোখে আরেকবার তাকান। সেখানে বৈচিত্র্য দেখতে পাবেন। শুধু বাঙ্গালি নয়, সুদূর গারো পাহাড়, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রাঙামাটির আদিবাসী মেয়েদের দেখবেন এই ছবিতে, যাদের লড়াকু মনোবলের কথা লিখেছে সানজিদা। নামগুলো দয়া করে একবার পড়ুন। আঁখি খাতুন, আনাই মগিনি, আনুচিং মগিনি, কৃষ্ণা রাণী, ঋতুপর্ণা চাকমা, তহুরা খাতুন, মনিকা চাকমা, মারিয়া মান্দা, মাসুরা পারভিন, মিসরাত জাহান মৌসুমী, রূপনা চাকমা, শামছুন্নাহার, শিউলি আজিম, সানজিদা আক্তার, সাবিনা খাতুন, সিরাত জাহান স্বপ্না। নামে, চেহারায়, উচ্চতায় এক অপার বৈচিত্র্য। বাংলাদেশের আসল চিত্রটি এমনই। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ছিল তেমন একটি বাংলাদেশ গড়ে তোলা যেখানে সব ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল মানুষ প্রকৃতির সাথে একাত্ব হয়ে গড়ে তুলবে সোনার বাংলা। প্রকৃতি জগতের টিকে থাকার মুখ্য নিয়ামক হচ্ছে বৈচিত্রের মধ্যে একত্ব (Unity in diversity)। যখনই তার অন্যথা হয়েছে, তখনই এসেছে ধ্বংস। গত কয়েক বছরে করোনাভাইরাস সারা পৃথিবীর জীববৈচিত্র ধ্বংসকারী মানবকুলকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে তা দেখিয়ে দিচ্ছে। আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে কীভাবে মানুষ যুগ যুগ ধরে হত্যা করছে বৈচিত্রকে। এভাবে চলতে থাকলে আমরা একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো। তাই আমাদের মেয়েদের শুধু অভিনন্দন জানালেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজনও আমাদের আছে। আমাদের দেশের জাতিসত্তার অপরিহার্য অংশ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রতি নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক আচরণ আর কতদিন চলবে? কতদিন পর নারী ও পুরুষের সমান বেতন নিশ্চিত হবে বাংলাদেশে? কবে আমাদের আইনে এমন বিধান আসবে যেখানে নারী ও পুরুষ তাদের বাবা মায়ের সম্পত্তির সমান ভাগ পাবে? আমাদের সৌভাগ্য আমাদের হার না মানা নারীরা লড়াই করছে হাজার বছরের বৈষম্য, বঞ্চনার বিরুদ্ধে অবিরাম। তার ফলও তারা পেতে শুরু করেছে। সাফ ফুটবলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব তার একটি নজির মাত্র। সামনের দিনগুলোতে আমাদের লক্ষ্য হবে যেন আমাদের মেয়েরা আর বৈষম্য ও বঞ্চনার মুখোমুখি না হয়েই সাফল্যের শিখরে পৌঁছাতে পারে।
তথ্যসূত্র:
সৈয়দ আবুল মকসুদ, 'তেঁতুল তত্ত্ব' (প্রথম আলো, ১৫ জুলাই ২০১৩)
মো. আনোয়ার হোসেন, 'সমতার পৃথিবী- করোনাভাইরাসের সাথে কথোপকথন' (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর, মতামত, ১৭ই এপ্রিল ২০২০)