Published : 15 Sep 2020, 08:50 PM
গত ২৮ শে অগাস্ট সুইডেনের সর্বদক্ষিণে, ডেনমার্কের সীমান্তবর্তী তৃতীয় বৃহত্তম শহর মালমোতে কোরান পোড়ানোর জেরে কয়েকশ ক্ষুদ্ধ মুসলিম সহিংস বিক্ষোভ করেছে। পাশ্ববর্তী দেশ ডেনমার্কের কট্টর ডানপন্থী রাজনীতিক রাসমুস পালাদুন কোরান পোড়ানোর পেছনে ইন্ধন জুগিয়েছিলেন। তিনি নিজেও এই পোড়ানো কাজে অংশ নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাধ সাধে সুইডেনের পুলিশ; তাকে সীমান্ত অতিক্রম করতে দেওয়া হয়নি।
কোরান পোড়ানোর পক্ষের লোকদের যুক্তি হল মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অংশ হিসেবে তারা এই কাজ করেছে। এই কাজ করেই তারা থেমে থাকেনি। তারা কোরান পোড়ানোর দৃশ্যের ভিডিও ধারণ করে অন্তর্জালে ছড়িয়ে দিয়েছে। অথচ সুইডেন বা ডেনমার্কে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে ঘৃণা ছড়ানোর অধিকার কারও নাই। ডেনমার্কে এই কট্টর রাজনীতিক রাসমুস পালাদুন ইতিপূর্বে বর্ণবাদ এবং অন্যান্য অপরাধে সাজা ভোগ করেছিলেন।
এখন প্রশ্ন হল কোরান পুড়িয়ে কার কি লাভ?
কট্টরপন্থী রাজনীতির কুশীলবরা কিছু একটা ঘটিয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করতে চান। একই সঙ্গে মুসলিমদের প্ররোচিত করতে চান। তারা এই বলে জানান দিতে চান, তারা সক্রিয়; তাদেরও অবস্থান আছে। একই সঙ্গে ভিন্ন মতাবলম্বী বিশেষ করে অভিবাসী মুসলিমদের উস্কানি দিতে চান। আপাতদৃষ্টে মনে হয় কোরান পোড়ানোর উদেশ্য সফল হয়েছে।
কেননা শ কয়েক ক্ষুদ্ধ মুসলিম টোপটা ঠিকই গিলেছে। তারা সহিংস বিক্ষোভ দেখিয়েছে; ভাংচুর অগ্নিসংযোগ ইট পাটকেল নিক্ষেপের মত ঘটনা ঘটিয়েছে। এতে করে ইসলাম এবং মুসলিম সম্পর্কে মানুষের মাঝে বিরূপ ধারণা, ভুল বার্তা এবং অস্বস্তি তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করেছে। কট্টরপন্থীরা এরকমটাই চায়। কেননা তাতে করে বিবদমান অনেক সংকটের আড়ালে ঠেলে দিয়ে সংক্ষিপ্ত পথ ও সময়ে রাজনৈতিক ফায়দা লাভের সুযোগ পাওয়া যায়। বিগত দশকগুলোতে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোতে হয়েছেও তাই। সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে, ফিনল্যান্ডসহ উত্তর মেরু এলাকায় প্রায় সর্বত্রই ডানপন্থী এবং কট্টর ডানপন্থী পুঁজিবাদী রাজনীতি রমরমা অবস্থায় পৌছেছে। প্রকারান্তরে মার খেয়েছে সমাজবাদী গণতন্ত্রী প্রগতিশীল বামধারার রাজনীতি।
অভিবাসী মুসলমানদের সামাজিক সাংস্কৃতিক পারিবারিক নানা বিষয়কে অতিরঞ্জন করে কট্টর ডানপন্থী জাতীয়তাবাদীরা তুলে ধরেছে। কার্যত তারা লাভবান হয়েছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের বিবদমান সমস্যা ও সংকটের সমূহ দোষ গিয়ে পড়েছে অভিবাসীদের উপর। অভিবাসীদের বেশিরভাগ যেহেতু মুসলিম, তাই দায়টাও তাদের উপর দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক বিতর্ক এবং গণমাধ্যমের অদূরদৃষ্টি সম্পন্ন ভূমিকার কারণে অভিবাসী বিষয় নানা সময় ভুল বিতর্কের লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। মোটাদাগে বেকার সমস্যার কথাই বলা যায়। সমাজে এমন একটা সুপ্ত ধারণা এবং মনোভাবের উদয় হয়েছে, অভিবাসীরা না থাকলে যেন এই অঞ্চলে বেকার সমস্যা থাকত না। তারা যেন চাকরির বাজারে ভাগ বসিয়েছে। অথচ বেকারত্বের কয়েকটি বড় কারণ হচ্ছে অন্যকিছু। ব্যাপক হারে ডিজিটাল সেবা প্রবর্তনের কারণে কাজের ক্ষেত্র সংকোচিত হয়ে পড়েছে। কোথাও কোথাও কর আদায়ের হার কমানোর ফলে অর্থনীতি চাপের মধ্যে পড়েছে। বেসরকারিকরণের ফলে কর্মবাজার ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি বা শিল্পায়নের উল্লেখযোগ্য কোন নজির দৃশ্যমান নয়।
এই বাস্তবতায় আমার প্রশ্ন হলো, স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় কি ইসলাম বিদ্বেষ বাড়ছে? এই প্রশ্ন নিয়ে বিশদ আলোচনায় যাবার আগে কাছাকাছি সময়ের কয়েকটা ঘটনা উল্লেখ করতে চাই।
মধ্যপ্রাচ্যের কোন একটি দেশের একজন কার্টুনিস্ট, যিনি দুটি বিয়ে করেছেন, তারা আলাদা আলাদা সময়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার একটি দেশে ঢুকেছেন, আশ্রয় নিয়েছেন, শরণার্থী হয়েছেন। শেষতক স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। কিন্তু সমস্যা হল, এই অঞ্চলের আইন তো দুই বউ রাখার সুযোগ দেয় না। এই সংকটের সমাধান কোথায় কিভাবে? এই জন্যে এক পক্ষ ইসলামকে দোষারোপ করার সুযোগ পেতে পারে। বিপরীত পক্ষ এই অঞ্চলের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকেও দোষ দিতে ছাড়ে না। এখানে সাদামাটা সমাধান হল, আধুনিক সভ্য কোন ব্যবস্থাই দুটি বউ রাখার স্বীকৃতি দেয় না। সেখানে স্ক্যান্ডিনেভিয়া কেন দিবে?
একজনকে যখন এই অঞ্চলের কোন দেশে স্থায়ীভাবে থাকার সুযোগ দেওয়া হয়, তখন তার ধর্মীয় বা গোত্র বা বর্ণ পরিচয়কে গণনার মধ্যে ধরা হয় না। একজন মুসলিম বা হিন্দু বা খ্রিস্টান, কালা বা ধলা বৌদ্ধ বা ইহুদি; এরকমভাবে চিহ্নিত করার সুযোগ নাই। একজন ব্যক্তিমানুষ হিসেবে এক একজন এ অঞ্চলে ঢোকার পর যখন অতি মুসলমান, অতি হিন্দু, অতি খ্রিস্টান, অতি আস্তিক বা অতি নাস্তিক হয়ে যায়, তখন সাংস্কৃতিক অস্বস্তিটা শুরু হয়।
পরের ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশ থেকে আগত মুসলিম এক মা স্কুলে এসে তার সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েকে হিজাব পড়া অবস্থায় না দেখে গালে কষে চড় বসিয়ে দিয়েছেন, মেয়েটির সহপাঠিদের সামনেই। ঘটনা অধ্যক্ষ হয়ে নগর সংস্থা পর্যন্ত গড়িয়েছে। শেষতক নগর কর্তৃপক্ষ মেয়েটিকে তার মা-বাবার বাসা থেকে নিয়ে অন্যত্র থাকার ব্যবস্থা করেছে। এখানে মেয়েটির মা-বাবা অভিভাবকত্ব হারাবার মুখে পড়েছে, ধর্মীয় কারণে নয়, এখানকার বিদ্যমান আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবার কারণে। এই অঞ্চলের কোনও দেশেই শিশু বা সন্তানের উপর হাত তোলার বিন্দুমাত্র সুযোগ কারো নাই।
পরের ঘটনা অভিবাসী এক বাবা তার বিভিন্ন বয়সী স্কুল পড়ুয়া বাচ্চাদের রাত জাগিয়ে এবাদত করতে বাধ্য করেন। বাচ্চারা পরের দিন ক্লাশে গিয়ে ঘুমে ঢলে পড়ে। শেষে ঘটনা ফাঁস হয়ে যায়। তারাও সন্তানের অভিভাবকত্ব হারানোর মুখে পড়েন। এক পর্যায়ে ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। অভিযুক্ত ব্যক্তি ক্ষমা চেয়ে পার পেয়ে যান। এখানেও কিন্তু ধর্মীয় কারণে বা ধর্মীয় বিদ্বেষে তারা শাস্তির মুখে পড়েননি। শাস্তির মুখে পড়েছেন শিশু অধিকার লঙ্ঘনের দায়ে। জাতিসংঘ ঘোষিত শিশু কনভেনশনের শর্তগুলো মানলে স্ক্যান্ডিনেভিয়া কেন, কোন দেশেই শিশুর শান্তি বা স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবনযাপন বিঘ্ন ঘটানোর সুযোগ ও অধিকার কারো নাই। এই বাস্তবতাকে ধর্মীয় মোড়কে আড়াল করার সুযোগ নাই।
বিচ্ছিন্ন ঘটনা আরো ঘটেছে। বছর কয়েক আগে এক মুসলিম অভিবাসী বিপণী বিতানে পর্যাপ্ত পর্দানশীল পোশাক না পরার অজুহাতে মেয়েদের উপর আক্রমণ করেছে। এতে হতাহত হয়েছে। ওসব ঘটনার বা অপরাধের জেরে অপরাধীকে আদালত শাস্তি দিয়েছে, একজন মুসলিম হিসেবে নয়- একজন অপরাধী হিসেবে।
অন্যদিকে গত বছর নরওয়ের রাজধানী অসলোর শহরের এক মসজিদে অস্ত্রধারী এক সন্ত্রাসী হামলা করে। একই বন্ধুকধারী অন্য জায়গায় তার নিজের সৎবোনকেও হত্যা করে। হামলাকারী একজন শ্বেতাঙ্গ নরওয়েজিয়ান। মানশাওস নামের সেই যুবকের হত্যা এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অপরাধে ২১ বছরের সাজা হয়।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এসব ঘটনাগুলো দেখে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় কি ইসলাম বিদ্বেষ বাড়ছে?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে বা পরে ইউরোপে যেমন প্রাসঙ্গিক ছিল ইহুদি বিদ্বেষ বাড়ছে বা কমছে? তবে ইসলাম বিদ্বেষ বা অবিদ্বেষ বিষয়টা এতটা সাধারণীকরণ করা ঠিক হবে না। সামাজিক অসন্তোষ নানা কারণেই বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে সামাজিক বৈষম্যও। তার মূলে রয়েছে রাজনৈতিক ব্যর্থতা, অর্থনৈতিক সংকট। ১৯৯০ দশকে খোদ সুইডেনে বছরে হত্যাকাণ্ড ছিল চার। সেই সংখ্যা এখন চল্লিশে। স্বাভাবিক কারণে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সঙ্কটে বেশি মারের মুখে পড়ে অভিবাসীরা। তাই সঙ্কট ঘিরে প্রতিক্রিয়া বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দৃশ্যপটে তাদেরকে বেশি দেখা যায়। আর দায় এবং দোষটাও তাদের ঘাড়েই বেশি পড়ে। কেননা কম বেশি প্রায় সব দেশেই রাজনীতির মারপ্যাঁচে 'উদোর পিণ্ডি বুদোড় ঘাড়ে' কথাটা প্রযোজ্য।
একটা প্রশ্ন- বিদ্বেষ বলতে আমরা কী বুঝি? ইসলাম বিদ্বেষই বা কী? এই অঞ্চলে মুসলিমদের তো দমন করা হচ্ছে না। তাদের আইনসিদ্ধ কোন কাজেই বাধা দেওয়া হচ্ছে না। চাইলে মসজিদগুলোও নিয়ম মেনে সরকারি বরাদ্দ নিতে পারে। তবে কিছু মসজিদ ঘিরে কখনো কখনো নানা অনিয়ম ও আর্থিক কেলেঙ্কারী ফাঁস হয়ে পড়ে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় ইসলাম বা মুসলিম বাস্তবতায় যতটুকু প্রতীয়মান হয়- এখানে ইসলাম বিদ্বেষ বাড়ছে এরকম বলার কারণ নাই। কিছু ঘটনা বিদ্বেষপ্রসূত মনে হলেও, এগুলো এখন পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন ঘটনাই। কেননা এসব ঘটনার পেছনে রাষ্ট্র ও সমাজ কোন পর্যায় থেকেই সমর্থন বা পৃষ্টপোষকতা দেওয়া হয়নি। উৎসাহিতও করা হয়নি। এই অঞ্চল বিজ্ঞান এবং যুক্তি নির্ভর; তর্ক বিতর্কের মাধ্যমে ঐক্যমতে পৌঁছার ঐতিহ্য নিয়ে চলে।
তবে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ না বাড়লেও অস্বস্তি বা ভীতি যে কিছুটা বাড়ছে তা অস্বীকার করা যাবে না। বিশেষ করে ইরাক-সিরিয়া ঘিরে ইসলামিক স্টেটের বর্বরতা আর সিলসিলার সঙ্গেও স্ক্যান্ডিনেভীয় অঞ্চলের কারো কারো সংযোগ একটা কারণ।
অন্যদিকে আত্মীকরণ বা Assimilation এর ব্যর্থতার দোষ ও দায় কিছুটা সংগত এবং অসংগত কারণে পড়েছে ইসলামের উপর। এর একটি হল 'হালাল' খাবারের লোক দেখানো মহড়া। স্ক্যান্ডিনেভীয় অঞ্চলে হালাল এর তাৎপর্য হচ্ছে আপনার উপার্জনটা হালাল কি না, তারপরে খাবারটা স্বাস্থ্যসম্মত কি না। আর অন্যদিকে লোক দেখানো ইসলামপন্থিদের কাছে হালাল তো এক জিনিস না। একজন কাজ করছেন আইনবিরুদ্ধ বা নানা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে অনেক সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন, মসজিদের টাকার নয় ছয় করেছেন। অন্যদিকে দোকানে গিয়ে হাকডাক করছেন মাংসটা হালাল কী না? চিপসটা হালাল উপাদানে তৈরি কি না?
এরকম ঘটনাই সামাজিক স্তরে নানা অস্বস্তি বাড়াচ্ছে। দোষ গিয়ে পড়ছে ইসলামের উপর।
এই অঞ্চলের সমাজ যতটা উদার এবং যুক্তি নির্ভর, মুসলিমরা ততটা যুক্তি ও উদারতা নিয়ে আত্মীয়করণে এগিয়ে গেলে এখানে ইসলাম বিদ্বেষের কোন জায়গা নাই। একটা উদাহরণ দিতে চাই, সরকারি গুরুত্বপূর্ণ কোন ঘোষণায় সুইডিশ ইংরেজির পাশাপাশি এখন আরবিতেও থাকে। তাহলে? মেলাতে গেলে নিজেকেও মিলিতে হবে। আর এই সত্যটা উভয় পক্ষকেই মানতে হবে।