Published : 28 Aug 2020, 12:20 PM
জীবদ্দশায় বাঙালির মাঝে থাকলে এবছর তার বয়স হতো একশ বছর। এ বছর বাঙালি উদযাপন করছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। যথাযোগ্য মর্যাদায় জন্মশতবার্ষিকী পালনের জন্য ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে পরবর্তী এক বছর মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি প্রায় সকল পর্যায়ে বিভিন্ন আয়োজনে মুজিববর্ষকে সমৃদ্ধ করে তোলার উদ্যোগও ছিল সর্বত্র। করোনাভাইরাস মহামারীকালে সীমিত আকারে চলমান নানা আয়োজনের মধ্যেই এলো অগাস্ট। বাঙালির শোকের মাস।
বাঙালি জীবনে কোনো অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধুর বিশাল কীর্তিকে অস্বীকার করা যাবে না। লক্ষ্যে স্থির থেকে ত্যাগ, সাহস, মাটি ও মানবপ্রেমের আদর্শে তিনি আমাদের চিরকাল উদ্বুদ্ধ করবেন। তিনি দেশের গণমানুষের মুক্তিকে দৃষ্টিসীমার মধ্যে রাখতে নতুন ভাবনার ভুবন রচনায় মানুষের চিত্তলোকের চেতনাকে প্রসারিত করেছেন জীবনব্যাপী। তিনি বিশ্বাস করতেন, চেতনায় নতুন নতুন স্বপ্নের বীজ বুনতে না পারলে, নতুন কিছু পাওয়া যায় না। অতীতে স্বাধীনতা সাধারণ মানুষের প্রত্যক্ষ সুখ-সুবিধার সাথে সম্পর্কিত ছিল না। তারা শুধু স্বাধীন বলে গর্ব করতে পারত মাত্র। বর্তমানে স্বাধীনতা সামগ্রিকভাবে প্রতিজন মানুষের জীবন-জীবিকার সাথে জড়িত। স্বাধীনতা উপভোগ করার জন্য ব্যক্তি-জীবনে, সামাজিক জীবনে, সাংস্কৃতিক জীবনে, রাষ্ট্রিক জীবনে শ্রেয়কে বরণের গুরুত্ব অনুধাবন করা প্রয়োজন। জীবনকে ফুলে-ফলে ভরিয়ে তোলার জন্য স্বাধীনতা দরকার। সেই স্বাধীনতা বাঙালিকে উপহার দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। তাই বঙ্গবন্ধু বাঙালি জীবনে শ্রেষ্ঠ। তিনি সরবে সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান।
১৯৭৫ সালে স্বাধীনতা দিবসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'বাংলাদেশ দুনিয়ায় এসেছে, বাংলাদেশ থাকবে, কেউ একে ধ্বংস করতে পারবে না।' মার্কিন পররাষ্ট্র সচিবের তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশ এবং উন্নত দেশের তালিকায় নাম লেখাতে তরতর করে এগিয়ে চলেছে। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের রোল মডেল হিসেবে অনুকরণীয় হয়ে উঠেছে। শিক্ষার হার বেড়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে, আয়ু বেড়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে, রফতানি আয় বেড়েছে, কৃষি উৎপাদন বেড়েছে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়েছে, রেমিটেন্স বেড়েছে, বাজেটের আকার বেড়েছে। এখানেই শেষ নয়। দেশে আজ শিশু মৃত্যুর হার কমেছে, দারিদ্র্য কমেছে, অপুষ্টি কমেছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৃত্যুর হার কমেছে, বৈদেশিক ঋণ-অনুদানের নির্ভরতা কমেছে। স্ব-অর্থায়নে পদ্মা সেতু দৃশ্যমান, বিদ্যুৎ উৎপাদন চাহিদার কয়েকগুণ বেশি, সারাদেশে নদী সংস্কারের কাজ চলমান, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, সড়ক প্রশস্তকরণ-সংস্কার-ফ্লাইওভার-ব্রীজ-কালভার্ট তৈরির মহাযজ্ঞ চলছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ সহজতর করতে ইপিজেড করা হচ্ছে। নৌপথ উদ্ধার আর রেল পরিসেবা উন্নয়নের মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন চলছে, সামাজিক নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের করা হয়েছে সম্মানিত।
বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে। প্রতিদিন একনেকে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। তবে উন্নয়নকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে রাজনীতিকরণের প্রভাবও দৃশ্যমান হচ্ছে প্রকটভাবে। ১৯৭১ সালে আমরা যে প্রেরণায় বাঙালি হয়েছিলাম, অধিকার সচেতন হয়েছিলাম, স্বাধীনতা অর্জনে জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, ৩০ লক্ষ প্রাণ ও ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলাম সে প্রেরণাকে আজ রাজনীতিকরণের প্রতিযোগিতায় খুঁজে পেতে কষ্ট হচ্ছে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ২১০ পাতায় লিপিবদ্ধ আছে বঙ্গবন্ধুর উক্তি 'শাসকেরা যখন শোষক হয় অথবা শোষকদের সাহায্য করতে আরম্ভ করে তখন দেশের ও জনগণের মঙ্গল হওয়ার চেয়ে অমঙ্গলই বেশি হয়।' দেশের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকালে জাতির জনক আমাদের স্মরণে আছে বলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। রাজনীতির চলমান দৃশ্যকাব্যে দেখা যায় দেশ আছে এবং থাকবে তাই যে যেভাবে পারো ব্যক্তি স্বার্থে নিবেদিত হও। উন্নয়ন প্রকল্পের সময় বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যয় বৃদ্ধি, দুর্নীতি লাগাম ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের অংশীদার হতে দলে দলে মানুষ রাজনীতির পতাকা তলে জড়ো হচ্ছে।
একটা ফুলের তোড়া ব্যক্তির রাজনেতিক দর্শন, আদর্শকে পরিবর্তন করে দিচ্ছে। রাজনৈতিক দলও ব্যক্তিকে নিজেদের নীতি আদর্শে অনুপ্রাণিত বিবেচনায় সাদরে গ্রহণ করছে। স্বার্থের লোভে দিশেহারা হয়ে জীবনের অর্জন বিসর্জন দিয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠায় রং বদল করছে মানুষ। আমলা, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মী, শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে কৃষক, শ্রমিক, জেলে, তাতি, বাস্তুহারা পর্যন্ত সব শ্রেণি পেশার মানুষ রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্তির প্রতিযোগিতায় নিয়োজিত। ক্ষমতার অংশ হয়ে, যোগ্যতার চাইতে অনেক বেশি উচ্চাভিলাষী হয়ে, নীতি নৈতিকতাকে পাশে রেখে, নেতার আদর্শ ও সংকল্পকে ঠোঁটে রেখে, দেশ ও জনগণের কল্যাণ বিবেচনাকে প্রাধান্য না দিয়ে, মানবিক দায়বদ্ধতার উর্দ্ধে থেকে আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে রত। রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্ত পেশাজীবীদের সাথে দুর্নীতি যোগ হওয়ায় স্বাধীনতার ৫০ বছরেও সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ অধরাই রয়ে গিয়েছে। বিপরীতে উন্নয়ন প্রকল্প জবাবদিহিতা-দায়বদ্ধতাহীন হয়ে পড়েছে। যে যেখানে দায়িত্ব পেয়েছে সেখানেই নিজের সুবিধাবাদী চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছে।
দেশে আজ কোনো প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করা যায় না, ব্যয় বরাদ্দ কয়েকগুণ বৃদ্ধি না করে প্রকল্প শেষ হয় না, প্রকল্প শেষ হতে হতে তার লক্ষ্য উদ্দেশ্য ভুলে যায় মানুষ। দলে পদ পেয়ে ক্যাসিনো ব্যবসায় সম্রাট, ঠিকাদার ব্যবসায় শামীম, মধুচক্রে পাপিয়ারা প্রকাশ্যে আসলেও সাধারণ মানুষের বিশ্বাস এখনো বহুকিছু অপ্রকাশিত আছে। নেতাদের কর্মকাণ্ডে একটা কলাগাছ কেনা হচ্ছে ৬ লাখ টাকায়, একটা নারকেল গাছ কেনা হচ্ছে ৬২ লাখ টাকায়, একটা কাঠের চেয়ার কেনা হচ্ছে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকায়, একটা পর্দা কেনা হচ্ছে ৩৭ হাজার টাকায়, একটা বালিশ কেনা হচ্ছে ৯ হাজার টাকায়, একটা টিনের ছাপড়া ৬ কোটি টাকায়, এক পাতার তথ্য ফরম ছাপানো হচ্ছে ৮ টাকা ৩৭ পয়সায়। আবার কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণেরও জোয়ার এসেছে। কেউ গ্রাম দেখতে যাচ্ছেন, কেউ পুকুর কাটা শিখতে যাচ্ছেন, কেউ আফ্রিকায় পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা দেখতে যাচ্ছেন। অবস্থাদৃষ্টে বোধ হয় বাংলাদেশের স্থপতি যখন বলেছেন 'বাংলাদেশ দুনিয়ায় থাকবে' তাই নিজেদের স্বর্গরাজ্য তৈরি করতে বাঁধা কোথায়?
১৯৭৫ সালে স্বাধীনতা দিবসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু আরো বলেছিলেন যে, 'রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যায়, যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না আসে'। রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করলেও স্বাধীনতা ভোগের জন্য যে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রয়োজন- সে বোধটিই যেন দিনে দিনে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। একশ্রেণির মানুষ সরকারকে স্থিতি নির্ভর বিবেচনায় বাঁধাহীন অবাধ ভোগের সুবিধা পাচ্ছে। তোয়াজে তুষ্ট রেখে রাজত্ব করছে যে যার জায়গায়। ব্যাংক জালিয়াতি, শেয়ার ধস, সিন্ডিকেট ব্যবসা, ঠিকাদারি, এমএলএম ব্যবসা, ঘুস, দুর্নীতি, দুঃশাসনের ব্যাপকতায় আখের গোছানোর সুযোগ ভোগ করছে আর অন্য শ্রেণির জন্য ৫০০ টাকার সামাজিক নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করে আপ্লুত হচ্ছে। ফলে ২০১৭ সালে সরকারি পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে দেখা যায়, ১০ শতাংশ ধনীর হাতে দেশের আয়ের ৩৮ শতাংশ এবং সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের হাতে দেশের মোট আয়ের ১ শতাংশ সম্পদ আছে। আবার দেশের নিম্নবর্গ তথা অতিদরিদ্র ৫ শতাংশ মানুষের আয়ের তুলনায় উচ্চবর্গের ৫ শতাংশ মানুষ ১২১ গুণ বেশি আয় করে। এই অর্থনৈতিক বৈষম্যই বলে দেয় জাতির জনকের অনুসারীরা নেতার প্রতি কতটুকু অনুগত থেকে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তিতে নিবেদিত।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ গণপরিষদে বলেছিলেন সরকারি কর্মচারীদের মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে। তারা শাসক নন, তারা সেবক। জাতির জনকের নির্দেশ আজও বাংলাদেশে অনুরণিত হতে দেখা যায়। কিন্তু স্বাধীন দেশ উপযোগী মনোভাব পরিবর্তনের কোনো প্রয়োজন সরকারি কর্মচারীরা বিশ্বাস করে বলে মনেই হয় না। তারা জনগণের ইচ্ছার অনুগত সেবক হওয়ার বা থাকার চাইতে প্রভু হতেই আগ্রহী। তাদের ক্ষমতা প্রদর্শনের আগ্রহে ও প্রকাশিত দম্ভে, একজন শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে উন্নত মানুষের মধ্যে যে পরিশীলিত রুচির সৌজন্য থাকে তার খোঁজও জনগণ পায় না। বর্তমান সময়ে সরকারের স্থিতি নির্ভরতা প্রধান নিয়ামক হয়ে যাওয়ায় এ ক্ষমতাবান মানুষগুলো জবাবদিহিতা, দায়বদ্ধতার উর্ধ্বে চলে গিয়েছে। রাজনীতির অঙ্গীকার ও আশ্বাসের পাশাপাশি সরকারি কর্মচারীদের স্বভাবসিদ্ধ করুণাই জনগণের একমাত্র ভরসা।
অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ৪৮ পাতায় আছে, 'নেতারা যদি নেতৃত্ব দিতে ভুল করে, জনগণকে তার খেসারত দিতে হয়'। সাধারণ জনগণকে যে খেসারত দিতে হচ্ছে তা সামান্য দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন করতে পারলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। জনগণকে অর্থনৈতিক মুক্তির অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়নে করণীয় নির্ধারণে নেতারা ভুল নেতৃত্ব দিচ্ছেন কিনা তা বিবেচনার দাবি রাখে। সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করে- জনগণের ভরসার মূল্য দেয়ার মানসিকতায় 'মুজিববর্ষ' ক্ষমতার বলয়কে সংকল্পবদ্ধ করবে, গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে একাট্টা করবে। প্রত্যাশা করে এবারের শোকদিবসে ক্ষমতার বলয় সাধারণ মানুষের কল্যাণে ব্রতী হবে। বিশ্বাস করি- জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সরব উপস্থিতিতেই সাধারণ মানুষের মুক্তি সম্ভব।