Published : 22 Jul 2020, 08:43 PM
১৯ জুলাই দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার প্রিন্ট সংস্করণে প্রকাশ হয় বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)- এর প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কালাম আজাদ-এর মিথ্যা তথ্য নির্ভর উপসম্পাদকীয় 'একটি চিঠি বদলে দিল দৃশ্যপট'। আবুল কালাম আজাদ তার উল্লেখিত লেখাটিতে তথ্য পরিবেশন করেছেন। তিনি সেখানে দেশবাসীর উদ্দেশে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার চিঠি প্রসঙ্গেও প্রয়াত সর্বজন শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক বেবী মওদুদের ভূমিকা নিয়ে মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করেছেন।
সমকালীন ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এ চিঠি বিষয়ে মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করে তিনি ইতিহাস বিকৃতি ঘটিয়েছেন। আবুল কালাম আজাদ তার লেখায় উল্লেখ করেছেন:
"…১৬ জুলাই ভোর থেকেই নেত্রীকে গ্রেফতারের আনুষ্ঠানিক পর্ব শুরু হল। এ আরেক কালো অধ্যায় বাঙালির জীবনে। ভোর ৫টায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তা সুধা সদনে প্রবেশ করেন। তারা নেত্রীকে গ্রেফতারের বিষয়টি অবহিত করলেন। নেত্রী তাদের চা-নাস্তা দিতে বললেন তার বাসার স্টাফদের। এরই মধ্যে তিনি নিজেও তৈরি হলেন। নামাজ পড়লেন। কোরআন শরিফ পড়লেন। এরপর দেশবাসীর উদ্দেশে একটি চিঠি লিখে তার সুধা সদনের বাসায় অবস্থান করা নাতি টুটুলের কাছে দিয়ে বললেন, এটি যেন সে আমাকে পৌঁছে দেয়।"
"…আমি যেহেতু প্রেস সেক্রেটারি; তাই তিনি তার নাতি টুটুলকে বলেছিলেন এটি আমার হাতেই দিতে। খামবদ্ধ এ চিঠিতে কী আছে, আমি জানতাম না। টুটুলও না।"
"…আদালত থেকে আমি প্রেস ক্লাবে আসার কিছুক্ষণ পর, সাড়ে ১০টার দিকে টুটুল ফোন করে জানায়, আমার জন্য একটি চিঠি লিখে রেখে গেছেন নেত্রী। আমি কীভাবে নেব, তা জানতে চাইল টুটুল। আমি জবাবে ওকে বললাম, একটু অপেক্ষা করতে। কীভাবে নেব জানাব। এর কিছুক্ষণ পর ফোন করলেন প্রয়াত সাংবাদিক বেবী মওদুদ। নেত্রীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত তিনি সবার কাছে। বেবী মওদুদ বললেন, 'চিঠি আমার কাছে। টুটুলের কাছ থেকে আমি নিয়ে আসছি। তুমি এসে নিয়ে যাও।' আমি একটু রেগেই গেলাম এ খবর শুনে। তাকে বললাম, 'নেত্রী চিঠিটা আমাকে দিতে বলেছেন। আপনি কেন নিলেন?' এ নিয়ে আরও কিছু কথা হল। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন। এরপর জনকণ্ঠের সিনিয়র সাংবাদিক দুলাল ভট্টাচার্যকে দিয়ে চিঠিটা প্রেস ক্লাবে আমার উদ্দেশে পাঠিয়ে দিলেন। দুপুর ১টার মধ্যে চিঠি আমার হাতে এলো। কাউকে কিছু না বলে খাম খুলে ভেতরের কাগজটি বের করলাম। দেখলাম, গ্রেফতারের আগে দেশবাসীকে উদ্দেশ করে লেখা নেত্রীর একটি বক্তব্য।"
উল্লেখিত লেখায় আবুল কালাম আজাদ মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করতে গিয়ে সেই সময়ের তরুণ সাংবাদিক দুলাল আচার্য এর নামটি পর্যন্ত ভুল করেছেন, লিখেছেন 'দুলাল ভট্টাচার্য'। অথচ তার নাম দুলাল আচার্য।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় দুলাল আচার্য এর সঙ্গে। তিনি অকপটে জানালেন, 'আবুল কালাম আজাদ পরিবেশিত সকল তথ্য মিথ্যা, মূলত বেবী আপাকে ছোট করে নিজে সকল ক্রেডিট নিতে গিয়ে তিনি ইতিহাস বিকৃতি ঘটিয়েছেন।'
২০১২ সালের ১৬ জুলাই দুলাল আচার্য দৈনিক জনকণ্ঠে এই চিঠির বিষয়ে একটি নিবন্ধ লিখেন, সেখানে তিনি এই চিঠির নেপথ্যে আসল তথ্য তুলে ধরেন। দুলাল আচার্য তার নিবন্ধে যা লিখেছেন তা তুলে ধরলাম:
আজ ১৬ জুলাই। ২০০৭ সালের এদিনে ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্তে জাতির উদ্দেশে তিনি একটি চিঠি লিখে যান; যা পরদিন জাতীয় দৈনিকগুলো ফলাও করে প্রকাশ করে।
শেখ রেহানা সম্পাদিত ও প্রকাশিত সাপ্তাহিক বিচিত্রায় চাকরি করার সুবাদে এবং সাংবাদিক বেবী মওদুদের স্নেহধন্য হওয়ায় সেই স্মৃতিময় ঘটনায় নিজেকে সম্পৃক্ত করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। আজ বিশেষ করে মনে পড়ছে সেদিনের কথা।
ভোর ৬টায় রঞ্জনদার (বর্তমানে এটিএন নিউজে কর্মরত) ফোনে আমার ঘুম ভাঙ্গে। তিনি জানালেন, দুলাল, আপাকে (শেখ হাসিনা) গ্রেফতার করেছে; টিভি খুলে দেখ। টিভিতে চোখ রাখতেই গ্রেফতারের প্রস্তুতি দেখে বিস্মিত হই। সকাল ৯.৪৫ মিনিটে অফিসে পৌঁছি (বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের দুই বাড়ি আগে শুক্রাবাদ বাসস্ট্যান্ড)। দেখি বেবী আপা টিভি রুমে। সিএসবি চ্যানেলটি সরাসরি শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার, আদালতে নেয়াসহ নানা দৃশ্য সম্প্রচার করছে। আমি পাশের একটি চেয়ারে বসি। আদালত এলাকায় গাড়ি থেকে নামানোর সময় টানাহেঁচড়ার দৃশ্য টিভিতে দেখে বেবী আপা হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। তাঁর দু'চোখ বেয়ে পানি ঝরছে! তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। কেমন যেন শোকাবহ পরিবেশ। কিছুক্ষণ পর বেবী আপার মোবাইলে একটি ফোন এলো। তিনি কিছু না বলেই বের হয়ে গেলেন।
দুপুর দু'টার পর পরই অফিস ফাঁকা হয়ে যায়। অফিসে ওয়ালিদ, মনির ও আমি। চারদিকে এক ধরনের নীরবতা ও ভীতিকর পরিস্থিতি। রাস্তায় লোকজন খুব কম। কেমন যেন থমথমে ভাব। ওয়ালিদ (বিচিত্রার সার্কুলেশন ম্যানেজার) বলল, চল, সবাই চলে গেছে আমরাও যাই। আপা (বেবী আপা) মনে হয় আজ আর আসবেন না। আমি বললাম, দাঁড়াও একটু অপেক্ষা করি। বিচিত্রার চাকরি জীবনের প্রায় নয় বছরে একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। বেবী আপা অফিস থেকে যখনই বের হন না কেন, অফিস বন্ধ হওয়ার আগে একবার আসেন। বরাবরের মতো আমি আর মনির (অফিস সহকারী) অপেক্ষা করি।
বিকেল তিনটার কিছু বেশি হবে। বেবী আপা তাঁর রুমে ঢুকেই মনিরকে ডাকলেন। ৪/৫ মিনিট পর আমি ইচ্ছা করেই আপার রুমে যাই। দরজায় দাঁড়িয়ে আছি, আপা বইয়ের সেলফ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই বের করছেন, কিছু বই ইতোমধ্যে টেবিলেও রেখেছেন। আমাকে দেখে বললেন, দুলাল মনির আসুক, তোমাকে প্রেসক্লাব যেতে হবে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম, কিছু বললাম না। বুঝলাম আপার মনের অবস্থা ভাল না। আপা বললেন, তুমি এখন যাও আমি ডাকব। ৫ মিনিট পর মনির এসে বলল, দুলাল ভাই ফুপু ডাকছেন। (মনির বেবী আপাকে ফুপু বলে সম্বোধন করতেন)। আমি আপার রুমের দিকে এগুচ্ছি, পেছনে মনির। মনির বলল, দুলাল ভাই 'জরুরী' খবর আছে। আমি রুমে ঢুকতেই বেবী আপা বললেন, এখানে ২০ কপি আছে তুমি প্রেসক্লাব গিয়ে আজাদের (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সেক্রেটারি) কাছে দেবে। আজাদকে তোমার কথা বলা আছে। প্যাকেটটি হাতে নিয়ে যাও। আমি বুঝতে পারলাম, এটা বড় আপার হাতের লেখা। কারণ পাশেই মূল কপিটা রাখা ছিল। আমরা বিচিত্রায় যারা চাকরি করতাম তারা সবাই শেখ হাসিনাকে (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী) বড়আপা এবং রেহানা আপাকে ছোটআপা বলেই ডাকতাম। বিচিত্রায় চাকরি করার সুযোগে শেখ হাসিনার হাতের লেখার সঙ্গে আমার একটা পরিচয় রয়েছে। তাঁর বেশিরভাগ লেখাই বিচিত্রায় কম্পোজ হতো এবং এক পর্যায়ে সংশোধনের জন্য আমার কাছে আসত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সম্প্রতি প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'র কাজে কয়েকবার আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডে ফকরুল আলম স্যারের বাসায় যেতে হয়েছে। ডায়রির বাংলা কম্পোজের পর ইংরেজী করার জন্য স্যারের বাসায় বেবী আপা আমাকে পাঠাতেন। আমি অফিস ছুটির পর স্যারকে এগুলো পৌঁছে দিতাম।
আমি আমার সিটে গিয়ে ব্যাগটি গুছিয়ে নিয়ে প্যাকেটটি ব্যাগের একটি ভাঁজে রাখলাম। ওয়ালিদকে বললাম উঠো। টেবিল ছেড়ে উঠতেই বেবী আপা ডাকলেন- দুলাল। আমি কাছে যেতেই ১০০ টাকার একটি নোট দিয়ে বললেন, তাড়াতাড়ি যাও, দেরি করো না। আর শোন, আজাদকে বলবা যাঁরা আওয়ামী লীগ বিট করেন তাদের ফোনে ডেকে হাতে হাতে দিতে। ঠিক আছে আপা, বলেই আমি বের হয়ে গেলাম। রাস্তায় নেমেই ওয়ালিদ বলল, আমি তোমার সঙ্গে নেই। আমি বুঝলাম এটি তার দুষ্টুমি। বেবী আপা আমাকে এর আগে যত দায়িত্বই দিয়েছেন তার সবগুলোতে ওয়ালিদ কোন না কোনভাবে আমাকে সহায়তা করেছে।
আমরা মিরপুর থেকে আসা (৯ নম্বর) একটি লোকাল বাসে প্রথমে নিউমার্কেট যাই। নিউমার্কেটে গিয়ে বাস আর যাবে না। পরে নিউমার্কেট থেকে রিক্সায় প্রেসক্লাব যাই। ওয়ালিদ পল্টনে প্রেসে চলে যায়। প্রেসক্লাব গেট থেকে আমি আজাদ ভাইকে ফোন দেই। তিনি বললেন আমি ভেতরে। আমি ভেতরে ঢুকে দেখি আজাদ ভাই মাঠে পায়চারি করছেন। প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সংখ্যাও আজ কম।
আজাদ ভাই আমাকে দেখে বললেন কই দেও। প্যাকেটটি হাতে দিতেই তিনি কি যেন বলতে চাইলেন। আমি বললাম, আজাদ ভাই বেবী আপা বলেছেন, আওয়ামী লীগ বিট যাঁরা করেন তাঁদের ডেকে হাতে হাতে দিতে।
তিনি আমার দিকে তাকালেন। আজাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় মূলত বিচিত্রা অফিসেই। সম্ভবত ২০০২ সালে। তখন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার প্রেস উপদেষ্টা জাওয়াদুল করিম ভাই বিচিত্রা অফিসে (বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর) একটি কক্ষে বসতেন। সেখানে নেত্রীর প্রেস সংক্রান্ত কাজ চলত। শোকবাণী, বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসের বাণী সবই তখন এখান থেকে দেয়া হতো। জাওয়াদুল করিম ভাইকে সহায়তার জন্য এক সময় আসলাম সানী ভাইকে নিয়োগ দেয়া হয়। বেবী আপার নির্দেশে আমিও জাওয়াদ ভাইকে সহায়তা করতাম। আজাদ ভাই আসার আগে এখানে কিছুদিন কাজ করেছিলেন পিআইডির সদ্য সাবেক প্রধান হারুন-উর-রসিদ ভাই। আজাদ ভাই আসার পর হারুন ভাই আর আসতেন না। জাওয়াদ ভাই মারা যাওয়ার পর আজাদ ভাই পুরো দায়িত্ব নেন। সানী ভাই চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। তারপর যতদিন বিচিত্রা অফিসে নেত্রীর প্রেস অফিস ছিল ততদিন কম্পিউটার অপারেটর ফাতেমা কম্পোজ করত। আমি তা সংশোধন করে দিতাম। অনেক সময় বেবী আপা আমাকে ফোনে বলতেন অমুক যাবে তাকে একটি শোকবাণী অথবা কোন কাগজ রেডি করে রাখো। আমি এসে দেখব। পরোক্ষভাবে সেসময় বেবী আপাও নেত্রীর প্রেসের দায়িত্ব পালন করতেন।
-আজাদ ভাই খুলে পুরো চিঠিটা পড়লেন।
-আমি বললাম, আজাদ ভাই আমি কি আপনাকে কোনভাবে সহায়তা করতে পারি। তিনি বললেন, তুমি কোন্দিকে যাবে। আমি বললাম, মতিঝিলের দিকে। তিনি আমাকে ৬টি কপি দিয়ে বললেন। যাবার পথে এগুলো সংবাদ, যুগান্তর, ইত্তেফাক, ইনকিলাব, অবজারভার অফিসে দিয়ে যাবে। একটা বেশি আছে প্রয়োজনে ফটোকপি করে নিও।
প্রেসক্লাব থেকে বের হয়ে প্রথমে রঞ্জনদাকে ফোন দিলাম। রঞ্জন সেন (বিচিত্রার সাবেক কর্মী) তখন সংবাদের রিপোর্টার। রঞ্জনদা বললেন, 'আমি অফিসে'। সংবাদে ঢুকেই রঞ্জনদাকে একটি কপি দিলাম। তিনি দাঁড়িয়ে চোখ বুলিয়ে বার্তা সম্পাদক হয়ে নির্বাহী সম্পাদকের রুমে গেলেন। খুব দ্রুত সেখান থেকে বের হয়ে একটা রিক্সা নিলাম যুগান্তর অফিসের উদ্দেশ্যে। রিসিপশনে দাঁড়িয়ে ফজলুর রহমানকে (তিনিও বিচিত্রার সাবেক কর্মী, বর্তমানে সকালের খবরের চীফ রিপোর্টার) ফোন দিলাম। তিনি বললেন, উপরে আস। হাতে একটি কপি দিলে তিনি দ্রুত সাইফুল ভাইকে (বর্তমানে যুগান্তরের নির্বাহী সম্পাদক) দিলেন। কোথায় পেলাম জানতে চাইলে বললাম বেবী আপা দিয়েছে। সাইফুল ভাই এক নিঃশ্বাসে পড়ে আমার দিকে পরপর দু'বার তাকালেন, বললেন, যাও সাবধানে যেও। ফজলু ভাই আমার সঙ্গে নিচে নামলেন এবং আমাকে বললেন, এখন কোথায় যাবে। আমি বললাম ইত্তেফাক, ইনকিলাব। বললেন সাবধান, ব্যারিস্টার মইনুলের পত্রিকা কিন্তু।
আমি একটা রিক্সা নিয়ে ইত্তেফাকের গেটে নেমে উপরে উঠে প্রথম ফরাজী আজমল ভাইকে খুঁজলাম। দেখি তিনি অফিসে নেই। পরে জাহিদুর রহমান সজলকে খুঁজলাম সেও বাইরে। আমার পরিচিতদের মধ্যে আবুল খায়ের, স্পোর্টসের কাশীদা অফিসে থাকলেও তাদের কাছে দেয়াটা নিরাপদ মনে করলাম না। নিচে নেমে দুটো খাম কিনে ভেতরে একটি করে কপি ইত্তেফাক ও ইনকিলাব পত্রিকার প্রেস রিলিজ বক্সে রাখি। পরে আজাদ ভাইকে ফোন দেই। তাঁকে বিস্তারিত বললাম এবং আমার কাছে দু'টি কপি আছে বললাম। তিনি বললেন ঠিক আছে, তুমি কাছাকাছি থেকো। প্রয়োজনে ফোন দেব। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাসায় যেতে ইচ্ছা হলো না। হাঁটতে হাঁটতে মতিঝিল মসজিদ মার্কেটে অর্থকণ্ঠ অফিসে গেলাম। পত্রিকাটির মালিক আমার বন্ধু এনামুল হক এনাম। অফিসে বসে দুই গ্লাস পানি খেলাম। ভাবলাম বেবী আপাকে একটা ফোন দেই।
প্রথমবার তিনি ধরলেন না। দশ মিনিট পর আবার ফোন দিলে তিনি রিসিভ করেই বললেন, দুলাল বলো। আপাকে বিস্তারিত বললাম, তিনি বললেন ঠিক আছে বাসায় চলে যাও।"
দুলাল আচার্য এর সঙ্গে ফোনে কথার বলার পরে আবুল কালাম আজাদের লেখার প্রসঙ্গে কথা হয় সাংবাদিক রঞ্জন সেন-এর সঙ্গে, তিনি তখন দৈনিক সংবাদ পত্রিকার রিপোর্টার, দুলাল আচার্য এর সঙ্গে রঞ্জন সেন-এর তথ্য হবহু মিলে যায়, রঞ্জন সেন টেলিফোনে জানান- "বেবী আপা আমাকে ফোন দিলেন, তিনি বললেন, 'দুলাল যাবে তোমাকে একটি জিনিস পৌঁছে দেবে।' কিছুক্ষণ পর দুলাল আমাকে ফোন করলো, জানতে চাইলো আমি কোথায়, আমি বললাম আমি অফিসে। দুলাল বললো ও প্রেসক্লাব হয়ে আসবে। তারপর দুলাল আসলো, আমি যদি ভুল না করি তখন দুলালের সঙ্গে ওয়ালিদও ছিল। দুলাল আমার কাছে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে নেত্রীর লেখা চিঠির ফটোকপি দিয়ে বললো এটা বেবী আপা দিয়েছে। পরে সংবাদ থেকে যুগান্তরে গিয়েছিল ওরা। এত বছর পরে আবুল কালাম আজাদ ভাই কেন মিথ্যা তথ্য লিখলেন, আমি কিছুই বুঝলাম না।"
আবুল কালাম আজাদ তার লেখায় দাবি করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা গ্রেপ্তারের মুহূর্তে ঐতিহাসিক এই চিঠি তার জন্যই রেখে গিয়েছেন, তার এই তথ্য সত্য নয়। এমনকি তার হাতে যে চিঠি পৌঁছানো হয়েছে তাও ছিল ফটোকপি, তিনি চিঠির কোনও মূল কপি দেখাতে পারবেন না। বিচিত্রা অফিসের অফিস সহকারী মনির আর সাংবাদিক দুলাল আচার্য দুজনে বেবী মওদুদের নির্দেশে মূল কপি থেকে ফটোকপি করেন চিঠি। এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন দুলাল আচার্য নিজে।
প্রথমেই জানিয়ে নিচ্ছি আবুল কালাম আজাদ দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় রিপোর্টার ছিলেন। ইত্তেফাকে থাকাকালীন অবস্থাতেই বেবী মওদুদের সঙ্গে তার পরিচয়, পরবর্তীতে বেবী মওদুদের হাত ধরেই সুধাসদনে প্রবেশ। এমনকি শেখ হাসিনার প্রেস সেক্রেটারি হিসেবে তার নিয়োগের বিষয়েও প্রধান ভূমিকা পালন করেন বেবী মওদুদ। সাব-এডিটর থেকে প্রেস সেক্রেটারি পর্যন্ত আবুল কালাম আজাদকে তুলে আনেন বেবী মওদুদ।
আবুল কালাম আজাদ সস্তা ক্রেডিট নেওয়ার জন্য ইতিহাস বিকৃতি ঘটিয়েছেন। তিনি ভেবেছেন বেবী মওদুদ যেহেতু আর বেঁচে নেই সেহেতু কাউন্টার দেওয়ার কেউ নেই, নিকট অতীতের ঘটনাও সকলে ভুলে যাবে। শেখ হাসিনার গ্রেপ্তারের পরেও আবুল কালাম আজাদ একবারের জন্যও সুধাসদনে আসেননি। প্রেসক্লাবে নিরাপদেই ছিলেন।
আবুল কালাম আজাদ ভেবেছিলেন, বেবী মওদুদের অবর্তমানে এক যুগের এই সমান্য সময়ে ইতিহাস বিকৃতি ঘটিয়ে পার পেয়ে যাবেন। আসলে কী তাই? ছাত্রজীবন থেকে যে বেবী মওদুদ আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুকন্যার পাশে ছিলেন, তার ত্যাগ সব মিথ্যে হয়ে যাবে? ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই বেবী মওদুদ শেখ হাসিনার আপদে-বিপদে পাশে ছিলেন। বন্ধুত্বের খাতিরে এমন হৃদ্যতাপূর্ণ ত্যাগ ইতিহাসে বিরল।
বেবী মওদুদ চাইলে মন্ত্রী হতে পারতেন, কাড়ি কাড়ি টাকা আর সম্পদের মালিক হতে পারতেন, কিন্তু তিনি বৈষয়িক পথে হাঁটেননি। তিনি তার সততা নিয়ে সংগ্রাম করেছেন বেঁচে থাকার। স্বামীর মৃত্যুর পরে অনেক কষ্টে মানুষ করেছেন দুই সন্তানকে।
বাঙালি জাতি বেবী মওদুদের কাছে ঋণী হয়ে থাকবে আজীবন, কারণ বঙ্গবন্ধুর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' প্রকাশের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার অন্যতম সহযোদ্ধা ছিলেন বেবী মওদুদ। বাঙালির ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' আত্মপরিচয়ের অমূল্য দলিল হিসেবে পরিগণিত।
বাংলাদেশের প্রগতিশীল সকল আন্দোলন-সংগ্রামে বেবী মওদুদ এক আইকনিক নাম, একজন আবুল কালাম আজাদ হঠাৎ করে মিথ্যা তথ্যনির্ভর একটা কলাম লিখে বেবী মওদুদকে ছোট করতে চেয়ে মূলত নিজেই ছোট হলেন। তিনি ইতিহাস বিকৃতি ঘটিয়ে জাতির সঙ্গে প্রতারণা করলেন। তার মিথ্যা তথ্য নির্ভর এই উপসম্পাদকীয় প্রজন্ম ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করবে। এটা আবুল কালাম আজাদের ভ্রান্তি? নাকি অসুস্থতা?