Published : 18 Jul 2020, 09:56 PM
জীবন আপনাকে চিনতে বাধ্য করেছিল নির্মমভাবেই। ১৩ বছর বয়স থেকেই নিজেকে পূর্ণ মনে করতাম। প্রেমিক হয়ে উঠছিলাম। বাজারের পয়সা মারা ধান্দাটাও তখন থেকেই শুরু। 'প্রতিজ্ঞা' সিনেমা দেখে ফেরার পর বাবার হাতে ধরা খেলাম।
পেটানোর পর বাবার প্রথম প্রশ্ন- কোন ছবি দেইখতি গেলি? কোনওরকমে বললাম- প্রতিজ্ঞা।
বাবা ক্লাসিক্যাল গানের মানুষ ছিলেন। জিজ্ঞাসা করলেন- গানের লাইন কতি পারবিনে?
আমি বললাম- এক চোর যায় চলে, এ মন চুরি করে, পিছে লেগেছে দারোগা….
বাবা কিছুক্ষণ থম মেরে থেকে আবার প্রশ্ন করলেন- এই ছাওয়াল এই গানের শিল্পী কিডা?
আমি নাম বলতে পারলাম না। বাবা আবারো পেটানো শুরু করলেন। আর বলতে থাকলেন- পিছু লাগিছে দারোগায়…
পিছু লাগা সে-ই দারোগার নাম স্যার এন্ড্রু কিশোর। সেই থেকে আজ পর্যন্ত আমি এ স্যারের পিছু ছাড়তেই পারলাম না।
পরকাল বলে যদি কিছু থাকে হয়তো সেকালেও হয়তো পারবো না৷ ভালোবেসে মনে মনে আপনাকে স্যার বলতাম। আজ প্রকাশ্যে বললাম, আমৃত্যু বলবো; মাইন্ড করবেন স্যার?
আগেই বলেছি জীবন আপনাকে চিনতে বাধ্য করেছিল স্যার। আমি তখন বরিশাল ক্যাডেট কলেজের ক্লাশ টুয়েলভে। কালচারাল প্রিফেক্ট এর দায়িত্বে। এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এর তিন দিন আগে ক্লাস নাইনে পড়া ক্যাডেট আনিস এসে বললো- একটা গান গাইয়া শুনাই!
তারপর অনুমতির তোয়াক্কা না করেই গাইতে শুরু করলো-
ওগো বিদেশিনী তোমার চেরিফুল দাও, আমার শিউলি নাও
দুজনে প্রেমে হই ঋণী ওওওওওওও…
গান শুনে আমি তব্দা। এই আনিস আকাশ, গাছপালা দেখে আর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। পিটি ও প্যারেড এই আকাশ দেখেই করে বলে ওর নাম দিয়েছিলাম 'চাঁদ'। আমার তব্দা খাওয়া দেখে আনিস চাঁদ বললো- সরি বড় ভাই, অনেক বড়গো গান ছোডো মুখে গাইয়া ফালাইছি!
বহুকষ্টে গানটা হারমোনিয়ামে তোলা হলো। শিউলি ফুল পাওয়া গেল কিন্তু ঝামেলা বাঁধলো চেরিকে নিয়ে।
ক্যাডেট কলেজের সব লিখিত পরীক্ষা যেদিন শেষ, সেই রাতে জীবনের প্রথম প্রেমিকার বিয়ে! পদার্থ, রসায়ন আর জীববিজ্ঞান এর প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা দিতে গিয়ে বারবার মনে হলো প্রেমের প্র্যাকটিক্যালে আর কখনো হয়তো পাস করা হবে না।
কলেজ থেকে বিদায়ের আগের রাত। বিষাদের আলপনায় আঁকা অনুষ্ঠানের রাত। কান্না ছাড়া আর কোনও রং-তুলি নেই হাতে! রাত ১২টায় সাহস করে এলো একজন। সবে ক্লাশ এইটে উঠেছে। মন ভালো করার জন্য মনভাঙ্গা গান শোনাতে চায়-
…এতো কথা বোঝে পাখি মনের কথা বুঝলো না
আপন করে ভাবলাম যারে সেতো দূরে সরে রয়!
এইনা জ্বালার বিষের হৃদয় তিলে তিলে হয়রে ক্ষয়
এতোদিনে বুঝলাম আমি কেউ কারো নয়
ভালোবেসে গেলাম শুধুই ভালবাসা পেলাম না…
পরদিন সকালে চলে এলাম ক্যাডেট কলেজ থেকে। স্যার এন্ড্রু কিশোর আপনাকে রেখে আসতে পারলাম না। আপনি বুকের ভেতর থেকে গেলেন আগের মতোই! শেষ রাতে যে ছেলেটা আপনার গান শুনিয়েছিল তার নাম ইউসুফ হাসান অর্ক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এর নাটক ও নাট্ট্যতত্ত্বের শিক্ষক সে বহুদিন ধরে। এখনও সে গান গায়।
বাবার হাতে মার খাওয়া থেকে শুরু তারপর কলেজ জীবন শেষ। এরপর দেবদাস হয়ে নৌবাহিনীর শিক্ষানবিশ জীবন। সেখান থেকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। এন্ড্রু কিশোর আপনি বরাবরই আমার সাথে থেকে গেছেন ইংরেজি সেই জনপ্রিয় গানটার মতো- 'উইথ অর উইদাউট ইউ…'
বুয়েটে একবার উম্মাদনা দেখা দিল। অনেকে মিলে দলবেঁধে 'বেদের মেয়ে জোসনা' দেখার দিন আসলো। ভ্যান ভাড়া করে সেখানে হারমোনিয়াম তোলা হলো। এরপর সবাই মিলে শুরু করল সেই সিনেমার জনপ্রিয় গান গাওয়া- 'বেদের মেয়ে জোসনা আমায় কথা দিয়েছে, আসি আসি বলে জোসনা ফাঁকি দিয়েছে।'
যদিও নকল সুরের গান, কিন্তু উন্মাদনায় ভরা সেই গান আজও মানুষ গেয়ে থাকে সমান তালে। এর মাঝে বাসায় গেলে, বাবা একদিন আমাকে বললেন- সম্ভব হলে 'নয়নের আলো' ছবিটা দেখিস।
ওখানে এন্ড্রু কিশোরের দারুণ কিছু গান রয়েছে; তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য- 'আমার সারা দেহ খেওগো মাটি, শুধু চোখ দুটি মাটি খেয়ো না…'
এরপরের দিন দেখলাম বাবা পরম মমতায় আমার ছোটবোন শিল্পী সুরাইয়া হক কলিকে- 'আমার সারা দেহ খেওগো মাটি' গানটি শেখাচ্ছেন!
আপনি তখন থেকেই অন্য উচ্চতায়। মানুষের অন্তরে ঢুকে গেছেন অনেক আগেই। 'বড় ভালো লোক ছিল' সিনেমার সেই বিখ্যাত গান- 'হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস দম ফুরাইলে ফুস! তবুও তো কারোরই নাই একটুখানি হুঁশ' কিংবা 'ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে…' এসব গান আপনাকে সবার অন্তরের মাঝেই নিয়ে রাখলো। আপনি হয়ে উঠলেন বাংলা চলচ্চিত্রের গানে অপ্রতিদ্বন্দ্বী সম্রাট। আমার মতো কয়েক প্রজন্মের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায় আপনি ছিলেন, আপনি থাকবেন অনাদিকাল। আপনি মানুষের হৃদয়ের পুরস্কার, একাধিকবার জাতীয় পুরস্কার পেলেও গান আপনাকে কখনো অহংকারী করেনি।
তবে বাংলা চলচ্চিত্রের গান আপনাকে নিয়ে অহংকার করবে বহুদিন। ১৯৭৮-৭৯ সাল থেকে ২০২০। আপনার অবস্থান ছিল শীর্ষে। এ অবস্থান থেকে কেউ কখনো আর আপনাকে নামাতে চাইবে না। বিয়ের উৎসবে 'বেদের মেয়ে জোসনা, আমায় কথা দিয়েছে', যেমন গীত হবে, ঠিক তেমনি নতুন কাউকে প্রেমের প্রস্তাব দিতে হলে কেউ না কেউ কেউ গেয়ে উঠবেই- 'পড়েনা চোখের পলক, কি তোমার রূপের ঝলক, আমি জ্ঞান হারাবো মরেই যাব…'
আপনার গান নিয়ে আরও কয়েক প্রজন্ম বেঁচে থাকবে। যে ছেলেটা প্রেমিকাকে হারিয়ে ফেলেছে, কাব্য করে সেও গাইবে- 'আমি চিরকাল প্রেমেরই কাঙ্গাল/ যে ডালে বাধি বাসা ভাঙ্গে সেই ডাল…' অথবা 'সবাই তো ভালোবাসা চায়, কেউ চায় কেউ পায় না…';
আপনার গাওয়া মনভাঙ্গা সুরের গান প্রেমিক-প্রেমিকাদের পক্ষে কখনো ভোলা সম্ভব না- 'ভেঙ্গেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা /উড়েছে পাখি পথ অচেনা/ নীড়েরই ঠিকানা পাবে কিনা পাখি তা নিজেই জানেনা…'।
ভালোবাসার রূপ আর রং আপনার গানকে ভুলতে দেবেনা কখনো- 'চাঁদের সাথে আমি দেবনা তোমার তুলনা', কিংবা 'তুমি মোর জীবনের ভাবনা/হৃদয়ের সুখের দোলা…'।
ভালোবাসার রঙে সাজবেই তারুণ্য নির্ভর নতুন জীবন।.সেখানেও থাকবে আপনার গান- 'তুমি আমার জীবন, আমি তোমার জীবন/দুজন দুজনার কতো যে আপন কেউ জানেনা', অথবা 'কী জাদু করেছ বলো না…'।
আপনি মানুষকে বুঁদ করে রাখার জাদু জানতেন। আপনি জানতেন- আপনি কে। কিন্তু আমি? 'ডিফারেন্ট টাচ' ব্যান্ডের জিয়াউল হাসান পিয়াল এর স্মৃতিময় স্টুডিও তান এ যখন আপনার সাথে প্রথম দেখা হয় আমি বলেছিলাম- 'আই অ্যাম নোবডি। আমি কেউ না..।' এরপর যতবার আপনার সাথে দেখা হয়েছে আমি হ্যান্ডশেক করে বলতাম- 'আমি কেউ না..কিন্তু আপনি!'
আপনি গানের আকাশ থেকে নেমে আসা আমার কাছে এক প্রিয় গানের পাখি। এই পাখি সবার কাছে আসে না. ধরা দেয় না। হয়তো লালন সাঁইয়ের কাছে ছিল, হয়তো রাধারমন বা হাসন রাজার কাছে ছিল এই পাখি, হয়তো ছিল না। কখনো এই পাখি শুধু সুর তোলে অথবা কখনও শুধু গান গায়। আপনি মানুষের হৃদয়ের গান গাইতে এসেছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রে। গানের সুখ পাখি হয়ে উড়ে বেড়াতেন গানের আকাশে।
আমার স্কুল ও কলেজ জীবন, চাকরি পাওয়া, চাকরি হারানো ভবঘুরে জীবনযাপন বেছে নেওয়া, উড়নচণ্ডি এক ভাগ্যাকাশের নিয়তির মতোই আপনাকে মেনে নিয়েছিলাম। হৃদয়ের জানালাটা খুলে ডাকলেই চলে আসতেন আপনি। গানের রোদ্দুরে কিংবা বিষাদের মেঘে ডানা ঝাপটাতো গান পাখি। হয়তো গাইতো পাখি- 'চোখের জলে আমি ভেসে চলেছি', কিংবা 'এক বিন্দু ভালোবাসা দাও, আমি এক সিন্ধু হৃদয় দেব…'।
আমি আপনার কেউ না, তবু বহু বহুবছর আপনার কাছে আমার গানের হৃদয়টা বন্ধক ছিল। সবাই এখন বলছে পাখিটা আকাশে নেই, সেই গানের মতো কোথাও উড়ে গেছে- 'ভেঙ্গেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা/উড়েছে পাখি পথ অচেনা/নীড়েরই ঠিকানা পাবে কিনা/পাখি তা নিজেই জানে না…'
যেখানে গেছেন প্রিয় গানের পাখি, সেই ঠিকানা কী আপনি চেনেন? নাকি আপনি নিজেই জানেন না?
বিশেষ দ্রষ্টব্য: শুরু হয়েছিল গায়ক সঞ্জীব চৌধুরীকে নিয়ে। সঞ্জীবদা কথায় কথায় বলতেন- কবির আমি চলে গেলে কাব্য করে লিখিস- 'খুব সহজেই চলে যাওয়া শিখেছে মানুষ!' সেই থেকে শুরু। এরপর আজম খান। হুমায়ুন ফরীদি কিংবা হুমায়ূন আহমেদ। নায়ক রাজ রাজ্জাক কিংবা শিল্পী আব্দুল জব্বার । শিল্পী সুবীর নন্দী কিংবা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। আইউব বাচ্চু কিংবা কামাল লোহানী…।
মানুষ চলে যায় আর আমি স্মৃতিকথা লিখে রাখি। আমার মত এত স্মৃতিকথা হয়তো আর কারো কাছে জমা নেই! জুলাই এর পাঁচ তারিখে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হলাম। শ্বাসকষ্ট নিয়ে জীবন আর মরণের মাঝামাঝি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে জানলাম- প্রিয় এন্ড্রু কিশোর মারা গিয়েছেন! মনে হলো এন্ড্রুদার কাছে হৃদয় বন্ধক রাখা আছে। তাকে নিয়ে লিখতে হবে। মৃত্যুচিন্তা যখন আমাকে কুড়েকুড়ে খাচ্ছে তখন তাকে নিয়ে স্মৃতিগুলো লেখা শুরু করলাম। কখনো কাগজে লিখি। কখনো মেসেজ আকারে লিখে রাখি। রেকর্ড করে সবকিছু পাঠিয়ে রাখি বিডিনিউজ টোয়েমন্টিফোর ডটকমের মতামত পাতার ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তিটির কাছে।
কোনওদিন আর এন্ড্রুদার সামনে দাঁড়িয়ে বলা হবে না- আই আ্যাম নোবডি । আমি কেউ না। কেন জানি মাথা থেকে যাচ্ছে না গানটা- 'জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প …?
আপনাকে নিয়ে গল্পটা শেষ করা দরকার এন্ড্রু দা। নাকি পাখি উড়ে গেলে কোনও গল্প থাকে না, মানুষ নিজেই গল্প হয়ে যায়!