Published : 30 Jun 2020, 02:33 PM
উপরে কাডা ভিত্তে আডা, এই শিল্লুক যে না ভাঙাইতে পারে, হে উত্তইরা পাঁডা!' বরিশালের প্রবাদ। 'উত্তরইরা পাঁডা' হচ্ছি আমরা, যারা দক্ষিণ ছাড়া অন্য বঙ্গে জন্মেছি, বাস করি। উপরের শোলোকের উত্তর 'কাঁঠাল' আমার বর্তমান লেখার বিষয়বস্তু।
আজ থেকে বছর পঞ্চাশেক আগে, মুক্তিযুদ্ধপূর্ব কালে আমার বয়স তখন ছয়-সাত, আমাদের রান্নাঘরের পেছনে একটা হেলানো কাঁঠালগাছ ছিল। হয়তো ১৯৭০-এর তুফানে কাৎ হয়ে গিয়েছিল। হেঁটেই ওঠা যেত সে গাছে। ওঠা এতই সহজ ছিল যে রাতের বেলা শিয়াল সেই গাছে উঠে কাঁঠাল খেত। দিদিমার মুখে শুনেছি, ওনার কৈশোরে গাছটির কোমর যখন সোজা ছিল, মনু চৌধুরী নামে পাশের বাড়ির মা-মরা এক দুষ্ট বালক ঐ গাছে উঠে পাকা কাঁঠাল ভেঙে পেট ভরে কোষ খেয়ে গাছ থেকে নেমে আসত। কাঁঠালের ভুতির দণ্ডটি গাছের শাখাতেই লটকে থাকত। ভূতি আর বীচি পড়ত মাটিতে এবং কোষগুলো ওনার পেটে। নামতে নামতে মনু চৌধুরী নাকি বলতেন: 'অডি, আজুয়া আশিউয়া কোয়া খাইই!' (বঙ্গানুবাদ: ও বেটি, আজ আশিটি কোষ খেয়েছি) কোনো দিন আশিটি, কোনো দিন তারও বেশি। আমিও দেখেছি, এই গাছের কাঁঠাল এবং কাঁঠালের কোয়াগুলো বেশ বড়সড় হতো। আমার যখন জ্ঞান হয়েছে, তখন আমাদের মামা মনু চৌধুরী প্রায় বৃদ্ধ। উনি কখনও আমার মতো ছোট ছিলেন বা গাছে উঠে শিয়ালের মতো কাঁঠাল খেতেন – কল্পনা করে বেশ মজা পেতাম সেই প্রাককৈশোর বয়সে।
মানুষের মতো কাঁঠালেরও শৈশব, কৈশোর আর যৌবন রয়েছে। শিশু কাঁঠালের নাম 'মুচি', কিশোর কাঁঠালের নাম 'ইচড়' (পশ্চিমবঙ্গে 'এ্যাঁচোড়'), যুবক কাঁঠালের নাম 'কাঁঠাল'। মুচির এক তুতো ভাই ছিল 'ছুঁচি'। ছুঁচি সম্ভবত কাঁঠাল হতে পারত না, শুধু মুচিই কাঁঠাল হয়ে উঠত। মুচি বা ছুঁচির কোনো একটি খাওয়া বারণ ছিল, কাঁঠালের ফলন অটুট রাখার জন্যে। কোনটি খেতাম মনে নেই, ধরা যাক, মুচিই আমরা খেতাম। মুচি খেয়ে খেয়ে কষে গলা ধরে যেত। বেশি খেলে শরীর খারাপ হতে পারত বলে অভিভাবকেরা পছন্দ করত না আমাদের মুচি খাওয়া। কোনো সময়-অসময় ছিল না মুচি খাওয়ার। বাড়ির দাপুটে পুরুষ অভিভাবকেরা দিবানিদ্রায় মগ্ন হওয়ামাত্র মুচি পাটায় ছেঁচে, গুড়, কাঁচামরিচ মিশিয়ে 'জাইত্তা' বানাতে একজোট হতাম পাড়ার ছেলেমেয়েরা। আহা! সে কি স্বাদ পেতাম সেই জাইত্তায়। নাকের জলে, চোখের জলে একাকার হয়েও একটানা খেয়েই যেতাম আমরা। 'কার চেয়ে বেশি কে গিলিতে পারে, পড়ে যেত কাড়াকাড়ি!'
হিন্দু পুরাণে মানুষের এক বছরে দেবতাদের এক মাস, কখনও এক দিন। হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে আষাঢ় মাসের প্রথম দিকে (এ বছর ২২ জুন থেকে ২৫ জুন) মাতা বসুমতী ঋতুবতী হয়ে থাকেন। এই কদিন চাষবাস করা যাবে না, কারণ ঋতুকালে নারীকে কষ্ট দেওয়া যায় না। এই উৎসবের নাম 'অম্বুবাচী'। ছোটবেলায় দেখতাম, এলাকার মুসলমান কৃষকেরাও হিন্দুবাড়িতে জানতে আসতেন, অম্বুবাচী কখন শুরু, কখন শেষ। এই তিন দিন হিন্দু বিধবারা রান্না করা খাবার খেতেন না, দুধ, ফলমূল ইত্যাদি খেতেন। আমরা বাচ্চারাও দিদিমার কাছ থেকে ভাগ পেতাম। ফল খাওয়া অম্বুবাচী পালনের অঙ্গ। 'আষাঢ়-শ্রাবণ মানে নাকো মন।' ততদিনে দেশি আম শেষ। একটা ছড়া আমাকে মুখস্ত করানো হয়েছিল বর্ণমালা শেখার আগেই।
'বৈশাখেতে বড় গ্রীষ্ম, পাকে লিচু আম।
জৈষ্ঠ্য মাসে গাছে পাকে খেজুর আর জাম।
আষাঢ়ে কাঁঠাল পাকে বড় বড় কোয়া।
শ্রাবণে মালদহ আম, দেশি আম ভুয়া।'
অম্বুবাচী উপলক্ষে মালদহ আম আসত বাড়িতে, খুব বেশি নয় অবশ্য, কারণ আমার শৈশব কেটেছে মুক্তিযুদ্ধ ও ৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের অশান্ত সময়ে। বাড়িতে অর্থের কড়ারকম অভাব ছিল। অম্বুবাচীতে ফলের অভাব পূরণ করত বাড়ির গাছের কাঁঠাল। পাকার আগেই গাছ থেকে কাঁঠাল কেটে ফেলা হতো, হয়তো 'চোরের বাড়া ভাতে ছাই' দিতে। 'কাট্টলগাছ' নামে একটা খেলা আমরা খেলেছি বটে ছোটবেলায়। গায়েগতরে বড় একটা ছেলে বা মেয়ের কাঁধে-হাতে-কোমরে ঝুলে থাকত। অন্য একজন একটা করে ছড়া বলে নিজের হাতকে দা-য়ের মতো করে এক এক কোপে একেকটা কাঁঠাল কেটে নিয়ে জড়ো করত একটু দূরে। সব কাঁঠাল কাটা হয়ে গেলে নতুন একটি কাঁঠাল গাছ গজাত।
'বনের ভেতর থে বেরল হুমো। হুমোর গায়ে সাতশ ডুমো।' চব্বিশ পরগণার প্রবাদ। কিংবা 'একনা বুড়ি, সারা গায়ে ফুসুরি'। জলপাইগুড়ির প্রবাদ। বারান্দার একদিকে স্তুপ করে রাখা কাঁঠালের ডুমোতে হাত আর পায়ের তালু চেপে চেপে চোখের কাছে এনে দেখতাম, কী রকম ফুটিফুটি নকশা হয়েছে। 'তেল চুকচুক পাতা, ফলের উপর কাঁটা। পাকলে হয় মধুর মত, বিচি গোটা গোটা।' রঙপুরের প্রবাদ। ছাগকুলের প্রিয় খাদ্য কাঁঠাল পাতা। পাশের চৌধুরী বাড়ির মন্দিরে জগদ্ধাত্রী পূজার দিন সকালে বলির পাঁঠাগুলোর কাঁঠাল পাতা খাওয়া দেখতাম আমরা বাচ্চারা দলবেঁধে, অনেকটা যেমন করে ছেলেমেয়েরা কোরবানির গরুর কাছে ভিড় জমায়।
কাঁঠালের পাতা একটু বয়স হলে লালচে রঙ ধরে। নারকেলের শলা দিয়ে পাতার সঙ্গে পাতা আটকে মুকুট বানিয়ে মাথায় পরে ছোটবেলায় রাজা-রাজা খেলতাম। কাঁঠাল গাছ যখন চেরাই করা হতো, করাতের নিচে ঝুর ঝুর করে হলুদ রঙের গুড়া ঝরে পড়ত। কী দারুন এক গন্ধ বেরোতো সেই গুড়া থেকে, কাঁঠালগাছের তক্তা থেকে। দারুণ এক হলদেটে রঙ আছে কাঁঠাল কাঠে। এই কাঠ দিয়ে তৈরি আসবাবপত্রে পালিশ করার প্রয়োজনই হয় না। আচ্ছা, কোন রঙটিকে আমরা বলি 'কাঁঠালি' হলুদ? কাঁঠাল কাঠের রঙকে, নাকি কাঁঠালের কোয়ার রঙকে? 'কাঁঠালি চাঁপা' কিংবা 'কাঁঠালি কলা' নামকরণের সার্থকতা কি তার কাঁঠালমার্কা রঙের মধ্যেই নিহিত?
'খোট্টা ব্যাটারা কিলায়কে কাঁঠাল পাকায় দিয়া!' মনে আছে, শ্রীকান্ত উপন্যাসে আফিমখোর ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের সেই বিখ্যাত উক্তি? কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানোর সাহস আমাদের হতো না। আমরা বাচ্চারা উঠানে ফুটবল খেলতাম কাঁঠাল দিয়ে, বর্ষাকালে, বৃষ্টি একটু ধরে আসলেই। ব্যথা পেতাম পায়ে, কিন্তু আমাদের লাথিতে কাঁঠাল পেকে যেত, কিংবা পাকত হয়তো নিজের তাগিদেই। খুব বেয়াড়া হলে খন্তা পেরেক চুলার আগুনে ধরে গনগনে গরম করে কাঁঠালের বোঁটা কেটে দিয়ে ঢুকিয়ে দিতাম। পসারি মালের দোকান থেকে তুঁতে কিনে এনে ঢুকিয়ে দিতাম কাঁঠালের বোঁটার জায়গাটা খন্তা পেরেক দিয়ে ফুটো করে। কচি হোক কিংবা আমাদের এলাকায় যেমন বলে: 'বাত্তি', কাঁঠাল পাকতে কুল পেত না।
আরও বড় হয়ে, স্কুলে গিয়ে 'ইঁচড়ে পাকা' প্রবাদটি শিখেছিলাম। এঁচোরে কত কাঁঠাল আমরা বাচ্চারাই পাকিয়েছি, নিজেরা পাকতে পাকতে। তুঁতে নাকি বিষ, কিন্তু আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে কাঁঠালের কোষের ভিতরে ছড়িয়ে যাওয়া এত তুঁতে হজম কীভাবে অর্ধ শতকের বেশি কাটিয়ে দিলাম, ভাবতে অবাক লাগে। ইতিহাসে পড়েছি, রাজপুত্রদের নাকি প্রতিদিন স্বল্প পরিমাণ বিষ খাইয়ে খাইয়ে তাদের শরীরকে বিষ-সহ করে তোলা হতো, যাতে হত্যা করার উদ্দেশ্যে কেউ বিষপ্রয়োগ করলেও রাজপুত্রের অপ এবং অকালমৃত্যু না হয়। এভাবেই হয়তো বাঙালির বাচ্চাদের শরীরে রোগ ও বিষ প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মায়। এ কারণেই হয়তো করোনাভাইরাস আমাদের সঙ্গে তেমন সুবিধা করে উঠতে পারছে না।
'একটা বাপই, সারা গায়ে আটই।' জলপাইগুড়ির প্রবাদ। কাঁঠাল ভাঙতে গিয়ে হাতে 'আঢা' লেগে যেত। আঠা ছাড়াতে হাতে সরিসার তেল মেখে ঘসতাম অন্য কাঁঠালের গায়ে কিংবা চটে। তারপর সাবান মাখতাম। সাবান বলতে, বাংলা সাবান। গায়ের সাবান কালেভদ্রে কেনা হতো বাড়িতে, কারণ আমাদের কাছে সেটা ছিল বিলাস উপকরণ। শীতকালে যাত্রা হতো গ্রামে, মামারা অভিনয় করতেন, আমিও শিশুশিল্পী ছিলাম। যেদিন রাতে যাত্রা, শুধু সেদিন দুপুরেই একটা দেশি লাক্স সাবান কেনার আবদার রাখা হতো, মাথার তেলচটচটে চুলগুলোকে ফুরফুরে করে তোলার জন্যে। 'লেখাপড়া করে আগে বড় হও। সাবান মেখে বাবুয়ানি করার সুযোগ অনেক পাবে।' একবার এক পাড়াতুতো ফ্যাশনেবল প্লেবয় মামা নির্মলের সর্দিজ্বর হয়েছিল। আমার ডাক্তার মামার কাছে চিকিৎসার জন্যে আসলে ঔষধ দেবার আগে উনি খেঁকিয়ে উঠলেন: 'অউডা, হারা দিন ফইরর ঘাডত বই পোঁদত লাক্স সাবান মাখিলে সর্দি ন অইব না?' (বঙ্গানুবাদ: ওরে বেটা, সারা দিন পুকুরের ঘাটে বসে পাছায় লাক্স সাবান মাখলে সর্দি হবে না?)। সত্যিইতো, লাক্স সাবান মাখা, তাও আবার নিতম্বে, এত অনাচার ধর্মে সইলেও শরীরে সয় না? আমার শিক্ষক সন্তোষবাবুর একটা বাণী এখনও কানে বাজে: 'তিব্বত ৫৭০ সাবানর সুবিধা কী জান নি, কঅরঅ সাফ অয়, গঅতঅ মাখন যায়!' (বঙ্গানুবাদ: তিব্বত ৫৭০ সাবানের সুবিধা কী জানো তোমরা, কাপড়ও সাফ হয়, গায়েও মাখা যায়!) উনি শিক্ষক মানুষ, তিব্বত ক্রয়ের ক্ষমতা ছিল। আমাদের কাছে ৫৭০ পর্যন্ত তখনও অধরা, হিমালয়ের তিব্বতের মতো, সুদূরে, সুউচ্চে, চীনের দখলে। মাঝে মাঝে স্যারের কাপড় ধুয়ে দেবার সময় আমরা কয়েকজন ওনার তিব্বত সাবান চুরি করে গায়ে-পাছায় মেখে নিতাম। ভয়ে থাকতাম, সাবানের অনিবার্য ক্ষয় স্যার খেয়াল করছেন কিনা। আমরা বাংলা সাবানের গোল্লা কিনে তাতে তার পেঁচিয়ে দুই ভাগ, চার ভাগ করে কাটতাম। সেটাও ক্বচিৎ হাত ফসকে পানিয়ে পড়ে হারিয়ে গেলে ডুব দিয়ে খুঁজে খুঁজে চোখ লাল করে ঘরে ফিরতাম।
আগের দিনেতো স্কুল ছিল না, প্রবাদবাক্যগুলোই ছিল গণশিক্ষার একমাত্র কারিকুলাম, যুগান্তরের পাঠ্যসূচির অংশ। গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল। আমার কেন জানি মনে হয়, এই প্রবাদ বাঙালির তৈরি নয়। এত ভাবনাচিন্তা, পরিকল্পনা করে কাজ করা স্বভাব নয় বাঙালির। কাঁঠাল ভক্ষণের আগে গোঁফে তেল মেখে নেবে – এত সতর্কতা কি বাঙালিকে মানায়? এর চেয়ে বরং 'লেজেগোবরে' কথাটাই বাঙালি-চরিত্রের সঙ্গে যায় ভালো, যেমনটা আমরা দেখছি এই করোনাকালে, পাবলিক, সরকার, সবার আচরণে, সিদ্ধান্তগ্রহণে। তাছাড়া, বাঙালিরা গোঁফ খুব একটা রাখে না। তেল তারা নিজের গায়েই মাখে না খুব একটা, অন্যকে, বিশেষ করে ক্ষমতাবানদের দেবার জন্যে তুলে রাখে। বাঙালি মূলত 'লাথির কাঁঠাল', অর্থাৎ নিজে থেকে তারা কিছু করবে না, লাথি খেলেই শুধু কর্মে উদ্যোগী হবে। করোনার লকডাউনে এই সত্যটা নিশ্চয়ই প্রমাণিত হয়েছে। এছাড়া লক্ষ্য করবেন, বকশিস যে দেয়, বাঙালি তাকে সেবা দিতে চায় না। বাপ-মা তুলে যে গালাগালি করতে পারে, তারই সমধিক আদর বাঙালির কাছে।
বাঙালির হাসির গল্প। বাঙালিদের কাঁঠাল খেতে দেখে এক বোকা কাবুলিরও কাঁঠাল খাবার ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু কাঁঠাল খাবার আগে আঠা এড়াতে হাতে সরিষার তেল মাখার বাধ্যবাধকতাটা সে জানতো না, কেউ বলেও দেয়নি তাকে। কাঁঠালের স্বাদ-রস-গন্ধ কেমন উপভোগ করেছিল সেই কাবুলিওয়ালা, সেটা আমরা জানি না। যা জানি তা হচ্ছে, চুলদাড়িতে আঠা লেগে, সেই আঠা ছাড়াতে এক বাঙালিরই কুবুদ্ধিতে তাতে ছাই ছড়িয়ে, অবশেষে চুলদাড়ি মুণ্ডনে বাধ্য হয়েছিল সেই কাবুলিওয়ালা। গল্প ক্লাইমেক্সে পৌঁছে যখন রাস্তায় এক মুণ্ডিত মস্তক বৈরাগীকে দেখে কাবুলি তাকে জিগ্যেস করে: 'ভাই, তোমভি কাঁঠাল খায়া!' কাবুলিওয়ালা ভেবেছিল, সেই বৈরাগীও আরেক কাঁঠাল খাওয়া কাবুলি, তার জাতভাই। ফ্যালাসি, অ্যাবডাকশান বা (আমার বানানো প্রতিশব্দ) 'অপরোহ' যুক্তির দারুণ উদাহরণ এই গল্প – ক্লিনশেভড কোজাক মাত্রেই কাঁঠাল-খাওয়া কাবুলি নয়।
আরও বড় হয়ে পূর্ণদাস বাউলের গাওয়া গান: 'পিরীতি কাঁঠালের আঠা, লাগলে পরে ছাড়ে না!' এর ভাবার্থ বুঝতে পেরেছি। পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ার কি সুবিধা তাও শুনেছি, দেখেছি চারপাশে, যদিও নিজে পরখ করে দেখিনি। এই প্রবাদ বাঙালির ধান্দাবাজ মানসিকতার ইঙ্গিতবহ। কাঁঠাল সামাজিক ফল। এই ফল একা খাওয়া যায় না। দুই বন্ধু মিলে কাঁঠাল খাচ্ছিল। এক বন্ধু বেশি কাঁঠাল খাওয়ার অসৎ উদ্দেশ্যে অন্য বন্ধুকে প্রশ্ন করল: 'অউডা, তোর বাপ ক্যানে মইরেগে?' (বঙ্গানুবাদ: ও বেটা, তোর বাবা কীভাবে মরেছে?) বন্ধুর মনে নেমে এলো বিষাদ-শ্রাবণের মেঘ। সবিস্তার পিতার মৃত্যুর কাহিনি বর্ণনা করতে করতে এক সময় সে খেয়াল করে, একটি ছাড়া বাকি সব কোয়া বন্ধুর পেটস্থ হয়েছে। 'আইচ্ছা, কঅত, তোর বাপ ক্যানে মইজ্জে?' (বঙ্গানুবাদ: আচ্ছা, বলতো, তোর বাবা কীভাবে মরেছে?) – বন্ধুর কৌশল বন্ধুর উপরই প্রয়োগ করার শেষ বৃথাচেষ্টা করে অভুক্ত বন্ধুটি। ভরাপেট বন্ধু সর্বশেষ কোয়াটি 'মুখস্ত' করে উত্তর দেয়: 'পইরগে আর মইরগে!' (বঙ্গানুবাদ: পড়েছে আর মরেছে!)
কাঁঠাল মূলত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফল। তবে উত্তর ভারতে কাঁঠাল সম্ভবত হয় না। আফগানিস্তানে-পাকিস্তানে অর্থাৎ আর্যাবর্তে কি কাঁঠাল কখনও ছিল বা এখনও আছে? কাঁঠালের সর্বশেষ সীমা সম্ভবত বিহার। শুষ্ক অঞ্চলে ফল মিষ্ট হয়, রসও হয় বেশি। উত্তর ভারতের আম পূর্ব ভারতের আমের তুলনায় বেশি মিষ্ট। বিহারের কাঁঠালের একটা কোষ চিপলে নাকি এক কাপ রস হয়। দারুণ মিষ্টিও নাকি সেই রস। শ্রেফ শুনেছি, দেখার, চাখার সুযোগ হয়নি কখনও।
কাঁঠাল, বলা যেতে পারে, পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতেই ফলে বেশি। শ্রীলঙ্কায়ও নাকি প্রচুর কাঁঠাল হয়। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি কাঁঠাল ফলে দক্ষিণ ভারতের কেরালায়। কাঁঠালের ইংরেজি 'জ্যাকফ্রুট' শব্দটা নাকি এসেছে মালয়লম 'চাক্কা' শব্দ থেকে, প্রোটো-দ্রাবিড় ভাষায় 'কা' মানে ফল, 'চাক্কা' মানে 'চা-ফল'। জুলিয়াস সিজার গল (ফ্রান্স) জয় করে লিখেছিলেন: ভিনি-ভিডি-ভিসি, অর্থাৎ 'এলাম, দেখলাম জয় করলাম!' ১৪৯৯ সালে কালিকট-মালাবারে এসে পর্তুগীজ জলদস্যু বা জলবণিকেরা 'চাক্কা' দেখলেন, চাকলেন, (ফলের নামটি) লিখলেন। চ-এর ঘোষীভবন হয়ে পর্তুগীজদের ভাষায় কাঁঠালের নাম হয়ে গেল 'জাক্কা' এবং সেখান থেকে 'জাক্কাফল'। ফরাসিতে আবার গাছটিকে বলা হয় 'জাকিয়ে', কাঁঠালকে বলা হয় 'ফ্রুই দ্য জাকিয়ে'।
আজকের আফগান-পাকিস্তানিদের সাক্ষাৎ পূর্বপুরুষ আর্যদের সঙ্গে কাঁঠাল ফলটির পরিচয় হয়েছিল কি? আর্যকবি বাল্মিকী যে কাঁঠাল ফলটা চিনতেন তার প্রমাণ, রামায়ণে রামের পক্ষের এক সেনাপতির নাম ছিল পনস। রাবণ কয়েকদিন পর পর অশোক বনে বন্দীনি সীতাকে ইভটিজিং করতে আসতেন। একদিন এসে বললেন: 'তোমার স্বামীর পক্ষের সেনাপতি পনস পনসবৃক্ষের ন্যায় পতিত হইয়াছে!' কাঁঠালের সংস্কৃত প্রতিশব্দ 'পনস'। পনস-পুরাণ। কাঁঠালগাছের সঙ্গে বড়সড় কোনো সেনাপতির তুলনা করে জানি না বাল্মিকী কার সম্মান বাড়িয়েছিলেন, সেনাপতির, নাকি পনসবৃক্ষের। মনে রাখতে হবে, কাঁঠাল পৃথিবীর বৃহত্তম ফল, ৫০ কেজি পর্যন্ত ওজন হতে পারে কাঁঠালের। এ রকম শ খানেক কাঁঠাল-ফলা একটি মহীরুহের ভারিক্কি ভাব পাকানো গোঁফওয়ালা কোনো ফিল্ডমার্শালের চেয়ে কোনো অংশে কম হবার কথা নয়।
'এ পাড়ায় বুড়ি মরল, ও পাড়ায় গন্ধ পেল।' চব্বিশ পরগণার প্রবাদ। কাঁঠালে একটা গন্ধ আছে এবং সেই গন্ধ সবাই সহ্য করতে পারে না। 'এ বছর কাঁঠাল খেয়েছেন?' জিগ্যেস করেছিলাম আমার বন্ধু-সহকর্মী ঢাবি অধ্যাপক মাহবুব আহসান খান রাজিবকে। ফোনে 'হা-হা' অট্টহাসি শুনে মনে পড়ল, কাঁঠাল ফলটা ও সহ্যই করতে পারে না। রাজিব একা নন। অনেকের বিচারেই ব্রাত্য, অনেকটাই ছোটলোকের ভক্ষ্য কাঁঠাল ফলটা ঠিক আঙ্গুর-আপেলের সমপর্যায়ের নয়। ক্রিকেটের তুলনায় যেমন ডাংগুলি, কমলার তুলনায় তেমনি কাঁঠাল। ফার্মগেটের ওপারে গুলশান-বনানী-বারিধারায় ভোগ্য ফল নয় কাঁঠাল, অনেকটাই আমরা মানে পুরান ঢাকা-নিউমার্কেট এলাকার 'ফকিন্নি ডট কম' লোকজনের মুখে রোচে এ ফলটা।
আষাঢ়-শ্রাবণ মাস কাঁঠাল খেয়েই কাটিয়ে দিত পথের পাঁচালির সর্বজয়া আর অপু-দুর্গা। দিদি দুর্গার কাঁঠালপ্রীতি দেখে অপোগণ্ড অপু মাকে আধো আধো বোলো বলেছিল: 'দিদি কাঁঠালের খুব প্রভু, না মা?' আসলে অপু বলতে চেয়েছিল: 'দিদি কাঁঠালের খুব ভক্ত!' ভক্ত হয় কি সাধে? গরীবের এ ফলের যে কত শত পুষ্টিগুণ রয়েছে, আন্তর্জালে সেসবের খোঁজখবর নেয়া এমন কিছু কঠিন নয়। কাঁঠাল নাকি দুধের মতোই সম্পূর্ণ খাবার এবং শুধু তাই নয়, দুধের দোষগুলো কাঁঠালে নেই। গর্ভাবস্থায় কাঁঠাল খেতে বাধা নেই এবং কাঁঠাল খেলে নাকি গর্ভবতী মায়েদের অন্য কিছু না খেলেও চলবে।
এই করোনাকালে কাঁঠাল দিয়ে আমরা 'স্মুদি' বানিয়ে খেয়েছি। বিভিন্ন ফল, দুধ, দই, গাজর ইত্যাদি ব্লেন্ডারে মিশিয়ে বানানো ঘন একটি (আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে) উত্তর আমেরিকান পানীয় এই স্মুদি। কাঁঠাল দিয়ে আমরা প্যানকেক বানিয়েছি, বড়া ভেজেও খেয়েছি। পাকা কাঁঠালের কোয়া পাতলা করে কেটে অতি ক্ষীণ আঁচে তাওয়ায় শুকিয়ে কাঁঠালের চিপস বানিয়েছি। কাঁঠালসত্ত্ব বানানোও অসম্ভব নয়। সেদ্ধ বা সেঁকা কাঁঠালের বীচি স্বাদে, টেক্সচারে, পৃথিবীর কোনো নাট বা বাদামের চেয়ে ন্যূনতো নয়ই, বরং 'নাটের গুরু' সে। এই চিপস, বীচি, কাঁঠালের রস থেকে বানানো পনস-রামের সঙ্গে অনুপান হিসেবে চলতে পারে। কইয়ের তেলে কইভাজা! কাঁঠালের অতিফলনের এই দেশে লোকজন যদি একান্তই 'রামভক্ত' হনুমান হতে না চায়, তবে এই পনস-রাম বিদেশে রপ্তানি করা যেতে পারে। আর দেশে যারা চুপকে চুপকে বোতলরামের সেবা করে, পনস-রাম সহজলভ্য হলে বহু কোটি বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হতে পারে।
কাঁচা, আধপাকা কাঁঠালের তরকারি রেঁধেছি কয়েক দিন আগে। ধরুন মাংস রান্নার প্রস্তুতি নিয়ে কড়াইতে মাংসের বদলে ঢেলে দিলেন কাঁচা কাঁঠালের ডুমো ডুমো টুকরো। সঙ্গে আলুও দিতে পারেন, দোষ হবে না। মাংসের বাড়া সেই তরকারি, ভাত আর রুটি উভয়ের সঙ্গে চমৎকার যায়। পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা কাঁঠালকে গাছপাঁঠা বলে কি সাধে? বিদেশীরাও উদ্বুদ্ধ হয়ে কাঁঠালকে ব্যবহার করছে মাংসের বিকল্প হিসেবে – ইদানিং ইচরকুচি দিয়ে বার্গার, পিজ্জা বানানো হচ্ছে, আন্তর্জালে পড়েছি।
'মূলাকার বীর তার সর্বগায় শিঙ। দেড়বুড়ি অন্ত তার এক গোটা লিঙ।' রংপুরের প্রবাদ। কাঠালের ভূতির ভিতরে মুগুর-সদৃশ যে দণ্ডটিতে কোয়াগুলো আটকে থাকে, সেটি আমার গৃহিনী চাক করে কেটে ভেজে খাইয়েছে বেসন দিয়ে কিংবা বেসন ছাড়া, আজ থেকে বছর পঁচিশেক আগে এবং পুনরায় কয়েক দিন আগে। 'এত কিছু খেয়ে যদি নাহি উঠে মনটা, খাও তবে কচুপোড়া, খাও তবে ঘণ্টা।' যাদের কচুভাজা খাবার অভিজ্ঞতা আছে, কিন্তু ফরাসি পনির ভেজে খাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই, তাদের বলি, এই ভর্জিত পনস-লিঙ্গ-চক্র মানকচু ভাজা হইতে উত্তম, পনিরভাজা হইতে অধম। আকলমন্দেরা এই ইশারা থেকেই কাফি বুঝে নেবেন, স্বাদটা কী অপূর্ব হতে পারে।
কাঁঠাল আমাদের তেমন কিনতে হয় না। আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে যে কাঁঠাল ফলে সেগুলো সময়মতো সংগ্রহ করা গেলে সব শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারির বছরের কাঁঠালভোগ হয়ে যায়। কিন্তু এই করোনাকালে সব শুনশান। দারোয়ান ফোন করে জানাল, কাঁঠাল পেকে পেকে গাছ থেকে ঝরছে। পরিচালকের অনুমতি না থাকায় কাটতে পারছে না। অনুমতি দেওয়া হলো এবং কাঁঠালের ভেট পৌঁছে গেল বাড়ি বাড়ি। সব বছর এমন সৌভাগ্য হয় না। বেশির ভাগ আম-কাঁঠাল চুরি বা ডাকতি হয়ে যায় রাতের বেলা। নেতা বা নেতার চামচা বলে দাবি করা ছাত্ররা ভ্যান-ঠেলাগাড়ি নিয়ে এসে সব গাছের কাঁঠাল পেড়ে নিয়ে যায়। কিছু বলব, মোগো ঘাড়ে কয়ডা মাথা? প্রাক্তন ভিসি আরেফিন সিদ্দিক ক্যাম্পাসে ফলের গাছ রোপণে রাজি ছিলেন না, কারণ গাছে উঠে ফল পাড়তে গিয়ে গাছ থেকে ভূমিতে পতিত হয়ে ক্যাম্পাসে বছরে দুই এক জন আহত-নিহত হয়ই। একবার বায়েজিদ নামের এক ছাত্র গভীর রাতে আমগাছে উঠে আম পেড়ে, বস্তায় আম ভরে দেশের বাড়ি গিয়ে নিজের মাকে ঢাবির আম খাইয়ে এসেছিল। শোনামাত্র আমার বায়েজিদ বোস্তামির কথা মনে হয়েছিল, মাতৃভক্তির জন্যেতো বটেই, 'বস্তায় আম' ভরার কারণেও বটে।
ট্রেনের বগিতে একবার এক বৈষ্ণবের সহযাত্রী হয়েছিল কয়েকজন ফাজিল নাস্তিক যুবক। বৈষ্ণব বাবাজিকে বগি থেকে হটানোর উদ্দেশ্যে যুবকেরা ছাগমাংস ভক্ষণের আলাপ শুরু করে দিল। পাঁঠার কোন কোন অঙ্গ কীভাবে রসিয়ে খাওয়া যায়, ইত্যাকার আলাপ শুনতে শুনতে নিরামিশাষী বৈষ্ণবের গা গোলাতে শুরু করলো বিবমিষায়। তিতিবিরক্ত বৈষ্ণব যখন বগি থেকে অবতরণোদ্যত, যুবকদের একজন প্রশ্ন ছুড়ে দিল: 'গোসাঁইজি, পাঁঠার কোন জিনিষটা খাওয়া যায় না বলুনতো!' বাবাজি উত্তর দিলেন: 'কাছি আর নাদি ছাড়া কিছুইতো তোমরা ছাড়ো বলে মনে হয় না!'
কাঁঠালও পাঁঠার মতোই্। মানবের ভোগে লাগে না, এমন কিছুই যেন নেই এ গাছে। কাঁঠাল পাতা জড়িয়ে একটা পিঠা তৈরি হতো, হয়তো এখনও হয়। কাঁঠাল পাতায় করে আমরা ছাতু খেতাম। ভারতে শুকনো কাঁঠাল পাতা দিয়ে পাত্র বানিয়ে ঘুঘনি বিক্রি হয়। কাঁঠালের পাতাটা মানুষ খায় না বটে। কিন্তু ছাগল কাঁঠাল পাতা খায়, মানুষ ছাগল খায়, অতএব মানুষও কাঁঠাল পাতা খায়। আরিস্টোটলের আরোহ সিলোশিজম। সাধে কি বাঙালি কাঁঠালকে জাতীয় ফল করেছে। জাতীয় ফল কাঁঠাল জাতীয় গাছ 'আমগাছ'-এ ফলে না, তাতে কী যায় আসে! 'আম' কবিতার (কার রচনা ভুলে গেছি) শেষ দুই চরণ 'কাঁঠাল' সম্পর্কেও সমান প্রযোজ্য:
'কাঁঠাল কি শুধু গাছেই ফলে, কাঁঠাল শুধুই ফল?
কাঁঠাল মোদের স্মৃতির ফলকে সদা করে ঝলমল।'