Published : 18 Jun 2020, 05:10 PM
ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতা নতুন কোনো বিষয় নয়। এই খাতের ভঙ্গুরতা সবাই জেনে গেছে বেশ আগেই। সুশাসনের অভাব, খেলাপি ঋণের অসহনীয় চাপ, অদক্ষতা, ঋণ কেলেঙ্কারি, অনিয়ম এই খাতকে খাদের কিনারে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে। অনেকগুলো ব্যাংক এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে তাদের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
আইএমএফের গত বছর সেপ্টেম্বরের হিসেবে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ২৬ শতাংশ যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে এই পরিমাণ ১১-১২ শতাংশ। ১৫টির অধিক ব্যাংক ভুগছে ক্যাপিটাল সংকটে। আরও ১৫টির মত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রশাসক বসিয়েছে তাদের ভাঙন ঠেকানোর জন্য, সে কথাও আমরা জানতে পেরেছি ইতোমধ্যে।
এই অবস্থার মধ্যে করোনাভাইরাস মহামারী ব্যাংকিং খাত শুধু নয় সামগ্রিক অর্থনীতিকে স্মরণাতীতকালের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে যেখানে দেশীয় অর্থনীতি বড়জোর ২-৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যদিও সরকার মনে করছে এই প্রবৃদ্ধি হবে ৫ শতাংশের উপরে। করোনার ক্ষয়ক্ষতি থেকে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করার জন্য সরকার প্রায় সোয়া ১ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা যে প্যাকেজ দিয়েছে তার বেশির ভাগ বাস্তবায়নের দায়িত্বে আছে ব্যাংকিং খাত। ফলে তাদের ওপর প্রেশার আছে।
তাছাড়া আমরা জানি সরকার ব্যাংকগুলোর ওপর ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ এবং আমানতের ওপর সুদের হার ৬ শতাংশে নির্ধারণ করে দিয়েছে যাতে তাদের আয়ের একটা বড় অংশ সংকুচিত হয়ে পড়েছে। আবার এপ্রিল মে – এই দুই মাস সুদজনিত আয়কে ব্যাংকের আয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে নিষেধ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে সবগুলো ব্যাংক মিলে প্রায় ১৬-১৭ হাজার কোটি টাকার মত মুনাফা হারাবে। সামগ্রিক বিচারে ভালো নেই বর্তমানের ব্যাংকিং খাত, ফলে ভাল থাকার সুযোগ নেই ব্যাংকারদের।
বড় অর্থনৈতিক সংকটে প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকে থাকার জন্য বিভিন্ন ধরনের পন্থা অবলম্বন করতে হয়। বর্তমান সংকটের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গভীরতা অনেক বেশি। বাংলাদেশেই কয়েক কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন বা হারানোর ঝুঁকিতে আছেন। বিদেশে যারা কাজ করছেন তাদের মধ্যেও কয়েক লক্ষ লোক চাকরি হারিয়েছেন, অনেকে দেশে ফিরেছেন, অনেকেই ফেরার অপেক্ষায় আছেন যার চাপ পড়বে প্রবাসী আয়ে। আমরা জানি রপ্তানি আয় কমছে দ্রুতগতিতে। ধারণা করা হচ্ছে অনেক মানুষ না খেয়ে কষ্ট পাবে, মারা যাবে যদি অর্থনীতি স্থবিরতা কাটিয়ে দ্রুত সচল না হয়।
ব্যাংকিং বাংলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক, শৃঙ্খলাপূর্ণ ও সংগঠিত একটি খাত। এই খাতের ওপর দেশের উন্নয়ন এবং আর্থিক সঞ্চালন অনেকটাই নির্ভর করে। মানব শরীরে ধমনী দিয়ে যেমন শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রক্ত প্রবাহিত হয়, তেমনি ব্যাংকিং চ্যানেল দিয়ে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে অর্থের সঞ্চালন ঘটে। এজন্য এইখাতের সুস্থভাবে টিকে থাকা অর্থনীতির স্বার্থে অতীব জরুরি।
প্রশ্ন হচ্ছে ব্যাংক এই সংকট থেকে উত্তরণ করে ভালভাবে টিকে থাকবে কিভাবে?
টিকে থাকতে হলে তাদের খরচের ক্ষেত্রে কৃচ্ছতা সাধন করতে হবে। যেহেতু আয় বাড়ানোর অন্য কোনো পথ আপাতত খোলা নেই, অনেক বেশি নতুন ঋণ খেলাপি হবার সমূহ সম্ভাবনা আছে, পুরাতন খেলাপি ঋণ আদায়ের সম্ভাবনাও খুব ক্ষীণ, সুদ আয় কমে গেছে, তারল্য সংকটে আছে কেউ কেউ, কমিশন আয়সহ অন্যান্য চার্জ কমে গেছে তাদের সামনে একটা পথই খলা আছে সেটা হল খরচ কমানো।
ইতোমধ্যে এক্সিম ব্যাংক, দ্য সিটি ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক প্রধানত ৪০ হাজার টাকার বেশি বেতনধারীদের শতকরা ১৫ শতাংশ বেতন কাটা শুরু করেছে। অন্যদিকে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচারাল ব্যাংকের মতো ছোট পরিসরের প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের বেতন কাটবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। বেতন কেটে খরচ কমানো নিয়ে ব্যাংকারদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে এবং এটাই স্বাভাবিক। ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) এ বিষয়ে একটি জরুরি সভাও করেছে। সভায় বেশিরভাগ উদ্যোক্তা ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় বিশেষত বেতন কমিয়ে এই মন্দায় কোনো মতে টিকে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।
ব্যাংকের খরচের খাতগুলো মুলত কী কী?
ব্যাংকারদের বেতন ভাতা, রেন্ট, ইউটিলিটি, দেশ বিদেশে ট্রেনিং, আপ্যায়ন ভাতা, গাড়ি, গাড়ির তেল ও যন্ত্রাংশ ক্রয় ও সার্ভিসিং, নতুন শাখা খোলা, পদোন্নতি, নিয়োগ-পদোন্নতি-ইনক্রিমেন্ট ও ইনসেনটিভ বোনাস, যাতায়াত, স্টেশানারি, ফার্নিচার, জ্যেষ্ঠদের নানা ধরনের ভাতা, রিটায়ারমেন্টসহ নানাবিধ খরচ, স্থায়ী সম্পদ কেনা, বিদেশি ট্যুর, সিএসআর, ডোনেশন, চ্যারিটি, নানা মাধ্যমে বিজ্ঞাপন, গ্রাহক 'গেট টু গেদার' অফিসার ও এক্সিকিউটিভ 'গেট টু গেদার' ও ম্যানেজার কনফারেন্স, আইটি রিলেটেড, সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার কেনা ইত্যাদি নানাবিধ খাতে ব্যাংকের খরচ করতে হয়।
তাছাড়া বোর্ড মেম্বাররা মিটিঙে যোগদান করলে ভাতা পান, তাদের কারো কারো জন্য দামি গাড়ির ব্যবস্থা থাকে, বড় অফিসারদের জন্য দামি গাড়ি থাকে, বছর শেষে ডাইরেক্টররা লভ্যাংশ পান। এইসব মিলিয়ে ব্যাংকের খরচের খাত অনেক লম্বা।
ব্যাংক চাইলে প্রতিটা ক্ষেত্রে খরচ কমিয়ে প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখতে পারে। চাইলে কর্মীদের বাদ দিতেও পারে, তাদের বেতনে কাটছাঁট করতে পারে যেমনটি করেছে কয়েকটি ব্যাংক। চাইলে ডাইরেক্টরেরা এক দুই বছর লভ্যাংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিতে পারেন, অনেকগুলি বিকল্প আছে।
ব্যাংকের ডাইরেক্টররা সভা করে যে পরামর্শ দিয়েছেন সেখানে তারা বেতন কাটার কথায় সায় দিয়েছেন, (যদিও এই সিদ্ধান্ত আসা উচিত ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের কাছ থেকে যদি দেশের ব্যাংকিং খাতে সুশাসন থাকত) কিন্তু লভ্যাংশ না নেওয়ার ঘোষণা দেননি, দিলে ব্যাংকের কর্মকর্তা কর্মচারীরা ভাল বোধ করতেন হয়তোবা। তারা ব্যাথিত হয়েছেন কারণ তাদের এই করোনাভাইরাস সংকটের মধ্যেও নিয়মিত অফিস করতে হয়েছে, হচ্ছে।
ভারতের ইকোনিমিক টাইমস ডটকম একটা অনলাইন সার্ভে করেছে সম্প্রতি। এটি ৩০৭৪ চাকরিজীবীর উপর জরিপটি করেছে। তার মধ্যে ৩৯ শতাংশ কোভিডের কারণে বেতন কর্তনের শিকার হয়েছে এবং ১৫ শতাংশ চাকুরি হারিয়েছেন। ১৫ শতাংশ ২৫ শতাংশের বেশি বেতন কর্তনের শিকার হয়েছেন। ৪৩ শতাংশ বর্তমান চাকুরিতেই আছেন, নতুন চাকুরি খোঁজেননি।
আমাদের দেশেও ইতোমধ্যে অনেকেই বেকার হয়ে পড়েছেন যদিও কোনো জরিপ এখনও হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গত ডিসেম্বর ভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, দেশে সক্রিয় ৫৯টি ব্যাংকে বর্তমানে জনবল রয়েছে এক লাখ ৭৮ হাজার ৪৩০ জন। এর মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকে আছেন এক লাখ ৯ হাজার ১২৭ জন। বিদেশি ব্যাংকে তিন হাজার ৮৫৮ জন। আর সরকারি ব্যাংকে ৬৫ হাজার ৪৪৫ জন। এই দুঃসময়ে এই এত ব্যাংককর্মীদের বেতনে কাটছাঁট করলে তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন কারণ সবার জীবনযাপনে অনেক পরিবর্তন আসবে, তাদের কর্মস্পৃহা কমে যাবে যার প্রভাব পড়বে খেলাপি ঋণ আদায়সহ নানাবিধ কার্যাবলীতে, যার ফলে ব্যাংকের ব্যবসায়ের প্রবৃদ্ধি যেমন কমবে তেমনি কমবে মুনাফা।
ব্যাংকগুলোকে টিকে থাকার জন্য নিচের পরামর্শগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে
১) সামনের দুই বছর ব্যাংকের ডাইরেক্টররা লভ্যাংশসহ কোনো ধরনের আর্থিক সুবিধা ব্যাংক থেকে নেবেন না এবং শেয়ারহোল্ডারদেরও লভ্যাংশ দেওয়ার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেবেন।
২) অনেক ব্যাংকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত লোকবল রয়েছে। বিশেষ করে সর্বশেষে অনুমোদনপ্রাপ্ত ব্যাংকগুলোতে বাড়তি লোকবল থাকার অভিযোগ উঠেছে যাদের অধিকাংশই বিশেষ খাতিরে নিয়োগপ্রাপ্ত এবং দক্ষতার বিচারে তারা পিছিয়ে । এদেরকে এখন বেছে বেছে বাদ দেওয়া যেতে পারে।
৩) যেসব শাখা খোলার ক্ষেত্রে প্রয়োজনের চেয়ে একটি গোষ্ঠীর স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে এবং ভাড়ার পরিমাণ বাজার-দরের চেয়ে অনেক বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে সেগুলোর খরচ কমানোর দিকে নজর নেওয়া যেতে পারে।
৪) অনেক ব্যাংকে অনেকগুলো এএমডি ও ডিএমডি রয়েছেন, যাদের বেতন অনেক বেশি; কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে তাদের অনুপস্থিতি ব্যাংকে তেমন প্রভাব তৈরি করে না। যেসব জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা বিশেষ ভুমিকা রাখেন না তাদের বাদ দেওয়া অথবা বেতন অর্ধেক করে দেওয়া যেতে পারে।
৫) গড়পড়তা বেতন কমিয়ে আনা অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত হবে। যারা সত্যিকারের যোগ্য, তাদের পুরস্কৃত করার সময়ও এখন। সৎ কিন্তু আপাতত-অযোগ্যদের যোগ্যতা বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করতে হবে এবং যদি তারা তা না পারেন, তখন বাদ দেওয়ার চিন্তা করতে হবে।
৬) উপরে উল্লেখিত সমস্ত খরচের খাত থেকে দেশি ট্রেইনিংটা অব্যাহত রাখতে হবে। অনলাইনে বিদেশি ট্রেনিঙের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে তাতে খরচ কম হবে। দক্ষতা বাড়ানোর বিকল্প নেই।
৭) খেলাপি ঋণ আদায়ে খুব জোর অব্যাহত রাখতে হবে। ছোট ব্যবসার দিকে নজর দিতে হবে এবং আমানত বাড়ানোর প্রতি গুরুত্ব আরোপের বিকল্প নেই।
তাছাড়া প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে যদি কঠিন কোনো সিদ্ধান্তে যেতে হয় তাহলে প্রথমে কর্মীদের মধ্যে এই বিশ্বাস সঞ্চারিত করতে হবে যে তাদের ভালোর জন্য কঠিন সিদ্ধান্তটি নিতে বাধ্য হচ্ছে ব্যাংক এবং সেক্ষেত্রে এই ঘোষণা আগে আসতে হবে যে ব্যাংকের ডাইরেক্টর, এমডি, এএমডি, ডিএমডিসহ জ্যেষ্ঠকর্তারা ছোটদের চেয়ে বেশি স্যাক্রিফাইস করছেন। যদি এমডি বলেন তিনি আগামী দুই বছর বেতন অর্ধেক নেবেন তাহলে ১৫-২০ শতাংশ বেতন কাটলে তাদের কষ্ট হবে কিন্তু কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না বলে অনুমান করা যায়।