Published : 02 Jun 2020, 10:13 PM
বোরকা পরা দুইজন তরুণী আসলেন। এসেই ঘোমটা খুললেন। আড়চোখে তাকালেন আমার দিকে। চমক খাওয়া চাহনি তাদের! কিছুটা উত্তেজিত। কিছুটা লজ্জিত। আমি এক পলক তাকালাম। তাকিয়ে মাথা নিচু করলাম। মনে হলো- এরা বিউটি পার্লার থেকে এসেছে। দুইজনেরই পাফ করা চুল। মুখমণ্ডলে যথেষ্ঠ প্রসাধনীর আস্তরণ। গা থেকে সস্তা পারফিউমের গন্ধ আসছে, যাতে নাসারন্ধ্র খাড়া হবার উপক্রম।
আমার সামনে বসা নারী অফিসারের দিকে তাকালাম। আমার দিকে তার দৃষ্টি নেই। ওদের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, কী সমস্যা?
একজন বলতে থাকল, 'কোনও সমস্যা নাই মাদাম! হুদ্দাই হুদ্দাই আটকাইছে। ডিস্টার্প করার লাই আটকাইছে। আই ত্রাভেল বি-ফুর থ্রি কান্ত্রি!'
নারী অফিসার দক্ষ ইমিগ্রেশন অফিসার। আমার দিকে এবার তাকালেন। মিটিমিটি হাসলেন। তারপর আবার ওদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার ইংলিশ ইজ নাইস!
তরুণী বললেন, জি মাদাম, রাইত রাইত।
সে বলছে- রাইট রাইট। আমি যেন শুনলাম, রাইত রাইত!
হাসলাম একটু মিটমিটি।
আমি যখন এয়ারপোর্টে কাজ করতাম। তখনকার ঘটনা এটি। তরুণী দুজন আসলে দুবাই যাবে। দুবাই গিয়ে বারে নাচবে। মদ না খেলেও কোকাকোলা গ্লাসে নিয়ে ভান করবে মদ খাচ্ছে। তাদের দরকার টাকা। তিন মাস থাকবে। তারপর দেশে ফিরবে। আবার আরেক দেশে যাবে।
নিম্ন আয়ের এসব তরুণী সুযোগের অভাবে ভালো ইংরেজি না পারলেও, ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দ দিয়ে কাজ চালানোর মতো কথা বলতে শিখে গেছে। কোনওমতে বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলতে পারলেই হয়। যেমনটি পারে- আমাদের বঙ্গবাজারে ছেলেমেয়েরা ইংলিশসহ অন্যান্য ভাষা বলতে। হয়তো দুবাই নেমে বোরকাটা গাড়িতেই খুলেই ব্যাগে ভরবে আর শর্ট ড্রেসটা সাজিয়ে নিবে। তারপর হাই ভোল্টেজ গানের সঙ্গে কোন পুরুষকে হাত ধরে টেনে নিবে নাচার জন্য।
দুবাইতে চলে, ডাবল স্ট্যান্ডার্ড হিসেব-নিকাশ। একদিকে ইসলাম, অন্যদিকে পর্যটকদের আকর্ষণের ব্যবস্থা। সারা পৃথিবীর বনেদী পরিবার সেখানে এখন ব্যবসা করছে।
বাংলাদেশ এখন সেপথে যাবে কিনা তা নির্ভর করবে আমাদের নীতি-নির্ধারকদের উপর। কিন্ত আমাদের নীতি-নির্ধারকরা চাইলেও অনেক সময় এখানে সবকিছু হয় না। ইসলামি সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে কতিপয় গোষ্ঠি এখানে একটা বড় বাধা তৈরি করতে পারে।
এভাবে বললে, অনেকেরই মনে হতে পারে 'ইসলামি সেন্টিমেন্ট'-কে উন্নয়নের বাধা বলছি। কিন্তু তা নয়। দুবাইয়ে দুই তরুণীর ভ্রমণে যাওয়ার বিষয়টি যেমন আমলে নেওয়ার মত, এর বিপরীতে কানাডার দিকে তাকাতে পারি। কানাডায় শব্দ দূষণে মামলা হয়, কিন্তু সেখানেও এখন কিছু জায়গায় আজান দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে সরকার।
তার মানে হলো দুবাই ধর্মান্ধ নয়, আবার কানাডাও তা নয়। সহজে বলতে পারি, যার যার ধর্ম তার তার কাছে, রাষ্ট্রনীতি আলাদা।
বলা হচ্ছে, করোনাভাইরাসের এই মহামারী শেষ হলে উন্নত দেশগুলো ঠিকই ঘুরে দাঁড়াবে। কারণ, তাদের হাতে কোনও না কোনও চাবি আছে। হয় তারা পর্যটন দিয়ে আগাবে, না হয় শিক্ষা ডিগ্রি বিক্রি করে আগাবে। আমরা এই ক্রান্তিকালেও ওইসব দেশে ভ্রমণে যাবো। আবার পড়ালেখা করতে কোটি কোটি টিউশন ফি দিয়ে ভর্তি হবো। শুধু কী তাই! অস্ত্রের নিপুণ খেলা আছে সাথে। কেউ অস্ত্র বানিয়ে বেঁচবে, কেউ কিনবে।
প্রশ্ন জাগতে পারে, আমরা কীভাবে দাঁড়াবো? অর্থনীতির চাকাটা কীভাবে ঘুরবে আমাদের? গার্মেন্টস, ওষুধ শিল্প আমাদের ভালো ভরসা। আরো আছে চামড়া থেকে কাঁচামাল। এসব খাতগুলো আমাদের অর্থনীতিরি চাকাটা দীর্ঘদিন ঘুরিয়ে আসছে। এই চাকাটা আরও ঘোরানোর জন্য পর্যটন শিল্পকে দিয়ে আরেকটা জোর ধাক্কা দেওয়া যায় কি?
ভাবার সময় কিন্তু এখনই। কিছুদিন আগে দেখেছি, আমাদের লোকজন ক্যাসিনো চালিয়ে গোপনে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। থাইল্যান্ড, সিংগাপুর হলো এদের কাছে 'প্রমোদতরী জাহাজ'। ওখানে ওরা সম্রাট বনে গিয়েছে। জনগণকে আড়ালে-আবডালে রেখে ওরা সেসব করছে। টাকা পাচার করছে।
তখন কথা উঠেছিল, যারা খারাপ তাদেরকে ভালো করা সহজ নয়। তাদের একখান চড় লাগিয়ে চরে পাঠিয়ে দিলে হয়। সেটা নোয়াখালির চর হোক আর পটুয়াখালীর হোক। ওরা সেখানে ওয়ার্ল্ড স্ট্যান্ডার্ড বার বা ক্যাসিনো বানাবে। আর আমাদের ট্যাক্স আমাদের থাকবে। জনগণের টাকা বিদেশে পাচার হবে না। আর বিদেশিরা এসে গ্লাসে টাকা ঢালবে।
এতোবড় চড় কে মারবে- যে এক ধাক্কায় অর্থনীতির চাকাটাও সেই পথেই হাঁটবে! সহজ নয়।
খোলাখুলিভাবে বললে পুঁজিবাদী বিশ্বের পর্যটন শিল্প তিন 'ম' এর উপর নির্ভর করে। পুঁজিবাদের মতে, এ তিন 'ম' হলো- মদ, মেয়েমানুষ ও মাটি। এখানে 'মাটি' মানে 'মানি' অর্থাৎ আমাদের 'টাকা'। আমাদের দেশে অবশ্য এই তিন 'ম'-ই হচ্ছে বেশিরভাগ মামলা মোকদ্দমার কারণ। তা যেহেতু আজ আলোচনার নয়। সেদিকে নাই বা গেলাম।
এই তিন 'ম' চাঙ্গা করা খুবই কঠিন। কিন্তু সম্ভব বটে। তা নির্ভর করবে আমরা কতোটা সেকুলারিটি ধারণ করতে পারি, এখানে ধর্ম কতোটা নাক গলায়- এসবের উপর। কথায় বলে, জনগণ যেরকম, দেশও আগায় সেরকম। এই তিন 'ম' বাস্তবায়িত হবে কি হবে না, সেটার পক্ষে বা বিপক্ষে বলছি না। কেবল মনে করিয়ে দিতে চাইছি, বৈশ্বিক পর্যটন এভাবে চলে।
তিন 'ম' এর আলোচনা তোলা থাক। এসব বাদেও আমাদের ভালো দিকগুলো কী নেই? আছে বিস্তর। আছে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। নজর দিতে হবে সেদিকে। বিদেশিদের সকল সুযোগ-সুবিধা চিন্তা করে ঢেলে সাজাতে হবে।
কক্সবাজারকে সপ্তাহে তিন দিন বিদেশিদের জন্য করে দেওয়া যেতে পারে। যেহেতু বিশাল সৈকত, একটি অংশ নির্ধারণ করে সপ্তাহে সাতদিনই দেওয়া যেতে পারে। আমরা সাধারণরা সেদিকে যাব না। যদি যেতেই হয় ডলার 'পে' করে যাব। কেউ যেন এই কথা ভেবে আন্দোলন না করে বসে- নিজের সি-বিচে নিজে ডলার দিয়ে যেতে হবে, এটা কোনও নীতি হতে পারে না! আপনি বিভিন্ন দেশে গিয়ে ডলার খরচ করেন। তখন এখানেও করবেন।
আছে আমাদের সবুজ পার্বত্য অঞ্চল। আমার তো মনে হয়, পরিবেশ, জলবায়ু ও সৌন্দর্যের দিক থেকে সুইজারল্যান্ডের চেয়ে আমাদের পার্বত্য অঞ্চল অনেক বৈচিত্র্যময়। প্রকৃতির মনোরম পরিবেশে কার ভালো না লাগে যেতে! একটু অবসর পেলেই তো হাফ ছাড়তে আমরা প্রকৃতি খুঁজে বেড়াই।
আছে, ঐতিহ্য বা ইতিহাসের একটা বিশাল জগৎ। চীনের ফরবিডেন সিটিতে পর্যটকদের এমন ভিড় আপনি ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যেতে পারেন। আমাদের ভাষার ইতিহাসকে বিশ্বের কাছে জাগ্রত করতে পারি। যেহেতু বিশ্বে আমাদের 'ভাষাযুদ্ধ' ইতিমধ্যে পরিচিত- শহীদ মিনারকে ধরে আশপাশকে ভাস্কর্যসহ কিছু স্মৃতি স্পট তৈরি করা যেতে পারে।
আছে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। শুধু সাভারে স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে এই ইতিহাস সীমাবদ্ধ না রেখে পুরো পর্যটন উপযোগী চিন্তা ও কৌশল হাতে নিয়ে আগানো যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে আমাদের সন্তানদের নিয়ে বাধ্যতামূলকভাবে বেড়িয়ে আসার সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে। এতে দেশপ্রেমও জাগ্রত হবে আবার পর্যটনের চাকাও ঘুরবে।
আছে, কর্কটক্রান্তি রেখা। ফরিদপুরে তার ছেদবিন্দু। সরকার ইতোমধ্যে পরিকল্পনা করছে, এই বিন্দুকে সাজানো হবে। আমাদের পরিকল্পনাবিদরা যেন আগামী ৫০০ বছর পর কী হবে, তার কথা মাথায় রেখে পরিকল্পনা করেন। হোটেল-মোটেলসহ বিশাল বিশাল রাস্তাঘাট ও পর্যাপ্ত অঞ্চল নিয়ে যেন হয়!
পর্যটন খাত নিয়ে করতে হবে গবেষণা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উৎসাহ দিতে হবে, তহবিল দিতে হবে যাতে পর্যটনকে আধুনিক ও উদ্ভাবনী উপায়ে কীভাবে ঢেলে সাজানো যায় সে গবেষণায় নিয়োজিত হতে পারে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই কালে সারাবিশ্ব অর্থনৈতিক চাকা পুনরায় সচল করবে। ওরা ঘুরে দাঁড়াবে। আমরাও ঘোরাবো। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করব। সবসময় ঘুরে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু এবার পর্যটন জগতকে নজর না দিয়ে নয়।